শিবের গীত-দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
দেশে এখন এক নম্বর জাতীয় সমস্যা—না, আদমশুমারিতে জনসংখ্যার একটা বড় অংশ গায়েব হয়ে যাওয়া নয়, রোজা না আসতেই নিত্য বাজারে অগ্নিকাণ্ড শুরু হয়ে যাওয়া নয়, এমনকি ‘ঈদের পরেই আন্দোলন’ নিয়ে ব্যবসায়ীদের (এবং অব্যবসায়ী সাধারণ মানুষজনের) বিশাল উদ্বেগও নয়—এক নম্বর সমস্যা হচ্ছে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী এবং এর ফলে সৃষ্ট নানা জটিলতা।
বিরোধী দল ও তাদের অনুসারী বা অনুগত সুশীল-অসুশীল সমাজ এই সংশোধনীতে দেখছে, একদলীয় শাসনব্যবস্থার প্রত্যাবর্তন এবং দেশকে ধর্মহীন করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র হিসেবে (সংবিধান থেকে আল্লাহর নাম বাদ দেওয়া হয়েছে বলে দাবি তুলে হরতাল করে, লাঠিসোঁটা হাতে গাড়ি-বাস ভেঙেছেন ধর্মীয় নানা দলের কর্মীরা; আবার সংবিধানে বিসমিল্লাহ রেখে দেওয়ায় বাম দল ও প্রগতিশীল মানুষজনের বিরাগভাজন হয়েছে সরকার)। বিরোধী নেত্রী অবশ্য একটা সমাধানের ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ক্ষমতায় গিয়ে এই সংবিধান তিনি ছুড়ে ফেলে দেবেন। সংবিধানের যা বয়স—প্রায় ৪০ হতে চলল—এবং তার ওপর যত সার্জারি করা হয়েছে এবং কেটে-ছিঁড়ে তাকে যেভাবে একাকার করা হয়েছে, তাতে অবশ্য বেচারাকে অবসরে পাঠানোর চিন্তাটা খারাপ নয়। বিরোধী নেত্রী ক্ষমতায় গেলে যদি নতুন সংবিধান রচনার উদ্যোগ নেন, তাহলে তাঁর অনুগত-অনুসারী সুশীল সমাজের কয়েকজন কিছুদিন অন্তত একটা ভালো চাকরি পাবেন। তাঁরা বিশ্বের ৫৬টি দেশের সংবিধান পরীক্ষা করার জন্য সেসব দেশে ভ্রমণে যেতে পারবেন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে চিরস্থায়ী রূপ দিয়ে সংবিধানের একটি অলঙ্ঘনীয় ধারায় এটিকে এনশ্রাইন করা হলে পরে ওই ৫৬টি দেশ থেকে সংবিধান বিশেষজ্ঞরাও বাংলাদেশে শিক্ষা সফরে আসবেন।
পঞ্চদশ সংশোধনী যেহেতু এক নম্বর সমস্যা, এই সমস্যার একটা সমাধান তো আমাদের খুঁজতেই হবে। আমার মতে, একে উতরানোর একটা সহজ উপায় হচ্ছে, আরও একটা সংশোধনীর—ষোড়শ সংশোধনীর ব্যবস্থা করা। সরকারের সংবিধান বিশেষজ্ঞদের কাছে আমার সবিনয় নিবেদন, ষোড়শ সংশোধনীটি সংসদের আগামী অধিবেশনেই আনুন এবং পাস করার ব্যবস্থা করুন। এটি করা হলে সব রাজনৈতিক হানাহানি, বিদ্বেষ ও অবিশ্বাসের অবসান হবে। এই সংশোধনীর মূল প্রস্তাব হবে জাতীয় সংসদ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হোক।
একটি কক্ষ লুই কানের দালানে অবস্থিত বর্তমান সংসদ, যেখানে নির্বাচনে বিজয়ী দলের সদস্যরা বসবেন, অন্যটি হবে রাজপথ, (নয়াপল্টন, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ) যেখানে বিজিতেরা বসবেন। আমাদের মহান জাতীয় সংসদে যেহেতু আর কোনো দিন বিরোধীদলীয় সাংসদেরা পদধূলি দেবেন না, (শুধু সদস্যপদ টিকিয়ে রাখা, সম্মানী-ভাতা ইত্যাদি উত্তোলন ও শুল্কমুক্ত গাড়ি পাওয়ার আনুষ্ঠানিকতার জন্য যে কদিন না গেলেই নয়, সে কদিন বাদ দিয়ে) সে জন্য এই দ্বিকক্ষীয় আয়োজনটি হবে অতিশয় উত্তম। সংসদের সব আসন হবে সরকারি দলের, রাজপথের সব আসন হবে বিরোধী দলের। তাতে আরেকটা লাভ হবে—ফ্লোর ক্রসিং চিরতরে নিষিদ্ধ হবে। রাজপথে বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত একজন ডেপুটি স্পিকার কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। ফলে নয়াপল্টন বা বঙ্গবন্ধু এভিনিউ বন্ধ করে যেসব জনসভা হবে, সেগুলো সংসদীয় কার্যক্রমের অংশ হয়ে যাবে। তাতে আরও লাভ হবে, কারও বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করার বিধান থাকবে না, যাতে ভবিষ্যতের শিক্ষার্থীরা ‘আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ভাষা ব্যবহারে শিষ্টতা’ বিষয়ে অবারিত গবেষণার সুযোগ পায়।
আরও একটি লাভের কথাও না বললে নয়, যেহেতু রাজপথের আন্দোলন সংসদীয় কার্যক্রম হিসেবে বিবেচ্য হবে, মতিয়া-নাসিম-ফারুক সাহেবসহ অন্য সাংসদদের পুলিশের লাঠিপেটা খেতে হবে না, ডেমরার সেই বিখ্যাত দৌড়বিদ-রাজনীতিবিদও তাঁর আসনে বসেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। তবে সবচেয়ে বড় লাভ হবে, রাজপথের সংসদকক্ষের সব দাবি-দাওয়া সংসদে পাস হয়েছে বলে ধরে নেওয়া সরকার তা মানতে বাধ্য থাকবে।
ষোড়শ সংশোধনী পাস হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হবে না, দেশ এক দলের শাসনের দিকে যাবে না, কাউকে আর সংবিধান ছুড়েও ফেলতে হবে না এবং এ জন্য দেশদ্রোহের অভিযোগও তাকে শুনতে হবে না। আর রাজপথের সংসদকক্ষে মূল সংসদের মতো ৩৩০টি আসন থাকায় অনেক বেশি অভাবী সাংসদ শুল্কমুক্ত গাড়ি পাবেন এবং সংসদীয় দলের অংশ হয়ে বিদেশ ভ্রমণে যেতে পারবেন।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
পঞ্চদশ সংশোধনী যেহেতু এক নম্বর সমস্যা, এই সমস্যার একটা সমাধান তো আমাদের খুঁজতেই হবে। আমার মতে, একে উতরানোর একটা সহজ উপায় হচ্ছে, আরও একটা সংশোধনীর—ষোড়শ সংশোধনীর ব্যবস্থা করা। সরকারের সংবিধান বিশেষজ্ঞদের কাছে আমার সবিনয় নিবেদন, ষোড়শ সংশোধনীটি সংসদের আগামী অধিবেশনেই আনুন এবং পাস করার ব্যবস্থা করুন। এটি করা হলে সব রাজনৈতিক হানাহানি, বিদ্বেষ ও অবিশ্বাসের অবসান হবে। এই সংশোধনীর মূল প্রস্তাব হবে জাতীয় সংসদ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হোক।
একটি কক্ষ লুই কানের দালানে অবস্থিত বর্তমান সংসদ, যেখানে নির্বাচনে বিজয়ী দলের সদস্যরা বসবেন, অন্যটি হবে রাজপথ, (নয়াপল্টন, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ) যেখানে বিজিতেরা বসবেন। আমাদের মহান জাতীয় সংসদে যেহেতু আর কোনো দিন বিরোধীদলীয় সাংসদেরা পদধূলি দেবেন না, (শুধু সদস্যপদ টিকিয়ে রাখা, সম্মানী-ভাতা ইত্যাদি উত্তোলন ও শুল্কমুক্ত গাড়ি পাওয়ার আনুষ্ঠানিকতার জন্য যে কদিন না গেলেই নয়, সে কদিন বাদ দিয়ে) সে জন্য এই দ্বিকক্ষীয় আয়োজনটি হবে অতিশয় উত্তম। সংসদের সব আসন হবে সরকারি দলের, রাজপথের সব আসন হবে বিরোধী দলের। তাতে আরেকটা লাভ হবে—ফ্লোর ক্রসিং চিরতরে নিষিদ্ধ হবে। রাজপথে বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত একজন ডেপুটি স্পিকার কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। ফলে নয়াপল্টন বা বঙ্গবন্ধু এভিনিউ বন্ধ করে যেসব জনসভা হবে, সেগুলো সংসদীয় কার্যক্রমের অংশ হয়ে যাবে। তাতে আরও লাভ হবে, কারও বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করার বিধান থাকবে না, যাতে ভবিষ্যতের শিক্ষার্থীরা ‘আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ভাষা ব্যবহারে শিষ্টতা’ বিষয়ে অবারিত গবেষণার সুযোগ পায়।
আরও একটি লাভের কথাও না বললে নয়, যেহেতু রাজপথের আন্দোলন সংসদীয় কার্যক্রম হিসেবে বিবেচ্য হবে, মতিয়া-নাসিম-ফারুক সাহেবসহ অন্য সাংসদদের পুলিশের লাঠিপেটা খেতে হবে না, ডেমরার সেই বিখ্যাত দৌড়বিদ-রাজনীতিবিদও তাঁর আসনে বসেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। তবে সবচেয়ে বড় লাভ হবে, রাজপথের সংসদকক্ষের সব দাবি-দাওয়া সংসদে পাস হয়েছে বলে ধরে নেওয়া সরকার তা মানতে বাধ্য থাকবে।
ষোড়শ সংশোধনী পাস হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হবে না, দেশ এক দলের শাসনের দিকে যাবে না, কাউকে আর সংবিধান ছুড়েও ফেলতে হবে না এবং এ জন্য দেশদ্রোহের অভিযোগও তাকে শুনতে হবে না। আর রাজপথের সংসদকক্ষে মূল সংসদের মতো ৩৩০টি আসন থাকায় অনেক বেশি অভাবী সাংসদ শুল্কমুক্ত গাড়ি পাবেন এবং সংসদীয় দলের অংশ হয়ে বিদেশ ভ্রমণে যেতে পারবেন।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments