একজন ছৈয়দ আহম্মদের গল্প by জিয়াউর রহমান চৌধুরী
আজ থেকে প্রায় ১০১ বছর আগে একজন মানুষ জন্মেছিলেন এখানে। তিনি বিখ্যাত কোনো নাট্যকার বা কোনো বিদ্বান পণ্ডিতও নন। তাঁর নাম ছৈয়দ আহম্মদ। পাঠকের কাছে মুদ্রিত পত্রিকা পৌঁছে দেওয়াই তাঁর কাজ। বিগত সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রতিদিন লক্ষ্মীপুরের মানুষের কাছে পত্রিকা পৌঁছানোর কাজ করে আসছেন মানুষটি। গণপ্রজাতন্ত্রী
বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত জাতীয় পরিচয়পত্রে তাঁর জন্মসালের উল্লেখ করা হয়েছে ১ মার্চ ১৯১১। পিতা ও মাতার নাম যথাক্রমে মৃত মকরম আলী ও মৃত আম্বিয়া ভানু।
শতবর্ষী এই আলোর মানুষটি সম্পর্কে খোঁজ নিতেই গত আট ফেব্রুয়ারি রওনা হই উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরের উদ্দেশে। বাস থেকে নেমে প্রথমেই হাজির হই শহরের রহমানিয়া প্রেসে। ঘড়িতে তখন আটটা ছুঁইছুঁই। ‘এই সকালে ছৈয়দ আহম্মদকে কি পাওয়া যাবে?’ মনে মনে এমন প্রশ্ন করতেই দেখা মিলল মানুষটির। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, পরনে পুরোনো বিবর্ণ শার্ট ও লুঙ্গি। ডান হাতে একটি লাঠি ধরা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢাকা থেকে পত্রিকার গাড়ি এসে পৌঁছাবে। তাই পুরোনো পত্রিকা আর কাগজপত্র বির্িছয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু তখনো কাজে আসেননি তাঁর অনেক সহকর্মী। প্রস্তুতি সম্পন্ন করে তার ওপরই বসে পড়েন তিনি। এরপর চেয়ে থাকেন রাস্তার দিকে, কখন আসবে পত্রিকার গাড়ি, কখন শুরু হবে তাঁর কাজ। এ রকম প্রস্তুতির ফাঁকেই ছৈয়দ আহম্মদ সম্পকে কথা হয় রহমানিয়া প্রেসের কর্মী রাকিব হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, প্রতিদিন সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে রহমানিয়া প্রেসে চলে আসেন ছৈয়দ আহমদ। ‘মাঝে মাঝে সকালবেলা দোকান খুলতে এসে দেখি ছৈয়দ কাকা বসে আছেন। প্রায় সময়ই তিনি আমাদের আগেই এসে বসে থাকেন আর থাকেন সারা দিন, অনেক সময় রাত পর্যন্ত।’ পত্রিকার গাড়ি এসে পৌঁছালে ব্যস্ত হয়ে পড়েন ছৈয়দ আহম্মদ। শুরু হয় তাঁর কাজ। সন্ধ্যার আগে আর তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয় না। সারা দিনের কর্মব্যস্ততা শেষে সন্ধ্যায় স্থানীয় একটি হোটেলে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। আজ থেকে প্রায় ৭৫ বছর আগে পত্রিকা বিক্রির কাজ শুরু করেন তিনি। সন-তারিখটা ঠিক মনে করতে পারছিলেন না। ছৈয়দ আহম্মদ ভূঁইয়া বলেন, ‘পথমে নুকাত কাম কইততাম। হিয়ার হরে একদিন চুচুয়া মুলভীর লগে ইয়ানো আঁই পথরিকা বেচার কাম শুরু করি।’ (নোয়াখালীর ভাষায় বলা কথাগুলো হলো, ‘প্রথমে নৌকায় কাজ করতাম। তারপরে একদিন স্থানীয় চুচুয়া মৌলভীর মাধ্যমে এই রহমানিয়া প্রেসে এসে পত্রিকা বিক্রির কাজ শুরু করি।’) মাত্র চার পয়সায় বাংলার বাণী, ইত্তেফাক আর কলকাতার যুগান্তর বিক্রি করতেন শুরুর দিকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগ, ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং ৯০-এর গণ-অভ্যুথানসহ সব আন্দোলনের স্বাক্ষী এই ছৈয়দ আহম্মদ ভূঁইয়া। রহমানিয়া প্রেস প্রতিষ্ঠাতা ও ছৈয়দ আহম্মদের আশ্রয়দাতা প্রয়াত সাংবাদিক গোলাম রহমানের ছেলে আনোয়ার রহমান বলেন, ‘আমার বয়স প্রায় ৬২ বছর। আমি স্কুলজীবন থেকেই ছৈয়দ চাচাকে পত্রিকা বিক্রি করতে দেখছি। পত্রিকা পড়তে না পারলেও পত্রিকা বিক্রির প্রতি তাঁর অসম্ভব ঝোঁক ছিল। অনেকে অনেকবার তাঁকে এ কাজ ছেড়ে দিতে বললেও তিনি এখনো হেঁটে হেঁটে পত্রিকা বিক্রি করছেন। এমনকি যেদিন পত্রিকা বের হয় না সেদিনও পুরোনো পত্রিকা নিয়ে বের হয়ে যান। পত্রিকার প্রতি অন্য রকম নেশা তাঁর।’ শুরুর দিকের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সে সময় ডাকহরকরারা পায়ে হেঁটে পত্রিকা পৌঁছে দিত। সকালবেলার পত্রিকা আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। সন্ধ্যার সময় পত্রিকা বিক্রির জন্য বের হতাম।’ মুক্তিযুদ্ধের কথা জিজ্ঞেস করলে ছৈয়দ আহম্মদ জানান, সে সময় ইত্তেফাক আর সংগ্রাম ছাড়া অন্য কিছু বিক্রি করতে পারতেন না। ‘আর হানাদার বাহিনী তাদের দেখলে হাতের কনুই পরীক্ষা করত। কারণ মুক্তিযোদ্ধাদের কনুইয়ে ট্রেনিংয়ের কারণে ক্ষত হয়ে থাকত। আর পাকিস্তানিদের সালাম দিলে তারা খুশি হয়ে যেত।’ মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কথা এভাবেই বললেন তিনি। লক্ষ্মীপুর বাজারের ব্যবসায়ী মাহাবুবুর রহমান চৌধুরী ছৈয়দ আহম্মদ সম্পর্কে বলেন, ‘আমরা ছোটবেলায় স্কুলে যাওয়ার সময় ছৈয়দ আহম্মদকে দেখতাম পত্রিকা হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে। ছাত্র বলতেই তিনি আমাদের বিনে পয়সায় পত্রিকা পড়তে দিতেন। আজও এই মানুষটিকে পত্রিকা হাতে নিয়ে সেই চিরচেনা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি।’
লক্ষ্মীপুরের ছেলে থেকে বুড়ো, আবালবৃদ্ধবনিতা সবার কাছেই একনামে পরিচিত এই ছৈয়দ আহম্মদ ভূঁইয়া। বাচ্চা ছেলেমেয়েদের কাছে ছৈয়দ নানা আর বয়স্কদের কাছে ছৈয়দ চাচা নামেই পরিচিত তিনি।
ছৈয়দ আহম্মদ ভূঁইয়ার তিন ছেলে ও চার মেয়ে। ছেলে আবুল কালাম ও নাতি মোহাম্মদ মোক্তার এখন তাঁর মতোই পত্রিকা বিক্রির কাজ করেন। ছৈয়দ আহম্মদ প্রতিদিন পত্রিকা বিক্রি করে ২৫০ টাকার মতো পান। এ টাকা দিয়ে টানাটানির সংসার না চললেও পত্রিকা বিক্রির কাজটা এখনো করে চলেছেন। এই ফিচার লেখা অবস্থায় লক্ষ্মীপুর থেকে খবর পেলাম, ছৈয়দ আহম্মদ গুরুতর অসুস্থ। অসুস্থ হওয়ায় নিষেধ সত্ত্বেও পত্রিকা হাতে নিয়ে আগের মতো বের হতে চান তিনি। শতবর্ষের এই আলোর মানুষটির জীবনে অভাব নিত্যদিনের তারপরও বড় হূদয় তাঁর, পাইকবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের সময় নিজের ভিটেমাটির চার শতাংশ জমি দানে তিনি পিছপা হননি। সুস্থ হয়ে আবারও তিনি ফিরতে চান তাঁর একমাত্র পেশায়।
শতবর্ষী এই আলোর মানুষটি সম্পর্কে খোঁজ নিতেই গত আট ফেব্রুয়ারি রওনা হই উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরের উদ্দেশে। বাস থেকে নেমে প্রথমেই হাজির হই শহরের রহমানিয়া প্রেসে। ঘড়িতে তখন আটটা ছুঁইছুঁই। ‘এই সকালে ছৈয়দ আহম্মদকে কি পাওয়া যাবে?’ মনে মনে এমন প্রশ্ন করতেই দেখা মিলল মানুষটির। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, পরনে পুরোনো বিবর্ণ শার্ট ও লুঙ্গি। ডান হাতে একটি লাঠি ধরা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢাকা থেকে পত্রিকার গাড়ি এসে পৌঁছাবে। তাই পুরোনো পত্রিকা আর কাগজপত্র বির্িছয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু তখনো কাজে আসেননি তাঁর অনেক সহকর্মী। প্রস্তুতি সম্পন্ন করে তার ওপরই বসে পড়েন তিনি। এরপর চেয়ে থাকেন রাস্তার দিকে, কখন আসবে পত্রিকার গাড়ি, কখন শুরু হবে তাঁর কাজ। এ রকম প্রস্তুতির ফাঁকেই ছৈয়দ আহম্মদ সম্পকে কথা হয় রহমানিয়া প্রেসের কর্মী রাকিব হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, প্রতিদিন সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে রহমানিয়া প্রেসে চলে আসেন ছৈয়দ আহমদ। ‘মাঝে মাঝে সকালবেলা দোকান খুলতে এসে দেখি ছৈয়দ কাকা বসে আছেন। প্রায় সময়ই তিনি আমাদের আগেই এসে বসে থাকেন আর থাকেন সারা দিন, অনেক সময় রাত পর্যন্ত।’ পত্রিকার গাড়ি এসে পৌঁছালে ব্যস্ত হয়ে পড়েন ছৈয়দ আহম্মদ। শুরু হয় তাঁর কাজ। সন্ধ্যার আগে আর তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয় না। সারা দিনের কর্মব্যস্ততা শেষে সন্ধ্যায় স্থানীয় একটি হোটেলে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। আজ থেকে প্রায় ৭৫ বছর আগে পত্রিকা বিক্রির কাজ শুরু করেন তিনি। সন-তারিখটা ঠিক মনে করতে পারছিলেন না। ছৈয়দ আহম্মদ ভূঁইয়া বলেন, ‘পথমে নুকাত কাম কইততাম। হিয়ার হরে একদিন চুচুয়া মুলভীর লগে ইয়ানো আঁই পথরিকা বেচার কাম শুরু করি।’ (নোয়াখালীর ভাষায় বলা কথাগুলো হলো, ‘প্রথমে নৌকায় কাজ করতাম। তারপরে একদিন স্থানীয় চুচুয়া মৌলভীর মাধ্যমে এই রহমানিয়া প্রেসে এসে পত্রিকা বিক্রির কাজ শুরু করি।’) মাত্র চার পয়সায় বাংলার বাণী, ইত্তেফাক আর কলকাতার যুগান্তর বিক্রি করতেন শুরুর দিকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগ, ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং ৯০-এর গণ-অভ্যুথানসহ সব আন্দোলনের স্বাক্ষী এই ছৈয়দ আহম্মদ ভূঁইয়া। রহমানিয়া প্রেস প্রতিষ্ঠাতা ও ছৈয়দ আহম্মদের আশ্রয়দাতা প্রয়াত সাংবাদিক গোলাম রহমানের ছেলে আনোয়ার রহমান বলেন, ‘আমার বয়স প্রায় ৬২ বছর। আমি স্কুলজীবন থেকেই ছৈয়দ চাচাকে পত্রিকা বিক্রি করতে দেখছি। পত্রিকা পড়তে না পারলেও পত্রিকা বিক্রির প্রতি তাঁর অসম্ভব ঝোঁক ছিল। অনেকে অনেকবার তাঁকে এ কাজ ছেড়ে দিতে বললেও তিনি এখনো হেঁটে হেঁটে পত্রিকা বিক্রি করছেন। এমনকি যেদিন পত্রিকা বের হয় না সেদিনও পুরোনো পত্রিকা নিয়ে বের হয়ে যান। পত্রিকার প্রতি অন্য রকম নেশা তাঁর।’ শুরুর দিকের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সে সময় ডাকহরকরারা পায়ে হেঁটে পত্রিকা পৌঁছে দিত। সকালবেলার পত্রিকা আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। সন্ধ্যার সময় পত্রিকা বিক্রির জন্য বের হতাম।’ মুক্তিযুদ্ধের কথা জিজ্ঞেস করলে ছৈয়দ আহম্মদ জানান, সে সময় ইত্তেফাক আর সংগ্রাম ছাড়া অন্য কিছু বিক্রি করতে পারতেন না। ‘আর হানাদার বাহিনী তাদের দেখলে হাতের কনুই পরীক্ষা করত। কারণ মুক্তিযোদ্ধাদের কনুইয়ে ট্রেনিংয়ের কারণে ক্ষত হয়ে থাকত। আর পাকিস্তানিদের সালাম দিলে তারা খুশি হয়ে যেত।’ মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কথা এভাবেই বললেন তিনি। লক্ষ্মীপুর বাজারের ব্যবসায়ী মাহাবুবুর রহমান চৌধুরী ছৈয়দ আহম্মদ সম্পর্কে বলেন, ‘আমরা ছোটবেলায় স্কুলে যাওয়ার সময় ছৈয়দ আহম্মদকে দেখতাম পত্রিকা হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে। ছাত্র বলতেই তিনি আমাদের বিনে পয়সায় পত্রিকা পড়তে দিতেন। আজও এই মানুষটিকে পত্রিকা হাতে নিয়ে সেই চিরচেনা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি।’
লক্ষ্মীপুরের ছেলে থেকে বুড়ো, আবালবৃদ্ধবনিতা সবার কাছেই একনামে পরিচিত এই ছৈয়দ আহম্মদ ভূঁইয়া। বাচ্চা ছেলেমেয়েদের কাছে ছৈয়দ নানা আর বয়স্কদের কাছে ছৈয়দ চাচা নামেই পরিচিত তিনি।
ছৈয়দ আহম্মদ ভূঁইয়ার তিন ছেলে ও চার মেয়ে। ছেলে আবুল কালাম ও নাতি মোহাম্মদ মোক্তার এখন তাঁর মতোই পত্রিকা বিক্রির কাজ করেন। ছৈয়দ আহম্মদ প্রতিদিন পত্রিকা বিক্রি করে ২৫০ টাকার মতো পান। এ টাকা দিয়ে টানাটানির সংসার না চললেও পত্রিকা বিক্রির কাজটা এখনো করে চলেছেন। এই ফিচার লেখা অবস্থায় লক্ষ্মীপুর থেকে খবর পেলাম, ছৈয়দ আহম্মদ গুরুতর অসুস্থ। অসুস্থ হওয়ায় নিষেধ সত্ত্বেও পত্রিকা হাতে নিয়ে আগের মতো বের হতে চান তিনি। শতবর্ষের এই আলোর মানুষটির জীবনে অভাব নিত্যদিনের তারপরও বড় হূদয় তাঁর, পাইকবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের সময় নিজের ভিটেমাটির চার শতাংশ জমি দানে তিনি পিছপা হননি। সুস্থ হয়ে আবারও তিনি ফিরতে চান তাঁর একমাত্র পেশায়।
No comments