এইচএসসির ভালো ফল-মেধাবীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দিতে হবে

সারা দেশে এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে গত বুধবার। এবারের ফলাফল অনেক দিক থেকেই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। ফলের প্রায় সব সূচকই যৎসামান্য হলেও এগিয়েছে। এটা প্রমাণ করে যে দেশে শিক্ষার মান কিছুটা হলেও এগিয়েছে। শিক্ষামন্ত্রীও একই দাবি করেছেন।


যেখানে আমরা পিছিয়ে না গেলেই খুশি হই, সেখানে সামান্য অগ্রগতিও আমাদের খুশি করবে, তাতে সন্দেহ নেই। বিশেষ করে দেশের অধিকাংশ শিক্ষাব্যবস্থায় যে ধরনের নৈরাজ্য চলছে, তাতে এই অগ্রগতিকে অপ্রত্যাশিতই বলতে হবে। এ জন্য শিক্ষার্থীদের প্রচেষ্টা এবং পড়ার টেবিলে ফিরে আসার প্রবণতা অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে। তাদের অভিনন্দন জানাই। কাজেই ফল আরো ভালো হলে আরো খুশি হতাম_এ ধরনের কথা না বলে বরং শিক্ষামন্ত্রীকে আমরা বলতে চাই, অগ্রগতির এই ধারা ভবিষ্যতে যেন অটুট থাকে, যেন আরো বেগবান হয়, সেই চেষ্টা অব্যাহত রাখুন।
এইচএসসির ফলাফলে এবার সারা দেশে প্রথম হয়েছে রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত খবরে দেখা যায়, এই কলেজের কয়েক শিক্ষার্থী বলছিল, তারা কেউই কোচিং বা প্রাইভেট টিউশনির আশ্রয় নেয়নি। তারা জানিয়েছে, নিয়মিত ক্লাস করা ছাড়াও শিক্ষকদের সহায়তা এবং আমাদের প্রচেষ্টার ফলেই এত ভালো ফল করা সম্ভব হয়েছে। তাদের সঙ্গে আমরাও সম্পূর্ণ একমত। স্কুল-কলেজগুলোতে যদি ঠিকমতো লেখাপড়া হয়, তাহলে ছাত্ররাও উৎসাহিত হয় ভালো ফলের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে। এক শিক্ষার্থীর মা তো বলেই ফেললেন, এই কলেজের শিক্ষকদের হাতে সন্তানকে ছেড়ে দিয়ে আমরা একরকম নিশ্চিন্ত ছিলাম। মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ছাড়া সারা দেশে যে আটটি শিক্ষা বোর্ড রয়েছে, তার মধ্যে সাতটিতেই প্রথম হয়েছে ক্যাডেট কলেজগুলো। সেখানেও কোচিং-টিউশনির বালাই নেই। শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় তত্ত্বাবধান ও শিক্ষার্থীদের চেষ্টাই ভালো ফল এনে দিয়েছে। সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই চিত্রই কাম্য ছিল। কিন্তু নৈতিকতাবর্জিত কিছু শিক্ষক ছাত্রদের কোচিং ক্লাসে যেতে বাধ্য করার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের উপযুক্ত তত্ত্বাবধান করেন না। শিক্ষামন্ত্রীও বারবার এই প্রবণতার বিরুদ্ধে শিক্ষকদের হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে একমত প্রকাশ করে আমরাও বলতে চাই, এই প্রবণতা যত কমবে, দেশে শিক্ষার মান তত বাড়বে। তারই কিছুটা প্রমাণ এবারের এইচএসসি পরীক্ষা।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও উপেক্ষার ফলে ক্যান্সারের মতো অনেক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষার মান উন্নয়ন করতে হলে সেই সমস্যাগুলো থেকেও আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। তার মধ্যে অন্যতম সমস্যা হচ্ছে, শিক্ষা ভবনের দুর্নীতি, রাজনীতির সঙ্গে শিক্ষকদের বড় বেশি সম্পৃক্ততা ও রাজনৈতিক মেরুকরণ থেকে একেক সময় শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একেকটি ইউনিয়নের সীমাহীন দৌরাত্ম্য এবং নিয়োগ, পদোন্নতিসহ সর্বক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব বিদ্যমান থাকা। এর ফলে যোগ্য শিক্ষকরা বঞ্চিত হন এবং যোগ্য লোকজন শিক্ষকতা পেশায় আসতে পারেন না। সদ্য সমাপ্ত জেলা প্রশাসক সম্মেলনেও সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠেছে যে তাঁরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দিচ্ছেন। পত্রপত্রিকায় এমন অভিযোগ প্রায়ই দেখা যায় যে স্কুল-কলেজভেদে শিক্ষক নিয়োগে পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেওয়া হয় এবং এর সঙ্গে এমপিরা সরাসরি যুক্ত। ঘুষ দিয়ে যাঁরা শিক্ষকতা পেশায় ঢোকেন, তাঁরা আর যা-ই হোন, শিক্ষক হওয়ার যোগ্য নন। এই ধারা যদি চলতে থাকে তাহলে সামগ্রিকভাবে শিক্ষার মান বাড়বে না।
সবশেষে এবারের ফলাফলের আরেকটি দিক উল্লেখ না করলেই নয়। এবার প্রায় সমানসংখ্যক ছাত্র ও ছাত্রী পাস করেছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো সূচক। এই সূচকটি প্রমাণ করে যে আমাদের নারীসমাজ অনেক দূর এগিয়ে এসেছে। মেয়েদের পড়িয়ে কী হবে_অভিভাবকদের সেই মানসিকতারও পরিবর্তন হচ্ছে। পাশাপাশি নারী শিক্ষার্থীসহ মেধাবী শিক্ষার্থীরা যাতে উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ পায় তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আমরা আশা করি, রাষ্ট্র সে ব্যাপারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিয়োজিত করবে।

No comments

Powered by Blogger.