হিল উইমেন্স ফেডারেশন-ইলিরা দেওয়ান পাহাড়ি নারী ও দুই যুগের অভিযাত্রা
১৯৮৮ সালের ৮ মার্চ স্বৈরাচারী সামরিক শাসকের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রীর অসীম সাহস ও উদ্যোগে আত্মপ্রকাশ করেছিল হিল উইমেন্স ফেডারেশন। দুই যুগের দীর্ঘ পরিক্রমায় এই সংগঠনকে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে বর্তমান অবস্থানে আসতে হয়েছে।
স্বাধীনতার পর পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্ররাজনীতির পটভূমির দিকে তাকালে আমরা দেখি, বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম ছাত্র প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের আগে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৮৯ সালের ৪ মে লংগদুতে সংঘটিত গণহত্যার প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে একই সালের ২০ মে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ আত্মপ্রকাশ করে। আশির দশকের শেষের দিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক সামরিক উপস্থিতি এবং সরকারের উদ্যোগে সমতল থেকে হাজার হাজার ছিন্নমূল বাঙালি পরিবারগুলোকে যখন পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপনের জন্য নেওয়া শুরু হয়, তখন থেকেই পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে সামপ্রদায়িক সমপ্রীতির ভিত্তি বিনষ্ট হতে থাকে। ১৯৮০ সালের ২৫ মার্চ কলমপতির কাউখালী বাজারে সংঘটিত সামপ্রদায়িক ঘটনার মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বড় ধরনের সামপ্রদায়িক সহিংসতার শুরু। এ ঘটনায় স্থানীয় অনেক পাহাড়ি গ্রামবাসীরা হতাহত হন এবং বৌদ্ধ মন্দির ও ধর্মীয় মূর্তি ধ্বংস করা হয়। নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে শুরু হওয়া এই সামপ্রদায়িক সহিংসতা ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তিও থামাতে পারেনি। কারণ, চুক্তির পরও পার্বত্য চট্টগ্রামে এক ডজনের অধিক সামপ্রদায়িক সহিংস ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
১৯৮৮ সালে হিল উইমেন্স ফেডারেশন গঠিত হলেও এই সংগঠনের প্রথম কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৫ সালের ১৫ জানুয়ারি খাগড়াছড়িতে। উইমেন্স ফেডারেশনের লক্ষ্য শুধু সমাজ থেকে নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করা নয়, একই সঙ্গে রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দাবিটাও অন্যতম।
বাঘাইছড়ির কল্পনা চাকমা হিল উইমেন্স ফেডারেশনের একজন সাধারণ কর্মী হয়েও ১ম কেন্দ্রীয় সম্মেলনে তাঁর সক্রিয় উপস্থিতি ও প্রখর বুদ্ধিমত্তার কারণে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হন। পরে তাঁকে সর্বসম্মতভাবে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রথম কেন্দ্রীয় সম্মেলনে উপস্থাপিত বক্তব্যে তিনি বলেছেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান সমস্যার একমাত্র সমাধান স্বায়ত্তশাসন প্রদানের মাধ্যমে নারীদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। গণ্ডিবদ্ধ জীবন নয়, চাই মুক্ত জীবন।’ (সূত্র: কল্পনা চাকমার ডায়েরি, ২০০১)। কিন্তু তেজোদীপ্ত এই নেত্রীকে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র সাত ঘণ্টা আগে রাতের আঁধারে তাঁর নিজ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় চিহ্নিত বাহিনীর কিছু মুখোশধারী দুষ্কৃতকারী। আজ ১৬ বছর পরও রাষ্ট্র কল্পনা চাকমার খোঁজ দিতে পারেনি। এই ব্যর্থতার দায় এ যাবৎকালের ক্ষমতাসীন সব সরকার ও রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।
বর্তমানে হিল উইমেন্স ফেডারেশন (চুক্তি পক্ষীয়) পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম নারী সংগঠন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি’র সঙ্গে যৌথভাবে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি নারী ও শিশুরা কীভাবে যুদ্ধ পরিবেশে বেড়ে উঠেছে, সেসব অভিজ্ঞতার আলোকে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের উদ্যোগে ১৯৯৯ সালে ‘পাহাড়ের রুদ্ধকণ্ঠ’ নামে প্রথম সংকলন প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া কল্পনা চাকমার ডায়েরি নামে আরেকটি বই ২০০১ সালে হিল উইমেন্স ফেডারেশন প্রকাশ করে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সব ধরনের নিপীড়নের বিরুদ্ধে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের ভূমিকা অগ্রগণ্য। পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি জিইয়ে রাখার জন্য একটি বিশেষ মহল প্রায়ই তৎপর থাকে। এরই অংশ হিসেবে ১৯৯৫ সালে খাগড়াছড়িতে কতিপয় বিপথগামী মাদকাসক্ত পাহাড়ি ছেলেদের দিয়ে ‘মুখোশ বাহিনী’ গঠন করা হয়েছিল। এই বাহিনীর কাজ হলো, যারা হিল উইমেন্স ফেডারেশন, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সঙ্গে যুক্ত, তাদের বাড়ি থেকে তুলে এনে বিশেষ স্থানে নিয়ে গিয়ে মারধর করা, হুমকি প্রদান করা। এই বাহিনীর উৎপাতে খাগড়াছড়িবাসী অতিষ্ঠ হলেও কেউ মুখ খোলার সাহস করেনি। কিন্তু হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেতৃত্বে নারীরাই প্রথম এদের বিরুদ্ধে শহরে লাঠি মিছিল বের করেছিল। যেমনটি আমরা দেখেছি ২০০৯ সালে রাঙামাটির ঘিলাছড়িতে এক পাহাড়ি গৃহবধূকে নিরাপত্তা বাহিনীর এক সদস্য ধর্ষণের চেষ্টা করলে এর প্রতিবাদে শত শত পাহাড়ি নারী রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কে অবস্থান নিয়ে এর প্রতিবাদ করেছিল। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাজেকে সংঘটিত ঘটনার প্রতিবাদে নারীরা কীভাবে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল।
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেতৃত্বে পাহাড়ি নারীরা এখনো স্বাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে রাজপথে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
ইলিরা দেওয়ান: হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
১৯৮৮ সালে হিল উইমেন্স ফেডারেশন গঠিত হলেও এই সংগঠনের প্রথম কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৫ সালের ১৫ জানুয়ারি খাগড়াছড়িতে। উইমেন্স ফেডারেশনের লক্ষ্য শুধু সমাজ থেকে নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করা নয়, একই সঙ্গে রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দাবিটাও অন্যতম।
বাঘাইছড়ির কল্পনা চাকমা হিল উইমেন্স ফেডারেশনের একজন সাধারণ কর্মী হয়েও ১ম কেন্দ্রীয় সম্মেলনে তাঁর সক্রিয় উপস্থিতি ও প্রখর বুদ্ধিমত্তার কারণে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হন। পরে তাঁকে সর্বসম্মতভাবে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রথম কেন্দ্রীয় সম্মেলনে উপস্থাপিত বক্তব্যে তিনি বলেছেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান সমস্যার একমাত্র সমাধান স্বায়ত্তশাসন প্রদানের মাধ্যমে নারীদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। গণ্ডিবদ্ধ জীবন নয়, চাই মুক্ত জীবন।’ (সূত্র: কল্পনা চাকমার ডায়েরি, ২০০১)। কিন্তু তেজোদীপ্ত এই নেত্রীকে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র সাত ঘণ্টা আগে রাতের আঁধারে তাঁর নিজ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় চিহ্নিত বাহিনীর কিছু মুখোশধারী দুষ্কৃতকারী। আজ ১৬ বছর পরও রাষ্ট্র কল্পনা চাকমার খোঁজ দিতে পারেনি। এই ব্যর্থতার দায় এ যাবৎকালের ক্ষমতাসীন সব সরকার ও রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।
বর্তমানে হিল উইমেন্স ফেডারেশন (চুক্তি পক্ষীয়) পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম নারী সংগঠন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি’র সঙ্গে যৌথভাবে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি নারী ও শিশুরা কীভাবে যুদ্ধ পরিবেশে বেড়ে উঠেছে, সেসব অভিজ্ঞতার আলোকে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের উদ্যোগে ১৯৯৯ সালে ‘পাহাড়ের রুদ্ধকণ্ঠ’ নামে প্রথম সংকলন প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া কল্পনা চাকমার ডায়েরি নামে আরেকটি বই ২০০১ সালে হিল উইমেন্স ফেডারেশন প্রকাশ করে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সব ধরনের নিপীড়নের বিরুদ্ধে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের ভূমিকা অগ্রগণ্য। পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি জিইয়ে রাখার জন্য একটি বিশেষ মহল প্রায়ই তৎপর থাকে। এরই অংশ হিসেবে ১৯৯৫ সালে খাগড়াছড়িতে কতিপয় বিপথগামী মাদকাসক্ত পাহাড়ি ছেলেদের দিয়ে ‘মুখোশ বাহিনী’ গঠন করা হয়েছিল। এই বাহিনীর কাজ হলো, যারা হিল উইমেন্স ফেডারেশন, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সঙ্গে যুক্ত, তাদের বাড়ি থেকে তুলে এনে বিশেষ স্থানে নিয়ে গিয়ে মারধর করা, হুমকি প্রদান করা। এই বাহিনীর উৎপাতে খাগড়াছড়িবাসী অতিষ্ঠ হলেও কেউ মুখ খোলার সাহস করেনি। কিন্তু হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেতৃত্বে নারীরাই প্রথম এদের বিরুদ্ধে শহরে লাঠি মিছিল বের করেছিল। যেমনটি আমরা দেখেছি ২০০৯ সালে রাঙামাটির ঘিলাছড়িতে এক পাহাড়ি গৃহবধূকে নিরাপত্তা বাহিনীর এক সদস্য ধর্ষণের চেষ্টা করলে এর প্রতিবাদে শত শত পাহাড়ি নারী রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কে অবস্থান নিয়ে এর প্রতিবাদ করেছিল। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাজেকে সংঘটিত ঘটনার প্রতিবাদে নারীরা কীভাবে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল।
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেতৃত্বে পাহাড়ি নারীরা এখনো স্বাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে রাজপথে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
ইলিরা দেওয়ান: হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
No comments