গদ্যকার্টুন-অজ সংবাদ by আনিসুল হক

ছাগল প্রতিযোগিতা হচ্ছে। গ্রান্ড ফিনালে। রাজ্যের সেরা ছাগল নির্বাচন করা হবে। এই প্রতিযোগিতায় গ্রান্ড চ্যাম্পিয়ন হলো একটি ছাগল। রানার্সআপ হলো আরেকটা। চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ম্যাগি নামের একজন ছাত্রীর ছাগল। ম্যাগি আবার পশুপালন বিদ্যারই ছাত্রী। তার ছোট ভাইয়ের ছাগল হয়েছিল রানার্সআপ।


কিন্তু এক সপ্তাহ পর এই ফল বাতিল বলে ঘোষণা করল রাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস।
কারণ, ডোপ পরীক্ষায় এই ছাগল দুটো উত্তীর্ণ হতে পারেনি।
এই ছাগল দুটো নিষিদ্ধ ড্রাগস সেবন করেছিল।
কাজেই ফল বাতিল।
ঘটনা ঘটেছে আমেরিকার কলোরাডো রাজ্যে। ১৪ অক্টোবর অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের চিঠি প্রতিযোগী ছাগল দুটোর মালিকের হাতে পৌঁছায়। অ্যাটর্নি জেনারেল জানিয়ে দেন, ডোপ পরীক্ষায় পজিটিভ হওয়ায় ছাগল দুটোর চ্যাম্পিয়নশিপ ও রানার্সআপশিপ কেড়ে নেওয়া হলো। খবর এপির।
ওই ছাগল দুটোর মূত্র পরীক্ষার পর রাজ্যের মাদক বিশেষজ্ঞরা স্থির করেন ছাগল দুটো ডোপ-পাপি। তাদের মূত্রে র‌্যাকটোপ্যামাইন নামের নিষিদ্ধ উপাদান পাওয়া গেছে। এই র‌্যাকটোপ্যামাইন শূকরের খাদ্যে থাকতে পারবে, কিন্তু ছাগলের জন্য সেই খাদ্য নিষিদ্ধ।
কথায় বলে, ছাগলে কি না খায়! কিন্তু আমেরিকার ছাগলের পক্ষে যা খুশি তা খাওয়া সম্ভব নয়। যেমন সেখানকার ছাগলের পক্ষে সম্ভব নয় শূকরের খাদ্য খাওয়া।
আমেরিকা আসলেই একটা কৌতুককর দেশ। ওরা ফেসবুকে পাতা খুলেছিল একটা ছাগলের ছবি দিয়ে। পাতার নাম—এই ছাগল কি ওবামার চেয়ে বেশি সমর্থক জোগাড় করতে পারবে? ওই ছাগলের সমর্থকের সংখ্যা হাজারে হাজারে বাড়তে শুরু করেছিল। শেষ পর্যন্ত ফেসবুক কর্তৃপক্ষ ওই ফ্যান পেজটি বন্ধ করে দেয়।
হাস্যকৌতুকের ওয়েবপাতাগুলোর খবর অনুসারে, এ ব্যাপারে হোয়াইট হাউসের মন্তব্য চাওয়া হলে তারা মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানায়।
ওই ছাগলটাকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী করার দাবি ওঠে। এমনকি ওই ছাগলের সঙ্গে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে কে দাঁড়াতে পারে, তা নিয়েও নানা রকমের প্রস্তাব আসতে শুরু করে।
কৌতুককর ওয়েব পাতায় বলা হয়, শেষ পর্যন্ত হোয়াইট হাউসের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে মুখ খোলেন, ‘আমরা জানি, ওবামার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চাইছে ছাগল। এ নিয়ে কথা বলার কী আছে! ছাগল তো ছাগলই।’
কিন্তু ছাগল ছাগল ছাড়া আর কিছু না হোক, তাদের তো একটা দল লাগবে। এই ছাগল কোন দলের টিকিটে নির্বাচন করবে, ডেমোক্রেটিক না রিপাবলিকান, তা নিয়ে গবেষণা ও হাসাহাসি শুরু হয়। রম্য ওয়েবসাইট বলছে, তারা ওই ছাগলের সাক্ষাৎকার চেয়েছিলেন, কিন্তু ছাগলটি তাদের প্রস্তাবে কোনো রকমের সাড়াই দেয়নি।
এখানেই বোধ হয় বাংলাদেশের সঙ্গে আমেরিকার পার্থক্য। বাংলাদেশে সাক্ষাৎকার চাওয়ার আগেই পাওয়া যায়, শুধু তাই না, সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য অনেকেই ছুটে চলে যান মাইক্রোফোনের সামনে।
ওদিকে জার্মানির এক ছাগল খবরের জন্ম দিয়েছে গ্রেপ্তার হয়ে। সে ব্যস্ত রাস্তায় চলে এসেছিল। আর থমকে গিয়েছিল সব যানবাহন। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। আর তার গলায় হাতকড়া পরায়।
আপনাদের মনে হতে পারে, এই লেখকের কী হলো। দুনিয়ার ছাগলের খবর সে একখানে করছে কেন।
আচ্ছা, আচ্ছা, আপনারা কি জর্জ অরওয়েলকে জিজ্ঞেস করবেন, কেন তিনি অ্যানিমেল ফার্ম লিখেছিলেন।
আসলে গদ্যকার্টুনের কোনো বিষয় খুঁজে পাচ্ছি না। চারদিকে, বাস্তব দুনিয়ায়, এত মজার মজার কাণ্ড ঘটছে, এত কৌতুকপ্রদ বাণী প্রচারিত হচ্ছে যে, এখন রম্যলেখকের পক্ষে রম্যরচনা লেখা কঠিন হয়ে পড়েছে। পত্রিকার প্রথম পাতায় যদি সত্যিকারের খবর হিসেবে আপনি গদ্যকার্টুন পাঠ করেন, তাহলে ভেতরের পাতায় কল্পকাহিনি আপনি কেন পড়বেন?
ছাগল নিয়ে ঈশপের কাহিনিটা আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই। এক নেকড়ে একটা গর্তের মধ্যে পড়ে গেল। সে কিছুতেই ওপরে উঠতে পারছে না। তখন ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিল একটা ছাগল। ছাগল উঁকি দিয়ে দেখল, গর্তের মধ্যে একটা নেকড়ে। সে বলল, কী হে নেকড়ে, ওখানে কী করো। নেকড়ে বলল, এটা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জায়গা। আর এখানকার পানি পৃথিবীর সবচেয়ে সুস্বাদু পানি। লাফ দাও। এসে নিজে পান করে দেখো। ছাগলটা এক লাফে গর্তে নামল। নেকড়েটা ছাগলের ঘাড়ে পা রেখে গর্ত থেকে উঠে গেল ওপরে। ঈশপের উপদেশ হলো, ‘লুক বিফোর ইউ লিপ’।
ছাগলের সঙ্গে পাগলের ধ্বনিগত মিল থাকায় ছাগল নিয়ে কথা বলতে গেলেই পাগলের কথা উঠবে। বাংলা প্রবাদ আছে, পাগলে কি না বলে ছাগলে কি না খায়। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, স্কেপগোট। এই শব্দটা ছাগল থেকেই এসেছে, যে নিরীহ লোক/দল/গোষ্ঠী বা দেশের ওপরে কোনো একটা খারাপ কাজের দায় অকারণেই চাপিয়ে দেওয়া হয়। বাংলায় বোধ হয় একেই বলা যায় বলির পাঁঠা।
আর বাঘ শিকারের সময় ছাগল দরকার হয়। ছাগলকে বেঁধে রাখা হয় টোপ হিসেবে। শিকারি লুকিয়ে থাকে নিরাপদ স্থানে, বন্দুক হাতে। ছাগলের ডাকে বিভ্রান্ত হয়ে বাঘ আসা মাত্রই শিকারি গুলি ছোড়ে।
আমাদের এক নেতা বলছেন, পদ্মা সেতুর দুর্নীতি যা হওয়ার হয়েছে আগের সরকারের আমলে, করেছেন আগের সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী। আরেক নেতা বলছেন, নিজামী-সাঈদী-মুজাহিদরা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেননি, বরং আওয়ামী লীগই মুক্তিযুদ্ধ করেনি।
এই প্রেক্ষাপটে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম লিখেছেন, অবশ্যই আমাদের নেতারা ভাবেন আমরা ইডিয়ট (ডেইলি স্টার, ২১ অক্টোবর, ২০১১)।
এ বিষয়ে আমি আর কোনো মন্তব্য করতে চাই না।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.