হারানো দিনের ঢাকার বাইজি by মাহবুব আলমওয়াকার এ খান
স্বামীর মৃতদেহ ভেলায় নিয়ে বেহুলা সুন্দরী ভেসে চলেছেন অমরাবতীর পথে, দেবতাদের কাছে মৃত স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা চাইতে। দেবলোকে পৌঁছে বেহুলা তাঁর অপূর্ব নৃত্যগীতে দেবতাদের প্রসন্নতা লাভ করে স্বামী লখিন্দরের প্রাণ ফিরে পেলেন। বেহুলা নর্তকী ছিলেন না, ছিলেন ধনিক-বণিকের ঘরের কুলবধূ।
কিন্তু ৬৪ কলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কলা নৃত্যবিদ্যাটি ভালোভাবেই রপ্ত করেছিলেন তিনি। এই কাহিনির যে সমাজতাত্ত্বিক দিকটি আমাদের চোখে পড়ে, সেটি হলো মধ্যযুগেও নাচ-গানের চর্চা বাংলার উচ্চকোটি সমাজের অন্তঃপুরেও আদৃত ছিল। বাংলাদেশে নাচ-গানের যে বরাবরই কদর ছিল, তার বড় প্রমাণ নানা মন্দির ও বিহারের গায়ে নর-নারীর নৃত্যদৃশ্য নিয়ে তৈরি টেরাকোটা ফলকের অপূর্ব সমারোহ ও প্রাচুর্য।
‘বাঙালির বাদশা’ ইলিয়াস শাহি সুলতানদের রাজধানী গৌড় পান্ডুয়ার নাচ-গানের চর্চার কথা লিখে গেছেন ১৫ শতকের গোড়ার দিকে সফরকারী চীনা দূত মাহুয়ান, যিনি চীন সম্রাটের রাজদূতদের সহকারী হিসেবে বাংলার সুলতানের দরবারে হাজির হয়েছিলেন। ভোজের সময় আনন্দ দেওয়ার জন্য সুলতানের গাইয়ে ও নাচিয়েদের দক্ষতা নিজের চোখে দেখেছিলেন তিনি। আরও একজন চীনা রাজদূত হুহিয়েন একই তথ্য জানিয়ে লিখেছেন, এরা যখন নিমন্ত্রণ করে তখন অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্য নাচের বন্দোবস্ত থাকে। নর্তকীদের পোশাকেরও একটি স্নিগ্ধ বর্ণনা দিয়েছেন তিনি এমনই ভাষায়, ‘এরা হালকা লাল রঙের ফুল তোলা জামা পরে। শরীরের তলার দিকটায় এরা রঙিন রেশমের কাপড় জড়িয়ে রাখে। গলায় আর কাঁধে এদের পেনড্যান্ট আর হার। কবজিতে নীল আর দামি পাথর থাকে।’ (বঙ্গবৃত্তান্ত অসীম রায়)
সুলতানি আমলে সোনারগাঁ ছিল রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের একটি বৃহৎ প্রশাসনিক ও সামরিক কেন্দ্র এবং গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যনগর। অনেক গবেষক একে বাংলার সুলতানদের দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবেও মনে করেন। সোনারগাঁ যে গৌড় পান্ডুয়ার মতো সংগীত ও নৃত্যকলার উর্বর ক্ষেত্র ছিল, এমনটি ধারণা করা অসংগত হবে না।
মোগল শাসনামলে সুবেদার ইসলাম খান রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় নিয়ে এলে এই নতুন রাজধানী জাহাঙ্গীরনগরে সংগীত আর নৃত্যের কেন্দ্রটি যে আরও প্রসারিত হয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ঢাকার একটি দক্ষ সংগীত ও নৃত্যশিল্পীর দল ছিল। মি. শার্লিমান তাঁর বাংলার ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন, ঢাকায় ইসলাম খানের দরবারে ১২০০ কাঞ্চনী শোভা পেত। যাদের পেশা নাচ-গান। এ থেকে অনুমিত হয়, ইসলাম খানের ঢাকা আসার আগেও এখানে গান-বাজনার ব্যাপক চর্চা ছিল। তা না হলে ১২০০ কাঞ্চনীর এত অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর দরবারে হাজির হওয়া অসম্ভব হতো। কাঞ্চনী ছাড়াও তাঁর দরবারে ছিল লুলি, হোরকানি ও ডোমনি—এরা সবাই নাচনী মেয়ে। এদের জন্য তাঁর বার্ষিক খরচ হতো ৮০ হাজার টাকা। ইসলাম খানের সংগীত ও নৃত্যশিল্পীদের সুখ্যাতি মোগলসম্রাট জাহাঙ্গীরের কানে পৌঁছাতে দেরি হয়নি। তিনি নাকি ঢাকা থেকে কিছু সেরা গায়ক ও নর্তকীকে মোগল শাহি দরবারের জন্য চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। সম্রাট তাঁর দরবারের সংগীতজ্ঞ প্রেমরঙ্গাকেও ঢাকায় ইসলাম খানের দরবারে পাঠিয়েছিলেন।
দীর্ঘদিন সুবে বাংলার রাজধানী ছিল ঢাকা। রাজধানীর মর্যাদা হারানোর পরও সংগীতের জন্য ঢাকার খ্যাতি ছিল অটুট। ১৮৫৭-এর পর এই খ্যাতি আরও বৃদ্ধি পায়। লখনৌর অনেক বাইজি সংগীতজ্ঞ চলে আসেন মুর্শিদাবাদে এবং পরে ঢাকায়। তাঁদের সহায়তা করতেন নবাব পরিবারের বংশধরেরা, মৌলভীবাজারের মোগল বংশোদ্ভূত জমিদার ও নবাবপুরের ধনী বসাক পরিবার। এ ছাড়া যাঁরা সাহায্য করতেন তাঁরা হলেন ভাওয়ালের রাজপরিবার, কাশিমপুর বনিয়া ও পুবাইলের জমিদার। তখন লখনৌ, বেনারস, পাটনা ও কলকাতার প্রতিষ্ঠিত বাইজিরা ঢাকায় এসে তাঁদের অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। সংগীতের পুরোনো কেন্দ্র হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই ঢাকায় ছিলেন কয়েক গুণ গুণী বাইজি। কণ্ঠসংগীতের ওস্তাদ হুসেন মিয়া ঢাকার অনেক বাইজিকে তালিম দিয়েছিলেন। পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে ঢাকার বাইজিদের আমন্ত্রণ জানানো হতো। বহিরাগত অনেক বাইজি ঢাকায় দীর্ঘদিন থেকে গেছেন। কেউ কেউ স্থায়ীভাবেও। আবার অনেকে প্রায়ই ঘুরেফিরে ঢাকায় আসতেন। এসব অস্থায়ী বাইজির পাশাপাশি স্থানীয় মেয়েদেরও বাইজির পেশা বেছে নিতে দেখা গেছে। এই বাইজিদের সম্পর্কে অনেক তথ্য দিয়েছেন হাকিম হাবিবুর রহমান (১৮৮১-১৯৪৭), গনিউর রাজা, সৈয়দ তৈফুর, মুনতাসীর মামুন, সাঈদ আহমদ, অনুপম হায়াত ও সত্যেন সেন। এ ছাড়া পুরোনো পত্রপত্রিকা ও ব্যক্তিগত ডায়েরি থেকেও কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া গেছে। এসব সূত্রের দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই এ নিবন্ধটি লেখা হয়েছে।
ঢাকায় বাইজিদের পাশাপাশি খেমটাওয়ালিরাও দোর্দণ্ডপ্রতাপে রাজত্ব করেছেন। বাইজি নাচ-গান আর খেমটা নাচ-গানের মধ্যে পার্থক্যটা সত্যেন সেনের লেখায় ভালোভাবে ফুটে উঠেছে। খেমটা হলো হালকা ধরনের এবং আদিরসাত্মক। বাইজিরা এককভাবে নাচত। আর এককভাবে সংগীত পরিবেশন করত। বাইজি ও খেমটা নাচের মূল পার্থক্য হলো খেমটা নাচের মধ্যে পায়ের কাজটিই প্রধান এবং নৃত্যভঙ্গির মধ্য দিয়ে যৌন আবেদন সৃষ্টি করা হতো। অন্যদিকে ‘বাইজি নাচে প্রধান ছিল হাতের ছন্দময় দোলা এবং মুখ, চোখ, নাক ও ঠোঁটের সূক্ষ্ম কম্পন।’ বাইজিদের পোশাক ছিল পেশওয়াজ, চুড়িদার পাজামা-ওড়না, পায়ে চিকন ঘুঙুর। ‘খেমটাওয়ালিরা জাতে উঠত বাইজি হয়ে,’ লিখেছেন সত্যেন সেন।
নওয়াব আবদুল গনি ও নওয়াব আহসানউল্লাহর দরবারের কয়েকজন বাইজির উল্লেখ করেছেন হাকিম হাবিবুর রহমান। এঁদের মধ্যে রয়েছেন সুপনজান, সেকালের নামী গায়িকা ও তবলাবাদক, এনাহীজান নওয়াব আবদুল গনির শাহবাগ উৎসবে নেচেছিলেন। হাকিম সাহেব তাঁকে শাহবাগের বার্ষিক উৎসবে দেখেন বলে লিখেছেন। তিনি উত্তর ভারত থেকে ঢাকায় এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। আবেদী বাই এসেছিলেন পাটনা থেকে। তাঁর এক মেয়ে ১৯৪৬-৪৭ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। আন্নু, গান্নু ও নওয়াবীন—এই তিন বোন নওয়াব আবদুল গনির দরবারে নিয়মিত নাচতেন, গাইতেন এবং মাসোহারা নিতেন। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি ছিল নওয়াবীনের। তিনি বিশ শতকের চল্লিশ দশক পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। মুনতাসীর মামুন জানিয়েছেন, এই তিন বোনই ‘পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি’ ভাড়া করে ১৮৮০ সালের নভেম্বরে টিকিটের বিনিময়ে ইন্দ্রসভা নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন। ঢাকায় মহিলাদের নিয়ে এটিই ছিল প্রথম নাট্যাভিনয়। আচ্ছি বাই ছিলেন নওয়াব আবদুল গনির সবচেয়ে নামকরা বাইজি। লখনৌ থেকে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। নৃত্য ও গীতে সুনিপুণা আচ্ছি ছিলেন অনেকের ওস্তাদ। হাকিম হাবিবুর রহমান লিখেছেন যে ঢাকায় আচ্ছি বাইয়ের মতো বড় নর্তকী তার পরেও কেউ আসেনি। ১৯১৪-১৫ সালের দিকে তিনি মারা যান। এ ছাড়া যাঁদের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন তাঁরা হলেন, ওয়াসু, বাতানী, জামুরদ, হীরা পান্না, ইমামী এবং তিনজন হিন্দু বাইজি অতুল, লক্ষ্মী ও কালী বাই। আখের খুকী নামের একজন খেমটাওয়ালির উল্লেখ করেছেন হাকিম হাবিবুর রহমান। খেমটা নাচ প্রদর্শন, বাংলা গান ও হিন্দি ঠুমরি গেয়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি। আমিরজান বাইজি ছিলেন উনিশ শতকের ঢাকার বিখ্যাত গায়িকা ও নর্তকী। জিন্দাবাহারের রাজলক্ষ্মীও ছিলেন ঢাকার আরেক বিখ্যাত বাইজি। জিন্দাবাহারে তাঁর পাঁচ-ছয়টি বাড়ি ছিল। সংগীতশিল্পীর চেয়ে দান-ধ্যানের জন্য তিনি ছিলেন অধিক সম্মানিত। ১৮৮৬ সালে ভূমিকম্পের পর জিন্দাবাহারের কালীবাড়ি ভেঙে গেলে তা মেরামত করে দেন তিনি। রমনার কালীবাড়িও সাজানোর জন্য তিনি মোটা চাঁদা দিয়েছিলেন। মুনতাসীর মামুন আমিরজান ও রাজলক্ষ্মী সম্বন্ধে একটি চিত্তাকর্ষক তথ্য দিয়েছেন। ১৮৭৪ সালে নওয়াব আবদুল গনি ঢাকা শহরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য এক বৈঠকের আয়োজন করেন। সেই বৈঠকে রাজা-মহারাজা জমিদার ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এই দুজন বাইজিও উপস্থিত ছিলেন। নবাব পানি সরবরাহ প্রকল্পে সবাইকে কিছু অর্থ সাহায্য করতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। এ আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলেন মাত্র দুজন—আমিরজান ও রাজলক্ষ্মী—তাঁরা প্রত্যেকে ৫০০ টাকা করে দান করতে রাজি হয়েছিলেন। নবাব অবশ্য পরে কারও কাছ থেকে কোনো সাহায্য না নিয়ে নিজেই এক লাখ টাকা দান করেছিলেন।
উনিশ শতকের নব্বইয়ের দশকের দিকে ঢাকায় এসেছিলেন সিনেটের গনিউর রাজা। সে সময় ঢাকায় মধ্যবিত্তের বিনোদনের তেমন সুস্থ ব্যবস্থা ছিল না। তবে ঢাকা তখন বাইজিদের জন্য বিখ্যাত। গনিউর রাজা তাঁর আত্মজৈবনিক রচনায় বর্ণনা সীমিত রেখেছেন এই বাইজি এবং খেমটাওয়ালিদের মধ্যে। তিনি এই খেমটাওয়ালিদের একটি বর্ণনা দিয়েছেন এমনই ভাষায়:
‘সহর ঘুরিতে ২ অপরাহ্নে [অপরাহ্নে] কিঞ্চিত জলযোগ করিলাম, ও আরও বেড়াইয়া প্রায় ৭।। টার সময় সাচিবন্দর সারদা নাম্নী খেমটাওয়ালির দুতালার উপরে উঠিলাম। ও উক্ত খেমটাওয়ালিকে গান-বাজনার যোগাড় করিতে সোপর্দা, ছামাজি ইত্যাদিকে ডাকাইয়া আনাইবার কথা বলিলাম, ও হুইচকি ব্রান্ডি সুডা ওয়াটার ইত্যাদির জন্য কতেক টাকা দিলাম। অল্প সময়ের মধ্যেই সমস্তের যোগাড় হইয়া গেল।
‘ছামাজি সারঙ্গ বাজাইতে লাগিল, সোপর্দা তবলা বাজাইতে আরম্ভ করিল ও মদ্যপায়ীদের মধ্যে ৫/৭ যে জনা হইয়াছিল তন্মধ্যে খেমটাওয়ালিই একজনকে ছাকি [অর্থাৎ পান পাত্র দাতা] নিযুক্ত করিল, ও সুডা ওয়াটার খুলিয়া মিশ্রিত করিয়া আমরাসহ প্রায় ৮/১০ জনাকে ক্রমান্বয়ে পাত্র বিলি করিতে লাগিল।
‘ওদিকে খেমটাওয়ালি গান আরম্ভ করিল, ও সোপর্দা, ও ছামাজি ইত্যাদি একযোগে সাদত করিতে আরম্ভ করিল। গানবাদ্য খুব জমিল, সুরাপাত্রও অনবরত চলিতে লাগিল।...’
(সূত্র-ঢাকা সমগ্র ১ মুনতাসীর মামুন। ঢাকা-২০০৩।)
এখানে খেমটাওয়ালি প্রসঙ্গে গনিউর রাজার বলা একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। একদিন তিনি সরলা নামের খেমটাওয়ালির বাড়িতে ‘গান-বাজনা’ শুনতে গিয়েছেন। সবাই চলে গেলে খেমটাওয়ালি তাঁকে বলেছিল, ‘তুমি যে মুসলমান, তাহা আমি পূর্বেই বুঝিয়াছি, আমরা হিন্দু রমণী মুসলমানকে জায়গা দেই না, সমাজে দূষিত হইতে হয়। আমি বলিলাম, তোমাদের আবার সমাজ আছে নাকি? সে বলিল, থাকিবে বই কি, যদিও আমরা নাম লিখাইয়ছি তথাপি আমাদের হিন্দুয়ানি সবই বজায় আছে।’ তাদের নৃত্য ও কণ্ঠের মাধুর্যের বর্ণনার পাশাপাশি গনিউর রাজা খেমটাওয়ালিদের দৌরাত্ম্য ও অন্ধকার জীবনের কথাও উল্লেখ করতে ভোলেননি।
বিশ শতকের প্রথম দিকে ঢাকার সবচেয়ে বিখ্যাত বাইজি ছিলেন জিন্দাবাহার লেনের দেবী বাইজি বা দেবী বালা। ঢাকার নবাব পরিবারের খাজা মওদুদের ডায়েরি থেকে (সম্পাদনা অনুপম হায়াত) জানা যায়, ১৯১৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে খাজা হাবিবুল্লাহর বিয়ের অনুষ্ঠানে দেবী বাইজি ও অন্য এক বাইজি নাচ-গান করেছিলেন। দেবী বাইজি পরে প্রথম ঢাকায় নির্মিত পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র (নির্বাক) দ্য লাস্ট কিস-এ অভিনয় করেন। হরিমতি বাইজি ঢাকায় এসে ছিলেন। তিনিও এই নির্বাক ছবিটিতে অভিনয় করেন। শিল্পী পরিতোষ সেন তাঁর আত্মজৈবনিক রচনা জিন্দাবাহারে এক হরিমতি বাই সম্পর্কে লিখেছেন, ‘হরিমতি বাঈজীর ঘরটি আমাদের বারান্দা থেকে পরিষ্কারই দেখা যায়। প্রতিদিনের অভ্যাসমতো ভৈরবী রাগে গান ধরেছেন, “রসিয়া তোরি আখিয়ারে জিয়া লালচায়” ঠুংরি ঠাটের গানের এ কলিটির সুরের মাধুর্য্যে আমাদের জিন্দাবাহার গলিটি কানায় কানায় ভরে উঠেছে।’
বাইজিদের হাসি, গান আর আনন্দের পেছনে লুকিয়ে ছিল অনেক কান্না, বেদনা আর দীর্ঘশ্বাস। কারও জন্ম ঘোর অন্ধকারে ঢাকা, অথচ এর জন্য তার কোনো হাত নেই; কেউ প্রতারিত হয়ে পথের ভিখারি হয়ে শেষ জীবন কষ্টে কাটিয়েছেন। যাঁরা ভাগ্যবান, তাঁরা স্বীকৃতি পেয়ে বেগম হতে পেরেছেন। আবার এঁদের কুহকের বলি হয়েছে অনেকের সংসার, জীবিকা ও জীবন।
ঢাকার বাইজিদের দিন গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকেই ফুরিয়ে যেতে থাকে। দেশ ভাগ ও জমিদার প্রথার উচ্ছেদ এঁদের পৃষ্ঠপোষকহীন করে ফেলে। আজ তাঁদের স্মৃতি রয়ে গেছে শুধু কিছু সংগীতজ্ঞ ও প্রাচীন সম্ভ্রান্ত মানুষের অতীতচারণায়। আরও রয়ে গেছে তাঁদের দুলর্ভ ও দুস্প্রার্প্য রংচটা কিছু আলোকচিত্র, যার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে বিস্মৃতির এক বিষাদময় ইতিকথা।
কৃতজ্ঞতা: কে এম হালিম
‘বাঙালির বাদশা’ ইলিয়াস শাহি সুলতানদের রাজধানী গৌড় পান্ডুয়ার নাচ-গানের চর্চার কথা লিখে গেছেন ১৫ শতকের গোড়ার দিকে সফরকারী চীনা দূত মাহুয়ান, যিনি চীন সম্রাটের রাজদূতদের সহকারী হিসেবে বাংলার সুলতানের দরবারে হাজির হয়েছিলেন। ভোজের সময় আনন্দ দেওয়ার জন্য সুলতানের গাইয়ে ও নাচিয়েদের দক্ষতা নিজের চোখে দেখেছিলেন তিনি। আরও একজন চীনা রাজদূত হুহিয়েন একই তথ্য জানিয়ে লিখেছেন, এরা যখন নিমন্ত্রণ করে তখন অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্য নাচের বন্দোবস্ত থাকে। নর্তকীদের পোশাকেরও একটি স্নিগ্ধ বর্ণনা দিয়েছেন তিনি এমনই ভাষায়, ‘এরা হালকা লাল রঙের ফুল তোলা জামা পরে। শরীরের তলার দিকটায় এরা রঙিন রেশমের কাপড় জড়িয়ে রাখে। গলায় আর কাঁধে এদের পেনড্যান্ট আর হার। কবজিতে নীল আর দামি পাথর থাকে।’ (বঙ্গবৃত্তান্ত অসীম রায়)
সুলতানি আমলে সোনারগাঁ ছিল রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের একটি বৃহৎ প্রশাসনিক ও সামরিক কেন্দ্র এবং গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যনগর। অনেক গবেষক একে বাংলার সুলতানদের দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবেও মনে করেন। সোনারগাঁ যে গৌড় পান্ডুয়ার মতো সংগীত ও নৃত্যকলার উর্বর ক্ষেত্র ছিল, এমনটি ধারণা করা অসংগত হবে না।
মোগল শাসনামলে সুবেদার ইসলাম খান রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় নিয়ে এলে এই নতুন রাজধানী জাহাঙ্গীরনগরে সংগীত আর নৃত্যের কেন্দ্রটি যে আরও প্রসারিত হয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ঢাকার একটি দক্ষ সংগীত ও নৃত্যশিল্পীর দল ছিল। মি. শার্লিমান তাঁর বাংলার ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন, ঢাকায় ইসলাম খানের দরবারে ১২০০ কাঞ্চনী শোভা পেত। যাদের পেশা নাচ-গান। এ থেকে অনুমিত হয়, ইসলাম খানের ঢাকা আসার আগেও এখানে গান-বাজনার ব্যাপক চর্চা ছিল। তা না হলে ১২০০ কাঞ্চনীর এত অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর দরবারে হাজির হওয়া অসম্ভব হতো। কাঞ্চনী ছাড়াও তাঁর দরবারে ছিল লুলি, হোরকানি ও ডোমনি—এরা সবাই নাচনী মেয়ে। এদের জন্য তাঁর বার্ষিক খরচ হতো ৮০ হাজার টাকা। ইসলাম খানের সংগীত ও নৃত্যশিল্পীদের সুখ্যাতি মোগলসম্রাট জাহাঙ্গীরের কানে পৌঁছাতে দেরি হয়নি। তিনি নাকি ঢাকা থেকে কিছু সেরা গায়ক ও নর্তকীকে মোগল শাহি দরবারের জন্য চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। সম্রাট তাঁর দরবারের সংগীতজ্ঞ প্রেমরঙ্গাকেও ঢাকায় ইসলাম খানের দরবারে পাঠিয়েছিলেন।
দীর্ঘদিন সুবে বাংলার রাজধানী ছিল ঢাকা। রাজধানীর মর্যাদা হারানোর পরও সংগীতের জন্য ঢাকার খ্যাতি ছিল অটুট। ১৮৫৭-এর পর এই খ্যাতি আরও বৃদ্ধি পায়। লখনৌর অনেক বাইজি সংগীতজ্ঞ চলে আসেন মুর্শিদাবাদে এবং পরে ঢাকায়। তাঁদের সহায়তা করতেন নবাব পরিবারের বংশধরেরা, মৌলভীবাজারের মোগল বংশোদ্ভূত জমিদার ও নবাবপুরের ধনী বসাক পরিবার। এ ছাড়া যাঁরা সাহায্য করতেন তাঁরা হলেন ভাওয়ালের রাজপরিবার, কাশিমপুর বনিয়া ও পুবাইলের জমিদার। তখন লখনৌ, বেনারস, পাটনা ও কলকাতার প্রতিষ্ঠিত বাইজিরা ঢাকায় এসে তাঁদের অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। সংগীতের পুরোনো কেন্দ্র হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই ঢাকায় ছিলেন কয়েক গুণ গুণী বাইজি। কণ্ঠসংগীতের ওস্তাদ হুসেন মিয়া ঢাকার অনেক বাইজিকে তালিম দিয়েছিলেন। পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে ঢাকার বাইজিদের আমন্ত্রণ জানানো হতো। বহিরাগত অনেক বাইজি ঢাকায় দীর্ঘদিন থেকে গেছেন। কেউ কেউ স্থায়ীভাবেও। আবার অনেকে প্রায়ই ঘুরেফিরে ঢাকায় আসতেন। এসব অস্থায়ী বাইজির পাশাপাশি স্থানীয় মেয়েদেরও বাইজির পেশা বেছে নিতে দেখা গেছে। এই বাইজিদের সম্পর্কে অনেক তথ্য দিয়েছেন হাকিম হাবিবুর রহমান (১৮৮১-১৯৪৭), গনিউর রাজা, সৈয়দ তৈফুর, মুনতাসীর মামুন, সাঈদ আহমদ, অনুপম হায়াত ও সত্যেন সেন। এ ছাড়া পুরোনো পত্রপত্রিকা ও ব্যক্তিগত ডায়েরি থেকেও কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া গেছে। এসব সূত্রের দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই এ নিবন্ধটি লেখা হয়েছে।
ঢাকায় বাইজিদের পাশাপাশি খেমটাওয়ালিরাও দোর্দণ্ডপ্রতাপে রাজত্ব করেছেন। বাইজি নাচ-গান আর খেমটা নাচ-গানের মধ্যে পার্থক্যটা সত্যেন সেনের লেখায় ভালোভাবে ফুটে উঠেছে। খেমটা হলো হালকা ধরনের এবং আদিরসাত্মক। বাইজিরা এককভাবে নাচত। আর এককভাবে সংগীত পরিবেশন করত। বাইজি ও খেমটা নাচের মূল পার্থক্য হলো খেমটা নাচের মধ্যে পায়ের কাজটিই প্রধান এবং নৃত্যভঙ্গির মধ্য দিয়ে যৌন আবেদন সৃষ্টি করা হতো। অন্যদিকে ‘বাইজি নাচে প্রধান ছিল হাতের ছন্দময় দোলা এবং মুখ, চোখ, নাক ও ঠোঁটের সূক্ষ্ম কম্পন।’ বাইজিদের পোশাক ছিল পেশওয়াজ, চুড়িদার পাজামা-ওড়না, পায়ে চিকন ঘুঙুর। ‘খেমটাওয়ালিরা জাতে উঠত বাইজি হয়ে,’ লিখেছেন সত্যেন সেন।
নওয়াব আবদুল গনি ও নওয়াব আহসানউল্লাহর দরবারের কয়েকজন বাইজির উল্লেখ করেছেন হাকিম হাবিবুর রহমান। এঁদের মধ্যে রয়েছেন সুপনজান, সেকালের নামী গায়িকা ও তবলাবাদক, এনাহীজান নওয়াব আবদুল গনির শাহবাগ উৎসবে নেচেছিলেন। হাকিম সাহেব তাঁকে শাহবাগের বার্ষিক উৎসবে দেখেন বলে লিখেছেন। তিনি উত্তর ভারত থেকে ঢাকায় এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। আবেদী বাই এসেছিলেন পাটনা থেকে। তাঁর এক মেয়ে ১৯৪৬-৪৭ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। আন্নু, গান্নু ও নওয়াবীন—এই তিন বোন নওয়াব আবদুল গনির দরবারে নিয়মিত নাচতেন, গাইতেন এবং মাসোহারা নিতেন। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি ছিল নওয়াবীনের। তিনি বিশ শতকের চল্লিশ দশক পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। মুনতাসীর মামুন জানিয়েছেন, এই তিন বোনই ‘পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি’ ভাড়া করে ১৮৮০ সালের নভেম্বরে টিকিটের বিনিময়ে ইন্দ্রসভা নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন। ঢাকায় মহিলাদের নিয়ে এটিই ছিল প্রথম নাট্যাভিনয়। আচ্ছি বাই ছিলেন নওয়াব আবদুল গনির সবচেয়ে নামকরা বাইজি। লখনৌ থেকে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। নৃত্য ও গীতে সুনিপুণা আচ্ছি ছিলেন অনেকের ওস্তাদ। হাকিম হাবিবুর রহমান লিখেছেন যে ঢাকায় আচ্ছি বাইয়ের মতো বড় নর্তকী তার পরেও কেউ আসেনি। ১৯১৪-১৫ সালের দিকে তিনি মারা যান। এ ছাড়া যাঁদের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন তাঁরা হলেন, ওয়াসু, বাতানী, জামুরদ, হীরা পান্না, ইমামী এবং তিনজন হিন্দু বাইজি অতুল, লক্ষ্মী ও কালী বাই। আখের খুকী নামের একজন খেমটাওয়ালির উল্লেখ করেছেন হাকিম হাবিবুর রহমান। খেমটা নাচ প্রদর্শন, বাংলা গান ও হিন্দি ঠুমরি গেয়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি। আমিরজান বাইজি ছিলেন উনিশ শতকের ঢাকার বিখ্যাত গায়িকা ও নর্তকী। জিন্দাবাহারের রাজলক্ষ্মীও ছিলেন ঢাকার আরেক বিখ্যাত বাইজি। জিন্দাবাহারে তাঁর পাঁচ-ছয়টি বাড়ি ছিল। সংগীতশিল্পীর চেয়ে দান-ধ্যানের জন্য তিনি ছিলেন অধিক সম্মানিত। ১৮৮৬ সালে ভূমিকম্পের পর জিন্দাবাহারের কালীবাড়ি ভেঙে গেলে তা মেরামত করে দেন তিনি। রমনার কালীবাড়িও সাজানোর জন্য তিনি মোটা চাঁদা দিয়েছিলেন। মুনতাসীর মামুন আমিরজান ও রাজলক্ষ্মী সম্বন্ধে একটি চিত্তাকর্ষক তথ্য দিয়েছেন। ১৮৭৪ সালে নওয়াব আবদুল গনি ঢাকা শহরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য এক বৈঠকের আয়োজন করেন। সেই বৈঠকে রাজা-মহারাজা জমিদার ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এই দুজন বাইজিও উপস্থিত ছিলেন। নবাব পানি সরবরাহ প্রকল্পে সবাইকে কিছু অর্থ সাহায্য করতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। এ আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলেন মাত্র দুজন—আমিরজান ও রাজলক্ষ্মী—তাঁরা প্রত্যেকে ৫০০ টাকা করে দান করতে রাজি হয়েছিলেন। নবাব অবশ্য পরে কারও কাছ থেকে কোনো সাহায্য না নিয়ে নিজেই এক লাখ টাকা দান করেছিলেন।
উনিশ শতকের নব্বইয়ের দশকের দিকে ঢাকায় এসেছিলেন সিনেটের গনিউর রাজা। সে সময় ঢাকায় মধ্যবিত্তের বিনোদনের তেমন সুস্থ ব্যবস্থা ছিল না। তবে ঢাকা তখন বাইজিদের জন্য বিখ্যাত। গনিউর রাজা তাঁর আত্মজৈবনিক রচনায় বর্ণনা সীমিত রেখেছেন এই বাইজি এবং খেমটাওয়ালিদের মধ্যে। তিনি এই খেমটাওয়ালিদের একটি বর্ণনা দিয়েছেন এমনই ভাষায়:
‘সহর ঘুরিতে ২ অপরাহ্নে [অপরাহ্নে] কিঞ্চিত জলযোগ করিলাম, ও আরও বেড়াইয়া প্রায় ৭।। টার সময় সাচিবন্দর সারদা নাম্নী খেমটাওয়ালির দুতালার উপরে উঠিলাম। ও উক্ত খেমটাওয়ালিকে গান-বাজনার যোগাড় করিতে সোপর্দা, ছামাজি ইত্যাদিকে ডাকাইয়া আনাইবার কথা বলিলাম, ও হুইচকি ব্রান্ডি সুডা ওয়াটার ইত্যাদির জন্য কতেক টাকা দিলাম। অল্প সময়ের মধ্যেই সমস্তের যোগাড় হইয়া গেল।
‘ছামাজি সারঙ্গ বাজাইতে লাগিল, সোপর্দা তবলা বাজাইতে আরম্ভ করিল ও মদ্যপায়ীদের মধ্যে ৫/৭ যে জনা হইয়াছিল তন্মধ্যে খেমটাওয়ালিই একজনকে ছাকি [অর্থাৎ পান পাত্র দাতা] নিযুক্ত করিল, ও সুডা ওয়াটার খুলিয়া মিশ্রিত করিয়া আমরাসহ প্রায় ৮/১০ জনাকে ক্রমান্বয়ে পাত্র বিলি করিতে লাগিল।
‘ওদিকে খেমটাওয়ালি গান আরম্ভ করিল, ও সোপর্দা, ও ছামাজি ইত্যাদি একযোগে সাদত করিতে আরম্ভ করিল। গানবাদ্য খুব জমিল, সুরাপাত্রও অনবরত চলিতে লাগিল।...’
(সূত্র-ঢাকা সমগ্র ১ মুনতাসীর মামুন। ঢাকা-২০০৩।)
এখানে খেমটাওয়ালি প্রসঙ্গে গনিউর রাজার বলা একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। একদিন তিনি সরলা নামের খেমটাওয়ালির বাড়িতে ‘গান-বাজনা’ শুনতে গিয়েছেন। সবাই চলে গেলে খেমটাওয়ালি তাঁকে বলেছিল, ‘তুমি যে মুসলমান, তাহা আমি পূর্বেই বুঝিয়াছি, আমরা হিন্দু রমণী মুসলমানকে জায়গা দেই না, সমাজে দূষিত হইতে হয়। আমি বলিলাম, তোমাদের আবার সমাজ আছে নাকি? সে বলিল, থাকিবে বই কি, যদিও আমরা নাম লিখাইয়ছি তথাপি আমাদের হিন্দুয়ানি সবই বজায় আছে।’ তাদের নৃত্য ও কণ্ঠের মাধুর্যের বর্ণনার পাশাপাশি গনিউর রাজা খেমটাওয়ালিদের দৌরাত্ম্য ও অন্ধকার জীবনের কথাও উল্লেখ করতে ভোলেননি।
বিশ শতকের প্রথম দিকে ঢাকার সবচেয়ে বিখ্যাত বাইজি ছিলেন জিন্দাবাহার লেনের দেবী বাইজি বা দেবী বালা। ঢাকার নবাব পরিবারের খাজা মওদুদের ডায়েরি থেকে (সম্পাদনা অনুপম হায়াত) জানা যায়, ১৯১৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে খাজা হাবিবুল্লাহর বিয়ের অনুষ্ঠানে দেবী বাইজি ও অন্য এক বাইজি নাচ-গান করেছিলেন। দেবী বাইজি পরে প্রথম ঢাকায় নির্মিত পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র (নির্বাক) দ্য লাস্ট কিস-এ অভিনয় করেন। হরিমতি বাইজি ঢাকায় এসে ছিলেন। তিনিও এই নির্বাক ছবিটিতে অভিনয় করেন। শিল্পী পরিতোষ সেন তাঁর আত্মজৈবনিক রচনা জিন্দাবাহারে এক হরিমতি বাই সম্পর্কে লিখেছেন, ‘হরিমতি বাঈজীর ঘরটি আমাদের বারান্দা থেকে পরিষ্কারই দেখা যায়। প্রতিদিনের অভ্যাসমতো ভৈরবী রাগে গান ধরেছেন, “রসিয়া তোরি আখিয়ারে জিয়া লালচায়” ঠুংরি ঠাটের গানের এ কলিটির সুরের মাধুর্য্যে আমাদের জিন্দাবাহার গলিটি কানায় কানায় ভরে উঠেছে।’
বাইজিদের হাসি, গান আর আনন্দের পেছনে লুকিয়ে ছিল অনেক কান্না, বেদনা আর দীর্ঘশ্বাস। কারও জন্ম ঘোর অন্ধকারে ঢাকা, অথচ এর জন্য তার কোনো হাত নেই; কেউ প্রতারিত হয়ে পথের ভিখারি হয়ে শেষ জীবন কষ্টে কাটিয়েছেন। যাঁরা ভাগ্যবান, তাঁরা স্বীকৃতি পেয়ে বেগম হতে পেরেছেন। আবার এঁদের কুহকের বলি হয়েছে অনেকের সংসার, জীবিকা ও জীবন।
ঢাকার বাইজিদের দিন গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকেই ফুরিয়ে যেতে থাকে। দেশ ভাগ ও জমিদার প্রথার উচ্ছেদ এঁদের পৃষ্ঠপোষকহীন করে ফেলে। আজ তাঁদের স্মৃতি রয়ে গেছে শুধু কিছু সংগীতজ্ঞ ও প্রাচীন সম্ভ্রান্ত মানুষের অতীতচারণায়। আরও রয়ে গেছে তাঁদের দুলর্ভ ও দুস্প্রার্প্য রংচটা কিছু আলোকচিত্র, যার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে বিস্মৃতির এক বিষাদময় ইতিকথা।
কৃতজ্ঞতা: কে এম হালিম
No comments