প্রতিরোধের মার্চ-ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুললেন নারীরা by মালেকা বেগম
মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি-পর্বে নারীর অংশগ্রহণকে ব্যতিক্রম হিসেবেই বিবেচনা করার ভ্রান্তিবিলাস চলেছে। মূলধারার বাইরে যেন আলাদা এক উদ্যোগ ছিল বলেই ভেবেছেন ইতিহাসবিদেরা। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন ও অভ্যুত্থানে দেশের জেলা শহরে, ঢাকায় ছাত্রীরা, নারীরা, দলে দলে, কাতারে কাতারে হেঁটেছেন, স্লোগান দিয়েছেন, লেফট-রাইট করেছেন, হাতে
থাকত কাঠের তৈরি বন্দুক বা লাঠি। এই গৌরবের কুঁচকাওয়াজের দৃশ্যও ক্যামেরায় ধরে রেখেছিলেন আলোকচিত্রী রশিদ তালুকদারসহ সে সময়ের আরও কয়েকজন আলোকচিত্রী এবং সাংবাদিকদের অনেকেই লিখেছিলেন। তাঁরা ছিলেন একান্ত নারীবান্ধব সহযোদ্ধা। কিন্তু মূলধারার ইতিহাস লেখকদের লেখায় স্থান পায়নি সেসব কাহিনি। নারীদের লেখা বইয়ে পাওয়া যাবে সেসব দিনের অমূল্য সব বিবরণ।
১৯৬৯ সালের ১৯ জানুয়ারি ছাত্রীদের মিছিলে পুলিশ লাঠিপেটা করে। ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদুজ্জামান। আসাদের মা ছাত্রনেতাদের কাছে লিখে পাঠালেন তাঁর শোকার্ত-বজ্রকঠিন বাণী, ‘আমার আসাদের মৃত্যু হয়নি। আমার আসাদ বলত, “মা, আগামী ১০ বছরের মধ্যে এই মাতৃভূমি নতুন জীবন পাবে।” আমার আসাদের এই স্বপ্ন তোমরা সার্থক কোরো।’ দৈনিক আজাদ পত্রিকায় এই খবরটি পড়ে বাংলার সব মা কাঁদলেন, একাত্মতা জানালেন, ২২ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে বের হওয়া পাঁচ হাজার ছাত্রছাত্রীর শোক মিছিলে যোগ দিলেন।
২৪ জানুয়ারি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল হলো। পুলিশ-বেষ্টনী ভেঙে ঢাকা শহরে ছাত্রদের মিছিল থেকে কালো পতাকা হাতে দীপা দত্ত ও তরু আহমেদ এগিয়ে গেলেন। আমরা সেই মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা দেখলাম বেষ্টনী ভাঙার পর ছাত্র-জনতা পথে নেমে চললেন পল্টন ময়দানের দিকে। সেই দিন সন্ধ্যা ছয়টায় বটতলা থেকে মশাল মিছিল বের হলে দলে দলে মায়েরা-বোনেরা যোগ দিলেন। ২৫ জানুয়ারি ঢাকায় গুলিতে নিহত হন নাখালপাড়ার আনোয়ারা খাতুন ও তাঁর দুগ্ধপোষ্য শিশু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২ জন শিক্ষকের স্ত্রী ২৮ জানুয়ারি পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে জানালেন যে ছাত্র-জনতা-মায়েদের ওপর পাকিস্তানি সরকারের সশস্ত্র হামলার পরিণামের জন্য সরকারকে দায়ী থাকতে হবে।
২৮ জানুয়ারি চট্টগ্রামে কালো দিবস পালন করে ছাত্রীরা। ৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা থেকে কারফিউ জারি হবে জেনে ঢাকার নারীসমাজ কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে সকাল ১০টায় শহীদ মিনারে সমাবেশ করেন এবং আড়াই হাজার নারী মিছিল করে হাইকোর্টের সামনে দিয়ে নবাবপুর হয়ে বাহাদুর শাহ পার্কে যান। বোরকা পরা হাজার হাজার পর্দানশিন অন্তঃপুরিকা সেই মিছিলে যোগ দেন। মায়েদের সঙ্গে সহযোদ্ধা ছিল শিশু-কিশোরীরা। নবাবপুর রোড দিয়ে যওয়ার সময় আমরা মিছিলের যাত্রীরা স্বাগত শ্রদ্ধা পেয়েছিলাম স্থানীয় সব বাড়ির নারী-পুরুষদের ছিটিয়ে দেওয়া ফুলের পাপড়ি আর গোলাপজলের সৌরভে। সেই সভায়-মিছিলে-স্লোগানে নারীসমাজ সোচ্চার ছিল ১১ দফা দাবি এবং ছাত্র হত্যার বিচারের দাবিতে।
আমরা অনেকেই তখন ছাত্রত্ব শেষ করেছি। ছাত্র ইউনিয়ন এবং গোপন ‘পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি’-এর গোপন সদস্য হওয়ার কঠিন ব্রত পালনকারী আমরা সারা দেশের শত শত মেয়ে তখন শপথে শপথে আত্মনিবেদনে পাগলপারা ছিলাম। সুফিয়া কামালের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের মধ্য দিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ‘মহিলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করতে হবে। ১৯৬৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি সংগঠনটি গঠিত হলো। সমাজসেবী, যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময়ে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা, আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, বাম রাজনৈতিক নেত্রীদের মধ্যে সংগ্রাম পরিষদে ছিলেন জোবেদা খাতুন চৌধুরী, বদরুন্নেসা আহমেদ, আমেনা আহমেদ, সেলিনা বানু, রাজিয়া বানু, সারা আলী, হামিদা হোসেন, নূরজাহান মুরশিদ, জোহরা তাজউদ্দিন, সাজেদা চৌধুরী, হাজেরা মাহমুদ, কামরুন নাহার লাইলী, ফরিদা হাসান, আজিজা ইদরিস, রেবেকা মহিউদ্দিন, দীপাদত্ত, সেলিনা বাহার জামান, কনিকা ভট্টাচার্য, মনোয়ারা বিবি প্রমুখ। আমরা কমিউনিস্ট পার্টির আদর্শে লালিত মেয়েরা তো ছিলামই।
সেই বছর ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষাশহীদ দিবস ছিল। প্রথম সরকারি ঘোষিত ছুটির দিন। সেটা ছিল স্বাধিকার আন্দোলনের অমোঘ বিজয়। মহিলা সংগ্রাম পরিষদের আয়োজনে নারীসমাজ দলে দলে প্রভাতফেরিতে যোগ দেন। নির্ভয়ে বলিষ্ঠ সাহসে নারীসমাজের দৃপ্ত খালি পায়ের দ্রুত হাঁটার ছবিটা আজও আমাদের নারীসমাজের মুক্তি আন্দোলনে অনুপ্রেরণা দিচ্ছে।
আন্দোলন, সভা, মিছিলে, পিকেটিংয়ে তখনো নারীদের প্রকাশ্য উপস্থিতি ছিল নামমাত্র। কিন্তু আন্দোলন-সংগ্রামে আহত, শহীদ, বন্দীদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে সহমর্মিতা জানিয়ে তাঁরাও সহযোদ্ধা হতেন।
মহিলা সংগ্রাম পরিষদের ঘোষণায়, কর্মনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে পুরুষ-সংগ্রামীদের পাশাপাশি নারীসমাজও সহযোদ্ধা হিসেবে দৃশ্যমান হলো। মহিলা সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলতে, কাজ সংগঠিত করতে ছাত্রীসমাজ সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিল।
আয়শা খানম, মুনিরা আক্তার, মাহফুজা খানম, ফওজিয়া মোসলেম, মিনি মর্জিনা, রোকেয়া কবীর, মাখদুমা নার্গিস, নাজমুন নাহার, কাজী তামান্না, রাফিয়া আখতার ডলি, ফোরকান বেগম, মমতাজ বেগম, শামসুন্নাহার প্রমুখ ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের নেত্রীরা চলমান ছাত্র গণ-আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন।
১৯৭০ সালের ৪ এপ্রিল সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে ‘পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদ’ গঠিত হলে সাধারণ সম্পাদিকা হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় জেলায় জেলায়, পাড়ায় পাড়ায় সাধারণ নারীদের আকুলতা, ব্যাকুলতা, কর্মস্পৃহায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। নারীসমাজ তখন থেকেই দাবি জানিয়েছে, নারীদের সংরক্ষিত আসনে গণভোটে সরাসরি নির্বাচন, রাজবন্দীদের মুক্তি, নারী শ্রমিকদের মজুরি বৈষম্য দূর করা, মাতৃসদন প্রতিষ্ঠা, জিনিসের দাম কমানো, নারী নির্যাতন বন্ধ করার। দেশের স্বাধিকার ও নারীর স্বাধিকার তখন একই স্রোতে মিশেছিল।
আপওয়া, পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতি, পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সংসদের সদস্যরা ১৯৭১ সালের সেই উত্তাল মার্চে নিজ নিজ কর্মসূচি চালিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিতে যোগ দিচ্ছিলেন। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে নারীসমাজ উদ্দীপ্ত হতে থাকে। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল’। নারীরা, মায়েরা, প্রবীণারা, তরুণীরা সেই দুর্গ গড়ে তুলতে প্রস্তুতি নিতে থাকেন। সবাই শপথে শপথে বলীয়ান হয়ে বাড়ি ফিরে নানা পরিকল্পনা করলেন। হাতে লাঠি তুলে নিয়ে, মাথায় ক্যাপ ও পায়ে কেডস পরে দৃপ্তভঙ্গিতে প্রতিদিন তাঁরা কুচকাওয়াজ করেছেন, শরীরচর্চার প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন। দেশের সব জেলায় নারীদের সংগঠিত করে কুচকাওয়াজ ও অস্ত্রের ট্রেনিংয়ের মনোবল তৈরি করতে থাকেন আওয়ামী লীগ মহিলা শাখা, পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদ এবং ছাত্রীরা। ঢাকায় কুচকাওয়াজ করতে আমরা সবাই একত্র হতাম কোনো দিন সেগুন বাগিচায় মিসেস সারা আলীর বাসার মাঠে, কোনো দিন ধানমন্ডি গার্লস কলেজের মাঠে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পলাশীতে, ঝিকাতলায়, রায়েরবাজারে, কলাবাগানে, গোপীবাগে, সূত্রাপুরে ও গেন্ডারিয়ায়। সে সময় সমবেত নারীরা বলতেন, তাঁদের স্বামী-সন্তানেরাও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গিয়েছেন। ‘যুদ্ধ যুদ্ধ’ প্রস্তুতির প্রয়োজনে তাঁদের বাড়িগুলো হয়ে উঠেছিল একেকটি দুর্গের মতো। বাড়ির, পরিবারের সবাই একই ভাবনায় আলোড়িত হতেন, সংগ্রামী নানা কাজের তৎপরতায় একাত্ম হয়ে ছিলেন। একদিকে মায়ের কুচকাওয়াজে যাওয়ার তাড়া, বাবা আর ছেলে যাচ্ছে অসহযোগ আন্দোলনের কাজে, মেয়েও যাচ্ছে অস্ত্র চালনা শেখার প্রশিক্ষণে—সবাই সমঝোতার সহযোগ গড়ে তুলেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি-পর্বে এ দেশের পুরুষতান্ত্রিক-পিতৃতান্ত্রিক সমাজে-পরিবারে নারীর প্রতি এমন সহমর্মিতা কিছুটা বিস্ময়কর বৈকি। সাময়িক ছিল সেই সহযোগিতা। মুক্তিযুদ্ধের পর কোথায় গেল সেই নারী-পুরুষের পারস্পরিক শ্রদ্ধার, মর্যাদার, সমতার বোধ? সে সময় যা দেখেছিলাম, পেয়েছিলাম, তুলনায় আজ সেই বোধ যেন ‘মূল্যবোধ’ হারিয়ে দিশাহারা।
সে সময় বহু বাড়িতে গোপন সভা, সাংস্কৃতিক রিহার্সেল হতো। তাঁদের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন স্থপতি মাজহারুল ইসলাম ও হোসনে আরা ইসলাম (বেবী আপা)। তাঁদের পরীবাগের বাড়িটি ছিল সে সময়ের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ছাত্র আন্দোলনের দুর্গ। পুরো পরিবারটি যুক্ত হয়েছিল এই সংগ্রামের সঙ্গে। অশীতিপর বৃদ্ধ অসুস্থ স্থপতি মাজহারুল ইসলাম ও হোসনে আরা ইসলামকে আমাদের অগণিত মুক্তিযোদ্ধার পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
কবি সুফিয়া কামালের বাড়ি-পরিবারের সবাই ছিলেন নিবেদিত যোদ্ধা।
৮ মার্চ থেকে ভবনে ভবনে কালো পতাকা তোলার কর্মসূচি সফল করেছেন মায়েরা, মেয়েরা। একাত্তরের গেরিলা (লেখক জহিরুল ইসলাম) বইয়ে মেয়েদের ট্রেনিংয়ের বহু তথ্য আছে। চট্টগ্রামের মেয়েদের যুদ্ধ প্রস্তুতি, ঢাকার ছাত্রী নার্সদের ট্রেনিং, মাইজদী কোর্টে মেয়েদের ট্রেনিং ইত্যাদি চলতে থাকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত। পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের কর্মকাণ্ডও চলেছে উত্তাল ২৫ মার্চ দিন পর্যন্ত। রাতে শুরু হলো পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ, গোলাবর্ষণ, গণহত্যা, যুদ্ধ ঘোষণা।
বাংলার ঘরে ঘরে নারীদের, শিশুদের, যুবকদের ওপর নেমে এল অত্যাচার, নৃশংসতা। মুক্তিযুদ্ধের ডাকে নারীরাও ঝাঁপিয়ে পড়লেন শহরে বন্দরে। এই সময়কালে, মুক্তিযুদ্ধের পরে নারীরা সন্তানদের নাম রেখেছেন স্বাধীন, আজাদ, মুক্তি, জয়া, জয়, বিজয়, বিজয়া, জয়শ্রী।
মালেকা বেগম: নারীনেত্রী। শিক্ষক, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
১৯৬৯ সালের ১৯ জানুয়ারি ছাত্রীদের মিছিলে পুলিশ লাঠিপেটা করে। ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদুজ্জামান। আসাদের মা ছাত্রনেতাদের কাছে লিখে পাঠালেন তাঁর শোকার্ত-বজ্রকঠিন বাণী, ‘আমার আসাদের মৃত্যু হয়নি। আমার আসাদ বলত, “মা, আগামী ১০ বছরের মধ্যে এই মাতৃভূমি নতুন জীবন পাবে।” আমার আসাদের এই স্বপ্ন তোমরা সার্থক কোরো।’ দৈনিক আজাদ পত্রিকায় এই খবরটি পড়ে বাংলার সব মা কাঁদলেন, একাত্মতা জানালেন, ২২ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে বের হওয়া পাঁচ হাজার ছাত্রছাত্রীর শোক মিছিলে যোগ দিলেন।
২৪ জানুয়ারি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল হলো। পুলিশ-বেষ্টনী ভেঙে ঢাকা শহরে ছাত্রদের মিছিল থেকে কালো পতাকা হাতে দীপা দত্ত ও তরু আহমেদ এগিয়ে গেলেন। আমরা সেই মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা দেখলাম বেষ্টনী ভাঙার পর ছাত্র-জনতা পথে নেমে চললেন পল্টন ময়দানের দিকে। সেই দিন সন্ধ্যা ছয়টায় বটতলা থেকে মশাল মিছিল বের হলে দলে দলে মায়েরা-বোনেরা যোগ দিলেন। ২৫ জানুয়ারি ঢাকায় গুলিতে নিহত হন নাখালপাড়ার আনোয়ারা খাতুন ও তাঁর দুগ্ধপোষ্য শিশু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২ জন শিক্ষকের স্ত্রী ২৮ জানুয়ারি পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে জানালেন যে ছাত্র-জনতা-মায়েদের ওপর পাকিস্তানি সরকারের সশস্ত্র হামলার পরিণামের জন্য সরকারকে দায়ী থাকতে হবে।
২৮ জানুয়ারি চট্টগ্রামে কালো দিবস পালন করে ছাত্রীরা। ৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা থেকে কারফিউ জারি হবে জেনে ঢাকার নারীসমাজ কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে সকাল ১০টায় শহীদ মিনারে সমাবেশ করেন এবং আড়াই হাজার নারী মিছিল করে হাইকোর্টের সামনে দিয়ে নবাবপুর হয়ে বাহাদুর শাহ পার্কে যান। বোরকা পরা হাজার হাজার পর্দানশিন অন্তঃপুরিকা সেই মিছিলে যোগ দেন। মায়েদের সঙ্গে সহযোদ্ধা ছিল শিশু-কিশোরীরা। নবাবপুর রোড দিয়ে যওয়ার সময় আমরা মিছিলের যাত্রীরা স্বাগত শ্রদ্ধা পেয়েছিলাম স্থানীয় সব বাড়ির নারী-পুরুষদের ছিটিয়ে দেওয়া ফুলের পাপড়ি আর গোলাপজলের সৌরভে। সেই সভায়-মিছিলে-স্লোগানে নারীসমাজ সোচ্চার ছিল ১১ দফা দাবি এবং ছাত্র হত্যার বিচারের দাবিতে।
আমরা অনেকেই তখন ছাত্রত্ব শেষ করেছি। ছাত্র ইউনিয়ন এবং গোপন ‘পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি’-এর গোপন সদস্য হওয়ার কঠিন ব্রত পালনকারী আমরা সারা দেশের শত শত মেয়ে তখন শপথে শপথে আত্মনিবেদনে পাগলপারা ছিলাম। সুফিয়া কামালের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের মধ্য দিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ‘মহিলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করতে হবে। ১৯৬৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি সংগঠনটি গঠিত হলো। সমাজসেবী, যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময়ে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা, আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, বাম রাজনৈতিক নেত্রীদের মধ্যে সংগ্রাম পরিষদে ছিলেন জোবেদা খাতুন চৌধুরী, বদরুন্নেসা আহমেদ, আমেনা আহমেদ, সেলিনা বানু, রাজিয়া বানু, সারা আলী, হামিদা হোসেন, নূরজাহান মুরশিদ, জোহরা তাজউদ্দিন, সাজেদা চৌধুরী, হাজেরা মাহমুদ, কামরুন নাহার লাইলী, ফরিদা হাসান, আজিজা ইদরিস, রেবেকা মহিউদ্দিন, দীপাদত্ত, সেলিনা বাহার জামান, কনিকা ভট্টাচার্য, মনোয়ারা বিবি প্রমুখ। আমরা কমিউনিস্ট পার্টির আদর্শে লালিত মেয়েরা তো ছিলামই।
সেই বছর ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষাশহীদ দিবস ছিল। প্রথম সরকারি ঘোষিত ছুটির দিন। সেটা ছিল স্বাধিকার আন্দোলনের অমোঘ বিজয়। মহিলা সংগ্রাম পরিষদের আয়োজনে নারীসমাজ দলে দলে প্রভাতফেরিতে যোগ দেন। নির্ভয়ে বলিষ্ঠ সাহসে নারীসমাজের দৃপ্ত খালি পায়ের দ্রুত হাঁটার ছবিটা আজও আমাদের নারীসমাজের মুক্তি আন্দোলনে অনুপ্রেরণা দিচ্ছে।
আন্দোলন, সভা, মিছিলে, পিকেটিংয়ে তখনো নারীদের প্রকাশ্য উপস্থিতি ছিল নামমাত্র। কিন্তু আন্দোলন-সংগ্রামে আহত, শহীদ, বন্দীদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে সহমর্মিতা জানিয়ে তাঁরাও সহযোদ্ধা হতেন।
মহিলা সংগ্রাম পরিষদের ঘোষণায়, কর্মনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে পুরুষ-সংগ্রামীদের পাশাপাশি নারীসমাজও সহযোদ্ধা হিসেবে দৃশ্যমান হলো। মহিলা সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলতে, কাজ সংগঠিত করতে ছাত্রীসমাজ সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিল।
আয়শা খানম, মুনিরা আক্তার, মাহফুজা খানম, ফওজিয়া মোসলেম, মিনি মর্জিনা, রোকেয়া কবীর, মাখদুমা নার্গিস, নাজমুন নাহার, কাজী তামান্না, রাফিয়া আখতার ডলি, ফোরকান বেগম, মমতাজ বেগম, শামসুন্নাহার প্রমুখ ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের নেত্রীরা চলমান ছাত্র গণ-আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন।
১৯৭০ সালের ৪ এপ্রিল সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে ‘পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদ’ গঠিত হলে সাধারণ সম্পাদিকা হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় জেলায় জেলায়, পাড়ায় পাড়ায় সাধারণ নারীদের আকুলতা, ব্যাকুলতা, কর্মস্পৃহায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। নারীসমাজ তখন থেকেই দাবি জানিয়েছে, নারীদের সংরক্ষিত আসনে গণভোটে সরাসরি নির্বাচন, রাজবন্দীদের মুক্তি, নারী শ্রমিকদের মজুরি বৈষম্য দূর করা, মাতৃসদন প্রতিষ্ঠা, জিনিসের দাম কমানো, নারী নির্যাতন বন্ধ করার। দেশের স্বাধিকার ও নারীর স্বাধিকার তখন একই স্রোতে মিশেছিল।
আপওয়া, পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতি, পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সংসদের সদস্যরা ১৯৭১ সালের সেই উত্তাল মার্চে নিজ নিজ কর্মসূচি চালিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিতে যোগ দিচ্ছিলেন। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে নারীসমাজ উদ্দীপ্ত হতে থাকে। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল’। নারীরা, মায়েরা, প্রবীণারা, তরুণীরা সেই দুর্গ গড়ে তুলতে প্রস্তুতি নিতে থাকেন। সবাই শপথে শপথে বলীয়ান হয়ে বাড়ি ফিরে নানা পরিকল্পনা করলেন। হাতে লাঠি তুলে নিয়ে, মাথায় ক্যাপ ও পায়ে কেডস পরে দৃপ্তভঙ্গিতে প্রতিদিন তাঁরা কুচকাওয়াজ করেছেন, শরীরচর্চার প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন। দেশের সব জেলায় নারীদের সংগঠিত করে কুচকাওয়াজ ও অস্ত্রের ট্রেনিংয়ের মনোবল তৈরি করতে থাকেন আওয়ামী লীগ মহিলা শাখা, পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদ এবং ছাত্রীরা। ঢাকায় কুচকাওয়াজ করতে আমরা সবাই একত্র হতাম কোনো দিন সেগুন বাগিচায় মিসেস সারা আলীর বাসার মাঠে, কোনো দিন ধানমন্ডি গার্লস কলেজের মাঠে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পলাশীতে, ঝিকাতলায়, রায়েরবাজারে, কলাবাগানে, গোপীবাগে, সূত্রাপুরে ও গেন্ডারিয়ায়। সে সময় সমবেত নারীরা বলতেন, তাঁদের স্বামী-সন্তানেরাও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গিয়েছেন। ‘যুদ্ধ যুদ্ধ’ প্রস্তুতির প্রয়োজনে তাঁদের বাড়িগুলো হয়ে উঠেছিল একেকটি দুর্গের মতো। বাড়ির, পরিবারের সবাই একই ভাবনায় আলোড়িত হতেন, সংগ্রামী নানা কাজের তৎপরতায় একাত্ম হয়ে ছিলেন। একদিকে মায়ের কুচকাওয়াজে যাওয়ার তাড়া, বাবা আর ছেলে যাচ্ছে অসহযোগ আন্দোলনের কাজে, মেয়েও যাচ্ছে অস্ত্র চালনা শেখার প্রশিক্ষণে—সবাই সমঝোতার সহযোগ গড়ে তুলেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি-পর্বে এ দেশের পুরুষতান্ত্রিক-পিতৃতান্ত্রিক সমাজে-পরিবারে নারীর প্রতি এমন সহমর্মিতা কিছুটা বিস্ময়কর বৈকি। সাময়িক ছিল সেই সহযোগিতা। মুক্তিযুদ্ধের পর কোথায় গেল সেই নারী-পুরুষের পারস্পরিক শ্রদ্ধার, মর্যাদার, সমতার বোধ? সে সময় যা দেখেছিলাম, পেয়েছিলাম, তুলনায় আজ সেই বোধ যেন ‘মূল্যবোধ’ হারিয়ে দিশাহারা।
সে সময় বহু বাড়িতে গোপন সভা, সাংস্কৃতিক রিহার্সেল হতো। তাঁদের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন স্থপতি মাজহারুল ইসলাম ও হোসনে আরা ইসলাম (বেবী আপা)। তাঁদের পরীবাগের বাড়িটি ছিল সে সময়ের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ছাত্র আন্দোলনের দুর্গ। পুরো পরিবারটি যুক্ত হয়েছিল এই সংগ্রামের সঙ্গে। অশীতিপর বৃদ্ধ অসুস্থ স্থপতি মাজহারুল ইসলাম ও হোসনে আরা ইসলামকে আমাদের অগণিত মুক্তিযোদ্ধার পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
কবি সুফিয়া কামালের বাড়ি-পরিবারের সবাই ছিলেন নিবেদিত যোদ্ধা।
৮ মার্চ থেকে ভবনে ভবনে কালো পতাকা তোলার কর্মসূচি সফল করেছেন মায়েরা, মেয়েরা। একাত্তরের গেরিলা (লেখক জহিরুল ইসলাম) বইয়ে মেয়েদের ট্রেনিংয়ের বহু তথ্য আছে। চট্টগ্রামের মেয়েদের যুদ্ধ প্রস্তুতি, ঢাকার ছাত্রী নার্সদের ট্রেনিং, মাইজদী কোর্টে মেয়েদের ট্রেনিং ইত্যাদি চলতে থাকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত। পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের কর্মকাণ্ডও চলেছে উত্তাল ২৫ মার্চ দিন পর্যন্ত। রাতে শুরু হলো পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ, গোলাবর্ষণ, গণহত্যা, যুদ্ধ ঘোষণা।
বাংলার ঘরে ঘরে নারীদের, শিশুদের, যুবকদের ওপর নেমে এল অত্যাচার, নৃশংসতা। মুক্তিযুদ্ধের ডাকে নারীরাও ঝাঁপিয়ে পড়লেন শহরে বন্দরে। এই সময়কালে, মুক্তিযুদ্ধের পরে নারীরা সন্তানদের নাম রেখেছেন স্বাধীন, আজাদ, মুক্তি, জয়া, জয়, বিজয়, বিজয়া, জয়শ্রী।
মালেকা বেগম: নারীনেত্রী। শিক্ষক, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments