কালের পুরাণ-এক হাত রাজাকারে, আরেক হাত স্বৈরাচারে by সোহরাব হাসান
বিএনপির নেত্রী আন্দোলনের নামে গাড়ির শোভাযাত্রা করছেন। কারা কীভাবে এসব গাড়ি কিনেছে, তা আমরা দেখব।
পাটগ্রামের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজামী-মুজাহিদ-সাঈদী নন, আওয়ামী লীগই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি
চাঁপাইনবাবগঞ্জের জনসভায় বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া
পাটগ্রামের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজামী-মুজাহিদ-সাঈদী নন, আওয়ামী লীগই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি
চাঁপাইনবাবগঞ্জের জনসভায় বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া
চলতি বছরটি স্বাধীনতার ৪০ বছর বা চার দশক পূর্ণ হতে যাচ্ছে। এক দশক পরই আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করব। স্বভাবতই সরকার ও বিরোধী দলের কাছে আমাদের প্রত্যাশা ছিল, এই চার দশকের রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি নিয়ে তাঁরা বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করবেন। যা থেকে আমরা অতীতের ব্যর্থতার কারণগুলো যথাযথভাবে চিহ্নিত করতে পারব। দেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সেটি অত্যন্ত জরুরিও ছিল।
এখন যেসব নাগরিকের বয়স চল্লিশের কম, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি। আজকের শিশু ও তরুণেরা দেখেনি। নবপ্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানানো আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু খ্যাতিমান পণ্ডিতেরা, লেখক-বুদ্ধিজীবীরা সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন বলে মনে হয় না। আমাদের নেতা-নেত্রীরাও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানাতে চান না। তাঁরা নিজেদের পছন্দমতো ইতিহাস লেখাচ্ছেন। বদলাচ্ছেন। এ কারণেই এক সরকারের আমলের যাঁরা দেবতা হিসেবে বরেণ্য, অন্য সরকারের আমলে তাঁরাই পরিণত হন অপদেবতায়।
নির্বাচনের দুই-আড়াই বছর বাকি থাকতেই শীর্ষ নেত্রীরা নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন। বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া রোডমার্চ করে সরকার পতনের ডাক দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোডমার্চে ব্যবহূত গাড়ির হিসাব নেওয়ার কথা বলেছেন। দেশের সাধারণ মানুষ যে কষ্টে আছে, তার দিকে কারও খেয়াল নেই। কে কাকে কীভাবে ঘায়েল করবেন, কার ওপর কে একহাত নেবেন—সেই চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছেন। একে অন্যের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে চলেছেন। সেখানে মানুষের স্বপ্নের কথা নেই, ভালোবাসার কথা নেই। কেবলই ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে।
নির্বাচনী যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য একজন সাবেক স্বৈরাচারের হাত ধরেছেন। আরেকজন রাজাকারের পোশাক সাফসুতরো করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
সাম্প্রতিককালে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া ঢাকা-সিলেট এবং ঢাকা-চাঁপাইনবাবগঞ্জ রোডমার্চ করে বেশ উজ্জীবিত। এ কারণে তিনি কখন কী বলেন, তার ঠিকঠিকানা নেই। ঢাকা-সিলেট রোডমার্চে যে কথাগুলো একটু রাখঢাক রেখে বলেছেন, পরেরটিতে তা-ও রাখেননি। তিনি বলেছেন, আন্দোলনের আগুনে সরকারকে ছারখার করে দেবেন। এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে কাউকে ঘরে ঘরে আগুন জ্বালাতে দেওয়া হবে না।’
দেশের মানুষ অন্য আগুনে জ্বলছে। নিত্যপণ্যের দামের আগুন। শেয়ারবাজারের আগুন। বেকারত্বের আগুন। ক্ষুধা ও অপুষ্টির আগুন। ফতোয়া ও ইভ টিজিংয়ের আগুন। কিন্তু এসব কোনো কিছুই নেতা-নেত্রীদের স্পর্শ করছে না।
প্রধানমন্ত্রী জনসভা করে জানিয়ে দিচ্ছেন, দেশের মানুষ এখনই সবচেয়ে ভালো আছেন। কোথাও কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হলো বিরোধী দল—তাদের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে তিনি দেশবাসীর সহযোগিতা চাইছেন। তারা সহযোগিতা না করলেও ক্ষতি নেই। সাবেক স্বৈরাচার তো সঙ্গে আছে।
আর বিরোধীদলীয় নেতার দাবি, সরকার দেশকে বিদেশের হাতে তুলে দিচ্ছে। অতএব, দেশ রক্ষায় আরেকটি যুদ্ধ করতে হবে। কাদের নিয়ে সেই যুদ্ধ হবে, সে কথাও স্পষ্ট করেছেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেছেন, ‘জামায়াতের নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, কামারুজ্জামান, কাদের মোল্লা ও বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে স্বাধীনতাবিরোধী বলে মিথ্যা মামলা দিয়ে আটক করা হয়েছে। আসলে আওয়ামী লীগই হলো স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। আগে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। (প্রথম আলো, ২০ অক্টোবর)
এর আগে তিনি বগুড়ার জনসভায় বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ নেতারা একাত্তরে যুদ্ধ করেননি। তাঁরা এপার-ওপার করেছেন। বিএনপিই প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের দল।
এই প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের দল বিএনপি এবং তার নেত্রী খালেদা জিয়া এখন নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদীদের নিয়ে আরেকটি যুদ্ধের ডাক দিয়েছেন। অন্যদের কথা না হয় বাদই দিলাম, বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে যাঁরা একাত্তরে অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেছেন তাঁরা কি তাঁর এই আহ্বানে সাড়া দেবেন? এখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে লড়াই করতে, ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসতে তার জামায়াত বা অন্যান্য মৌলবাদী শক্তির সমর্থন প্রয়োজন হতে পারে। তাই বলে তিনি ইতিহাসের সত্য উল্টে দিতে পারেন না। রাজাকারকে মুক্তিযোদ্ধা বানাতে পারেন না।
একাত্তর সালে এ দেশে একটি যুদ্ধ হয়েছিল— মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ ঘটনা। নানা দুর্বলতা-ব্যর্থতা সত্ত্বেও সেই যুদ্ধে আওয়ামী লীগই নেতৃত্ব দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকার পরিচালিত হয় সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে। আর সেই যুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী, তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের ভূমিকা কী ছিল, তা সবার জানা। তারা শুধু মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেনি, পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর হিসেবে গণহত্যা, লুটপাট ও ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধও সংঘটিত করেছে। সে সময় ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রধান ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী। আর এই সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের নিয়েই গঠিত হয়েছিল আলবদর-আলশামস বাহিনী, যারা বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছিল। সে সময় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, পিডিপিসহ অনেক পাকিস্তানপন্থী দল। আজ পাকিস্তানিরা যখন একাত্তরের ভুলের জন্য অনুতপ্ত, তখন খালেদা জিয়া সেই যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে সাফাই গাইছেন। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বলে সার্টিফিকেট দিচ্ছেন।
খালেদা জিয়া যখন এসব কথা বলছেন, তখন কি তাঁর স্বামী মুক্তিযুদ্ধে অন্যতম সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমানের কথা একবারও মনে পড়েনি? জিয়া সেদিন কাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন—আওয়ামী লীগারদের বিরুদ্ধে, না রাজাকার-আলবদরদের বিরুদ্ধে? মুক্তিযুদ্ধে যে ১১ জন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন, তাঁরা সবাই মুজিবনগর সরকার তথা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে যুদ্ধ করেছেন। শাসক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ যেসব ভুল ও অন্যায় করেছে, আমরা তার সমালোচনা করব। প্রতিবাদ করব। প্রয়োজনে বিচারও দাবি করব। তাই বলে রাজাকারকে তো বিএনপির নেত্রী মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকার বানাতে পারেন না। খালেদা জিয়া আমাদের কথা বিশ্বাস না করলে মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিনকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। জিজ্ঞেস করতে পারেন শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেনকেও। এমনকি তিনি পড়ে দেখতে পারেন তাঁর স্বামী জিয়াউর রহমানের সেই বিখ্যাত লেখা ‘একটি জাতির জন্ম’ প্রবন্ধটিও, যেখানে জিয়া বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে স্বাধীনতার গ্রিন সিগন্যাল হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।
বিরোধীদলীয় নেতা রাজনীতিতে শিষ্টাচার প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। ব্যক্তিগত আক্রমণ পরিহার করার কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি যে অন্য একজনের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন করেছেন, সেটি কোন শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে? আমরা রাজনীতিতে সুস্থ ধারা ফিরে আসুক, তা চাই। সে সঙ্গে চাই, রাজাকার ও স্বৈরাচার তোষণ-নীতিরও অবসান।
এবার আসি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথায়। তিনি সরকারের মেয়াদের অর্ধেক পার করে এখনো পুরোনো রেকর্ডের মতো বিএনপি-জামায়াতের দুর্নীতি-সন্ত্রাসের কথা বলে যাচ্ছেন। তিনি ঘরে ঘরে আগুন জ্বালাতে দেবেন না বলে জানিয়েছেন। কিন্তু ঘরে ঘরে তো ক্ষুধা ও বেকারত্বের আগুন জ্বলছেই। সেই আগুন নেভানোর দায়িত্ব কার?
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বিশ্বব্যাংক বন্ধ করে দিয়েছে বিএনপির আমলের দুর্নীতির কারণে, সেই প্রমাণ তাঁর হাতে আছে। বিশ্বব্যাংক এ তথ্যটি প্রধানমন্ত্রীকে কবে জানিয়েছে? বিশ্বব্যাংক বর্তমান যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনের আগে? যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে এত দিন কেন জানালেন না? অর্থমন্ত্রী বা সরকারের অন্য কেউ সেই আবিষ্কারের কথা জানালেন না কেন? প্রেসনোটের ভাষ্য অনুযায়ী, যদি বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো অভিযোগই না থাকে, তাহলে দুদক কিসের তদন্ত করছে? সরকারই বা কার বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছে?
প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেতার রোডমার্চের গাড়িবহর কোথা থেকে এসেছে, তার হিসাব নেওয়ার কথা বলেছেন। তথ্য সংগ্রহের কথা বলেছেন। এসব করাই তো সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে প্রচ্ছন্নভাবে বিরোধী দলকে হুমকি দেওয়ার কথাও রয়েছে। তার অর্থ কি এই রোডমার্চ না করলে গাড়ির হিসাব নেওয়া হবে না? সেটি তো হতে পারে না। আইন সবার জন্য সমান হতে হবে। কোনো ব্যক্তি যদি আইন ভঙ্গ করে, সরকার তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। এর সঙ্গে সরকারবিরোধী আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না।
প্রধানমন্ত্রী বরাবরের মতো বিএনপির বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও অর্থ পাচারের অভিযোগ করেছেন। এসবের দুর্নীতির বিচারের কথা বলেছেন। সরকার বিচার করে দেখাবে, কে কী দুর্নীতি করে রাষ্ট্রের ও জনগণের কতটা ক্ষতি করেছে। সেই ক্ষতিপূরণ আদায় করাও সরকারের দায়িত্ব। সে কাজটি করতে পারলে সরকারকে জনগণ মোবারকবাদ জানাবে। আর না পারলে ভাববে, এসব কথার পেছনে নিশ্চয়ই অন্য মতলব আছে।
দুই নেত্রীর ভাষণ বিশ্লেষণ করে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম তাঁর চমৎকার মন্তব্য প্রতিবেদনে প্রশ্ন রেখেছেন, ‘আমাদের নেতা-নেত্রীরা কি আমাদের নির্বোধ ভাবেন?’ না, মাহ্ফুজ ভাই, নির্বোধ ভাবার বোধশক্তিও তাঁরা হারিয়ে ফেলেছেন। নেতা-নেত্রীরা দেশের সাধারণ মানুষকে ভোটের সংখ্যা ছাড়া কিছুই ভাবেন না। নেতা-নেত্রীরা মনে করেন, তাঁরা যা খুশি বলবেন, তা-ই মুখ বুজে শুনে যেতে হবে। তাঁরা যা খুশি করবেন, প্রতিবাদ করা যাবে না।
দুই দলই চায় অন্ধ ও বধির সমর্থক। সমালোচনা নয়, কেবল জয়ধ্বনি। জিন্দাবাদ। জনগণ কি ভাবল না ভাবল তাতে তাদের কিছু আসে যায় না। কেননা, এক দলের সঙ্গে আছে স্বৈরাচার, শিল্পী কামরুল হাসান যার নাম দিয়েছিলেন বিশ্ববেহায়া। আরেক দলের সঙ্গে আছে একাত্তরের রাজাকার, যারা এখন যুদ্ধাপরাধের আসামি। অতএব আমজনতা কী ভাবল না ভাবল তাতে নেতা-নেত্রীদের কী আসে যায়!
