কালের পুরাণ-ছোট দলের বড় কদর, না কেনাবেচার রাজনীতি by সোহরাব হাসান
‘দিনে বিরোধী দল, রাতে সরকারি দল’ কথাটি আশির দশকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেশ চালু ছিল। বিশেষ করে, সুবিধাবাদী রাজনীতিকেরা দিনে পল্টন ময়দানে গরম বক্তৃতা দিয়ে রাতে মিন্টো রোডে মন্ত্রীদের বাড়িতে ঘুরঘুর করতেন তদবিরের জন্য। যে নেতা যত বেশি গরম বক্তৃতা দিতেন, তাঁর সম্মানী নাকি তত বেশি হতো। তারপর দেখা যেত, একদিন রাতে বঙ্গভবনে গিয়ে মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন।
নব্বইয়ে স্বৈরাচারের পতনের বিএনপি ও আওয়ামী লীগের দ্বিদলীয় ব্যবস্থায় রাজনীতির চেহারা-চরিত্র অনেকটাই বদলে গেছে। ছোট দলের নেতাদের এখন আর মন্ত্রিপাড়ায় ঘুরঘুর করতে দেখা যায় না; কেননা বড় দলের ছোট নেতাদের কনুইয়ের গুঁতোয় সেখানে যাওয়ার জো নেই। তা ছাড়া দুই দলেই যেখানে খাই খাই নেতার সংখ্যা বেশি, সেখানে অন্য নেতাদের ঠাঁই হবে কী করে? নির্বাচনের আগে ছোট দলের নেতারা মনোনয়ন চাইলে বড় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতা-নেত্রীরা বলতেন, সাইনবোর্ড পাল্টে আসুন।
২০০১ সালের বিদায়ী সরকারের এক শীর্ষ নেতাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আপনারা সব সময় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির কথা বলেন। তাদের নিয়ে আন্দোলন করেন। কিন্তু নির্বাচনের সময় একলা চলেন কেন?’ তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমাদের দলেই এত প্রার্থী, তাঁদের জায়গা দেওয়া মুশকিল। তাঁরা নিজের চেষ্টায় নির্বাচিত হয়ে আসুক, মন্ত্রী করব।’ সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মাত্র ৬২ আসন পেয়েছিল। এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন বলেই নির্বাচনের দুই-আড়াই বছর আগে ছোট দলের বড় নেতাদের নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে গেছে।
২০ জুলাই সকালে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান কর্নেল (অব.) অলি আহমদের বাসায় যায়। দুই দলের নেতাদের মধ্যে সফল বৈঠক হয়েছে এবং বৈঠক শেষে অলি আহমদ বলেছেন, ‘বৃহত্তর ঐক্য গড়তে আমরা একমত হয়েছি। আমরা ঐক্যবদ্ধ হলে জাতীয়তাবাদী শক্তি আরও শক্তিশালী হবে।’ ওই বৈঠকের ছবি টেলিভিশন চ্যানেলের কল্যাণে দেশবাসী দেখেছে। কিন্তু রাতেই পরিবেশ ও বন প্রতিমন্ত্রী হাছান মাহমুদ অলি আহমদের বাসায় যান প্রধানমন্ত্রীর বার্তা নিয়ে। কী ছিল সেই বার্তায়, আমাদের জানা নেই। তবে রাত প্রায় ১২টা পর্যন্ত প্রতিমন্ত্রী ও এলডিপির নেতার মধ্যে বৈঠক হয়েছে, এটুকু জানিয়েছে গণমাধ্যম।
সকালের বৈঠকে অলি আহমদ বিএনপির নেতৃত্বে বৃহত্তর ঐক্য গড়তে রাজি হয়েছেন। আর রাতে মহাজোটের পক্ষে থাকা নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আওয়ামী লীগের নেতা। এর মাজেজা কী? পরদিন আওয়ামী লীগের দুই প্রভাবশালী নেতা ওবায়দুল কাদের ও জাহাঙ্গীর কবির নানক দেখা করেন কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে। সেখানেও নাকি ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন কাদের সিদ্দিকী। আগের আমলের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল। কার বা কাদের পরামর্শে মিরপুরের এস এ খালেককে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করানো হয়েছিল। ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু এক দিন পরই তো দেখা গেল, তিনি বিএনপির নেত্রীর সঙ্গে দেখা করে কান্নাকাটি করছেন। সেই সময়ে বিএনপির আরও দুই সাংসদকে মন্ত্রিসভায় নিয়ে আওয়ামী লীগ জাতীয় কথিত ঐকমত্যের সরকার করেছিল। কিন্তু সেই ঐকমত্য দেশের দূরে থাক, আওয়ামী লীগেরও উপকারে আসেনি।
কেবল অলি আহমদ বা কাদের সিদ্দিকী নন, ছোট দলের অন্যান্য নেতারও কদর বেড়েছে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, এঁরা তত মূল্যবান হয়ে উঠবেন। যেমন—তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে মূল্যবান হয়ে উঠেছিলেন ‘কিংস পার্টি’ খ্যাত দলের নেতারা। এখন সাইনবোর্ড ছাড়া তাদের কিছু নেই।
বিএনপির নেতারা এর আগে বৈঠক করেছেন বিকল্পধারার প্রেসিডেন্ট বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রধান কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গেও। অপেক্ষমাণ তালিকায় আছেন জাসদের নেতা আ স ম আবদুর রব। নানা কিসিমের ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে। তাদের ডাকা ৩০ ঘণ্টা হরতালের প্রতি বিএনপি সমর্থন জানিয়েছে। আর চারদলীয় জোটের ছোট তিন শরিক—জামায়াত, ইসলামী ঐক্যজোট ও বিজেপি তো আছেই। বিএনপির সঙ্গে আরও আছে ভাসানীর নামানুসারী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ছিটকে পড়া বিভিন্ন উপদল। বিএনপির সঙ্গে আছেন ছাত্রলীগের এককালের ডাকসাইটে নেতা ও মুহসীন হলের ছাত্র হত্যাকাণ্ডের অন্যতম দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি শফিউল আলম প্রধানও।
এদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও বসে নেই। মহাজোটের পরিধি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে তারা। দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ১১ দলীয় জোটের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। পরের মেয়াদে বাহাত্তরের সংবিধান অক্ষরে অক্ষরে পুনরুজ্জীবিত করবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন। সংবিধানে বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম ও রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখায় ১১ দলের নেতারা ক্ষুব্ধ। সেই ক্ষোভ প্রশমন করতেই কি এই আশ্বাসবাণী? আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে দুই বড় দলই। হঠাৎ করে বড় দলগুলোর এই জোটতৎপরতা বাড়ানোর কেন দরকার পড়ল, তা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। বিগত নির্বাচনের হিসাব ধরলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দেশের ৮০ শতাংশের বেশি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক পেয়েছে ৪৬ শতাংশ ভোট, বিএনপির ধানের শীষ ৪০ শতাংশ। আসনসংখ্যার দিক থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি আসনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় এসেছে। তার পরও পরিধি বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ল কেন? পড়ল এ কারণে যে, যে ভোটাররা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছে, তাদের বড় অংশ ইতিমধ্যে হতাশ হয়েছে। সেই হতাশা কাটানোর কোনো উদ্যোগ না নিয়ে ছোট দলের নেতাদের বাড়িতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে।
বিএনপি ‘বৃহত্তর ঐক্য’ গড়ার প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে জামায়াত। আওয়ামী লীগ বলছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও খালেদা জিয়ার পুত্রদের দুর্নীতির বিচার বন্ধের জন্য বিরোধী দল ষড়যন্ত্র করছে। সরকারের হাতে নানা বাহিনী ও সংস্থা আছে। সরকারের কাজ হবে তাদের কাজে লাগিয়ে সেই ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেওয়া। রাস্তায় বক্তৃতা দিলে তো ষড়যন্ত্র বন্ধ হবে না।
জোট নিয়ে দুই পক্ষই এখন মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ে নামছে। দুই প্রধান দল মুখে যা-ই বলুক, ভেতরে ভেতরে আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা ভালো করেই জানে, এটি ১৯৮৬ বা ১৯৯৬ নয়। এবারে একতরফা নির্বাচন করা যাবে না। করলেও তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। ২০০৭ সালে একতরফা নির্বাচনের প্রস্তুতি বিএনপির সর্বনাশ ডেকে নিয়েছিল। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ সে রকম কোনো উদ্যোগ নিলে তাকেও পস্তাতে হবে। এরশাদ যার বন্ধু তার শত্রুর প্রয়োজন হয় না। এখনই তিনি ৩০০ আসনে এককভাবে প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ সম্প্রতি এক সভায় বলেছেন, জাতীয় পার্টিসহ মহাজোটের শরিক দলগুলোও সরকারবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেবে। মওদুদ সাহেবের কথা একেবারে ভিত্তিহীন বলা যাবে না। আওয়ামী লীগের আচরণে জাতীয় পার্টি ক্ষুব্ধ। দলের একাংশ বিএনপির সঙ্গেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এরশাদ যেকোনো সময় মত পরিবর্তন করতে পারেন।
আমাদের দুর্ভাগ্য, রাজনীতির নিয়ন্ত্রক বড় দুটি দল, যারা রাজপথে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করে জয়ী হয়েছে, কর্মীরা জীবন দিয়েছেন, সেই দুটি দলের একটি সাবেক স্বৈরাচারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। অপরটি সখ্য গড়েছে মৌলবাদী ও যুদ্ধাপরাধী শক্তির সঙ্গে।
বড় দলগুলোর মধ্যে যদি ঠিকমতো গণতন্ত্রের চর্চা হতো, তারা যদি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা মনে রেখে তাদের সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হতো, তাহলে এভাবে ছোট দলগুলোর কাছে ধরনা দিতে হতো না। আওয়ামী লীগ মনে করে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বিএনপির ধারণা, জিয়ার আদর্শের মধ্যেই নিহিত রয়েছে দেশের উন্নতি। কিন্তু সেই স্বপ্ন ও আদর্শটি কী, তা তারা কখনো পরিষ্কার করে বলে না, জানেও না।
ছোট দলগুলোকে নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রশি টানাটানি এবারই প্রথম নয়। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে যে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল, তাকে সামনে রেখে বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও অলি আহমদকে নিয়ে মহাজোট গঠন করেছিলেন। কিন্তু সেই নির্বাচন আর হয়নি। সে সময়ে কর্নেল অলি ‘মা ও পুত্রদের’ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করার আগে তিনি কি সেই অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেবেন? কাদের সিদ্দিকী এত দিন আওয়ামী লীগকে পথভ্রষ্ট দল হিসেবেই গালমন্দ করে আসছিলেন। এখন তাঁর ভাষায় সেই পথভ্রষ্ট আওয়ামী লীগের সুপথে আসার কোনো লক্ষণ কি দেখেছেন। টাঙ্গাইলে ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই কি থেমে গেছে?
জোট বা ঐক্য হতে হয় আদর্শের ভিত্তিতে, নীতির ভিত্তিতে। কিন্তু আমাদের বড় দুই দলই সেসব বিসর্জন দিয়ে এখন ক্ষমতায় থাকা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।
আগামী দিনের রাজনীতির চেহারাটি কেমন হবে, বলা কঠিন। কিন্তু বড় দলগুলোর কাছে ছোট দলগুলোর যে কদর বেড়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হলো, হঠাৎ এই কদরের পেছনে কী কাজ করেছে? পদ-পদবি-সুযোগ-সুবিধা? অদৃশ্য লেনদেনের বিনিময়ে যে ঐক্য হয়, তা রাজনীতিকে আরও কলুষিত, দুর্নীতিগ্রস্ত, সন্ত্রাসনির্ভর করে তুলবে। আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে প্রকাশ্য কেনাবেচার কাজটি শুরু করেন প্রয়াত জিয়াউর রহমান। প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করতে তিনি ছোট ছোট দলের নেতাদের নানা অন্যায্য সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দিয়েছিলেন। এরশাদ ছিলেন তাঁরই ফটোকপি। রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারে এই দুই জেনারেল এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা করেননি। মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজের অনুসন্ধানে কিছু কিছু লোমহর্ষক ঘটনা বেরিয়ে এসেছে।
তখন ছিল স্বৈরাচারের শাসনামল। এখন গণতান্ত্রিক শাসনামলে জোটের বা মহাজোটের নামে কি আবার সেই বেচাকেনার রাজনীতিই ফিরে এল? তাহলে গণতন্ত্র ও স্বৈরাচারের মধ্যে কী পার্থক্য?
প্রশ্নটি শুনে এক রসিক বন্ধু বললেন, স্বৈরাচারের আমল থেকে গণতান্ত্রিক আমলের পার্থক্য তো আছেই। স্বৈরশাসকেরা রাজনীতিকদের কিনতেন। এখন ‘খালু মামুরা’ গোটা রাজনীতিই কিনে ফেলছেন।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
২০০১ সালের বিদায়ী সরকারের এক শীর্ষ নেতাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আপনারা সব সময় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির কথা বলেন। তাদের নিয়ে আন্দোলন করেন। কিন্তু নির্বাচনের সময় একলা চলেন কেন?’ তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমাদের দলেই এত প্রার্থী, তাঁদের জায়গা দেওয়া মুশকিল। তাঁরা নিজের চেষ্টায় নির্বাচিত হয়ে আসুক, মন্ত্রী করব।’ সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মাত্র ৬২ আসন পেয়েছিল। এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন বলেই নির্বাচনের দুই-আড়াই বছর আগে ছোট দলের বড় নেতাদের নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে গেছে।
২০ জুলাই সকালে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান কর্নেল (অব.) অলি আহমদের বাসায় যায়। দুই দলের নেতাদের মধ্যে সফল বৈঠক হয়েছে এবং বৈঠক শেষে অলি আহমদ বলেছেন, ‘বৃহত্তর ঐক্য গড়তে আমরা একমত হয়েছি। আমরা ঐক্যবদ্ধ হলে জাতীয়তাবাদী শক্তি আরও শক্তিশালী হবে।’ ওই বৈঠকের ছবি টেলিভিশন চ্যানেলের কল্যাণে দেশবাসী দেখেছে। কিন্তু রাতেই পরিবেশ ও বন প্রতিমন্ত্রী হাছান মাহমুদ অলি আহমদের বাসায় যান প্রধানমন্ত্রীর বার্তা নিয়ে। কী ছিল সেই বার্তায়, আমাদের জানা নেই। তবে রাত প্রায় ১২টা পর্যন্ত প্রতিমন্ত্রী ও এলডিপির নেতার মধ্যে বৈঠক হয়েছে, এটুকু জানিয়েছে গণমাধ্যম।
সকালের বৈঠকে অলি আহমদ বিএনপির নেতৃত্বে বৃহত্তর ঐক্য গড়তে রাজি হয়েছেন। আর রাতে মহাজোটের পক্ষে থাকা নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আওয়ামী লীগের নেতা। এর মাজেজা কী? পরদিন আওয়ামী লীগের দুই প্রভাবশালী নেতা ওবায়দুল কাদের ও জাহাঙ্গীর কবির নানক দেখা করেন কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে। সেখানেও নাকি ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন কাদের সিদ্দিকী। আগের আমলের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল। কার বা কাদের পরামর্শে মিরপুরের এস এ খালেককে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করানো হয়েছিল। ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু এক দিন পরই তো দেখা গেল, তিনি বিএনপির নেত্রীর সঙ্গে দেখা করে কান্নাকাটি করছেন। সেই সময়ে বিএনপির আরও দুই সাংসদকে মন্ত্রিসভায় নিয়ে আওয়ামী লীগ জাতীয় কথিত ঐকমত্যের সরকার করেছিল। কিন্তু সেই ঐকমত্য দেশের দূরে থাক, আওয়ামী লীগেরও উপকারে আসেনি।
কেবল অলি আহমদ বা কাদের সিদ্দিকী নন, ছোট দলের অন্যান্য নেতারও কদর বেড়েছে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, এঁরা তত মূল্যবান হয়ে উঠবেন। যেমন—তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে মূল্যবান হয়ে উঠেছিলেন ‘কিংস পার্টি’ খ্যাত দলের নেতারা। এখন সাইনবোর্ড ছাড়া তাদের কিছু নেই।
বিএনপির নেতারা এর আগে বৈঠক করেছেন বিকল্পধারার প্রেসিডেন্ট বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রধান কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গেও। অপেক্ষমাণ তালিকায় আছেন জাসদের নেতা আ স ম আবদুর রব। নানা কিসিমের ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে। তাদের ডাকা ৩০ ঘণ্টা হরতালের প্রতি বিএনপি সমর্থন জানিয়েছে। আর চারদলীয় জোটের ছোট তিন শরিক—জামায়াত, ইসলামী ঐক্যজোট ও বিজেপি তো আছেই। বিএনপির সঙ্গে আরও আছে ভাসানীর নামানুসারী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ছিটকে পড়া বিভিন্ন উপদল। বিএনপির সঙ্গে আছেন ছাত্রলীগের এককালের ডাকসাইটে নেতা ও মুহসীন হলের ছাত্র হত্যাকাণ্ডের অন্যতম দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি শফিউল আলম প্রধানও।
এদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও বসে নেই। মহাজোটের পরিধি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে তারা। দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ১১ দলীয় জোটের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। পরের মেয়াদে বাহাত্তরের সংবিধান অক্ষরে অক্ষরে পুনরুজ্জীবিত করবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন। সংবিধানে বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম ও রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখায় ১১ দলের নেতারা ক্ষুব্ধ। সেই ক্ষোভ প্রশমন করতেই কি এই আশ্বাসবাণী? আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে দুই বড় দলই। হঠাৎ করে বড় দলগুলোর এই জোটতৎপরতা বাড়ানোর কেন দরকার পড়ল, তা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। বিগত নির্বাচনের হিসাব ধরলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দেশের ৮০ শতাংশের বেশি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক পেয়েছে ৪৬ শতাংশ ভোট, বিএনপির ধানের শীষ ৪০ শতাংশ। আসনসংখ্যার দিক থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি আসনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় এসেছে। তার পরও পরিধি বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ল কেন? পড়ল এ কারণে যে, যে ভোটাররা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছে, তাদের বড় অংশ ইতিমধ্যে হতাশ হয়েছে। সেই হতাশা কাটানোর কোনো উদ্যোগ না নিয়ে ছোট দলের নেতাদের বাড়িতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে।
বিএনপি ‘বৃহত্তর ঐক্য’ গড়ার প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে জামায়াত। আওয়ামী লীগ বলছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও খালেদা জিয়ার পুত্রদের দুর্নীতির বিচার বন্ধের জন্য বিরোধী দল ষড়যন্ত্র করছে। সরকারের হাতে নানা বাহিনী ও সংস্থা আছে। সরকারের কাজ হবে তাদের কাজে লাগিয়ে সেই ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেওয়া। রাস্তায় বক্তৃতা দিলে তো ষড়যন্ত্র বন্ধ হবে না।
জোট নিয়ে দুই পক্ষই এখন মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ে নামছে। দুই প্রধান দল মুখে যা-ই বলুক, ভেতরে ভেতরে আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা ভালো করেই জানে, এটি ১৯৮৬ বা ১৯৯৬ নয়। এবারে একতরফা নির্বাচন করা যাবে না। করলেও তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। ২০০৭ সালে একতরফা নির্বাচনের প্রস্তুতি বিএনপির সর্বনাশ ডেকে নিয়েছিল। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ সে রকম কোনো উদ্যোগ নিলে তাকেও পস্তাতে হবে। এরশাদ যার বন্ধু তার শত্রুর প্রয়োজন হয় না। এখনই তিনি ৩০০ আসনে এককভাবে প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ সম্প্রতি এক সভায় বলেছেন, জাতীয় পার্টিসহ মহাজোটের শরিক দলগুলোও সরকারবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেবে। মওদুদ সাহেবের কথা একেবারে ভিত্তিহীন বলা যাবে না। আওয়ামী লীগের আচরণে জাতীয় পার্টি ক্ষুব্ধ। দলের একাংশ বিএনপির সঙ্গেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এরশাদ যেকোনো সময় মত পরিবর্তন করতে পারেন।
আমাদের দুর্ভাগ্য, রাজনীতির নিয়ন্ত্রক বড় দুটি দল, যারা রাজপথে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করে জয়ী হয়েছে, কর্মীরা জীবন দিয়েছেন, সেই দুটি দলের একটি সাবেক স্বৈরাচারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। অপরটি সখ্য গড়েছে মৌলবাদী ও যুদ্ধাপরাধী শক্তির সঙ্গে।
বড় দলগুলোর মধ্যে যদি ঠিকমতো গণতন্ত্রের চর্চা হতো, তারা যদি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা মনে রেখে তাদের সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হতো, তাহলে এভাবে ছোট দলগুলোর কাছে ধরনা দিতে হতো না। আওয়ামী লীগ মনে করে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বিএনপির ধারণা, জিয়ার আদর্শের মধ্যেই নিহিত রয়েছে দেশের উন্নতি। কিন্তু সেই স্বপ্ন ও আদর্শটি কী, তা তারা কখনো পরিষ্কার করে বলে না, জানেও না।
ছোট দলগুলোকে নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রশি টানাটানি এবারই প্রথম নয়। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে যে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল, তাকে সামনে রেখে বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও অলি আহমদকে নিয়ে মহাজোট গঠন করেছিলেন। কিন্তু সেই নির্বাচন আর হয়নি। সে সময়ে কর্নেল অলি ‘মা ও পুত্রদের’ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করার আগে তিনি কি সেই অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেবেন? কাদের সিদ্দিকী এত দিন আওয়ামী লীগকে পথভ্রষ্ট দল হিসেবেই গালমন্দ করে আসছিলেন। এখন তাঁর ভাষায় সেই পথভ্রষ্ট আওয়ামী লীগের সুপথে আসার কোনো লক্ষণ কি দেখেছেন। টাঙ্গাইলে ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই কি থেমে গেছে?
জোট বা ঐক্য হতে হয় আদর্শের ভিত্তিতে, নীতির ভিত্তিতে। কিন্তু আমাদের বড় দুই দলই সেসব বিসর্জন দিয়ে এখন ক্ষমতায় থাকা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।
আগামী দিনের রাজনীতির চেহারাটি কেমন হবে, বলা কঠিন। কিন্তু বড় দলগুলোর কাছে ছোট দলগুলোর যে কদর বেড়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হলো, হঠাৎ এই কদরের পেছনে কী কাজ করেছে? পদ-পদবি-সুযোগ-সুবিধা? অদৃশ্য লেনদেনের বিনিময়ে যে ঐক্য হয়, তা রাজনীতিকে আরও কলুষিত, দুর্নীতিগ্রস্ত, সন্ত্রাসনির্ভর করে তুলবে। আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে প্রকাশ্য কেনাবেচার কাজটি শুরু করেন প্রয়াত জিয়াউর রহমান। প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করতে তিনি ছোট ছোট দলের নেতাদের নানা অন্যায্য সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দিয়েছিলেন। এরশাদ ছিলেন তাঁরই ফটোকপি। রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারে এই দুই জেনারেল এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা করেননি। মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজের অনুসন্ধানে কিছু কিছু লোমহর্ষক ঘটনা বেরিয়ে এসেছে।
তখন ছিল স্বৈরাচারের শাসনামল। এখন গণতান্ত্রিক শাসনামলে জোটের বা মহাজোটের নামে কি আবার সেই বেচাকেনার রাজনীতিই ফিরে এল? তাহলে গণতন্ত্র ও স্বৈরাচারের মধ্যে কী পার্থক্য?
প্রশ্নটি শুনে এক রসিক বন্ধু বললেন, স্বৈরাচারের আমল থেকে গণতান্ত্রিক আমলের পার্থক্য তো আছেই। স্বৈরশাসকেরা রাজনীতিকদের কিনতেন। এখন ‘খালু মামুরা’ গোটা রাজনীতিই কিনে ফেলছেন।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments