অসুস্থ ছাত্ররাজনীতিই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অসুখ by লুৎফর রহমান রনো

একটি সমৃদ্ধ জাতি, সুন্দর ও মর্যাদাদীপ্ত দেশ বা সমাজ নির্মাণের জন্য জরুরি আলোকিত মানুষ গড়ে তোলা। এই আলোকিত মানুষ গড়ার কারখানা যে আমাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়_তা না বললেও চলে; কিন্তু এসব কারখানার (প্রতিষ্ঠানের) কলকব্জা এখন বিকল_ঠিক বিকল বলা চলে না, বিকৃত।


কেবল বিকৃত বলাও যায় না, একেবারে বিপরীত বস্তু উৎপাদন করছে। অর্থাৎ আলোকিত নয়, তৈরি করছে অন্ধকার-পিপাসু রাক্ষস। যারা জ্ঞান অর্জন নয়, চিন্তা-চর্চা নয়, নিদেনপক্ষে বই, খাতা-কলম পর্যন্ত স্পর্শ করে না, তাদের আবাস-আলয়গুলো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের যোদ্ধাদের দুর্গ। এতে থাকে বন্দুক-পিস্তল, লাঠি-কিরিচ-দা-বঁটি, চাকু-চাপাতি ও নানা ধরনের অস্ত্র। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খুন, ধর্ষণ, মারপিট, হল দখলের যুদ্ধ_সব ধরনের অপরাধ প্রতিনিয়ত সংঘটিত হচ্ছে। এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের পুলিশ গ্রেপ্তার করে না। কখনো এদের বিচার হয় না। নিরপরাধ অনেকের মৃত্যু ঘটেছে, গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে লাশ, স্বজনরা আহাজারি করেছেন, কবরস্থ করেছেন; বেশ কাহিনী শেষ। আবার অন্য খুন, অন্য কাহিনী_এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি চলছেই। ঐতিহাসিক সূত্রে আমরা অবগত যে সেনাশাসনের শুরুতে মেধাবী ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়েছিল, অর্থের ছড়াছড়ি ছিল, সেই থেকে কাড়াকাড়ি শুরু হলো ক্ষমতাসীন দলের ছাতার তলে জায়গা জুড়ার।
আশির দশকের অনেক ছাত্রনামধারী খুনি 'তারকা' নেতাদের নাম এখনো দেশবাসীর মনে আছে; কিন্তু তাতে কী আসে যায়। অনেক খুনি-সন্ত্রাসী সংসদ সদস্যও হয়েছেন। লাখোপতি, কোটিপতি হয়েছেন। তাঁদের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। সফল 'মানুষ' ও নেতা হিসেবে সমাজে, দেশে, রাজনৈতিক মঞ্চে হয়েছেন প্রতিষ্ঠিত। অতএব, যে পথে নাম, যশ, অর্থ সবই আসে, সে পথেই উত্তরসূরিরা চলবেন তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই; কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেই কলঙ্কিত কালের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাটা গণতান্ত্রিক সরকারগুলো ভাঙবে না কেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যবসায়ী, রাজনীতিক ও রাজনৈতিক দলের লাঠিয়াল হাতিয়ার, খুনি, চাঁদাবাজ তৈরির কারখানা ও সন্ত্রাসীদের অভয়াশ্রমরূপে আর কতকাল ব্যবহৃত হবে? রাজনৈতিক দলগুলোর কি খুব প্রয়োজন? হল দখল, সড়ক দখল_শক্তি প্রদর্শনের কি আজও প্রয়োজন রয়েছে? সব দলের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য, আদর্শ (যদি থাকে) দেশবাসীর কাছে তো অস্পষ্ট নয়। বরং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তথাকথিত ছাত্র রাজনীতির সুযোগে আদর্শহীন, অস্পষ্ট উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য যাদের বা অবাঞ্ছিত দুষ্টচক্রের শক্তি সঞ্চয়ের জায়গায় পরিণত হয়ে পড়ছে না? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আলোকিত মানুষ তৈরি না হয়ে, সুশীল শিক্ষিত শ্রেণীর বিকাশ না হয়ে ধর্মান্ধদের উন্মাদনা ও হিজবুত তাহ্রীরের বিস্তার চলছে। তা ছাড়া ওই কিরিচ-চাপাতি বন্দুকধারীদের অবৈধ আয়ের উৎস (চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি) বন্ধ করে দিয়ে মেধা বিকাশের পথ সুগম করে দিলে জাতি উপকৃত হতো। জ্ঞানী, বিচক্ষণ সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী পেতাম আমরা ভবিষ্যতে। যাঁরা দেশের মর্যাদা রক্ষা ও বৃদ্ধির জন্য নিজেদের প্রতিভা কাজে লাগাতে পারতেন।
সত্য যে সব ছাত্র দলীয় লড়াকু নয় বা দলীয় সরকারের অনুগ্রহ প্রত্যাশী নয়। তবে এও সত্য যে চাকরির ক্ষেত্রে দলীয় পরিচয়ে চাকরিপ্রাপ্তির বাড়তি সুবিধা-সম্ভাবনা থাকে। আর এই দলীয় চিন্তা থেকে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, ঘুষ ও নানা ধরনের অন্যায়-অনিয়মের সূত্রপাত ঘটে। প্রথমত মেধার মর্যাদা না থাকায় পড়ালেখার চেয়ে পেশীপেশার প্রাধান্য পাওয়ায় সহজ-সরল মেধাবী ছাত্ররা চরম হতাশায় ডুবে যায়। এর সুযোগ গ্রহণ করে ধর্মবাজরা_এই ফাঁক-ফোকর দিয়ে ঢুকে পড়ে মাদক কিংবা কেউ হাতে তুলে নেয় লাঠি-বন্দুক। এমন পরিস্থিতি যদি যুগের পর যুগ চলতে থাকে_এর পরিণামে যত ধরনের ও মাত্রার মন্দত্ব ও স্খলন-পতন হতে পারে তার সবই আজ এ দেশের সব ক্ষেত্রে শক্তভাবে বিরাজিত। সংসদ সদস্য থেকে ইউপি সদস্য পর্যন্ত নির্বাচিত করার মতো সৎ ও যোগ্য লোক খুঁজে পান না ভোটাররা। অবশেষে বাধ্য হয়ে প্রতীকের পার্থক্যে ভাগ হয়ে দলীয় লোকদের 'নির্বাচিত' করেন। তারপর কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে উন্নয়ন-প্রতিশ্রুতির মেয়াদ পার করেন। জনগণ তাদের নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের 'সংসদ বর্জন' রাজনীতি, কিন্তু সংসদ সদস্য হিসেবে সব ধরনের সুবিধা অর্জনের ভণ্ডামি দেখে। অন্যদিকে সরকারি দলের সংসদ সদস্যদের দৌরাত্ম্য, মন্ত্রীদের দায়িত্বহীন কথাবার্তা ও মন্ত্রণালয়গুলোর ব্যর্থতা দেখে দেখে ক্লান্ত কণ্ঠে স্বগতোক্তি করে, 'নাহ, এ দেশে কিছু হবে না...।' অর্থাৎ সাধারণ মানুষের কিছু হবে না, যাদের হওয়ার তাদের অনেক কিছুই হচ্ছে।
আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথায় আসা যাক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একসময় প্রাচ্যের অঙ্ফোর্ড বলা হতো। অথচ এখন বিশ্বের চার-পাঁচ শ মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নামই ওঠে না। পাশাপাশি দেশের দুর্নীতির মাত্রা হ্রাস পায় না। গণতন্ত্রচর্চার নামে রাজনীতির চরিত্রের কোনো রদবদল নেই। হানাহানি-হিংসা-বিদ্বেষ দলে দলে লেগেই থাকে। নেতা-নেত্রীরা কথা বলেন এমন ভাষা-ভঙ্গিতে, যা বিশ্বরাজনীতির বুদ্ধি-বিজ্ঞতা ও কূটকুশলতার বিচারে লজ্জাকর। উন্নত বিশ্বে_ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, আমেরিকায় সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের বিরোধিতা করতে দেখেছি ছাত্রদের। এমনকি পুঁজিবাদের বিরুদ্ধেও ছাত্র-জনতার বিদ্রোহ দেখেছি। সেসব দেশেও বিরোধী দল থাকে। কিন্তু কই, কিরিচ-চাপাতি, বন্দুক-বোমাবাজি তো করে না কেউ। সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও একদিন তাঁদের দেশের নেতৃত্ব দেবেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পেশীবাজ ও টেন্ডারবাজরাও নেতৃত্ব দেবে। এ কারণে তারা আমাদের ডমিনেট করে। কারণ রাষ্ট্র চালনা ক্যাম্পাসের গুণ্ডাদের দ্বারা হয় না। তাই বলি, ছাত্রদের হাতে বই তুলে দিলেই জাতির মেরুদণ্ড তৈরি হয় না। এ জন্য কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়কে রাজনীতির জন্য নয়, শিক্ষার্জন ও জ্ঞানচর্চার উন্মুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তোলা প্রাথমিক কাজ। যা চলছে তা হলো, মূল ব্যাধির উপসর্গ। ব্যাধি অতি গভীরে বলে কি শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ছে রাষ্ট্রের কর্ণধারদের? নাকি ব্যাধিটাই বাঁচিয়ে রাখছে তাঁদের, যাঁদের হাতে দেশের বাঁচা-মরা নির্ভর করে। আমাদের জবাব পেতে হবে। প্রতিকার খুঁজতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.