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
এখন যেসব নাগরিকের বয়স চল্লিশের কম, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি। আজকের শিশু ও তরুণেরা দেখেনি। নবপ্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানানো আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু খ্যাতিমান পণ্ডিতেরা, লেখক-বুদ্ধিজীবীরা সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন বলে মনে হয় না। আমাদের নেতা-নেত্রীরাও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানাতে চান না। তাঁরা নিজেদের পছন্দমতো ইতিহাস লেখাচ্ছেন। বদলাচ্ছেন। এ কারণেই এক সরকারের আমলের যাঁরা দেবতা হিসেবে বরেণ্য, অন্য সরকারের আমলে তাঁরাই পরিণত হন অপদেবতায়।
নির্বাচনের দুই-আড়াই বছর বাকি থাকতেই শীর্ষ নেত্রীরা নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন। বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া রোডমার্চ করে সরকার পতনের ডাক দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোডমার্চে ব্যবহূত গাড়ির হিসাব নেওয়ার কথা বলেছেন। দেশের সাধারণ মানুষ যে কষ্টে আছে, তার দিকে কারও খেয়াল নেই। কে কাকে কীভাবে ঘায়েল করবেন, কার ওপর কে একহাত নেবেন—সেই চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছেন। একে অন্যের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে চলেছেন। সেখানে মানুষের স্বপ্নের কথা নেই, ভালোবাসার কথা নেই। কেবলই ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে।
নির্বাচনী যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য একজন সাবেক স্বৈরাচারের হাত ধরেছেন। আরেকজন রাজাকারের পোশাক সাফসুতরো করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
সাম্প্রতিককালে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া ঢাকা-সিলেট এবং ঢাকা-চাঁপাইনবাবগঞ্জ রোডমার্চ করে বেশ উজ্জীবিত। এ কারণে তিনি কখন কী বলেন, তার ঠিকঠিকানা নেই। ঢাকা-সিলেট রোডমার্চে যে কথাগুলো একটু রাখঢাক রেখে বলেছেন, পরেরটিতে তা-ও রাখেননি। তিনি বলেছেন, আন্দোলনের আগুনে সরকারকে ছারখার করে দেবেন। এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে কাউকে ঘরে ঘরে আগুন জ্বালাতে দেওয়া হবে না।’
দেশের মানুষ অন্য আগুনে জ্বলছে। নিত্যপণ্যের দামের আগুন। শেয়ারবাজারের আগুন। বেকারত্বের আগুন। ক্ষুধা ও অপুষ্টির আগুন। ফতোয়া ও ইভ টিজিংয়ের আগুন। কিন্তু এসব কোনো কিছুই নেতা-নেত্রীদের স্পর্শ করছে না।
প্রধানমন্ত্রী জনসভা করে জানিয়ে দিচ্ছেন, দেশের মানুষ এখনই সবচেয়ে ভালো আছেন। কোথাও কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হলো বিরোধী দল—তাদের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে তিনি দেশবাসীর সহযোগিতা চাইছেন। তারা সহযোগিতা না করলেও ক্ষতি নেই। সাবেক স্বৈরাচার তো সঙ্গে আছে।
আর বিরোধীদলীয় নেতার দাবি, সরকার দেশকে বিদেশের হাতে তুলে দিচ্ছে। অতএব, দেশ রক্ষায় আরেকটি যুদ্ধ করতে হবে। কাদের নিয়ে সেই যুদ্ধ হবে, সে কথাও স্পষ্ট করেছেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেছেন, ‘জামায়াতের নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, কামারুজ্জামান, কাদের মোল্লা ও বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে স্বাধীনতাবিরোধী বলে মিথ্যা মামলা দিয়ে আটক করা হয়েছে। আসলে আওয়ামী লীগই হলো স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। আগে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। (প্রথম আলো, ২০ অক্টোবর)
এর আগে তিনি বগুড়ার জনসভায় বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ নেতারা একাত্তরে যুদ্ধ করেননি। তাঁরা এপার-ওপার করেছেন। বিএনপিই প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের দল।
এই প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের দল বিএনপি এবং তার নেত্রী খালেদা জিয়া এখন নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদীদের নিয়ে আরেকটি যুদ্ধের ডাক দিয়েছেন। অন্যদের কথা না হয় বাদই দিলাম, বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে যাঁরা একাত্তরে অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেছেন তাঁরা কি তাঁর এই আহ্বানে সাড়া দেবেন? এখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে লড়াই করতে, ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসতে তার জামায়াত বা অন্যান্য মৌলবাদী শক্তির সমর্থন প্রয়োজন হতে পারে। তাই বলে তিনি ইতিহাসের সত্য উল্টে দিতে পারেন না। রাজাকারকে মুক্তিযোদ্ধা বানাতে পারেন না।
একাত্তর সালে এ দেশে একটি যুদ্ধ হয়েছিল— মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ ঘটনা। নানা দুর্বলতা-ব্যর্থতা সত্ত্বেও সেই যুদ্ধে আওয়ামী লীগই নেতৃত্ব দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকার পরিচালিত হয় সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে। আর সেই যুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী, তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের ভূমিকা কী ছিল, তা সবার জানা। তারা শুধু মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেনি, পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর হিসেবে গণহত্যা, লুটপাট ও ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধও সংঘটিত করেছে। সে সময় ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রধান ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী। আর এই সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের নিয়েই গঠিত হয়েছিল আলবদর-আলশামস বাহিনী, যারা বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছিল। সে সময় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, পিডিপিসহ অনেক পাকিস্তানপন্থী দল। আজ পাকিস্তানিরা যখন একাত্তরের ভুলের জন্য অনুতপ্ত, তখন খালেদা জিয়া সেই যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে সাফাই গাইছেন। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বলে সার্টিফিকেট দিচ্ছেন।
খালেদা জিয়া যখন এসব কথা বলছেন, তখন কি তাঁর স্বামী মুক্তিযুদ্ধে অন্যতম সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমানের কথা একবারও মনে পড়েনি? জিয়া সেদিন কাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন—আওয়ামী লীগারদের বিরুদ্ধে, না রাজাকার-আলবদরদের বিরুদ্ধে? মুক্তিযুদ্ধে যে ১১ জন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন, তাঁরা সবাই মুজিবনগর সরকার তথা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে যুদ্ধ করেছেন। শাসক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ যেসব ভুল ও অন্যায় করেছে, আমরা তার সমালোচনা করব। প্রতিবাদ করব। প্রয়োজনে বিচারও দাবি করব। তাই বলে রাজাকারকে তো বিএনপির নেত্রী মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকার বানাতে পারেন না। খালেদা জিয়া আমাদের কথা বিশ্বাস না করলে মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিনকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। জিজ্ঞেস করতে পারেন শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেনকেও। এমনকি তিনি পড়ে দেখতে পারেন তাঁর স্বামী জিয়াউর রহমানের সেই বিখ্যাত লেখা ‘একটি জাতির জন্ম’ প্রবন্ধটিও, যেখানে জিয়া বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে স্বাধীনতার গ্রিন সিগন্যাল হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।
বিরোধীদলীয় নেতা রাজনীতিতে শিষ্টাচার প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। ব্যক্তিগত আক্রমণ পরিহার করার কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি যে অন্য একজনের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন করেছেন, সেটি কোন শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে? আমরা রাজনীতিতে সুস্থ ধারা ফিরে আসুক, তা চাই। সে সঙ্গে চাই, রাজাকার ও স্বৈরাচার তোষণ-নীতিরও অবসান।
এবার আসি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথায়। তিনি সরকারের মেয়াদের অর্ধেক পার করে এখনো পুরোনো রেকর্ডের মতো বিএনপি-জামায়াতের দুর্নীতি-সন্ত্রাসের কথা বলে যাচ্ছেন। তিনি ঘরে ঘরে আগুন জ্বালাতে দেবেন না বলে জানিয়েছেন। কিন্তু ঘরে ঘরে তো ক্ষুধা ও বেকারত্বের আগুন জ্বলছেই। সেই আগুন নেভানোর দায়িত্ব কার?
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বিশ্বব্যাংক বন্ধ করে দিয়েছে বিএনপির আমলের দুর্নীতির কারণে, সেই প্রমাণ তাঁর হাতে আছে। বিশ্বব্যাংক এ তথ্যটি প্রধানমন্ত্রীকে কবে জানিয়েছে? বিশ্বব্যাংক বর্তমান যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনের আগে? যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে এত দিন কেন জানালেন না? অর্থমন্ত্রী বা সরকারের অন্য কেউ সেই আবিষ্কারের কথা জানালেন না কেন? প্রেসনোটের ভাষ্য অনুযায়ী, যদি বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো অভিযোগই না থাকে, তাহলে দুদক কিসের তদন্ত করছে? সরকারই বা কার বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছে?
প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেতার রোডমার্চের গাড়িবহর কোথা থেকে এসেছে, তার হিসাব নেওয়ার কথা বলেছেন। তথ্য সংগ্রহের কথা বলেছেন। এসব করাই তো সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে প্রচ্ছন্নভাবে বিরোধী দলকে হুমকি দেওয়ার কথাও রয়েছে। তার অর্থ কি এই রোডমার্চ না করলে গাড়ির হিসাব নেওয়া হবে না? সেটি তো হতে পারে না। আইন সবার জন্য সমান হতে হবে। কোনো ব্যক্তি যদি আইন ভঙ্গ করে, সরকার তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। এর সঙ্গে সরকারবিরোধী আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না।
প্রধানমন্ত্রী বরাবরের মতো বিএনপির বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও অর্থ পাচারের অভিযোগ করেছেন। এসবের দুর্নীতির বিচারের কথা বলেছেন। সরকার বিচার করে দেখাবে, কে কী দুর্নীতি করে রাষ্ট্রের ও জনগণের কতটা ক্ষতি করেছে। সেই ক্ষতিপূরণ আদায় করাও সরকারের দায়িত্ব। সে কাজটি করতে পারলে সরকারকে জনগণ মোবারকবাদ জানাবে। আর না পারলে ভাববে, এসব কথার পেছনে নিশ্চয়ই অন্য মতলব আছে।
দুই নেত্রীর ভাষণ বিশ্লেষণ করে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম তাঁর চমৎকার মন্তব্য প্রতিবেদনে প্রশ্ন রেখেছেন, ‘আমাদের নেতা-নেত্রীরা কি আমাদের নির্বোধ ভাবেন?’ না, মাহ্ফুজ ভাই, নির্বোধ ভাবার বোধশক্তিও তাঁরা হারিয়ে ফেলেছেন। নেতা-নেত্রীরা দেশের সাধারণ মানুষকে ভোটের সংখ্যা ছাড়া কিছুই ভাবেন না। নেতা-নেত্রীরা মনে করেন, তাঁরা যা খুশি বলবেন, তা-ই মুখ বুজে শুনে যেতে হবে। তাঁরা যা খুশি করবেন, প্রতিবাদ করা যাবে না।
দুই দলই চায় অন্ধ ও বধির সমর্থক। সমালোচনা নয়, কেবল জয়ধ্বনি। জিন্দাবাদ। জনগণ কি ভাবল না ভাবল তাতে তাদের কিছু আসে যায় না। কেননা, এক দলের সঙ্গে আছে স্বৈরাচার, শিল্পী কামরুল হাসান যার নাম দিয়েছিলেন বিশ্ববেহায়া। আরেক দলের সঙ্গে আছে একাত্তরের রাজাকার, যারা এখন যুদ্ধাপরাধের আসামি। অতএব আমজনতা কী ভাবল না ভাবল তাতে নেতা-নেত্রীদের কী আসে যায়!
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments