বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৩৪২ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। শওকত আলী সরকার, বীর বিক্রম অদম্য এক মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধারা দুপুরে এক দফা যুদ্ধ করলেন পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে। তাঁদের নেতৃত্বে শওকত আলী সরকার।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেও তাঁরা ব্যর্থ হলেন। অসম যুদ্ধে পাকিস্তানিরাই জয়ী হলো। শওকত আলী সরকার সহযোদ্ধাদের নিয়ে পিছু হটে সাময়িকভাবে আত্মগোপন করতে বাধ্য হলেন, কিন্তু দমে গেলেন না। বিকেলে পুনঃসংগঠিত ও শক্তি বৃদ্ধি করে আবার পাল্টা আক্রমণ চালালেন। এবার পাকিস্তানি সেনারা বিপর্যস্ত। শেষে পাকিস্তানিরা তাদের হতাহত সহযোদ্ধাদের ফেলে পালিয়ে গেল। এ ঘটনা অনন্তপুরে। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে।
অনন্তপুর কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের অন্তর্গত। সেদিন ছিল বাংলা পৌষ মাসের ৫ বা ৬ তারিখ। বেলা ১১টার দিকে একদল পাকিস্তানি সেনা হঠাত্ হাতিয়া ইউনিয়নে আসে। তাদের নেতৃত্বে ছিল এক মেজর। পাকিস্তানি সেনারা সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে থাকে। হাতিয়া ইউনিয়নের অনন্তপুরে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের মূল শিবির।
পাকিস্তানি সেনারা একপর্যায়ে কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে সেদিকে রওনা হয়। খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করেন। কিন্তু তাঁরা সংখ্যায় ছিলেন অনেক কম। ভারী অস্ত্রশস্ত্রও তাঁদের কাছে তেমন ছিল না। অন্যদিকে পাকিস্তানি সেনা ছিল সংখ্যায় বিপুল। ভারী অস্ত্রশস্ত্রও ছিল অনেক। গুলির শব্দ শুনে পাকিস্তানিরা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান চিহ্নিত করে নিমিষে কয়েকটি গ্রাম ঘিরে ফেলে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের না পেয়ে তারা নির্বিচারে গ্রামের মানুষকে হত্যা ও বাড়িঘরে আগুন দিতে শুরু করে।
মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁদের বেপরোয়া আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে ঝোপ-জঙ্গলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। চারদিকে তখন আহত গ্রামবাসীর চিত্কার। মৃত মানুষের রক্তে ভেসে গেছে গ্রাম। দুঃসহ এক পরিস্থিতি।
এমন পরিস্থিতিতে শওকত আলী সরকার বেশিক্ষণ নীরব থাকতে পারলেন না। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে আবার ঝাঁপিয়ে পড়লেন পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে। এবার তাঁরা সংখ্যায় কিছুটা বেশি। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেয় মুক্তিযোদ্ধাদের অপর দল—চাঁদ প্লাটুনের কিছু মুক্তিযোদ্ধা। গ্রামবাসী হত্যার প্রতিশোধ নিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শওকত আলী সরকার মুখোমুখি যুদ্ধ শুরু করেন। তাঁর সাহসিকতায় উজ্জীবিত হন সব মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা বেসামাল হয়ে পড়ে। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস আরও বেড়ে যায়। বিপুল বিক্রমে তাঁরা যুদ্ধ করেন। এক সময় শওকত আলী সরকারসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। কিন্তু তাঁদের হাতেও হতাহত হয় ২৫-৩০ জন পাকিস্তানি সেনা। শেষ পর্যন্ত নিহত কয়েকজনের লাশ ফেলে পাকিস্তানিরা পালিয়ে যায় কুড়িগ্রামে। সেদিন পাকিস্তানি সেনারা কয়েক শ নিরস্ত্র মানুষ হত্যা করে। জীতেন্দ্র নাথ, গোলজার হোসেন, মনতাজ আলী, আবুল কাসেম কাচু, নওয়াব আলীসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে শহীদ হন।
শওকত আলী সরকার ১৯৭১ সালে শিক্ষার্থী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রশিক্ষণ শেষে যুদ্ধ করেন ১১ নম্বর সেক্টরের মানকারচর সাব-সেক্টরে।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শওকত আলী সরকারকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৭২।
শওকত আলী সরকারের পৈতৃক বাড়ি ছিল কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলার রানীগঞ্জ ইউনিয়নের দক্ষিণ ওয়ারী গ্রামে। এই গ্রাম নদীভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে তিনি বসবাস করেন চিলমারী থানাহাট বাজারে। তাঁর বাবার নাম ইজাব আলী সরকার। মা শরিতুজ নেছা। স্ত্রী খালেদা খানম। তাঁদের চার মেয়ে দুই ছেলে।
সূত্র: কুড়িগ্রামে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক সফি খান এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১১।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
অনন্তপুর কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের অন্তর্গত। সেদিন ছিল বাংলা পৌষ মাসের ৫ বা ৬ তারিখ। বেলা ১১টার দিকে একদল পাকিস্তানি সেনা হঠাত্ হাতিয়া ইউনিয়নে আসে। তাদের নেতৃত্বে ছিল এক মেজর। পাকিস্তানি সেনারা সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে থাকে। হাতিয়া ইউনিয়নের অনন্তপুরে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের মূল শিবির।
পাকিস্তানি সেনারা একপর্যায়ে কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে সেদিকে রওনা হয়। খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করেন। কিন্তু তাঁরা সংখ্যায় ছিলেন অনেক কম। ভারী অস্ত্রশস্ত্রও তাঁদের কাছে তেমন ছিল না। অন্যদিকে পাকিস্তানি সেনা ছিল সংখ্যায় বিপুল। ভারী অস্ত্রশস্ত্রও ছিল অনেক। গুলির শব্দ শুনে পাকিস্তানিরা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান চিহ্নিত করে নিমিষে কয়েকটি গ্রাম ঘিরে ফেলে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের না পেয়ে তারা নির্বিচারে গ্রামের মানুষকে হত্যা ও বাড়িঘরে আগুন দিতে শুরু করে।
মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁদের বেপরোয়া আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে ঝোপ-জঙ্গলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। চারদিকে তখন আহত গ্রামবাসীর চিত্কার। মৃত মানুষের রক্তে ভেসে গেছে গ্রাম। দুঃসহ এক পরিস্থিতি।
এমন পরিস্থিতিতে শওকত আলী সরকার বেশিক্ষণ নীরব থাকতে পারলেন না। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে আবার ঝাঁপিয়ে পড়লেন পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে। এবার তাঁরা সংখ্যায় কিছুটা বেশি। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেয় মুক্তিযোদ্ধাদের অপর দল—চাঁদ প্লাটুনের কিছু মুক্তিযোদ্ধা। গ্রামবাসী হত্যার প্রতিশোধ নিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শওকত আলী সরকার মুখোমুখি যুদ্ধ শুরু করেন। তাঁর সাহসিকতায় উজ্জীবিত হন সব মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা বেসামাল হয়ে পড়ে। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস আরও বেড়ে যায়। বিপুল বিক্রমে তাঁরা যুদ্ধ করেন। এক সময় শওকত আলী সরকারসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। কিন্তু তাঁদের হাতেও হতাহত হয় ২৫-৩০ জন পাকিস্তানি সেনা। শেষ পর্যন্ত নিহত কয়েকজনের লাশ ফেলে পাকিস্তানিরা পালিয়ে যায় কুড়িগ্রামে। সেদিন পাকিস্তানি সেনারা কয়েক শ নিরস্ত্র মানুষ হত্যা করে। জীতেন্দ্র নাথ, গোলজার হোসেন, মনতাজ আলী, আবুল কাসেম কাচু, নওয়াব আলীসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে শহীদ হন।
শওকত আলী সরকার ১৯৭১ সালে শিক্ষার্থী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রশিক্ষণ শেষে যুদ্ধ করেন ১১ নম্বর সেক্টরের মানকারচর সাব-সেক্টরে।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শওকত আলী সরকারকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৭২।
শওকত আলী সরকারের পৈতৃক বাড়ি ছিল কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলার রানীগঞ্জ ইউনিয়নের দক্ষিণ ওয়ারী গ্রামে। এই গ্রাম নদীভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে তিনি বসবাস করেন চিলমারী থানাহাট বাজারে। তাঁর বাবার নাম ইজাব আলী সরকার। মা শরিতুজ নেছা। স্ত্রী খালেদা খানম। তাঁদের চার মেয়ে দুই ছেলে।
সূত্র: কুড়িগ্রামে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক সফি খান এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১১।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments