শেকড়ের ডাক-জাপানে ভূমিকম্পের বর্ষপূর্তি : আমরা কিছু শিখব কি? by ফরহাদ মাহমুদ
জাপানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ৯ মাত্রার একটি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল ২০১১ সালের ১১ মার্চ। আর তারপর আরো প্রলয়ঙ্করী আঘাত হেনেছিল ভূমিকম্প থেকে সৃষ্ট সুনামি। উপকূলের কোথাও কোথাও ৬৫ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়ে আছড়ে পড়েছিল সাগরের জল। রিকুজেনতাকাতা এবং ওনাগাওয়া নামের দুটি শহর রীতিমতো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল।
ফুকুশিমার দাই-ইচি পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে ঘটে গিয়েছিল সাম্প্রতিক ইতিহাসের ভয়াবহতম পারমাণবিক দুর্ঘটনা। সব মিলিয়ে এই দুর্যোগে মারা গিয়েছিল ১৯ হাজারের বেশি মানুষ, আহত হয়েছিল অনেকে। বহু মানুষ গৃহহারা হয়েছিল। এই দুর্যোগে জাপানের ২১০ বিলিয়ন বা ২১ হাজার কোটি ডলারের বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, যা একক কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে সর্বাধিক ক্ষয়ক্ষতি। গত ১১ মার্চ সারা জাপানে সেই দুর্ঘটনার বর্ষপূর্তি পালন করা হয়েছে। জাপান এখনো সেই ক্ষত পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি, তবে অনেকটাই সামলে নিয়েছে বলা যায়।
টোকিওতে বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োসিহিকো নোদা বলেছেন, জাপানের মানুষ অতীতেও এ রকম অনেক দুর্যোগ মোকাবিলা করেছে। প্রতিবারই তারা সাহস ও শক্তি নিয়ে ধ্বংসস্তূপের উঠে দাঁড়িয়েছে এবং প্রতিবারই দেশ 'অপেক্ষাকৃত ভালো স্থান হিসেবে পুনরায় জন্ম নিয়েছে।' ভূমিকম্পের দেশ হিসেবে পরিচিত জাপানের মানুষের সেই মনোবল যে আছে, সে ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকেও তারা উঠে দাঁড়িয়েছিল। শুধু উঠে দাঁড়ানো নয়, অর্থনৈতিকভাবে যে অগ্রগতি তারা অর্জন করেছে, তা রীতিমতো ঈর্ষণীয়। ভূমিকম্প ও সুনামির ঝাপটাও তারা কাটিয়ে উঠবে এ ব্যাপারে কোনো দ্বিধা নেই। কিন্তু আমরা? আমাদের কি ক্ষমতা আছে, এ রকম কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠার। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আমাদের সে রকম প্রস্তুতি আছে কি?
ভূমিকম্প নয়, এমনিতেই আমাদের রাজধানী শহর ঢাকায় একের পর এক ভবন ধসের ঘটনা ঘটছে। আর উদ্ধার তৎপরতা! তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়িতে একটি পাঁচ তলা ভবন একদিকে কাত হয়ে পড়েছিল। ভবনের নিচে চাপা পড়েছিল আরো কয়েকটি কাঁচা ঘর। মারা গেল আটজন, আহত হলো ২২ জন। ভবনের ভেতরে কয়েক দিন ধরে আটকে থাকল অর্ধশতাধিক লোক। ঠিকমতো উদ্ধার তৎপরতা চালানো যাচ্ছিল না। কারণ গলিটির এমন অবস্থা যে সেখানে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়িও ঢুকতে পারছিল না। এটি শুধুু বেগুনবাড়ি নয়, ঢাকা মহানগরীর অধিকাংশ এলাকারই একটি অতি পরিচিত চিত্র। অথচ এ রকম গলির ভেতরেও রয়েছে বহু 'হাইরাইজ' ভবন। এখানে বড় ধরনের ভূমিকম্পের পর অবস্থা কি হতে পারে- কল্পনা করা যায় কি?
এই তেজগাঁওয়েই কয়েক বছর আগে ফিনিঙ্রে একটি ভবন ধসে পড়েছিল। সাভারের স্পেকট্রাম ভবন ধসে বহু লোক হতাহত হয়েছিল। শান্তিনগর, নারিন্দা, কল্যাণপুরসহ বেশ কিছু স্থানে বহুতল ভবন একদিকে কাত হয়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্প ছাড়াই ভবনে ফাটল তৈরি হতে দেখা গেছে। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? ৯ মাত্রার প্রয়োজন হবে না, ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেও এসব ভবন টিকে থাকতে পারবে না। কেন? নির্মাণ প্রকৌশলীদের উত্তর একটিই- নির্মাণ ত্রুটি। যথাযথভাবে মাটি পরীক্ষার পর প্রয়োজন অনুযায়ী ভিত্তি গড়ে তোলা হয় না। ইমারত নির্মাণ বিধিমালা তো নয়ই, এমনকি ভবন নির্মাণের নূ্যনতম নিয়ম-কানুনও মানা হয় না। অনেকের মতে, রাজধানীতে এ রকম ভবনের সংখ্যাই বেশি। বছরখানেক আগে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কার কথাটিই বর্তমান খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী সংসদকে অবহিত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, রাজধানীতে ৭ মাত্রার কাছাকাছি ভূমিকম্প হলেও ৭০ হাজারের বেশি বাড়িঘর ধসে পড়বে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এই মহানগরীর বাড়িঘর নির্মাণে কোনো শৃঙ্খলা এসেছে কি? বাড়িঘর তৈরিতে যাতে নিয়ম-কানুন মানা হয়, সে জন্য রাজউক বা সরকার কতটা তৎপর? জাপানে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ঘরবাড়ি নির্মাণ করা প্রায় অসম্ভব। তার পরও কত বড় ক্ষতি তাদের মেনে নিতে হয়েছে। অতি দ্রুততার সঙ্গে তারা উদ্ধার তৎপরতা সম্পন্ন করেছে। আমরা কি পারব সে রকম দ্রুততার সঙ্গে উদ্ধারকাজ চালাতে? প্রশ্নই ওঠে না। সে রকম প্রস্তুতিও আমাদের নেই। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত 'ভূমিকম্প মোকাবিলায় সচেতনতা ও করণীয়' শীর্ষক এক সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা দাবি করেছেন, ঢাকার প্রায় সব ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ। রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরের ৭২ হাজার বাড়িঘর বিধ্বস্ত হবে। আর সেই ধ্বংসস্তূপ উদ্ধারে লেগে যাবে বছরের পর বছর।
২০০৮ সালের ১২ মে চীনের সিচুয়ান প্রদেশে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই তারা মূল উদ্ধার তৎপরতা সম্পন্ন করেছিল। ভূমিকম্পবিধ্বস্ত এলাকাটিতে জনসংখ্যার ঘনত্ব ছিল ঢাকার তুলনায় অনেক কম। সেখানকার অবকাঠামোও ছিল অনেক বেশি টেকসই। তার পরও সেখানে প্রাণহানির সংখ্যা প্রায় এক লাখে পেঁৗছেছিল। আর ঢাকায় একই মাত্রার ভূমিকম্প হলে উদ্ধার তৎপরতা সাত বছরেও সম্পন্ন করা যেত কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তাৎক্ষণিকভাবে মারা যাওয়া লোকের সংখ্যাই হবে অনেক বেশি। ভেতরে আটকে পড়া লোকজনও খাবার, পানি ও চিকিৎসার অভাবে মারা যাবে।
ইতিপূর্বে সাভারের স্পেকট্রাম ভবন, বেগুনবাড়ির ফিনিক্স ভবন, র্যাংগস ভবনের হঠাৎ ধসে পড়া কয়েক তলার ধ্বংসস্তূপ অপসারণের সময়ই তার প্রমাণ পেয়েছি। একেকটি ভবনে উদ্ধারকাজ সম্পন্ন করতে এক মাসেরও বেশি লেগে গিয়েছিল। সেই হিসাবে ধসে পড়া ৭২ হাজার ভবনের উদ্ধারকাজ সম্পন্ন করতে ৭২ হাজার মাস বা ছয় হাজার বছর লাগবে। হয়তো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসবে। কিন্তু দুর্গম গলিপথে উদ্ধারকাজের জন্য আনা যন্ত্রপাতি পেঁৗছানো যাবে কি? চীনে তো আহতদের দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমাদের হাসপাতাল ভবনগুলো টিকে থাকবে কি? নিমতলীর অগি্নকাণ্ডের পরই তো আমরা দেখেছি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কি ত্রাহি অবস্থা। আর যেখানে লাখ লাখ লোক আহত হবে, তাদের চিকিৎসার সামান্যতম ব্যবস্থাও কি আমাদের আছে?
