আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৬৬)-কলকাতার পথে by আলী যাকের

বক্সনগর পৌঁছে দেখি সেখানে শরণার্থীদের বেশ ভিড়। দুটি ছাদখোলা পুরনো জিপে করে তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সোনাইমুড়ি পর্যন্ত। একমাত্র জিপ ছাড়া এই দুর্গম পাহাড়ি পথে চলাচল প্রায় অসম্ভব। আমরা সবাই একটি জিপে উঠে বসি। আমরা ১০ জন এবং তারপর আরো ১০ জন অপরিচিত যাত্রী। মোট ২০ জন যাত্রী নিয়ে জিপ রওনা হয়।

আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে পেছনের বাম্পারের ওপর পা রেখে ছাউনি দেওয়ার রডে ঝুলে থেকে গোটা রাস্তাটি পার হয়েছিলাম দুলতে দুলতে। মাঝখানে একটি পাহাড়ের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এর গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো প্রায় ২৫ জনের মতো মানুষ। এদের সবারই মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফ। বেশ কয়েক দিন শেভ করা হয়নি স্পষ্টতই বোঝা গেল। তাঁরা আমাদের জিপ থামালেন। প্রথমে একটু শঙ্কা হলো পরে বুঝলাম যে তাঁরা আমাদের বাংলাদেশেরই লোক। তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন যুদ্ধ কেমন চলছে ভেতরে? আমরা তাঁদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে তাঁরা চট্টগ্রাম থেকে নোয়াখালী পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানি আর্মিতে কর্মরত ছিলেন। পালিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছেন আপাতত। তাঁরা সবাই যুদ্ধে যাবেন। এমনই তাঁদের ইচ্ছা। ভালো লাগল যে আমাদের জন্য সব শেষ হয়ে যায়নি। বস্তুতপক্ষে সব শুরু হলো কেবলমাত্র।
সোনাইমুড়িতে পৌঁছে আমরা ছয়জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ও চার বাচ্চা একটি ভাঙা ট্যাক্সি উঠলাম। তারপর আগরতলা। আগরতলায় হৈহৈ কাণ্ড রৈরৈ ব্যাপার। রাস্তায় মনে হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। বস্তুতপক্ষে পরে জানতে পেরেছি যে, আগরতলার নিজস্ব যে জনসংখ্যা তা দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল ওই সময় শরণার্থীদের আশ্রয় গ্রহণের কারণে। আমাদের একটা ভদ্র গোছের খাবারের দোকানে বসিয়ে দুলাভাই আওয়ামী লীগের পরিচিতজনদের খোঁজে গেলেন। অল্পক্ষণ পরে ফিরে এসে বললেন, একটি জায়গা পাওয়া গেছে। আমরা তাঁর সঙ্গে চললাম। আমাদের মালপত্র বিশেষ কিছু ছিল না। আমার সঙ্গে দুটি হাফ শার্ট, একটি প্যান্ট ও একটি লুঙ্গি। সবাই ওই রকম নিজ হাতে বহন করা যায় ধরনের কাপড় বাজারের ব্যাগে ভরে নিয়ে এসেছে। তাই নিয়ে গিয়ে উঠলাম একটি বাড়িতে। একতলা বাড়ি, সদ্য নির্মিত, সামনে একটু আঙ্গিনা আর পেছনে বিশাল আঙ্গিনা পেরিয়ে তারপর ল্যাট্রিন। এ আঙ্গিনার মাঝখানে যতদূর মনে পড়ে, একটি ছোটখাটো পুকুরও ছিল। এই বিল্ডিংয়ের দুটি ঘরে আমরা জায়গা করে নিলাম। একটিতে আমাদের চারজন মেয়ে এবং অন্যটিতে আমরা পুরুষরা। যে ঘরটিতে আমরা ছিলাম সেখানে রাতের বেলা মাটির ওপর বিছানা পাতা হলো লম্বা করে এবং আমাদের সঙ্গে রাত্রি যাপন করলেন আওয়ামী লীগের তোফায়েল আহমেদ, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন প্রমুখ। পরদিন সকালে উঠে নাশতা খেতে গেলাম বাড়ির উল্টো দিকে একটা ছোট খাবারের দোকানে। আমরা পুরুষরা খেয়ে মেয়েদের জন্য খাবার নিয়ে আসব। সেখানে বসে সিদ্ধান্ত নিলাম যে যত শিগগির সম্ভব আমাদের পরিকল্পিত শেষ গন্তব্যে যেতে হবে। তখনও জানি না কিভাবে যাব। কেননা হাতে যৎসামান্য টাকা-পয়সা ছিল। সেটা ভাঙিয়ে অতি অল্পই ভারতীয় মুদ্রা পাওয়া গেল। সব খোঁজখবর শুরু করলাম ওই দিনই। আমার বোনাই তারেক, আমি এবং দুলাভাই মিলে খোঁজ নিয়ে জানলাম যে আগরতলা থেকে কলকাতায় আমাদের পক্ষে প্লেনে যাওয়া অসম্ভব। যেতে হবে স্থলপথে। অর্থাৎ আগরতলা থেকে সোজা উত্তর দিকে উঠে তারপর বাংলাদেশকে দক্ষিণে রেখে স্থলপথে যেতে হবে পশ্চিমে। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমের শেষ প্রান্তে অর্থাৎ দিনাজপুরের কাছে গিয়ে আবার দক্ষিণ দিকে যাত্রা। তারপর ফারাক্কা বাঁধের ওপর দিয়ে গঙ্গা পেরিয়ে কলকাতা। ওই পথেই যেতে হবে আমাদের। শুনেছি ত্রিপুরার উত্তর প্রান্তের স্টেশন ধর্মনগর থেকে 'পাহাড় লাইন' নামে একটি রেল সার্ভিস আছে যা ত্রিপুরা থেকে আসাম হয়ে মেঘালয়ের ওপর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে একেবারে কলকাতা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। মাঝপথে লাইন বদল হয়, মিটার গেজ থেকে ব্রড গেজ। ফলে ট্রেনও বদল করতে হয়। কিন্তু মোটামুটি নিরুপদ্রবে যাওয়া যায় ওই লাইনে। কিন্তু আগরতলা থেকে ধর্মনগর, এই পথটুকু, স্থলপথে যেতে হবে। এটিও কম দূরত্বের নয়। যতদূর মনে পড়ে ত্রিপুরা থেকে ধর্মনগরের দূরত্ব ১০৮ কিলোমিটার। এ রাস্তাটি মোটামুটি ভালো এবং পাহাড়ের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে যায়। তবে সাধারণ পরিবহন বলতে যা বোঝায় তা তেমন নেই এই পথে। এখন অবশ্য ধর্মনগর থেকে আগরতলা অবধি ট্রেন আসে কিন্তু তখনও সেই ব্যবস্থা হয়নি। আমরা খোঁজখবর নিয়ে জানলাম যেকোনো বাস সার্ভিস নেই ওই পথে। মালভর্তি ট্রাকে করে যাওয়া যায়, কিছু পয়সা দিয়ে, তবে তাতে কষ্ট আছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, ট্রাকেই যাব। ট্রাকস্ট্যান্ড এগিয়ে সেখানে এক ট্রাক মালিকের সঙ্গে ব্যবস্থা পাকাপাকি করে এলাম। বড় আপা, দুলাভাই আর বাচ্চা বসবে সামনে, ড্রাইভারের সঙ্গে, আর আমরা সবাই পেছনে মালপত্রের সঙ্গে জায়গা করে নেব। বাসায় ফিরে গিয়ে সবাইকে জানাতেই তারা হৈহৈ করে উঠল। কারই পছন্দ হয়নি ট্রাকে ভ্রমণ করার এই ব্যবস্থা। উপায় নেই বলে তাদের শান্ত করা গেল। পরের দিন সকাল ৭টায় সামান্য কিছু নাশতা সেরে আমরা ট্রাকে চেপে বসলাম। বেশকিছু খাদ্যসামগ্রীর বস্তার ওপর সবাই চেষ্টা করছি শক্ত-পোক্ত হয়ে বসার। ট্রাক চলতে শুরু করল। আমরা হেলেদুলে এদিক ওদিক পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে রইলাম। ট্রাক যখন পাহাড়ি পথে ছুটতে লাগল তখন পরিবেশটা ভারি সুন্দর, মনোরম লাগল আমার কাছে। আমি কলকাতার কোনো লেখায় যেন পড়েছিলাম যে, পথে একটি পাহাড় গাত্রে কিছু ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছিল পাহাড় কেটে, যেগুলো দেখে রবীন্দ্রনাথ উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন। আমার দুই চোখ ডানে-বায়ে তাকিয়ে সেই ভাস্কর্যের অন্বেষণ করতে লাগল। দেখতে পেলাম না। কে জানে হয়তো সেগুলো পথের থেকে ভেতরে।
(চলবে.....)

No comments

Powered by Blogger.