শেয়ারবাজারের মূল সমস্যা যেখানে by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ
শেয়ারবাজারে বিপর্যয়ের পর থেকে নানা ধরনের বিচার-বিশ্লেষণ, সমালোচনা এবং বিভিন্ন প্রস্তাব আসছে। এটাই স্বাভাবিক। আবার এ কথাও ঠিক, অনেকে বিপর্যয় আসার বহু আগ থেকেই কিছুটা সতর্ক করে দিয়েছিলেন। এর সমস্যা চিহ্নিত করা এবং তার প্রতিকারের কী উপায়, তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা যে পর্যায়ে পেঁৗছেছে, তাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের
জুতা আবিষ্কারের কথা মনে পড়ে যায়। এ কবিতাটি আমাদের প্রবেশিকা পরীক্ষার সিলেবাসে ছিল। সেই হবুচন্দ্র রাজা এবং গবুচন্দ্র মন্ত্রীর দেশের কাহিনী। মাঝেমধ্যে এমন প্রতিবেদন ছাপা হচ্ছে, যেখানে প্রতিবেদনটি বস্তুনিষ্ঠ না হয়ে নেতিবাচক এবং আতঙ্ক সৃষ্টির কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে। ১২ মে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাংলা দৈনিকে সংবাদ শিরোনাম ছিল, গত চার বছরে কত টাকা শেয়ারবাজার থেকে বাংলাদেশের বাইরে চলে গেছে। অনাবাসিক কেউ বিনিয়োগ করতে চাইলে একটি এফসি অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। সেই অ্যাকাউন্টে বিদেশ থেকে টাকা আসবে এবং সেই টাকা থেকে শেয়ার কেনার মূল্য চুকিয়ে দেবে। দীর্ঘদিন বাংলাদেশের শেয়ারবাজার চাঙ্গা ছিল, সংগত কারণে বাইরে থেকে টাকা পাঠিয়ে বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জন করার কথা। প্রতিবেদকের রিপোর্টটি বস্তুনিষ্ঠ হতো যদি তিনি বলতেন, দেশের বাইরে থেকে কত টাকা এসেছিল এবং তার বিপরীতে কত টাকা বেরিয়ে গেছে। এটা ঠিক যে সংকট দেখলে বিদেশিরা কেটে পড়বে। বিদেশিরা যেন অবাধ capital appreciation-সহ সব ধরনের মুনাফা না নিয়ে যায়, তার জন্য একটি দেশের উচিত তার দেশের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া। যেমন_সম্পূর্ণ capital appreciation নিয়ে যেতে হলে কমপক্ষে এক বছর তাকে অপেক্ষা করতে হবে। তবে তার মূলধন ফেরত নেওয়ার অধিকার সব সময় থাকতে হবে।
১৯৯৭ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যে বিপর্যয় এসেছিল, সে সময় মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছিলেন। এ নিয়ে পশ্চিমা অর্থনৈতিক গুরুরা তাঁর খুব সমালোচনা করেছিলেন। পরে অনেকে স্বীকার করেছেন, মাহাথির ঠিক ছিলেন। আসলে মালয়েশিয়ার কপাল ভালো যে তাদের প্রধানমন্ত্রী একজন এমবিবিএস ডাক্তার হয়েও অর্থনীতি (ক্যাপিটাল মার্কেটসহ) ভালো বুঝতেন। মাহাথিরের লেখা বই 'A New Deal for Asia' সবার পড়া উচিত। শেয়ারবাজারে যে ধস নামল এবং পরে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যে তদন্ত রিপোর্ট দিলেন, তাতে এটা প্রমাণিত হয়েছে, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশন (এসইসি) একটি ব্যর্থ প্রতিষ্ঠান। তবে ব্যর্থতার সারিতে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং খোদ অর্থ মন্ত্রণালয়কে দাঁড় করানো যেতে পারে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পুরো দোষের ভাগী এসইসিকে হতে হবে। স্টক এঙ্চেঞ্জের ব্যর্থতার প্রশ্নই ওঠে না। কেননা তাদের Hidden agenda হলো যেকোনো মূল্যে মুনাফা অর্জন। ১৯৯৬ সালের দুর্যোগের পর দেখা গেছে, সে সময় কিছু সদস্য মার্কিন মুল্লুকে চিত্তবিনোদনে গেছেন, আর কেউ কেউ সরকারের সঙ্গে আঁতাত গড়ে ব্যাংক, বীমা ইত্যাদির মালিক হয়েছেন। অথচ কিছু নিরীহ মানুষ জীবিকার পথ হিসেবে শেয়ার ব্যবসায় নেমে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে, হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭-০৮ এবং ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মোট বিনিয়োগ হয়েছিল যথাক্রমে ১৩২১ এবং ১৪৯৮ বিলিয়ন টাকা। ২০০৭, ২০০৮ এবং ২০০৯ সালে শেয়ারবাজারে আইপিওর মাধ্যমে আসে যথাক্রমে ৪৮৯, ২৩১ এবং ৩৮১ কোটি টাকার শেয়ার। বেশ কিছু টাকার শেয়ার এসেছে প্রত্যক্ষ লিস্টিংয়ের মাধ্যমে। এই শেয়ারের টাকা এর আগেই বিনিয়োগ হয়েছে। উদ্যোক্তা পরিচালক যাঁরা এ শেয়ার ছেড়েছেন, তাঁরা প্রাপ্ত অর্থ কিভাবে ব্যয় করবেন, সেটা তাঁদের ব্যাপার। বিশ্লেষণে দেখা যায় যে শতকরা দশমিক ২-৩ ভাগের বেশি অর্থ দেশের বিনিয়োগে আসেনি। এখানে মনে রাখতে হবে, স্টক এঙ্চেঞ্জে যে লেনদেন হয়, তা অর্থনীতির পরিভাষায় বিনিয়োগ নয়। হবুচন্দ্র-গবুচন্দ্রের কথা বলেছি এ কারণে, বিএনপির এক নেতা বললেন, শেয়ারবাজার থেকে ৮৫ হাজার কোটি টাকা উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তিনি মার্কেট ক্যাপিটালটিকে টাকার হিসাবে আমলে নিয়েছেন। অর্থাৎ যার যা খুশি তা-ই বলে যাচ্ছেন। এদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব জানালেন যে তাঁরা খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছেন। ২০০১-এর জাতীয় নির্বাচনোত্তর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যে নির্যাতন হয়েছিল এর তদন্ত রিপোর্ট সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে এবং তাঁরা তা-ও প্রত্যাখ্যান করেছেন। এ অবস্থা দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ক্ষুধিত পাষাণ' গল্পের পাগল মেহের আলীর কথা মনে পড়ল। সে চিৎকার করে বলে বেড়াত, সব কুছ ঝুটা হ্যায়, তফাত যাও! তদন্ত রিপোর্ট প্রত্যাখ্যানের কী আছে তা বোধগম্য নয়। তদন্ত রিপোর্ট দেওয়া হয় সরকারের কাছে। সরকার থেকে তো আর কারো কাছে পত্র দিয়ে বলা হয় না যে এটি গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করুন। রিপোর্ট প্রকাশের পর যে কেউ এ সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করতে পারেন। ভুলত্রুটি তুলে ধরতে পারেন। সরকার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কী ব্যবস্থা নেবে, সেটা তো সরকারের ব্যাপার।
ফিরে আসি মূল আলোচনায়। বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে বোঝা যাচ্ছে, বাজারে শেয়ারপ্রবাহ তেমন বাড়েনি। অথচ বিনিয়োগকারী এসেছেন অনেক। অনেকবার অবশ্য বলা হয়েছে, শেয়ারের প্রবাহ বাড়াতে হবে। এ জন্য সরকারের কাছে বারবার আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জ কর্তৃপক্ষ জানাতে পারেনি যে তাদের সদস্য যাঁদের অনেকেরই আইপিও করার সুযোগ রয়েছে, তাঁরা কতজন আইপিওতে এসেছেন। ডিএসই, সিএসই কর্তৃপক্ষ বাত কি বাত হিসেবে বলেছে নতুন শেয়ারের কথা। তাদের তো কোনো ক্ষতি নেই। ব্যবসা হয়েছে, কমিশন পেয়েছে, অন্য সুযোগ-সুবিধার কথা না-ইবা বললাম। আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য দিয়ে দেখিয়ে দিলাম যে জাতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ক্যাপিটাল মার্কেটের অবদান খুবই নগণ্য। এটুকু সংগ্রহ না করলে কিছু এসে-যেত না। আজ সরকার যদি বড় বড় প্রকল্প যেমন পদ্মা সেতু কিংবা এঙ্প্রেস হাইওয়ের জন্য বন্ড বা ডিবেঞ্চারের মাধ্যমে অর্থ উঠাত, তাহলে বলা যেত, রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য জনগণের সম্পদকে ক্যাপিটাল মার্কেটের মাধ্যমে কাজে লাগানো হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়টা বুঝতে হবে যে স্টক এঙ্চেঞ্জ একটি বাজার, যেখানে পণ্য কেনাবেচা হয়। এর উৎপাদন অন্যত্র। আর সে ব্যাপারে সরকারের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এবং এ কাজটি জনগণের তথা রাষ্ট্রের স্বার্থে করতে হবে। কিছু ব্যক্তির স্বার্থ নয়, ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থের ঊধর্ে্ব উঠতে হবে অর্থ মন্ত্রণালয়কে। এখন ঘুরেফিরে একটা কথাই আসছে তা হলো, শেয়ারবাজার কি ঘুরে দাঁড়াবে? ঘুরে দাঁড়ানো বলতে কি সেই আগের অবস্থা যে শেয়ারের দাম শুধু বাড়তেই থাকবে? এটা কি কোনো অর্থনীতির সংজ্ঞায় পড়ে যে দ্রব্যের দাম বেড়েই চলবে। যদি এমনটি চলতে থাকে, তাহলে একপর্যায়ে গিয়ে ক্র্যাক করবে। কোনো সন্দেহ নেই ইতিমধ্যে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, সর্বস্বান্ত হয়েছেন। তাঁদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়েও এ কথা বলতে হয় যে শেয়ারবাজারের আগের অবস্থায় যাওয়া কাম্য নয়। সরকারের তরফ থেকে বাংলাদেশ ফান্ড ছাড়ার ব্যবস্থার ফলে এ রকম একটা ধারণা হয়েছে, শেয়ারবাজার আবার চাঙ্গা হবে। কিছুটা হয়তো হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে কতটা হওয়া উচিত? এ ফান্ড না ছেড়ে কিছু শেয়ার বাড়লে কাজ হতো।
একটা যুক্তি দেখানো হয় যে স্টক এঙ্চেঞ্জ চাঙ্গা থাকলে প্রাইমারি মার্কেটে লোক আসতে আগ্রহী থাকবে। সে কথাটা সব মার্কেটের জন্য প্রযোজ্য। চাঙ্গা ভাব মানে আকাশচুম্বী হতে পারে না। শেয়ারবাজারে তারল্য সংকট রয়েছে_এ কথাটা বলা অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর। এ পর্যন্ত যত আইপিও এসেছে, কোনোটি কি অবিক্রীত থেকেছে? বরঞ্চ প্রতিটিতে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি আবেদন পড়েছে। যাঁরা পাননি বা পাবেন না, তাঁরা পরবর্তী সময়ে শেয়ারবাজারে যাবেন কিনতে। যদিও বহুবার বলা হয়েছে, আবারও বলতে হচ্ছে যে কিছুসংখ্যক ব্যবসায়ী এবং স্টক এঙ্চেঞ্জেরও এক শ্রেণীর সদস্য ব্যক্তিগত হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে শেয়ারবাজারে আসতে প্রলুব্ধ করেছেন কিছু শিক্ষিত বেকারকে। আর ডেভিলের ভূমিকায় ছিল কিছু হীন স্বার্থবাদী। এদের শাস্তি দিতে হবে। ইতিমধ্যে অত্যন্ত খোলাখুলি বলে দেওয়া উচিত, শেয়ারবাজারকে সে অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়; কেননা সেটা অর্থনৈতিক শাস্ত্র অনুযায়ী অগ্রহণযোগ্য। বেলুন বেশি ফুলাতে গেলে ফেটে যায়। তাই শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ যাঁরা টকশোতে গিয়ে নানা জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য দেন, তাঁরা যেন দয়া করে এটা বলেন যে সামগ্রিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শেয়ারবাজার কতটা চাপ সহ্য করতে পারবে। অবশ্য সেই সঙ্গে শেয়ারবাজারকে দুষ্কৃৃতকারী মুক্ত করতে হবে। এখানে সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম এস এ এম এস কিবরিয়ার কথা স্মরণ করতে হয়। ১৯৯৬ সালের বিপর্যয়ের পর তিনি কোনো কথায় প্ররোচিত হননি। অনেক সমালোচনা সইতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু তিনি নিজ সিদ্ধান্তে অটল এবং অবিচল ছিলেন। তিনি অর্থনীতির মেধাবী ছাত্র ছিলেন। যদিও বিনয় করে বলেছিলেন যে তিনি শেয়ারবাজার বোঝেন না। আসলে ঠিক বুঝতেন। তিনি জানতেন যে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির যে গতি, তার সঙ্গে সংগতি রেখে শেয়ারবাজারকে চলতে হবে। তাহলে কেউ প্রতারিত হবেন না, পুঁজি হারাবেন না। শেয়ারবাজার ক্যাসিনো নয়। তিনি আরো জানতেন, পুঁজিবাজার মানে শুধু স্টক এঙ্চেঞ্জ নয় যে একে নিয়ে সোহাগ করতে হবে। কিবরিয়ার পর সাইফুর রহমান অর্থমন্ত্রী হন। অবশ্য তিনি কিবরিয়ার আগেও অর্থমন্ত্রী ছিলেন। তিনিও শেয়ারবাজারকে স্বাভাবিক গতিতে চলতে দিয়েছেন, অতিরিক্ত কিছু করতে যাননি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল থেকে বেশি মাতামাতি শুরু হলো শেয়ারবাজার নিয়ে। মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর দুঃখজনক হলেও সত্য, স্টক এঙ্চেঞ্জের তাদের দলীয় কিছু সদস্য প্রলোভন দেখিয়ে এ বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে। অর্থমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, তাঁর কিছু ভুল হয়েছে। এর দ্বারা তিনি মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন। তবে যাঁরা তাঁকে ভুল বুঝিয়েছেন, তাঁরা অনুতপ্ত কি না জানি না। এ কথা মাথায় রাখতে হবে, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে এবং অর্থনীতির চাকা ঠিকমতো ঘুরলে শেয়ারবাজার চাঙ্গা হয়, উল্টোটা নয়। বরঞ্চ রাজনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিলে বা অর্থনৈতিক সংকট হলে শেয়ারবাজার উটপাখির মতো মুখ গুঁজে ফেলে।
লেখক : সাবেক ইপিএস ও শেয়ারবাজার বিশ্লেষক
১৯৯৭ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যে বিপর্যয় এসেছিল, সে সময় মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছিলেন। এ নিয়ে পশ্চিমা অর্থনৈতিক গুরুরা তাঁর খুব সমালোচনা করেছিলেন। পরে অনেকে স্বীকার করেছেন, মাহাথির ঠিক ছিলেন। আসলে মালয়েশিয়ার কপাল ভালো যে তাদের প্রধানমন্ত্রী একজন এমবিবিএস ডাক্তার হয়েও অর্থনীতি (ক্যাপিটাল মার্কেটসহ) ভালো বুঝতেন। মাহাথিরের লেখা বই 'A New Deal for Asia' সবার পড়া উচিত। শেয়ারবাজারে যে ধস নামল এবং পরে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যে তদন্ত রিপোর্ট দিলেন, তাতে এটা প্রমাণিত হয়েছে, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশন (এসইসি) একটি ব্যর্থ প্রতিষ্ঠান। তবে ব্যর্থতার সারিতে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং খোদ অর্থ মন্ত্রণালয়কে দাঁড় করানো যেতে পারে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পুরো দোষের ভাগী এসইসিকে হতে হবে। স্টক এঙ্চেঞ্জের ব্যর্থতার প্রশ্নই ওঠে না। কেননা তাদের Hidden agenda হলো যেকোনো মূল্যে মুনাফা অর্জন। ১৯৯৬ সালের দুর্যোগের পর দেখা গেছে, সে সময় কিছু সদস্য মার্কিন মুল্লুকে চিত্তবিনোদনে গেছেন, আর কেউ কেউ সরকারের সঙ্গে আঁতাত গড়ে ব্যাংক, বীমা ইত্যাদির মালিক হয়েছেন। অথচ কিছু নিরীহ মানুষ জীবিকার পথ হিসেবে শেয়ার ব্যবসায় নেমে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে, হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭-০৮ এবং ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মোট বিনিয়োগ হয়েছিল যথাক্রমে ১৩২১ এবং ১৪৯৮ বিলিয়ন টাকা। ২০০৭, ২০০৮ এবং ২০০৯ সালে শেয়ারবাজারে আইপিওর মাধ্যমে আসে যথাক্রমে ৪৮৯, ২৩১ এবং ৩৮১ কোটি টাকার শেয়ার। বেশ কিছু টাকার শেয়ার এসেছে প্রত্যক্ষ লিস্টিংয়ের মাধ্যমে। এই শেয়ারের টাকা এর আগেই বিনিয়োগ হয়েছে। উদ্যোক্তা পরিচালক যাঁরা এ শেয়ার ছেড়েছেন, তাঁরা প্রাপ্ত অর্থ কিভাবে ব্যয় করবেন, সেটা তাঁদের ব্যাপার। বিশ্লেষণে দেখা যায় যে শতকরা দশমিক ২-৩ ভাগের বেশি অর্থ দেশের বিনিয়োগে আসেনি। এখানে মনে রাখতে হবে, স্টক এঙ্চেঞ্জে যে লেনদেন হয়, তা অর্থনীতির পরিভাষায় বিনিয়োগ নয়। হবুচন্দ্র-গবুচন্দ্রের কথা বলেছি এ কারণে, বিএনপির এক নেতা বললেন, শেয়ারবাজার থেকে ৮৫ হাজার কোটি টাকা উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তিনি মার্কেট ক্যাপিটালটিকে টাকার হিসাবে আমলে নিয়েছেন। অর্থাৎ যার যা খুশি তা-ই বলে যাচ্ছেন। এদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব জানালেন যে তাঁরা খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছেন। ২০০১-এর জাতীয় নির্বাচনোত্তর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যে নির্যাতন হয়েছিল এর তদন্ত রিপোর্ট সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে এবং তাঁরা তা-ও প্রত্যাখ্যান করেছেন। এ অবস্থা দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ক্ষুধিত পাষাণ' গল্পের পাগল মেহের আলীর কথা মনে পড়ল। সে চিৎকার করে বলে বেড়াত, সব কুছ ঝুটা হ্যায়, তফাত যাও! তদন্ত রিপোর্ট প্রত্যাখ্যানের কী আছে তা বোধগম্য নয়। তদন্ত রিপোর্ট দেওয়া হয় সরকারের কাছে। সরকার থেকে তো আর কারো কাছে পত্র দিয়ে বলা হয় না যে এটি গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করুন। রিপোর্ট প্রকাশের পর যে কেউ এ সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করতে পারেন। ভুলত্রুটি তুলে ধরতে পারেন। সরকার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কী ব্যবস্থা নেবে, সেটা তো সরকারের ব্যাপার।
ফিরে আসি মূল আলোচনায়। বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে বোঝা যাচ্ছে, বাজারে শেয়ারপ্রবাহ তেমন বাড়েনি। অথচ বিনিয়োগকারী এসেছেন অনেক। অনেকবার অবশ্য বলা হয়েছে, শেয়ারের প্রবাহ বাড়াতে হবে। এ জন্য সরকারের কাছে বারবার আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জ কর্তৃপক্ষ জানাতে পারেনি যে তাদের সদস্য যাঁদের অনেকেরই আইপিও করার সুযোগ রয়েছে, তাঁরা কতজন আইপিওতে এসেছেন। ডিএসই, সিএসই কর্তৃপক্ষ বাত কি বাত হিসেবে বলেছে নতুন শেয়ারের কথা। তাদের তো কোনো ক্ষতি নেই। ব্যবসা হয়েছে, কমিশন পেয়েছে, অন্য সুযোগ-সুবিধার কথা না-ইবা বললাম। আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য দিয়ে দেখিয়ে দিলাম যে জাতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ক্যাপিটাল মার্কেটের অবদান খুবই নগণ্য। এটুকু সংগ্রহ না করলে কিছু এসে-যেত না। আজ সরকার যদি বড় বড় প্রকল্প যেমন পদ্মা সেতু কিংবা এঙ্প্রেস হাইওয়ের জন্য বন্ড বা ডিবেঞ্চারের মাধ্যমে অর্থ উঠাত, তাহলে বলা যেত, রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য জনগণের সম্পদকে ক্যাপিটাল মার্কেটের মাধ্যমে কাজে লাগানো হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়টা বুঝতে হবে যে স্টক এঙ্চেঞ্জ একটি বাজার, যেখানে পণ্য কেনাবেচা হয়। এর উৎপাদন অন্যত্র। আর সে ব্যাপারে সরকারের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এবং এ কাজটি জনগণের তথা রাষ্ট্রের স্বার্থে করতে হবে। কিছু ব্যক্তির স্বার্থ নয়, ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থের ঊধর্ে্ব উঠতে হবে অর্থ মন্ত্রণালয়কে। এখন ঘুরেফিরে একটা কথাই আসছে তা হলো, শেয়ারবাজার কি ঘুরে দাঁড়াবে? ঘুরে দাঁড়ানো বলতে কি সেই আগের অবস্থা যে শেয়ারের দাম শুধু বাড়তেই থাকবে? এটা কি কোনো অর্থনীতির সংজ্ঞায় পড়ে যে দ্রব্যের দাম বেড়েই চলবে। যদি এমনটি চলতে থাকে, তাহলে একপর্যায়ে গিয়ে ক্র্যাক করবে। কোনো সন্দেহ নেই ইতিমধ্যে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, সর্বস্বান্ত হয়েছেন। তাঁদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়েও এ কথা বলতে হয় যে শেয়ারবাজারের আগের অবস্থায় যাওয়া কাম্য নয়। সরকারের তরফ থেকে বাংলাদেশ ফান্ড ছাড়ার ব্যবস্থার ফলে এ রকম একটা ধারণা হয়েছে, শেয়ারবাজার আবার চাঙ্গা হবে। কিছুটা হয়তো হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে কতটা হওয়া উচিত? এ ফান্ড না ছেড়ে কিছু শেয়ার বাড়লে কাজ হতো।
একটা যুক্তি দেখানো হয় যে স্টক এঙ্চেঞ্জ চাঙ্গা থাকলে প্রাইমারি মার্কেটে লোক আসতে আগ্রহী থাকবে। সে কথাটা সব মার্কেটের জন্য প্রযোজ্য। চাঙ্গা ভাব মানে আকাশচুম্বী হতে পারে না। শেয়ারবাজারে তারল্য সংকট রয়েছে_এ কথাটা বলা অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর। এ পর্যন্ত যত আইপিও এসেছে, কোনোটি কি অবিক্রীত থেকেছে? বরঞ্চ প্রতিটিতে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি আবেদন পড়েছে। যাঁরা পাননি বা পাবেন না, তাঁরা পরবর্তী সময়ে শেয়ারবাজারে যাবেন কিনতে। যদিও বহুবার বলা হয়েছে, আবারও বলতে হচ্ছে যে কিছুসংখ্যক ব্যবসায়ী এবং স্টক এঙ্চেঞ্জেরও এক শ্রেণীর সদস্য ব্যক্তিগত হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে শেয়ারবাজারে আসতে প্রলুব্ধ করেছেন কিছু শিক্ষিত বেকারকে। আর ডেভিলের ভূমিকায় ছিল কিছু হীন স্বার্থবাদী। এদের শাস্তি দিতে হবে। ইতিমধ্যে অত্যন্ত খোলাখুলি বলে দেওয়া উচিত, শেয়ারবাজারকে সে অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়; কেননা সেটা অর্থনৈতিক শাস্ত্র অনুযায়ী অগ্রহণযোগ্য। বেলুন বেশি ফুলাতে গেলে ফেটে যায়। তাই শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ যাঁরা টকশোতে গিয়ে নানা জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য দেন, তাঁরা যেন দয়া করে এটা বলেন যে সামগ্রিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শেয়ারবাজার কতটা চাপ সহ্য করতে পারবে। অবশ্য সেই সঙ্গে শেয়ারবাজারকে দুষ্কৃৃতকারী মুক্ত করতে হবে। এখানে সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম এস এ এম এস কিবরিয়ার কথা স্মরণ করতে হয়। ১৯৯৬ সালের বিপর্যয়ের পর তিনি কোনো কথায় প্ররোচিত হননি। অনেক সমালোচনা সইতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু তিনি নিজ সিদ্ধান্তে অটল এবং অবিচল ছিলেন। তিনি অর্থনীতির মেধাবী ছাত্র ছিলেন। যদিও বিনয় করে বলেছিলেন যে তিনি শেয়ারবাজার বোঝেন না। আসলে ঠিক বুঝতেন। তিনি জানতেন যে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির যে গতি, তার সঙ্গে সংগতি রেখে শেয়ারবাজারকে চলতে হবে। তাহলে কেউ প্রতারিত হবেন না, পুঁজি হারাবেন না। শেয়ারবাজার ক্যাসিনো নয়। তিনি আরো জানতেন, পুঁজিবাজার মানে শুধু স্টক এঙ্চেঞ্জ নয় যে একে নিয়ে সোহাগ করতে হবে। কিবরিয়ার পর সাইফুর রহমান অর্থমন্ত্রী হন। অবশ্য তিনি কিবরিয়ার আগেও অর্থমন্ত্রী ছিলেন। তিনিও শেয়ারবাজারকে স্বাভাবিক গতিতে চলতে দিয়েছেন, অতিরিক্ত কিছু করতে যাননি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল থেকে বেশি মাতামাতি শুরু হলো শেয়ারবাজার নিয়ে। মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর দুঃখজনক হলেও সত্য, স্টক এঙ্চেঞ্জের তাদের দলীয় কিছু সদস্য প্রলোভন দেখিয়ে এ বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে। অর্থমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, তাঁর কিছু ভুল হয়েছে। এর দ্বারা তিনি মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন। তবে যাঁরা তাঁকে ভুল বুঝিয়েছেন, তাঁরা অনুতপ্ত কি না জানি না। এ কথা মাথায় রাখতে হবে, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে এবং অর্থনীতির চাকা ঠিকমতো ঘুরলে শেয়ারবাজার চাঙ্গা হয়, উল্টোটা নয়। বরঞ্চ রাজনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিলে বা অর্থনৈতিক সংকট হলে শেয়ারবাজার উটপাখির মতো মুখ গুঁজে ফেলে।
লেখক : সাবেক ইপিএস ও শেয়ারবাজার বিশ্লেষক
No comments