এ দেশে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্পটি হয়েছিল ১৮৯৭ সালে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৮.১। সিলেটের ডাউকি ফল্ট সিস্টেমে উৎপত্তি হওয়া এই ভূমিকম্পে ময়মনসিংহ, রংপুর, ঢাকাসহ অনেক স্থানেই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ঢাকায় সে সময় যত ইঁটের তৈরি ভবন ছিল প্রায় সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ১৯৫০ সালে আসামে ৮.৬ মাত্রার আরেকটি বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। তার প্রভাবও আমাদের দেশে পড়েছিল। ১৯১৮ সালে সিলেটের শাহজিবাজারে ৭.৬ মাত্রার একটি বড় ভূমিকম্প হয়েছিল, যাকে শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্প হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এটির উৎপত্তি হয়েছিল শাহজিবাজার ফল্ট থেকে। এ ছাড়া ১৯৩০ সালে কুচবিহারের ঢুবরি ফল্টে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্পটি ছিল ৭.১ মাত্রার। এই ফল্টের প্রভাব বলয়ের মধ্যে রয়েছে আমাদের রংপুর-কুড়িগ্রাম অঞ্চল। ১৮৮৫ সালে ৭ মাত্রার আরেকটি বড় ভূমিকম্প হয়েছিল বগুড়া অঞ্চলে, এটি 'বেঙ্গল আর্থকোয়েক' হিসেবে খ্যাত। এ ছাড়া ১৮৬৯ সালে 'কাছার ভূমিকম্প' নামে খ্যাত আরেকটি বড় ভূমিকম্প হয়েছিল ভারতের ত্রিপুরায়। এটির উৎপত্তি ত্রিপুরা ফল্ট সিস্টেমে, যার দ্বারা আমরাও প্রভাবিত হই। এ ছাড়াও আমাদের কয়েকটি ফল্ট সিস্টেম রয়েছে, সেগুলো হলো : চট্টগ্রাম ফল্ট সিস্টেম, রাজশাহীর তানোর ফল্ট সিস্টেম, সীতাকুণ্ড-টেকনাফ ফল্ট সিস্টেম এবং ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ফল্ট সিস্টেম। কাজেই যেকোনো ফল্ট সিস্টেমে যেকোনো সময় অধিক মাত্রার ভূমিকম্প বা বড় ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে। উৎপত্তিস্থলের কাছাকাছি ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি থাকলেও মাটির গঠনগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী অপেক্ষাকৃত দূরেও ভূমিকম্পের তীব্রতা বা ক্ষয়ক্ষতি অপেক্ষাকৃতভাবে বেশি হতে পারে। আগেই বলেছি, ঢাকায় ক্ষয়ক্ষতি বেশি হতে পারে অতিরিক্ত ঘনবসতি এবং আমাদের নানা অপরিকল্পিত কর্মকাণ্ডের কারণে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে ঢাকার ৩৫ শতাংশ এবং ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ৪৩ শতাংশ বাড়িঘর ধসে পড়বে। কাজেই বড় ভূমিকম্প আঘাত হানার আশঙ্কা আমাদের আছেই। সেই দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি থাকতে হবে। বাড়িঘর নির্মাণে নিয়মনীতি মানার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। ভূমিকম্প আগে হোক, তারপরই দেখা যাবে- এ ধরনের মানসিকতা চরম মূর্খতারই পরিচায়ক।
লেখক : সাংবাদিক
টোকিওতে বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োসিহিকো নোদা বলেছেন, জাপানের মানুষ অতীতেও এ রকম অনেক দুর্যোগ মোকাবিলা করেছে। প্রতিবারই তারা সাহস ও শক্তি নিয়ে ধ্বংসস্তূপের উঠে দাঁড়িয়েছে এবং প্রতিবারই দেশ 'অপেক্ষাকৃত ভালো স্থান হিসেবে পুনরায় জন্ম নিয়েছে।' ভূমিকম্পের দেশ হিসেবে পরিচিত জাপানের মানুষের সেই মনোবল যে আছে, সে ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকেও তারা উঠে দাঁড়িয়েছিল। শুধু উঠে দাঁড়ানো নয়, অর্থনৈতিকভাবে যে অগ্রগতি তারা অর্জন করেছে, তা রীতিমতো ঈর্ষণীয়। ভূমিকম্প ও সুনামির ঝাপটাও তারা কাটিয়ে উঠবে এ ব্যাপারে কোনো দ্বিধা নেই। কিন্তু আমরা? আমাদের কি ক্ষমতা আছে, এ রকম কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠার। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আমাদের সে রকম প্রস্তুতি আছে কি?
ভূমিকম্প নয়, এমনিতেই আমাদের রাজধানী শহর ঢাকায় একের পর এক ভবন ধসের ঘটনা ঘটছে। আর উদ্ধার তৎপরতা! তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়িতে একটি পাঁচ তলা ভবন একদিকে কাত হয়ে পড়েছিল। ভবনের নিচে চাপা পড়েছিল আরো কয়েকটি কাঁচা ঘর। মারা গেল আটজন, আহত হলো ২২ জন। ভবনের ভেতরে কয়েক দিন ধরে আটকে থাকল অর্ধশতাধিক লোক। ঠিকমতো উদ্ধার তৎপরতা চালানো যাচ্ছিল না। কারণ গলিটির এমন অবস্থা যে সেখানে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়িও ঢুকতে পারছিল না। এটি শুধুু বেগুনবাড়ি নয়, ঢাকা মহানগরীর অধিকাংশ এলাকারই একটি অতি পরিচিত চিত্র। অথচ এ রকম গলির ভেতরেও রয়েছে বহু 'হাইরাইজ' ভবন। এখানে বড় ধরনের ভূমিকম্পের পর অবস্থা কি হতে পারে- কল্পনা করা যায় কি?
এই তেজগাঁওয়েই কয়েক বছর আগে ফিনিঙ্রে একটি ভবন ধসে পড়েছিল। সাভারের স্পেকট্রাম ভবন ধসে বহু লোক হতাহত হয়েছিল। শান্তিনগর, নারিন্দা, কল্যাণপুরসহ বেশ কিছু স্থানে বহুতল ভবন একদিকে কাত হয়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্প ছাড়াই ভবনে ফাটল তৈরি হতে দেখা গেছে। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? ৯ মাত্রার প্রয়োজন হবে না, ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেও এসব ভবন টিকে থাকতে পারবে না। কেন? নির্মাণ প্রকৌশলীদের উত্তর একটিই- নির্মাণ ত্রুটি। যথাযথভাবে মাটি পরীক্ষার পর প্রয়োজন অনুযায়ী ভিত্তি গড়ে তোলা হয় না। ইমারত নির্মাণ বিধিমালা তো নয়ই, এমনকি ভবন নির্মাণের নূ্যনতম নিয়ম-কানুনও মানা হয় না। অনেকের মতে, রাজধানীতে এ রকম ভবনের সংখ্যাই বেশি। বছরখানেক আগে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কার কথাটিই বর্তমান খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী সংসদকে অবহিত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, রাজধানীতে ৭ মাত্রার কাছাকাছি ভূমিকম্প হলেও ৭০ হাজারের বেশি বাড়িঘর ধসে পড়বে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এই মহানগরীর বাড়িঘর নির্মাণে কোনো শৃঙ্খলা এসেছে কি? বাড়িঘর তৈরিতে যাতে নিয়ম-কানুন মানা হয়, সে জন্য রাজউক বা সরকার কতটা তৎপর? জাপানে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ঘরবাড়ি নির্মাণ করা প্রায় অসম্ভব। তার পরও কত বড় ক্ষতি তাদের মেনে নিতে হয়েছে। অতি দ্রুততার সঙ্গে তারা উদ্ধার তৎপরতা সম্পন্ন করেছে। আমরা কি পারব সে রকম দ্রুততার সঙ্গে উদ্ধারকাজ চালাতে? প্রশ্নই ওঠে না। সে রকম প্রস্তুতিও আমাদের নেই। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত 'ভূমিকম্প মোকাবিলায় সচেতনতা ও করণীয়' শীর্ষক এক সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা দাবি করেছেন, ঢাকার প্রায় সব ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ। রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরের ৭২ হাজার বাড়িঘর বিধ্বস্ত হবে। আর সেই ধ্বংসস্তূপ উদ্ধারে লেগে যাবে বছরের পর বছর।
২০০৮ সালের ১২ মে চীনের সিচুয়ান প্রদেশে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই তারা মূল উদ্ধার তৎপরতা সম্পন্ন করেছিল। ভূমিকম্পবিধ্বস্ত এলাকাটিতে জনসংখ্যার ঘনত্ব ছিল ঢাকার তুলনায় অনেক কম। সেখানকার অবকাঠামোও ছিল অনেক বেশি টেকসই। তার পরও সেখানে প্রাণহানির সংখ্যা প্রায় এক লাখে পেঁৗছেছিল। আর ঢাকায় একই মাত্রার ভূমিকম্প হলে উদ্ধার তৎপরতা সাত বছরেও সম্পন্ন করা যেত কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তাৎক্ষণিকভাবে মারা যাওয়া লোকের সংখ্যাই হবে অনেক বেশি। ভেতরে আটকে পড়া লোকজনও খাবার, পানি ও চিকিৎসার অভাবে মারা যাবে।
ইতিপূর্বে সাভারের স্পেকট্রাম ভবন, বেগুনবাড়ির ফিনিক্স ভবন, র্যাংগস ভবনের হঠাৎ ধসে পড়া কয়েক তলার ধ্বংসস্তূপ অপসারণের সময়ই তার প্রমাণ পেয়েছি। একেকটি ভবনে উদ্ধারকাজ সম্পন্ন করতে এক মাসেরও বেশি লেগে গিয়েছিল। সেই হিসাবে ধসে পড়া ৭২ হাজার ভবনের উদ্ধারকাজ সম্পন্ন করতে ৭২ হাজার মাস বা ছয় হাজার বছর লাগবে। হয়তো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসবে। কিন্তু দুর্গম গলিপথে উদ্ধারকাজের জন্য আনা যন্ত্রপাতি পেঁৗছানো যাবে কি? চীনে তো আহতদের দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমাদের হাসপাতাল ভবনগুলো টিকে থাকবে কি? নিমতলীর অগি্নকাণ্ডের পরই তো আমরা দেখেছি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কি ত্রাহি অবস্থা। আর যেখানে লাখ লাখ লোক আহত হবে, তাদের চিকিৎসার সামান্যতম ব্যবস্থাও কি আমাদের আছে?
এ দেশে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্পটি হয়েছিল ১৮৯৭ সালে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৮.১। সিলেটের ডাউকি ফল্ট সিস্টেমে উৎপত্তি হওয়া এই ভূমিকম্পে ময়মনসিংহ, রংপুর, ঢাকাসহ অনেক স্থানেই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ঢাকায় সে সময় যত ইঁটের তৈরি ভবন ছিল প্রায় সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ১৯৫০ সালে আসামে ৮.৬ মাত্রার আরেকটি বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। তার প্রভাবও আমাদের দেশে পড়েছিল। ১৯১৮ সালে সিলেটের শাহজিবাজারে ৭.৬ মাত্রার একটি বড় ভূমিকম্প হয়েছিল, যাকে শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্প হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এটির উৎপত্তি হয়েছিল শাহজিবাজার ফল্ট থেকে। এ ছাড়া ১৯৩০ সালে কুচবিহারের ঢুবরি ফল্টে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্পটি ছিল ৭.১ মাত্রার। এই ফল্টের প্রভাব বলয়ের মধ্যে রয়েছে আমাদের রংপুর-কুড়িগ্রাম অঞ্চল। ১৮৮৫ সালে ৭ মাত্রার আরেকটি বড় ভূমিকম্প হয়েছিল বগুড়া অঞ্চলে, এটি 'বেঙ্গল আর্থকোয়েক' হিসেবে খ্যাত। এ ছাড়া ১৮৬৯ সালে 'কাছার ভূমিকম্প' নামে খ্যাত আরেকটি বড় ভূমিকম্প হয়েছিল ভারতের ত্রিপুরায়। এটির উৎপত্তি ত্রিপুরা ফল্ট সিস্টেমে, যার দ্বারা আমরাও প্রভাবিত হই। এ ছাড়াও আমাদের কয়েকটি ফল্ট সিস্টেম রয়েছে, সেগুলো হলো : চট্টগ্রাম ফল্ট সিস্টেম, রাজশাহীর তানোর ফল্ট সিস্টেম, সীতাকুণ্ড-টেকনাফ ফল্ট সিস্টেম এবং ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ফল্ট সিস্টেম। কাজেই যেকোনো ফল্ট সিস্টেমে যেকোনো সময় অধিক মাত্রার ভূমিকম্প বা বড় ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে। উৎপত্তিস্থলের কাছাকাছি ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি থাকলেও মাটির গঠনগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী অপেক্ষাকৃত দূরেও ভূমিকম্পের তীব্রতা বা ক্ষয়ক্ষতি অপেক্ষাকৃতভাবে বেশি হতে পারে। আগেই বলেছি, ঢাকায় ক্ষয়ক্ষতি বেশি হতে পারে অতিরিক্ত ঘনবসতি এবং আমাদের নানা অপরিকল্পিত কর্মকাণ্ডের কারণে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে ঢাকার ৩৫ শতাংশ এবং ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ৪৩ শতাংশ বাড়িঘর ধসে পড়বে। কাজেই বড় ভূমিকম্প আঘাত হানার আশঙ্কা আমাদের আছেই। সেই দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি থাকতে হবে। বাড়িঘর নির্মাণে নিয়মনীতি মানার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। ভূমিকম্প আগে হোক, তারপরই দেখা যাবে- এ ধরনের মানসিকতা চরম মূর্খতারই পরিচায়ক।
লেখক : সাংবাদিক
No comments