স্মরণ-একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি by মোহীত উল আলম
শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন সম্পর্কে জানতে যাঁরা ইচ্ছুক, তাঁদের কাছে আজ যাঁকে নিয়ে আলোচনা করছি, তিনি অপরিচিত কেউ নন। আবার অনেকে হয়তো তাঁর সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তাঁদের কাছে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় তুলে ধরার জন্য আলোচনাটি করছি।
তাঁর নাম বীর উত্তম শহীদ খাজা নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া। ১৯৭১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর তিনি শহীদ হন সিলেট জেলার কানাইঘাট থানার মমতাজগঞ্জ ক্যাম্পের অধীন আটগ্রাম সড়কের বাজার নামক স্থানে একটি সম্মুখযুদ্ধে। মৃত্যুর এ ঘটনা মাহবুব-উল আলম তাঁর বাঙ্গালীর মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত-এর (নতুন সংস্করণ ২০১১, অনুপম প্রকাশনী) ‘সংযোজন’ ৯ পৃষ্ঠায় লিখছেন: ‘৪ঠা সেপ্টেম্বর তাঁরা কানাইঘাটের একটা বড় পুল ধ্বংস করে দিয়ে ফিরে আসছিলেন। এমন সময় পাকিস্তানি বাহিনীর ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে যান। পথ করে নিতে তাঁদের ৬ ঘণ্টা তুমুল গুলি চালাতে হয়। কিন্তু পথ যখন পরিষ্কার হলো, তখন দেখা গেল বাহিনীর প্রিয় কমান্ডার নিজাম ভাই আর ইহলোকে নেই, গুলি খেয়ে প্রাণ ত্যাগ করেছেন।’ ২০১১ সালের ৭ এপ্রিল প্রথম আলোর একটি লেখায় অনুরূপ বলা হচ্ছে, ‘১৯৭১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের দলনেতা খাজা নিজাম উদ্দিন তাঁর দল নিয়ে সিলেট জেলার কানাইঘাটের আটগ্রাম সড়কের বাজারের কাছে একটি সেতু বিস্ফোরক দিয়ে ধ্বংস করেন। সে সময় একদল পাকিস্তানি সেনা সেতুর খুব কাছাকাছি অবস্থান করছিল। তখন পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে তাঁদের সম্মুখযুদ্ধ শুরু হয়।’
নিজাম উদ্দিন সমাহিত আছেন মোমটিলায় লাল শাহ, পাতা শাহ ও গুলু শাহ—এই তিন আউলিয়ার মাজারের পাশেই। তাঁর বিক্রমে মমতাজগঞ্জ, নক্তিপাড়া, ভয়ামহিদ, মণিপুর প্রভৃতি অঞ্চল দীর্ঘকাল হানাদারমুক্ত ছিল। দেশবাসী এ বিরাট অঞ্চলের নাম দিয়েছে নিজামনগর। এলাকাবাসী তাঁকে ‘ক্যাপ্টেন নিজাম’ নামে সম্বোধন করতেন। অন্যদিকে কুমিল্লার কান্দিরপাড় থেকে পুলিশলাইন পর্যন্ত রাস্তার নামকরণ হয়েছে ‘শহীদ খাজা নিজাম উদ্দিন বীর উত্তম সড়ক’।
বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রণীত এক গেজেটে তাঁকে বীর উত্তম উপাধি দেয়। সেই তালিকায় তাঁর স্মারক নম্বর ১৪। তিনিই একমাত্র বেসামরিক শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, যিনি ‘মরণোত্তর বীর উত্তম’ উপাধি পান। এ প্রসঙ্গে শামসুজ্জামান খান তাঁর ‘শহীদ খাজা নিজাম উদ্দিন: যোদ্ধা’ শীর্ষক রচনায় লিখলেন: ‘শহীদ নিজামের মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল অনন্য। “বীর উত্তম” তালিকায় তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি ষাটের দশকের ছাত্র-গণ আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছেন। ঘটনার আকস্মিকতা কিংবা পারিপার্শ্বিকতার চাপে নয়, আজন্ম লালিত স্বপ্ন এবং বিশ্বাসের বাস্তবায়নের জন্য যাঁরা সেদিন দৃঢ়চিত্ত ও সুস্থির সিদ্ধান্তে পাক-বাহিনীর মোকাবেলায় নেমেছিলেন, তিনি ছিলেন তাঁদেরই একজন।’
যা হোক, চূড়ান্ত সনদ দেওয়া হয় যখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা প্রথমবার ক্ষমতায় এলেন। তাই সনদে তাঁর স্বাক্ষর বর্তমান।
নিজাম উদ্দিনের জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি। তাঁর জন্ম পিতার তৎকালীন কর্মস্থল জয়দেবপুর, ভাওয়াল, রাজবাড়ি, গাজীপুর হলেও তাঁদের বাড়ি হলো কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া থানার মালপাড়া গ্রাম। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল মাত্র সাড়ে ২২ বছর। অথচ দেশের জন্য অকাতরে প্রাণ দিতে দ্বিধা করলেন না! মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন তাঁর বিখ্যাত ভাষণ ‘গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস’-এ (১৯ নভেম্বর ১৮৬৩) আমেরিকার গৃহযুদ্ধে প্রাণত্যাগকারী শহীদদের উদ্দেশে যে উক্তিটি করেছিলেন, সেটি আমরা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নিজাম উদ্দিন বা সব শহীদের ওপর প্রয়োগ করতে পারি। তিনি বলেছিলেন, ‘এ মাটিকে তোমরা তোমাদের রক্ত দিয়ে পবিত্র করে গেছ। আমরা যা কিছুই করি না কেন, তা তোমাদের আত্মত্যাগের ধারেকাছে যেতে পারবে না।’ ঠিক সেই রকম নিজাম উদ্দিনের স্মৃতির তর্পণ করতে পারি আমরা। কিন্তু তাঁর সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের মহিমা আমরা হয়তো উপলব্ধি করতে পারব না।
নিজাম উদ্দিনের বাবা মরহুম আবদুল লতিফ ভূঁইয়া ও মাতা মরহুমা তাবেন্দা আখতার খাতুন। পিতা সরকারি কর্মকর্তা হওয়ায় নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়ার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা দেশের বিভিন্ন জেলায় সম্পন্ন হয়। উচ্চশিক্ষা নিতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ১৯৬৬ সালে। ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে ১৯৬৯ সালে স্নাতক সম্মান ও ১৯৭০ সালে স্নাতকোত্তর পাস করেন। এরপর ১৯৭১ সালে আইবিএতে। এমবিএ পড়ার সময় তিনি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন, যদিও তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন গিটারবাদক ও কবি হিসেবে তাঁর পরিচিতি বেড়ে উঠতে থাকে।
‘বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধরো/ বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ স্লোগানে উদ্বুদ্ধ ছিলেন তিনি। রাজনীতির ভুবনে তিনি ছিলেন বাংলা ছাত্রলীগের জাতীয় কার্যকরী সংসদের প্রচার সম্পাদক ও মুহসীন হল শাখার দলের কার্যকরী সম্পাদক। এ দায়িত্বে ছিলেন ২৫ মার্চ ১৯৭১ সাল পর্যন্ত।
তিনি ১৯৭১ সালের এপ্রিল-মে মাসের প্রথম ১০ দিন প্রশিক্ষণ নেন বিএসএফের কাছে এবং পরের এক মাস ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে। তাঁর প্রশিক্ষণস্থল ছিল ইন্দ্রনগর, আগরতলা, ভারত। প্রশিক্ষণ শেষে তিনি সিলেট অঞ্চলের ৪ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর জালালপুরের যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ‘সাব-সেক্টর সেকেন্ড-ইন-কমান্ড’ হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তাঁর নেতৃত্বে ছিলেন ৪৮৮ জন মুক্তিযোদ্ধা। কানাইঘাট অঞ্চলে এ দলটি এত কুশলতার সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকে যে, ভারতীয় বাহিনী তাদের ভূয়সী প্রশংসা করে।
তাঁর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর (পরবর্তী সময়ে মেজর জেনারেল) চিত্তরঞ্জন দত্ত, বীর উত্তম। ইকো-সেক্টর-কমান্ডার ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার ওয়াটকে। সি আর দত্ত ‘জীবনের চাইতে স্বাধীনতা অনেক বেশী মূল্যবান’ শীর্ষক একটি রচনায় নিজাম উদ্দিন সম্পর্কে লিখলেন, ‘সম্মুখ সমরে আমি তার দেশপ্রেম, সাহসিকতা ও বীরত্ব প্রত্যক্ষ করেছি। সাহসিকতাপূর্ণ অবদান ও বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে “বীরশ্রেষ্ঠ” খেতাবে ভূষিত করার জন্যে চার নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে আমি তৎকালীন সরকারের কাছে সুপারিশ করেছিলাম।’
নিজাম উদ্দিন এমবিএ পড়ার পাশাপাশি চাকরিও করতেন। চাকরিটা ছিল শেরাটন হোটেলের (বর্তমানে রূপসী বাংলা) হিসাবরক্ষণ দপ্তরে। তাঁর স্মৃতির স্মারক হিসেবে ওই হোটেলের প্রাঙ্গণে একটি প্রস্তরনির্মিত স্মৃতিফলক আছে।
যেহেতু শহীদ নিজাম উদ্দিন বীর উত্তম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন, তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি একটি সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁর ভাইদের কাছে তাঁর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষার সনদ হস্তান্তর করেছে। উভয় সনদে স্বাক্ষরিত তারিখ ৭ জুন ২০১১।
এখন শহীদ নিজাম উদ্দিনের স্মৃতি নানাভাবে ইতিহাসে সংরক্ষিত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাস অনুসন্ধান করা এখন বাংলাদেশের পরম কর্তব্য, মূল গবেষণার বিষয়। কারণ, এই মহান ও গৌরবময় ইতিহাস না জানলে বর্তমান প্রজন্ম দিকনির্দেশনা পাবে না।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস খোঁজার তাগিদ কীভাবে একটা পথ পেতে পারে, তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে মাহবুব-উল আলমের একটি চিঠি, যেটি তিনি শহীদ নিজাম উদ্দিনের বড় ভাই মেজর মোস্তফা কামালুদ্দীন ভূঁইয়াকে লিখেছিলেন ১৯৭৭ সালের ২৩ আগস্ট। তখন মাহবুব-উল আলমের বয়স ৭৯ বছর। চিঠিটির প্রাসঙ্গিকতা আছে বিধায় সেটি সম্পূর্ণ উদ্ধৃত করে বীর উত্তম শহীদ খাজা নিজাম উদ্দিনের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলিটি শেষ করছি।
মাহবুব-উল আলম লিখেছেন:
সালামু আলায়কুম:
আমি বাঙ্গালীর মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত নামে যে ১১৯৪ পৃষ্ঠার বিরাট গ্রন্থ প্রণয়ন ও প্রকাশ করিয়াছি উহাকে আরও নিখুঁৎ, আরও পূর্ণাঙ্গ ও সম্ভব হইলে সচিত্র করার ব্যাপারে জেলায় জেলায় টূর করিতেছি। এই উপলক্ষে কুমিল্লা ১৭/৮ পৌঁছিয়া ১৮/১৯ থাকিয়া ২০/৮ চলিয়া আসিয়াছি।
আপনার ভাই নিযামুদ্দীন মুক্তি-যুদ্ধে বিশেষ অংশ গ্রহণ করিয়া কানাইর ঘাটের নিকট শহীদ হইয়াছেন। তাঁহার বিবরণটা এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করিতে চাই।
আমি ‘করবী’, বাগিচাগাঁও গিয়া আপনার পিতার সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলাম। সেখান হইতে আপনার ঠিকানা সংগ্রহ করিয়াছি।
সম্ভব হইলে আমি আপনার সঙ্গে ৩১/৮ দেখা করিতে চাই। চেক-পোস্টে আপনি উহার ব্যবস্থা রাখিলে ইহা সম্ভব হইতে পারে। যাহাতে সে দেখায় বিবরণটা আমরা সমাপ্ত করিতে পারি তাহাও দেখিতে হইবে।
আমার টেলিফোন আছে। সম্ভব হইলে টেলিফোনেও আলাপ করিতে পারেন।
ভাল আছি। ভাল চাই।
খাদেম,
মাহবুব-উল আলম।
মোহীত উল আলম: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি, ইউল্যাব, ঢাকা।
mohit_13_1952@yahoo.com
নিজাম উদ্দিন সমাহিত আছেন মোমটিলায় লাল শাহ, পাতা শাহ ও গুলু শাহ—এই তিন আউলিয়ার মাজারের পাশেই। তাঁর বিক্রমে মমতাজগঞ্জ, নক্তিপাড়া, ভয়ামহিদ, মণিপুর প্রভৃতি অঞ্চল দীর্ঘকাল হানাদারমুক্ত ছিল। দেশবাসী এ বিরাট অঞ্চলের নাম দিয়েছে নিজামনগর। এলাকাবাসী তাঁকে ‘ক্যাপ্টেন নিজাম’ নামে সম্বোধন করতেন। অন্যদিকে কুমিল্লার কান্দিরপাড় থেকে পুলিশলাইন পর্যন্ত রাস্তার নামকরণ হয়েছে ‘শহীদ খাজা নিজাম উদ্দিন বীর উত্তম সড়ক’।
বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রণীত এক গেজেটে তাঁকে বীর উত্তম উপাধি দেয়। সেই তালিকায় তাঁর স্মারক নম্বর ১৪। তিনিই একমাত্র বেসামরিক শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, যিনি ‘মরণোত্তর বীর উত্তম’ উপাধি পান। এ প্রসঙ্গে শামসুজ্জামান খান তাঁর ‘শহীদ খাজা নিজাম উদ্দিন: যোদ্ধা’ শীর্ষক রচনায় লিখলেন: ‘শহীদ নিজামের মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল অনন্য। “বীর উত্তম” তালিকায় তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি ষাটের দশকের ছাত্র-গণ আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছেন। ঘটনার আকস্মিকতা কিংবা পারিপার্শ্বিকতার চাপে নয়, আজন্ম লালিত স্বপ্ন এবং বিশ্বাসের বাস্তবায়নের জন্য যাঁরা সেদিন দৃঢ়চিত্ত ও সুস্থির সিদ্ধান্তে পাক-বাহিনীর মোকাবেলায় নেমেছিলেন, তিনি ছিলেন তাঁদেরই একজন।’
যা হোক, চূড়ান্ত সনদ দেওয়া হয় যখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা প্রথমবার ক্ষমতায় এলেন। তাই সনদে তাঁর স্বাক্ষর বর্তমান।
নিজাম উদ্দিনের জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি। তাঁর জন্ম পিতার তৎকালীন কর্মস্থল জয়দেবপুর, ভাওয়াল, রাজবাড়ি, গাজীপুর হলেও তাঁদের বাড়ি হলো কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া থানার মালপাড়া গ্রাম। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল মাত্র সাড়ে ২২ বছর। অথচ দেশের জন্য অকাতরে প্রাণ দিতে দ্বিধা করলেন না! মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন তাঁর বিখ্যাত ভাষণ ‘গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস’-এ (১৯ নভেম্বর ১৮৬৩) আমেরিকার গৃহযুদ্ধে প্রাণত্যাগকারী শহীদদের উদ্দেশে যে উক্তিটি করেছিলেন, সেটি আমরা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নিজাম উদ্দিন বা সব শহীদের ওপর প্রয়োগ করতে পারি। তিনি বলেছিলেন, ‘এ মাটিকে তোমরা তোমাদের রক্ত দিয়ে পবিত্র করে গেছ। আমরা যা কিছুই করি না কেন, তা তোমাদের আত্মত্যাগের ধারেকাছে যেতে পারবে না।’ ঠিক সেই রকম নিজাম উদ্দিনের স্মৃতির তর্পণ করতে পারি আমরা। কিন্তু তাঁর সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের মহিমা আমরা হয়তো উপলব্ধি করতে পারব না।
নিজাম উদ্দিনের বাবা মরহুম আবদুল লতিফ ভূঁইয়া ও মাতা মরহুমা তাবেন্দা আখতার খাতুন। পিতা সরকারি কর্মকর্তা হওয়ায় নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়ার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা দেশের বিভিন্ন জেলায় সম্পন্ন হয়। উচ্চশিক্ষা নিতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ১৯৬৬ সালে। ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে ১৯৬৯ সালে স্নাতক সম্মান ও ১৯৭০ সালে স্নাতকোত্তর পাস করেন। এরপর ১৯৭১ সালে আইবিএতে। এমবিএ পড়ার সময় তিনি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন, যদিও তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন গিটারবাদক ও কবি হিসেবে তাঁর পরিচিতি বেড়ে উঠতে থাকে।
‘বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধরো/ বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ স্লোগানে উদ্বুদ্ধ ছিলেন তিনি। রাজনীতির ভুবনে তিনি ছিলেন বাংলা ছাত্রলীগের জাতীয় কার্যকরী সংসদের প্রচার সম্পাদক ও মুহসীন হল শাখার দলের কার্যকরী সম্পাদক। এ দায়িত্বে ছিলেন ২৫ মার্চ ১৯৭১ সাল পর্যন্ত।
তিনি ১৯৭১ সালের এপ্রিল-মে মাসের প্রথম ১০ দিন প্রশিক্ষণ নেন বিএসএফের কাছে এবং পরের এক মাস ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে। তাঁর প্রশিক্ষণস্থল ছিল ইন্দ্রনগর, আগরতলা, ভারত। প্রশিক্ষণ শেষে তিনি সিলেট অঞ্চলের ৪ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর জালালপুরের যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ‘সাব-সেক্টর সেকেন্ড-ইন-কমান্ড’ হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তাঁর নেতৃত্বে ছিলেন ৪৮৮ জন মুক্তিযোদ্ধা। কানাইঘাট অঞ্চলে এ দলটি এত কুশলতার সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকে যে, ভারতীয় বাহিনী তাদের ভূয়সী প্রশংসা করে।
তাঁর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর (পরবর্তী সময়ে মেজর জেনারেল) চিত্তরঞ্জন দত্ত, বীর উত্তম। ইকো-সেক্টর-কমান্ডার ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার ওয়াটকে। সি আর দত্ত ‘জীবনের চাইতে স্বাধীনতা অনেক বেশী মূল্যবান’ শীর্ষক একটি রচনায় নিজাম উদ্দিন সম্পর্কে লিখলেন, ‘সম্মুখ সমরে আমি তার দেশপ্রেম, সাহসিকতা ও বীরত্ব প্রত্যক্ষ করেছি। সাহসিকতাপূর্ণ অবদান ও বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে “বীরশ্রেষ্ঠ” খেতাবে ভূষিত করার জন্যে চার নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে আমি তৎকালীন সরকারের কাছে সুপারিশ করেছিলাম।’
নিজাম উদ্দিন এমবিএ পড়ার পাশাপাশি চাকরিও করতেন। চাকরিটা ছিল শেরাটন হোটেলের (বর্তমানে রূপসী বাংলা) হিসাবরক্ষণ দপ্তরে। তাঁর স্মৃতির স্মারক হিসেবে ওই হোটেলের প্রাঙ্গণে একটি প্রস্তরনির্মিত স্মৃতিফলক আছে।
যেহেতু শহীদ নিজাম উদ্দিন বীর উত্তম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন, তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি একটি সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁর ভাইদের কাছে তাঁর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষার সনদ হস্তান্তর করেছে। উভয় সনদে স্বাক্ষরিত তারিখ ৭ জুন ২০১১।
এখন শহীদ নিজাম উদ্দিনের স্মৃতি নানাভাবে ইতিহাসে সংরক্ষিত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাস অনুসন্ধান করা এখন বাংলাদেশের পরম কর্তব্য, মূল গবেষণার বিষয়। কারণ, এই মহান ও গৌরবময় ইতিহাস না জানলে বর্তমান প্রজন্ম দিকনির্দেশনা পাবে না।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস খোঁজার তাগিদ কীভাবে একটা পথ পেতে পারে, তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে মাহবুব-উল আলমের একটি চিঠি, যেটি তিনি শহীদ নিজাম উদ্দিনের বড় ভাই মেজর মোস্তফা কামালুদ্দীন ভূঁইয়াকে লিখেছিলেন ১৯৭৭ সালের ২৩ আগস্ট। তখন মাহবুব-উল আলমের বয়স ৭৯ বছর। চিঠিটির প্রাসঙ্গিকতা আছে বিধায় সেটি সম্পূর্ণ উদ্ধৃত করে বীর উত্তম শহীদ খাজা নিজাম উদ্দিনের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলিটি শেষ করছি।
মাহবুব-উল আলম লিখেছেন:
সালামু আলায়কুম:
আমি বাঙ্গালীর মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত নামে যে ১১৯৪ পৃষ্ঠার বিরাট গ্রন্থ প্রণয়ন ও প্রকাশ করিয়াছি উহাকে আরও নিখুঁৎ, আরও পূর্ণাঙ্গ ও সম্ভব হইলে সচিত্র করার ব্যাপারে জেলায় জেলায় টূর করিতেছি। এই উপলক্ষে কুমিল্লা ১৭/৮ পৌঁছিয়া ১৮/১৯ থাকিয়া ২০/৮ চলিয়া আসিয়াছি।
আপনার ভাই নিযামুদ্দীন মুক্তি-যুদ্ধে বিশেষ অংশ গ্রহণ করিয়া কানাইর ঘাটের নিকট শহীদ হইয়াছেন। তাঁহার বিবরণটা এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করিতে চাই।
আমি ‘করবী’, বাগিচাগাঁও গিয়া আপনার পিতার সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলাম। সেখান হইতে আপনার ঠিকানা সংগ্রহ করিয়াছি।
সম্ভব হইলে আমি আপনার সঙ্গে ৩১/৮ দেখা করিতে চাই। চেক-পোস্টে আপনি উহার ব্যবস্থা রাখিলে ইহা সম্ভব হইতে পারে। যাহাতে সে দেখায় বিবরণটা আমরা সমাপ্ত করিতে পারি তাহাও দেখিতে হইবে।
আমার টেলিফোন আছে। সম্ভব হইলে টেলিফোনেও আলাপ করিতে পারেন।
ভাল আছি। ভাল চাই।
খাদেম,
মাহবুব-উল আলম।
মোহীত উল আলম: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি, ইউল্যাব, ঢাকা।
mohit_13_1952@yahoo.com
No comments