নতুন নতুন শ্রমবাজার সন্ধান জরুরি by ড. মুহাম্মদ আশকার ইবনে শাইখ
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক ও জনশক্তি রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে পারছে_এ সত্যের মধ্যে কোনো ফাঁক নেই। কিন্তু জনশক্তি রপ্তানিতে সম্প্রতি ভাটা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে ওঠার পর আশা করা গিয়েছিল, এ খাতে আবার তেজি ভাব পরিলক্ষিত হবে। কিন্তু তা হয়নি।
মধ্যপ্রাচ্যসহ যেসব দেশে আমাদের শ্রমবাজার রয়েছে, সেসব দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতারও বিরূপ প্রভাব পড়েছে এ খাতে। সব কিছু মিলিয়ে নতুন নতুন শ্রমবাজার সন্ধানের তাগিদটা আবার জোরদারভাবে সামনে এলেও এ ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক তেমন কিছু পরিলক্ষিত হচ্ছে না। নির্দিষ্ট কয়েকটি শ্রমবাজারের ওপর নির্ভরতা কী বিপদ ডেকে আনতে পারে_এ অভিজ্ঞতা আমাদের সামনে আছে।
জনশক্তি রপ্তানির পথটি এখনো যথেষ্ট অমসৃণ। কিছুসংখক রিক্রুটিং এজেন্সির অনৈতিক কর্মকাণ্ড, দালালচক্রের হীন স্বার্থ চরিতার্থকরণের অব্যাহত চেষ্টা এবং জনশক্তি রপ্তানির নামে অবৈধভাবে মানুষপাচার ইত্যাদি বিষয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের শ্রমবাজারের যথেষ্ট ক্ষতি এরই মধ্যে করেছে। বাংলাদেশের মতো দারিদ্র্যপীড়িত একটি দেশের জন্য উলি্লখিত বিষয়গুলো বিষফোড়াসম। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের শ্রমিকদের এখনো যথেষ্ট কদর আছে কয়েকটি কারণে। প্রথমত, আমাদের শ্রমিকরা কঠোর শ্রম দিতে পারে; দ্বিতীয়ত, তুলনামূলকভাবে তাদের মজুরি কম। কিন্তু আমাদের রয়েছে দক্ষ শ্রমিকের অভাব। বিশ্বে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে এবং সেদিন খুব দূরে নয়, যেদিন দক্ষ শ্রমিক ছাড়া শ্রমশক্তি রপ্তানি দুরূহ হয়ে পড়বে। তাই দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরি করতে হবে নিজেদের স্বার্থেই।
আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা সঞ্চিতির ক্ষেত্রে যে রেকর্ড তা মূলত এই প্রবাসী-আয়ের সূত্রেই। কিন্তু যখন শোনা যায় সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের জনশক্তি রপ্তানির হার বাড়ছে না, বরং ক্রমাগত কমছে; তখন সংগত কারণেই শঙ্কা জাগে। ক্ষমতাসীন মহাজোট নানা ক্ষেত্রে সাফল্য দেখাতে পারলেও কয়েকটি ক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতার চিত্রও প্রকট। এর মধ্যে জনশক্তি রপ্তানিতে ভাটা, বাজার পরিস্থিতি সাধারণ মানুষের কাছে সহনীয় রাখতে না পারা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উলি্লখিত তিনটি বিষয়ের সঙ্গেই মানুষের জীবনযাত্রার প্রায় সব কিছু যুক্ত। দেশের অভ্যন্তরে শ্রমবাজার সংকুচিত এবং দুঃখজনক হলেও অসংখ্য কর্ম-উপযুক্ত মানুষ কর্মহীন। অশিক্ষিত বেকার তো আছেই, এর সঙ্গে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও ক্রমেই স্ফীত হচ্ছে। এত বিপুলসংখ্যক কর্মহীন মানুষের বোঝা বয়ে চলা দারিদ্র্যপীড়িত একটি দেশের পক্ষে খুবই কঠিন। আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে আমাদের সম্পর্কে কিছু বিরূপ ধারণাও তৈরি হয়েছিল। এর মধ্যে মৌলবাদী কিংবা জঙ্গি তৎপরতা অন্যতম। বর্তমানে তা কিছুটা পাল্টালেও পুরোপুরি কাটেনি। আমরা যারা ব্রিটেনে আছি, তারা বিষয়টি অহরহ টের পাই। কিছুদিন আগে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও মালয়েশিয়ায় গিয়েও এমন ধারণার আঁচ পেয়েছি। আরো একটি বিষয় খুবই অনুতাপের সঙ্গে বলতে হয়, বিদেশে অবস্থিত আমাদের অনেক কূটনৈতিক মিশনের কার্যক্রম সন্তোষজনক নয়। অনেক দেশের দূতাবাসেই আমাদের যোগ্য-দক্ষ লোকের বড় বেশি অভাব রয়েছে। দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় এমন কাজও হচ্ছে। নেপালে সর্বসাম্প্রতিক আমরা এমন চিত্রই দেখলাম। বর্তমানে নেপালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত যেসব কাণ্ডর্কীতি করেছেন তা চরম লজ্জার। দেশের জন্য কল্যাণের পথ প্রশস্ত করা কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা ক্ষেত্র উজ্জ্বল করা কূটনৈতিক মিশনগুলোর বড় দায়িত্ব। আমাদের শ্রমবাজার বিস্তৃত না হওয়ার পেছনে তাদের ব্যর্থতাও কম দায়ী নয়।
মধ্যপ্রাচ্য আমাদের বড় শ্রমবাজার। কিন্তু এই বাজার বিস্তৃত করা তো দূরের কথা, এখন অনেক ক্ষেত্রেই তা সংকুচিত হয়ে পড়ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের শ্রমবাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে নিকট-অতীতেও নিজ উদ্যোগে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যা মিডিয়ার মাধ্যমেই জ্ঞাত হয়েছিলাম। কিন্তু এ কাজটি করার জন্য আরো কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের দায়দায়িত্ব রয়েছে। এসব মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরা কি তাঁদের দায়িত্ব সফলভাবে পালন করতে পারছেন? তাঁরা কি জনশক্তি রপ্তানিকারক নামে পরিচিত কিছু অপকর্মকারীর শিকড় উৎপাটন করতে পেরেছেন? জনশক্তি রপ্তানির নামে অব্যাহতভাবে যেসব তুঘলকি কাণ্ড চলছে, এর যবনিকাপাত ঘটাতে পেরেছেন? এসব প্রশ্নের জবাব সুখকর নয়। সব কিছুই যদি প্রধানমন্ত্রীকে দেখভাল করতে হয়, তাহলে অন্যরা কী করেন? এমন চিত্র একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলজনক নয়।
জনশক্তি রপ্তানি কেন কমে যাচ্ছে, এর কারণ খুঁজে আশু প্রতিকারবিধান জরুরি। নতুন নতুন শ্রমবাজার সন্ধানের কাজটি আরো জরুরি। একইভাবে দক্ষ শ্রমিক তৈরির বিষয়টি গুরুত্বসহকারে আমলে নেওয়া দরকার। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রচুর শ্রমিকের চাহিদা রয়েছে। যত দূর জানি, তাদের দৃষ্টি এখন ভারতের দিকে। কারণ ভারত তাদের আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের ক্ষেত্র বিস্তৃত করার লক্ষ্যে পরিকল্পিত ও দূরদর্শী উদ্যোগ নিয়েছে। ভারত সরকার এ জন্য কয়েকটি বিশেষ দল গঠন করে দেশে দেশে তৎপরতা শুরু করেছে। আমাদেরও এমন পথ অবলম্বন করা খুব দরকার। খুব স্বাভাবিকভাবেই অনুমেয়, জনশক্তি রপ্তানি কমে গেলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান খাত প্রবাসী-আয়ের পরিমাণ কমে যাবে। আমাদের অর্থনীতির জন্য এমন সংবাদ অবশ্যই উদ্বেগজনক। একই সঙ্গে দেখা দেবে সামাজিক নানা সমস্যাও। কাজেই সময় নষ্ট না করে এ ক্ষেত্রে এখনই ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত।
লেখক : লন্ডনপ্রবাসী গবেষক
জনশক্তি রপ্তানির পথটি এখনো যথেষ্ট অমসৃণ। কিছুসংখক রিক্রুটিং এজেন্সির অনৈতিক কর্মকাণ্ড, দালালচক্রের হীন স্বার্থ চরিতার্থকরণের অব্যাহত চেষ্টা এবং জনশক্তি রপ্তানির নামে অবৈধভাবে মানুষপাচার ইত্যাদি বিষয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের শ্রমবাজারের যথেষ্ট ক্ষতি এরই মধ্যে করেছে। বাংলাদেশের মতো দারিদ্র্যপীড়িত একটি দেশের জন্য উলি্লখিত বিষয়গুলো বিষফোড়াসম। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের শ্রমিকদের এখনো যথেষ্ট কদর আছে কয়েকটি কারণে। প্রথমত, আমাদের শ্রমিকরা কঠোর শ্রম দিতে পারে; দ্বিতীয়ত, তুলনামূলকভাবে তাদের মজুরি কম। কিন্তু আমাদের রয়েছে দক্ষ শ্রমিকের অভাব। বিশ্বে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে এবং সেদিন খুব দূরে নয়, যেদিন দক্ষ শ্রমিক ছাড়া শ্রমশক্তি রপ্তানি দুরূহ হয়ে পড়বে। তাই দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরি করতে হবে নিজেদের স্বার্থেই।
আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা সঞ্চিতির ক্ষেত্রে যে রেকর্ড তা মূলত এই প্রবাসী-আয়ের সূত্রেই। কিন্তু যখন শোনা যায় সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের জনশক্তি রপ্তানির হার বাড়ছে না, বরং ক্রমাগত কমছে; তখন সংগত কারণেই শঙ্কা জাগে। ক্ষমতাসীন মহাজোট নানা ক্ষেত্রে সাফল্য দেখাতে পারলেও কয়েকটি ক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতার চিত্রও প্রকট। এর মধ্যে জনশক্তি রপ্তানিতে ভাটা, বাজার পরিস্থিতি সাধারণ মানুষের কাছে সহনীয় রাখতে না পারা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উলি্লখিত তিনটি বিষয়ের সঙ্গেই মানুষের জীবনযাত্রার প্রায় সব কিছু যুক্ত। দেশের অভ্যন্তরে শ্রমবাজার সংকুচিত এবং দুঃখজনক হলেও অসংখ্য কর্ম-উপযুক্ত মানুষ কর্মহীন। অশিক্ষিত বেকার তো আছেই, এর সঙ্গে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও ক্রমেই স্ফীত হচ্ছে। এত বিপুলসংখ্যক কর্মহীন মানুষের বোঝা বয়ে চলা দারিদ্র্যপীড়িত একটি দেশের পক্ষে খুবই কঠিন। আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে আমাদের সম্পর্কে কিছু বিরূপ ধারণাও তৈরি হয়েছিল। এর মধ্যে মৌলবাদী কিংবা জঙ্গি তৎপরতা অন্যতম। বর্তমানে তা কিছুটা পাল্টালেও পুরোপুরি কাটেনি। আমরা যারা ব্রিটেনে আছি, তারা বিষয়টি অহরহ টের পাই। কিছুদিন আগে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও মালয়েশিয়ায় গিয়েও এমন ধারণার আঁচ পেয়েছি। আরো একটি বিষয় খুবই অনুতাপের সঙ্গে বলতে হয়, বিদেশে অবস্থিত আমাদের অনেক কূটনৈতিক মিশনের কার্যক্রম সন্তোষজনক নয়। অনেক দেশের দূতাবাসেই আমাদের যোগ্য-দক্ষ লোকের বড় বেশি অভাব রয়েছে। দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় এমন কাজও হচ্ছে। নেপালে সর্বসাম্প্রতিক আমরা এমন চিত্রই দেখলাম। বর্তমানে নেপালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত যেসব কাণ্ডর্কীতি করেছেন তা চরম লজ্জার। দেশের জন্য কল্যাণের পথ প্রশস্ত করা কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা ক্ষেত্র উজ্জ্বল করা কূটনৈতিক মিশনগুলোর বড় দায়িত্ব। আমাদের শ্রমবাজার বিস্তৃত না হওয়ার পেছনে তাদের ব্যর্থতাও কম দায়ী নয়।
মধ্যপ্রাচ্য আমাদের বড় শ্রমবাজার। কিন্তু এই বাজার বিস্তৃত করা তো দূরের কথা, এখন অনেক ক্ষেত্রেই তা সংকুচিত হয়ে পড়ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের শ্রমবাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে নিকট-অতীতেও নিজ উদ্যোগে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যা মিডিয়ার মাধ্যমেই জ্ঞাত হয়েছিলাম। কিন্তু এ কাজটি করার জন্য আরো কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের দায়দায়িত্ব রয়েছে। এসব মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরা কি তাঁদের দায়িত্ব সফলভাবে পালন করতে পারছেন? তাঁরা কি জনশক্তি রপ্তানিকারক নামে পরিচিত কিছু অপকর্মকারীর শিকড় উৎপাটন করতে পেরেছেন? জনশক্তি রপ্তানির নামে অব্যাহতভাবে যেসব তুঘলকি কাণ্ড চলছে, এর যবনিকাপাত ঘটাতে পেরেছেন? এসব প্রশ্নের জবাব সুখকর নয়। সব কিছুই যদি প্রধানমন্ত্রীকে দেখভাল করতে হয়, তাহলে অন্যরা কী করেন? এমন চিত্র একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলজনক নয়।
জনশক্তি রপ্তানি কেন কমে যাচ্ছে, এর কারণ খুঁজে আশু প্রতিকারবিধান জরুরি। নতুন নতুন শ্রমবাজার সন্ধানের কাজটি আরো জরুরি। একইভাবে দক্ষ শ্রমিক তৈরির বিষয়টি গুরুত্বসহকারে আমলে নেওয়া দরকার। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রচুর শ্রমিকের চাহিদা রয়েছে। যত দূর জানি, তাদের দৃষ্টি এখন ভারতের দিকে। কারণ ভারত তাদের আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের ক্ষেত্র বিস্তৃত করার লক্ষ্যে পরিকল্পিত ও দূরদর্শী উদ্যোগ নিয়েছে। ভারত সরকার এ জন্য কয়েকটি বিশেষ দল গঠন করে দেশে দেশে তৎপরতা শুরু করেছে। আমাদেরও এমন পথ অবলম্বন করা খুব দরকার। খুব স্বাভাবিকভাবেই অনুমেয়, জনশক্তি রপ্তানি কমে গেলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান খাত প্রবাসী-আয়ের পরিমাণ কমে যাবে। আমাদের অর্থনীতির জন্য এমন সংবাদ অবশ্যই উদ্বেগজনক। একই সঙ্গে দেখা দেবে সামাজিক নানা সমস্যাও। কাজেই সময় নষ্ট না করে এ ক্ষেত্রে এখনই ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত।
লেখক : লন্ডনপ্রবাসী গবেষক
No comments