বাতিঘরের মতো শামসুর রাহমান by বেলাল চৌধুরী
'নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে বর্ণমালার' জন্য, প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতার জন্য (তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা') কিংবা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে প্রতীকী কবিতা 'ইলেক্ট্রার গান'সহ কত কবিতা লিখেছেন শামসুর রাহমান! অবিরল লিখেছেন, বাংলাদেশ আর বাঙালির হৃদয়ের স্পন্দন ধ্বনিত হয়েছে তাঁর কবিতায় নানা মাত্রায়।
ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ থেকে গণতন্ত্রের সংগ্রামে শহীদ নূর হোসেন_ এমনকি জঙ্গিবাদ-ফতোয়াবাজসহ সমাজের সকল অন্ধকারের বিরুদ্ধে আমৃত্যু সোচ্চার ছিলেন শামসুর রাহমান। প্রেমের কবিতায়ও গভীর হৃদয়বাদী তিনি। বাংলা কবিতার 'বরপুত্র' অভিধাও জীবদ্দশায় শুনেছেন কীর্তিমান এই কবি। আজীবন একমাত্র বাংলা সাহিত্যের সেবা করে সাহিত্যরসিক সব ধরনের মানুষের হৃদয় জয় করা খুব একটা সহজসাধ্য কাজ নয়। আমাদের কবিজ্যেষ্ঠ শামসুর রাহমান কিন্তু আশ্চর্য দক্ষতার সঙ্গে তাই করে গেছেন একটানা ৫০ বছর ধরে বিরতিহীনভাবে। তবে মাঝে মধ্যে কবির দেহ ও মনের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে অনির্দিষ্ট অস্থিরতা। একবার হয়তো মনে হয়েছে এই বুঝি কবি সব আদি ব্যাধি ছেড়ে আবার সটান হয়ে সাবলীলভাবে কলম হাতে নেবেন, নিয়েছেনও।
'এখন তোমার ঘুম নিশীথের দিঘিতে নিটোল
পদ্ম আর তোমার নিভৃত যৌবনের পূর্ণিমায়
উদ্ভাসিত ঘর : আমার চোখের পাতা জুড়ে
নেই আজ নিদ্রার কুসুম, জ্বালাধরা চোখ মেলে
তাকাই প্রহর, খালি শুনি প্রতারক জ্যোৎস্নার প্রভাবে
স্তব্ধ নিসর্গকে অপ্রস্তুত করে আচানক বাজে
বেজে ওঠে আমার খাতার পাতা অসমাপ্ত এক
চতুর্দশপদী বুকে নিয়ে জুড়ে দিয়েছে মাতম।'
কবি শামসুর রাহমানের সমস্ত অন্তরাত্মাজুড়ে রাশি রাশি কবিতার ছড়াছড়ি। তার কবিতাবলি কেবলই রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান নয়, গোটা বাংলাদেশের নৈসর্গিক জাগরণ, বাস্তবতার শিহরণ। আমাদের দৈনন্দিনতায় সংগ্রাম রাজবিদ্বেষ, প্রেম প্রণয়, ভালোবাসা শোক-দুঃখ কাতরতা, অর্থাৎ এক কথায় গোটা বাংলাদেশকেই হৃদয়ে ধারণ করে নীলকণ্ঠের মতো অতন্দ্র ছিলেন তিনি।
কবিজীবনের শেষ ক'দিন হাসপাতালের রোগশয্যাকে ঘিরে যেসব নাটক দেখা গেছে, তার কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা ছিল, তা বলা বেশ মুশকিলের ব্যাপার হয়েছিল। শামসুর রাহমান কবি হিসেবে অন্তত আমাদের মতো কবিতাপ্রেমীদের কাছে যেমন ছিলেন শেষ অবলম্বন, তেমনই অনিবার্য। সেই রাজনৈতিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সময় থেকে প্রতি বছর জাতীয় কবিতা পরিষদের অগ্রাভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া সব জায়গাতেই শামসুর রাহমানকে দেখেছি বুক চিতিয়ে সংগ্রামের অগ্রভাগে।
এছাড়া আরও কত যে স্নেহের দাবি রক্ষা করতে কখনও নিষ্ঠুর, নির্দয় অত্যাচারে পর্যবসিত হতেও দেখা গেছে তাঁকে। কবি কিন্তু সব অবস্থাতেই ছিলেন ঋজু, প্রশান্ত আর হাস্যোজ্জ্বল। যারা অন্তরের মধ্যে কবিকে পারলে বিদায় জানিয়ে বসেছিলেন, তাঁদের ব্যাপারে একটা কথাই বলা যায়, কবি শামসুর রাহমান যুগের পর যুগ থেকে যাবেন সাধারণ মানুষের হৃদয়ে, মুখে মুখে।
দেশভাগের মতো বেদনাদায়ক ঘটনার পর শামসুর রাহমান তাঁর সহজাত প্রতিভা নিয়ে আধুনিক কবিতাকে সঠিক নেতৃত্ব না দিতে পারলে, যারা বলেছিলেন শামসুর রাহমান আর লিখতে পারছেন না, ফুরিয়ে গেছেন, নিঃশেষিত, তাদের যে কী বেহাল দশা হতো তাই ভাবি। আর এক দল যারা উপরে উপরে শামসুর রাহমানের বন্ধু ও দরদি সেজে যে ধরনের বিষাক্ত ছোবল মারতে শুরু করেছিলেন, তাদের কথা না বলাই ভালো। শামসুর রাহমান শত বিপত্তির মাঝেও শক্ত হাতে হাল না ধরলে আজকে আমরা যারা আধুনিক কবিতার সেবক, তাদের যে কী দশা হতো, তা নাই-বা বলা হলো। শামসুর রাহমানের মতো কবিরা হাজার বছরে একবারই আসেন। কর্ষণে-বর্ষণে বিশ্ব সাহিত্যমাধ্যমকে চির সবুজ ও উর্বর করে রেখে গেছেন।
এ প্রসঙ্গে অনুজপ্রতিম গল্পকার গেল বছর বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত সুশান্ত মজুমদারের একটি মনোগ্রাহী কবিতার উল্লেখ না করে পারছি না। কবিতাটি কবির উদ্দেশে সুশান্তর নিবেদন আমার ভেতরে তারই মতো অবিকল এমন অভিব্যক্তি দেখা দিল যে তাঁর আন্তরিক মনোবাসনার সঙ্গে একাত্ম হতে এক নিমেষও সময় নিল না। কালের যবনিকা হয়তো এভাবে নেমে আসে। ঘোর তমসাচ্ছন্ন ব্যাপ্তি যার। অথচ শামসুর রাহমানই লিখে গিয়েছেন_ 'যদি একদিনও বেঁচে থাকি সে পর্যন্ত লিখে যাবো কবিতা।'
১৯৮৬ সালে কবিসংঘ 'পদাবলী' তাদের ষোড়শ প্রযোজনায় ধ্রুবপদ বেঁধে দিয়েছিলেন 'এই অস্থির সময়'। শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, 'এই অস্থির সময়ে কবিদের ভূমিকা কী হবে! তাদের লিখে যেতে হবে কবিতা, সে কবিতা শান্তির সপক্ষে মানবতার সপক্ষে সভ্যতার মহাসংকটে বাতিঘরের মতো দীপ্তিমান হোক।' শামসুর রাহমান আজ আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু তিনিও আমাদের বাতিঘর। তাঁকে দেখে যেতে হয়নি কুৎসিত সব খিস্তি খেউর আর অসুর শক্তির উত্থান। কারণ, শামসুর রাহমান প্রথম থেকেই ছিলেন মানবতাবাদী। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের মঙ্গল প্রত্যাশী। তিনি কখনোই রাজনৈতিক ডামাডোলের ভেতরে না থাকলেও তাঁকে বাধ্য হয়ে কলম ধরতে হয়েছিল স্বৈরাচার, সাম্প্রদায়িকতা আর জঙ্গিবাদের উত্থান ও ফতোয়াবাজির বিরুদ্ধে। 'ফুঁসে ওঠে ফতোয়া' নামের অসাধারণ কবিতার কথা কি ভোলা যাবে? ভোলা যাবে না তার প্রশ্নখচিত শেষ কাব্যগ্রন্থ 'কবে শেষ হবে এই গ্রহণের কাল'-এর কথাও। সমস্ত অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর জন্য যতদিন মানুষের তৃষ্ণা থাকবে, ভালোবাসার মানবিক আবেগের প্রতি মানুষ বিশ্বস্ত থাকবে, ততদিন বেঁচে থাকবেন শামসুর রাহমান অনিবার্য উচ্চারণের মধ্যে।
বেলাল চৌধুরী : কবি ও প্রাবন্ধিক
'এখন তোমার ঘুম নিশীথের দিঘিতে নিটোল
পদ্ম আর তোমার নিভৃত যৌবনের পূর্ণিমায়
উদ্ভাসিত ঘর : আমার চোখের পাতা জুড়ে
নেই আজ নিদ্রার কুসুম, জ্বালাধরা চোখ মেলে
তাকাই প্রহর, খালি শুনি প্রতারক জ্যোৎস্নার প্রভাবে
স্তব্ধ নিসর্গকে অপ্রস্তুত করে আচানক বাজে
বেজে ওঠে আমার খাতার পাতা অসমাপ্ত এক
চতুর্দশপদী বুকে নিয়ে জুড়ে দিয়েছে মাতম।'
কবি শামসুর রাহমানের সমস্ত অন্তরাত্মাজুড়ে রাশি রাশি কবিতার ছড়াছড়ি। তার কবিতাবলি কেবলই রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান নয়, গোটা বাংলাদেশের নৈসর্গিক জাগরণ, বাস্তবতার শিহরণ। আমাদের দৈনন্দিনতায় সংগ্রাম রাজবিদ্বেষ, প্রেম প্রণয়, ভালোবাসা শোক-দুঃখ কাতরতা, অর্থাৎ এক কথায় গোটা বাংলাদেশকেই হৃদয়ে ধারণ করে নীলকণ্ঠের মতো অতন্দ্র ছিলেন তিনি।
কবিজীবনের শেষ ক'দিন হাসপাতালের রোগশয্যাকে ঘিরে যেসব নাটক দেখা গেছে, তার কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা ছিল, তা বলা বেশ মুশকিলের ব্যাপার হয়েছিল। শামসুর রাহমান কবি হিসেবে অন্তত আমাদের মতো কবিতাপ্রেমীদের কাছে যেমন ছিলেন শেষ অবলম্বন, তেমনই অনিবার্য। সেই রাজনৈতিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সময় থেকে প্রতি বছর জাতীয় কবিতা পরিষদের অগ্রাভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া সব জায়গাতেই শামসুর রাহমানকে দেখেছি বুক চিতিয়ে সংগ্রামের অগ্রভাগে।
এছাড়া আরও কত যে স্নেহের দাবি রক্ষা করতে কখনও নিষ্ঠুর, নির্দয় অত্যাচারে পর্যবসিত হতেও দেখা গেছে তাঁকে। কবি কিন্তু সব অবস্থাতেই ছিলেন ঋজু, প্রশান্ত আর হাস্যোজ্জ্বল। যারা অন্তরের মধ্যে কবিকে পারলে বিদায় জানিয়ে বসেছিলেন, তাঁদের ব্যাপারে একটা কথাই বলা যায়, কবি শামসুর রাহমান যুগের পর যুগ থেকে যাবেন সাধারণ মানুষের হৃদয়ে, মুখে মুখে।
দেশভাগের মতো বেদনাদায়ক ঘটনার পর শামসুর রাহমান তাঁর সহজাত প্রতিভা নিয়ে আধুনিক কবিতাকে সঠিক নেতৃত্ব না দিতে পারলে, যারা বলেছিলেন শামসুর রাহমান আর লিখতে পারছেন না, ফুরিয়ে গেছেন, নিঃশেষিত, তাদের যে কী বেহাল দশা হতো তাই ভাবি। আর এক দল যারা উপরে উপরে শামসুর রাহমানের বন্ধু ও দরদি সেজে যে ধরনের বিষাক্ত ছোবল মারতে শুরু করেছিলেন, তাদের কথা না বলাই ভালো। শামসুর রাহমান শত বিপত্তির মাঝেও শক্ত হাতে হাল না ধরলে আজকে আমরা যারা আধুনিক কবিতার সেবক, তাদের যে কী দশা হতো, তা নাই-বা বলা হলো। শামসুর রাহমানের মতো কবিরা হাজার বছরে একবারই আসেন। কর্ষণে-বর্ষণে বিশ্ব সাহিত্যমাধ্যমকে চির সবুজ ও উর্বর করে রেখে গেছেন।
এ প্রসঙ্গে অনুজপ্রতিম গল্পকার গেল বছর বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত সুশান্ত মজুমদারের একটি মনোগ্রাহী কবিতার উল্লেখ না করে পারছি না। কবিতাটি কবির উদ্দেশে সুশান্তর নিবেদন আমার ভেতরে তারই মতো অবিকল এমন অভিব্যক্তি দেখা দিল যে তাঁর আন্তরিক মনোবাসনার সঙ্গে একাত্ম হতে এক নিমেষও সময় নিল না। কালের যবনিকা হয়তো এভাবে নেমে আসে। ঘোর তমসাচ্ছন্ন ব্যাপ্তি যার। অথচ শামসুর রাহমানই লিখে গিয়েছেন_ 'যদি একদিনও বেঁচে থাকি সে পর্যন্ত লিখে যাবো কবিতা।'
১৯৮৬ সালে কবিসংঘ 'পদাবলী' তাদের ষোড়শ প্রযোজনায় ধ্রুবপদ বেঁধে দিয়েছিলেন 'এই অস্থির সময়'। শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, 'এই অস্থির সময়ে কবিদের ভূমিকা কী হবে! তাদের লিখে যেতে হবে কবিতা, সে কবিতা শান্তির সপক্ষে মানবতার সপক্ষে সভ্যতার মহাসংকটে বাতিঘরের মতো দীপ্তিমান হোক।' শামসুর রাহমান আজ আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু তিনিও আমাদের বাতিঘর। তাঁকে দেখে যেতে হয়নি কুৎসিত সব খিস্তি খেউর আর অসুর শক্তির উত্থান। কারণ, শামসুর রাহমান প্রথম থেকেই ছিলেন মানবতাবাদী। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের মঙ্গল প্রত্যাশী। তিনি কখনোই রাজনৈতিক ডামাডোলের ভেতরে না থাকলেও তাঁকে বাধ্য হয়ে কলম ধরতে হয়েছিল স্বৈরাচার, সাম্প্রদায়িকতা আর জঙ্গিবাদের উত্থান ও ফতোয়াবাজির বিরুদ্ধে। 'ফুঁসে ওঠে ফতোয়া' নামের অসাধারণ কবিতার কথা কি ভোলা যাবে? ভোলা যাবে না তার প্রশ্নখচিত শেষ কাব্যগ্রন্থ 'কবে শেষ হবে এই গ্রহণের কাল'-এর কথাও। সমস্ত অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর জন্য যতদিন মানুষের তৃষ্ণা থাকবে, ভালোবাসার মানবিক আবেগের প্রতি মানুষ বিশ্বস্ত থাকবে, ততদিন বেঁচে থাকবেন শামসুর রাহমান অনিবার্য উচ্চারণের মধ্যে।
বেলাল চৌধুরী : কবি ও প্রাবন্ধিক
No comments