সময়চিত্র-দাতা হাতেম তায়ি by আসিফ নজরুল
হাতেম তায়ির গল্প আমরা পড়েছিলাম ছোটবেলায়। তিনি আরবের গোত্রপতি ছিলেন, কবিতা লিখতেন, অগাধ ধন-সম্পত্তিও ছিল তাঁর। কিন্তু তিনি সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন তাঁর দানশীলতার জন্য। ষষ্ঠ দশকের মানুষ ছিলেন তিনি।
তাঁর দানশীলতার খ্যাতি এতটাই ছিল যে এখনো আমাদের অনেকে কোনো দানবীরকে ‘দাতা হাতেম তায়ি’ বলে সম্বোধন করেন।
ভারতের প্রতি বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের একতরফা মহত্ত্বের প্রকাশ দেখে হাতেম তায়ির কথা মনে পড়ছে। এই মহত্ত্ব দেখানো হচ্ছে নানাভাবে। সীমান্ত চিহ্নিতকরণের নামে কয়েক শ একর জমি পেয়ে ভারতকে বিনিময়ে কয়েক হাজার একর জমি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভারতের পণ্য আর চাকরিজীবীদের জন্য প্রায় একতরফাভাবে খুলে দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের দুয়ার। বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলও ভারত দেখায় না, কিন্তু বাংলাদেশ সয়লাব হয়ে গেছে ভারতের চ্যানেলে!
আমাদের হাতেম তায়ি হওয়া এখানেই থেমে যায়নি। সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর হাতে একতরফাভাবে শত শত বাংলাদেশি নিহত হওয়ার পরও আমাদের সরকার তার মধ্যে বিরাট কোনো অসন্তোষের কারণ খুঁজে পায়নি। বরং গত বছর দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর যৌথ বিবৃতিতে এমনভাবে দুই দেশের বাহিনীর সংযমের কথা বলা হয়েছে, যাতে মনে হবে, আমাদের হাতেও নিহত হচ্ছে বহু ভারতীয়। আবার আমাদের সরকার ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের মামলায় অবসরে থাকা সামরিক ও গোয়েন্দা বাহিনীর এক ডজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে ধরে নিয়ে বিচার করছে। কিন্তু তারা কেউ ভুলেও উচ্চারণ করেনি যে বাংলাদেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে এর চেয়েও বড় যে অপরাধ ভারত একসময় করেছিল, তারও বিচার হওয়া উচিত! বেরুবাড়ী আমরা ভারতকে দিয়েছি কয়েক দশক আগে। বিনিময়ে এই সেদিন ভারত কেবল তিনবিঘা ২৪ ঘণ্টা খুলে রাখতে রাজি হয়েছে, সে-ও মালিকানা নিজের হাতে রেখে দিয়ে। দুই প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতিতে রহনপুর রেললাইনের মাধ্যমে নেপালে পণ্য সরবরাহের জন্য বাংলাদেশকে ট্রানজিট দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। নেপালের পত্রিকা পড়ে জানলাম, এটি নাকি আগেই ছিল। মাঝখানে ব্রডগেজ থেকে মিটারগেজে রূপান্তরের কারণে কয়েক বছর বন্ধ ছিল এ সুবিধা।
ভারতকে প্রায় সর্বস্ব দিয়ে তাহলে কী পেল বাংলাদেশ সরকার? মাত্র ৪৬টি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার? পুরোনো কিছু দায়দায়িত্ব কিয়দংশে পালন (তিনবিঘা) কিংবা তা আবার পালনে রাজি (নেপালে রেল ট্রানজিট) হয়েছে ভারত। আর আমরা দিয়েছি আমাদের যা দেওয়ার ছিল, সবই। এক বাকি ছিল ট্রানজিট। বলা হয়েছিল, সেটি নাকি দেওয়া হবে না তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগি চুক্তি না হলে। তিস্তার পানি আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে আমাদের অধিকার। ট্রানজিট পাওয়া ভারতের অধিকার নয়, প্রত্যাশা। ভারতকে ট্রানজিট না দিলেও ভারতের তাই উচিত ছিল তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা বাংলাদেশকে দেওয়া। নিজের অঞ্চলের মানুষের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তা রুখে দিয়েছেন। আমরা দাতা হাতেম তায়ি! তিস্তার পানির অধিকার পাইনি তো কী হয়েছে, একতরফাভাবেই ভারতকে ট্রানজিট দিতে আদা-জল খেয়ে লেগেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর দুজন উপদেষ্টা। তাঁদের মিশন সফল হয়েছে। ভারতকে নানা ফাঁকফোকর দিয়ে এখন সড়ক ট্রানজিটও দেওয়া হচ্ছে। সে-ও আবার বিনা মাশুলে!
এ দেশে যুগের পর যুগ একশ্রেণীর রাজনীতিক ও বিশেষজ্ঞ প্রচারণা চালিয়েছিলেন, ট্রানজিটের বিনিময়ে বিলিয়ন ডলার উপার্জন করব আমরা। কেউ কেউ এমনও বলেছিলেন যে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুরে পরিণত হয়ে যাবে ট্রানজিট দিলে। চীনসহ সব প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে সম্পৃক্ত করে পুরো এশিয়া আর ইউরোপের সঙ্গে আমাদের সড়ক ও রেল যোগাযোগ হলে আসলেও বিপুল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সম্ভাবনা ছিল আমাদের। কিন্তু এখন ট্রানজিটের নামে দেওয়া হচ্ছে শুধু একটি দেশকে করিডর-সুবিধা। আমাদের তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু তার বিনিময়ে কোটি ডলার কই?
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমান বলছেন, ‘আমরা ট্রানজিট বিষয়ে অভিজ্ঞ না, ভারত ট্রানজিট-সুবিধা ভোগ করুক, অভিজ্ঞতা অর্জন করা হলে আমরা মাশুলের কথা বিবেচনা করব।’ বিংশ শতকে এর চেয়ে বড় হাতেম তায়ি আমরা কোনো রাষ্ট্রে দেখেছি কি? এই হাতেম তায়িকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে হাতেম তায়ি মহত্ত্ব দেখাতেন নিজের ব্যক্তিগত সম্পদ দান করে; কিন্তু বাংলাদেশ কারও ব্যক্তিগত সম্পদ নয়, অনির্বাচিত কোনো উপদেষ্টারও নয়, নির্বাচিত কোনো প্রধানমন্ত্রীরও নয়। এই রাষ্ট্রের পক্ষে এ বিষয়ে করণীয় ঠিক করার জন্য যে কোর কমিটি নিয়োগ করা হয়েছিল, তারাই এখন বলছে, একতরফা ট্রানজিট দেওয়া ঠিক হয়নি। ট্রানজিট দেওয়ার প্রক্রিয়াও চরম অস্বচ্ছ ও প্রশ্নবিদ্ধ।
২.
ভারতকে বাংলাদেশ প্রথম একই সঙ্গে সড়ক ও নৌপথে ট্রানজিট দেয় গত বছর ৩০ নভেম্বর স্বাক্ষরিত একটি স্মারকবলে। বাংলাদেশের পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই স্মারক স্বাক্ষর করেন নৌ চলাচল মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং তা করা হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এড়িয়ে ও রুলস অব বিজনেস লঙ্ঘন করে (ডেইলি স্টার ১ ডিসেম্বর, ২০১০)। আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া হয়ে ত্রিপুরা পালটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য যন্ত্রাংশ পরিবহনের জন্য এ ট্রানজিট দেওয়া হয় কোনো রকম মাশুল ছাড়া। নৌপরিবহনমন্ত্রী তখন বলেছিলেন, মাশুল ও চার্জ পরে নির্ধারণ করা হবে সরকারের উচ্চপর্যায়ের মাধ্যমে। মাশুলের বিষয়ে আর কোনো সিদ্ধান্ত এরপর নেওয়া হয়নি, যদিও ভারতে দৈত্যাকৃতির ওয়ান ডাইমেনশনাল কার্গোর চলাচল শুরু হয় প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে।
এর মধ্যে ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত কোর কমিটি সড়ক, রেল ও নদীপথে ট্রানজিট ফি আদায়ের সুপারিশ করে, যাতে সড়কপথে প্রতি কিলোমিটার টনপ্রতি ৫.২৫ টাকা, রেল ২.২৫ টাকা এবং নৌপথে ১.৮৮ টাকা হারে চার্জ বা ফি আদায়ের সুপারিশ করা হয়। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি, পরিবেশ, অবকাঠামো, কাস্টম, বন্দরব্যবস্থাপনা, রাস্তাঘাট রক্ষণাবেক্ষণ, নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন খরচ বিবেচনা করে কমিটি বলে, এর চেয়ে কম হলে তা হবে দেশের জন্য ক্ষতিকর। কমিটির প্রতিবেদনে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো না থাকায় আগামী তিন বছর পর্যন্ত সড়ক ট্রানজিট না দেওয়ারও সুপারিশ করা হয়েছিল।
সরকারের ভেতরে ক্রিয়াশীল রহস্যময় প্রতাপশালী মহল কোনো কিছুর তোয়াক্কা করেনি। সরকারের গড়া কমিটির সুপারিশও তারা মানেনি। বরং মাত্র কয়েক দিন আগে ভারতকে নিয়মিত ট্রানজিট দেওয়া শুরু করা হয় বিনা মাশুলে। এর সূচনা ঘটে ১৬০ টন লোহাজাতীয় পদার্থ আশুগঞ্জ নৌবন্দর থেকে সড়কপথে আখাউড়া হয়ে আগরতলা যাওয়ার মাধ্যমে। অবকাঠামোবিহীন নৌবন্দর আর ভারী যান চলাচলে অনুপযোগী সড়কে বিনা মাশুলে নিয়মিত ট্রানজিট শুরু করার সমালোচনা করছেন এখন ট্রানজিট-সংক্রান্ত সরকারের কোর কমিটির সদস্যরা। কমিটির সদস্য রহমত উল্লাহ বলেন, ‘নৌ প্রটোকল সংশোধনের সময় মাশুল আরোপ না করা সরকারের একটি বড় ভুল। ফলে, এখন বিনা পয়সায় ভারত ট্রানজিট নিচ্ছে—এটি আমাদের খারাপ লাগছে।’ তিনি আরও বলেন যে অবকাঠামো নেই—এ কথা বলে বিনা মাশুলে ট্রানজিট আটকানো যেত।
ভারতের জন্য একতরফাভাবে লাভবান হওয়ার এই ট্রানজিট-সুবিধার সূত্রপাত হয় গত বছর প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালে। এ সময় ১৯৮০ সালের নৌ ট্রানজিট প্রটোকল নবায়ন বা সংশোধন করার সময় মাশুল আরোপ তো করাই হয়নি, বরং প্রথমবারের মতো ট্রানজিটের জন্য পোর্ট অব কল হিসেবে আশুগঞ্জকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ বিষয়ে সে সময় অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছিলেন, ‘স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে এটি একটি বিরাট ব্যর্থতা। সরকারের ব্যাখ্যা করা উচিত যে কী বিবেচনায় অতিপুরোনো এই প্রটোকলটি গত বছর (২০১০) নবায়ন করার সময় আশুগঞ্জকে অন্তর্ভুক্ত করা হলো এবং বাংলাদেশ এতে কীভাবে লাভবান হলো।’
৩.
আমি ট্রানজিট-বিশেষজ্ঞ নই। বহু পত্রিকা ঘেঁটে এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত পড়ে আমার মনে সাধারণ নাগরিক হিসেবে চারটি প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে, যার উত্তর সরকারের কোনো মহল থেকে এখনো দেওয়া হয়নি। প্রথমত, ১৯৮০ সালের প্রটোকল অন ওয়াটার ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রেড প্রটোকল নবায়নের সময় কাদের সঙ্গে পরামর্শ করে, কোন বিবেচনায় এবং কেন তড়িঘড়ি করে পর্যাপ্ত অবকাঠামো ছাড়াই আশুগঞ্জকে ভারতের জন্য ট্রানজিট-বন্দর হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হলো? দ্বিতীয়ত, ভারতের জন্য অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত লাভবান আশুগঞ্জ-আখাউড়া-আগরতলা নৌ ও সড়ক ট্রানজিটের বিনিময়ে কেন তখনই বাংলাদেশকে মাশুলের কথা তোলা হয়নি? কেন নিজের দেশকে সম্পূর্ণ যৌক্তিক একটি প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা হলো? কারা, কেন এ চরম দায়িত্বহীন ভূমিকা নিয়েছিল? তৃতীয়ত, পর্যাপ্ত নৌবন্দর ও সড়ক অবকাঠামো নেই—এ কারণে এ ট্রানজিট প্রদান বিলম্বিত করলে ২০১২ সালে প্রটোকলটি নবায়ন করার সময় বাংলাদেশ মাশুল চাওয়ার একটি সুযোগ পেত। তড়িঘড়ি করে কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া বিনা ঘোষণায় এবং বিনা মাশুলে ভারতকে নিয়মিত ট্রানজিট দেওয়ায় এ সুযোগও নষ্ট হলো। এর পেছনে কারা দায়ী, কাদের স্বার্থ দেখার জন্য বাংলাদেশের করদাতাদের অর্থে লালন করা হচ্ছে তাদের? চতুর্থত, ভারতের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন যে বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করার জন্য ভারত ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট ফি দিতে প্রস্তুত আছে। ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রীও বাংলাদেশ সফরকালে আন্তর্জাতিক রীতি অনুসারে ভারত সব চার্জ দিতে প্রস্তুত আছে বলেছিলেন। ভারতের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও কেন তাহলে তা করা সম্ভব হলো না?
আমার শেষ প্রশ্নটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জানি, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে সবচেয়ে বড় যে কারণে, তা হচ্ছে ট্রানজিট। ফলে, ভারতের কাছে বহু পাওনা ও প্রত্যাশা আদায়ে এটি আমাদের সবচেয়ে বড় দর-কষাকষি শক্তি। এসব পাওনা ও প্রত্যাশার প্রায় কোনো কিছু না আদায় করে বিনা মাশুলে ভারতকে ট্রানজিট দিয়ে দেওয়া কেমন ধরনের দায়িত্বশীলতা? রাষ্ট্রের সম্পত্তি আর স্বার্থ বিলিয়ে হাতেম তায়ি সাজার অধিকার বাংলাদেশের মানুষ কি কাউকে দিয়েছে?
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ভারতের প্রতি বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের একতরফা মহত্ত্বের প্রকাশ দেখে হাতেম তায়ির কথা মনে পড়ছে। এই মহত্ত্ব দেখানো হচ্ছে নানাভাবে। সীমান্ত চিহ্নিতকরণের নামে কয়েক শ একর জমি পেয়ে ভারতকে বিনিময়ে কয়েক হাজার একর জমি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভারতের পণ্য আর চাকরিজীবীদের জন্য প্রায় একতরফাভাবে খুলে দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের দুয়ার। বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলও ভারত দেখায় না, কিন্তু বাংলাদেশ সয়লাব হয়ে গেছে ভারতের চ্যানেলে!
আমাদের হাতেম তায়ি হওয়া এখানেই থেমে যায়নি। সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর হাতে একতরফাভাবে শত শত বাংলাদেশি নিহত হওয়ার পরও আমাদের সরকার তার মধ্যে বিরাট কোনো অসন্তোষের কারণ খুঁজে পায়নি। বরং গত বছর দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর যৌথ বিবৃতিতে এমনভাবে দুই দেশের বাহিনীর সংযমের কথা বলা হয়েছে, যাতে মনে হবে, আমাদের হাতেও নিহত হচ্ছে বহু ভারতীয়। আবার আমাদের সরকার ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের মামলায় অবসরে থাকা সামরিক ও গোয়েন্দা বাহিনীর এক ডজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে ধরে নিয়ে বিচার করছে। কিন্তু তারা কেউ ভুলেও উচ্চারণ করেনি যে বাংলাদেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে এর চেয়েও বড় যে অপরাধ ভারত একসময় করেছিল, তারও বিচার হওয়া উচিত! বেরুবাড়ী আমরা ভারতকে দিয়েছি কয়েক দশক আগে। বিনিময়ে এই সেদিন ভারত কেবল তিনবিঘা ২৪ ঘণ্টা খুলে রাখতে রাজি হয়েছে, সে-ও মালিকানা নিজের হাতে রেখে দিয়ে। দুই প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতিতে রহনপুর রেললাইনের মাধ্যমে নেপালে পণ্য সরবরাহের জন্য বাংলাদেশকে ট্রানজিট দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। নেপালের পত্রিকা পড়ে জানলাম, এটি নাকি আগেই ছিল। মাঝখানে ব্রডগেজ থেকে মিটারগেজে রূপান্তরের কারণে কয়েক বছর বন্ধ ছিল এ সুবিধা।
ভারতকে প্রায় সর্বস্ব দিয়ে তাহলে কী পেল বাংলাদেশ সরকার? মাত্র ৪৬টি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার? পুরোনো কিছু দায়দায়িত্ব কিয়দংশে পালন (তিনবিঘা) কিংবা তা আবার পালনে রাজি (নেপালে রেল ট্রানজিট) হয়েছে ভারত। আর আমরা দিয়েছি আমাদের যা দেওয়ার ছিল, সবই। এক বাকি ছিল ট্রানজিট। বলা হয়েছিল, সেটি নাকি দেওয়া হবে না তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগি চুক্তি না হলে। তিস্তার পানি আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে আমাদের অধিকার। ট্রানজিট পাওয়া ভারতের অধিকার নয়, প্রত্যাশা। ভারতকে ট্রানজিট না দিলেও ভারতের তাই উচিত ছিল তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা বাংলাদেশকে দেওয়া। নিজের অঞ্চলের মানুষের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তা রুখে দিয়েছেন। আমরা দাতা হাতেম তায়ি! তিস্তার পানির অধিকার পাইনি তো কী হয়েছে, একতরফাভাবেই ভারতকে ট্রানজিট দিতে আদা-জল খেয়ে লেগেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর দুজন উপদেষ্টা। তাঁদের মিশন সফল হয়েছে। ভারতকে নানা ফাঁকফোকর দিয়ে এখন সড়ক ট্রানজিটও দেওয়া হচ্ছে। সে-ও আবার বিনা মাশুলে!
এ দেশে যুগের পর যুগ একশ্রেণীর রাজনীতিক ও বিশেষজ্ঞ প্রচারণা চালিয়েছিলেন, ট্রানজিটের বিনিময়ে বিলিয়ন ডলার উপার্জন করব আমরা। কেউ কেউ এমনও বলেছিলেন যে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুরে পরিণত হয়ে যাবে ট্রানজিট দিলে। চীনসহ সব প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে সম্পৃক্ত করে পুরো এশিয়া আর ইউরোপের সঙ্গে আমাদের সড়ক ও রেল যোগাযোগ হলে আসলেও বিপুল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সম্ভাবনা ছিল আমাদের। কিন্তু এখন ট্রানজিটের নামে দেওয়া হচ্ছে শুধু একটি দেশকে করিডর-সুবিধা। আমাদের তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু তার বিনিময়ে কোটি ডলার কই?
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমান বলছেন, ‘আমরা ট্রানজিট বিষয়ে অভিজ্ঞ না, ভারত ট্রানজিট-সুবিধা ভোগ করুক, অভিজ্ঞতা অর্জন করা হলে আমরা মাশুলের কথা বিবেচনা করব।’ বিংশ শতকে এর চেয়ে বড় হাতেম তায়ি আমরা কোনো রাষ্ট্রে দেখেছি কি? এই হাতেম তায়িকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে হাতেম তায়ি মহত্ত্ব দেখাতেন নিজের ব্যক্তিগত সম্পদ দান করে; কিন্তু বাংলাদেশ কারও ব্যক্তিগত সম্পদ নয়, অনির্বাচিত কোনো উপদেষ্টারও নয়, নির্বাচিত কোনো প্রধানমন্ত্রীরও নয়। এই রাষ্ট্রের পক্ষে এ বিষয়ে করণীয় ঠিক করার জন্য যে কোর কমিটি নিয়োগ করা হয়েছিল, তারাই এখন বলছে, একতরফা ট্রানজিট দেওয়া ঠিক হয়নি। ট্রানজিট দেওয়ার প্রক্রিয়াও চরম অস্বচ্ছ ও প্রশ্নবিদ্ধ।
২.
ভারতকে বাংলাদেশ প্রথম একই সঙ্গে সড়ক ও নৌপথে ট্রানজিট দেয় গত বছর ৩০ নভেম্বর স্বাক্ষরিত একটি স্মারকবলে। বাংলাদেশের পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই স্মারক স্বাক্ষর করেন নৌ চলাচল মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং তা করা হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এড়িয়ে ও রুলস অব বিজনেস লঙ্ঘন করে (ডেইলি স্টার ১ ডিসেম্বর, ২০১০)। আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া হয়ে ত্রিপুরা পালটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য যন্ত্রাংশ পরিবহনের জন্য এ ট্রানজিট দেওয়া হয় কোনো রকম মাশুল ছাড়া। নৌপরিবহনমন্ত্রী তখন বলেছিলেন, মাশুল ও চার্জ পরে নির্ধারণ করা হবে সরকারের উচ্চপর্যায়ের মাধ্যমে। মাশুলের বিষয়ে আর কোনো সিদ্ধান্ত এরপর নেওয়া হয়নি, যদিও ভারতে দৈত্যাকৃতির ওয়ান ডাইমেনশনাল কার্গোর চলাচল শুরু হয় প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে।
এর মধ্যে ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত কোর কমিটি সড়ক, রেল ও নদীপথে ট্রানজিট ফি আদায়ের সুপারিশ করে, যাতে সড়কপথে প্রতি কিলোমিটার টনপ্রতি ৫.২৫ টাকা, রেল ২.২৫ টাকা এবং নৌপথে ১.৮৮ টাকা হারে চার্জ বা ফি আদায়ের সুপারিশ করা হয়। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি, পরিবেশ, অবকাঠামো, কাস্টম, বন্দরব্যবস্থাপনা, রাস্তাঘাট রক্ষণাবেক্ষণ, নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন খরচ বিবেচনা করে কমিটি বলে, এর চেয়ে কম হলে তা হবে দেশের জন্য ক্ষতিকর। কমিটির প্রতিবেদনে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো না থাকায় আগামী তিন বছর পর্যন্ত সড়ক ট্রানজিট না দেওয়ারও সুপারিশ করা হয়েছিল।
সরকারের ভেতরে ক্রিয়াশীল রহস্যময় প্রতাপশালী মহল কোনো কিছুর তোয়াক্কা করেনি। সরকারের গড়া কমিটির সুপারিশও তারা মানেনি। বরং মাত্র কয়েক দিন আগে ভারতকে নিয়মিত ট্রানজিট দেওয়া শুরু করা হয় বিনা মাশুলে। এর সূচনা ঘটে ১৬০ টন লোহাজাতীয় পদার্থ আশুগঞ্জ নৌবন্দর থেকে সড়কপথে আখাউড়া হয়ে আগরতলা যাওয়ার মাধ্যমে। অবকাঠামোবিহীন নৌবন্দর আর ভারী যান চলাচলে অনুপযোগী সড়কে বিনা মাশুলে নিয়মিত ট্রানজিট শুরু করার সমালোচনা করছেন এখন ট্রানজিট-সংক্রান্ত সরকারের কোর কমিটির সদস্যরা। কমিটির সদস্য রহমত উল্লাহ বলেন, ‘নৌ প্রটোকল সংশোধনের সময় মাশুল আরোপ না করা সরকারের একটি বড় ভুল। ফলে, এখন বিনা পয়সায় ভারত ট্রানজিট নিচ্ছে—এটি আমাদের খারাপ লাগছে।’ তিনি আরও বলেন যে অবকাঠামো নেই—এ কথা বলে বিনা মাশুলে ট্রানজিট আটকানো যেত।
ভারতের জন্য একতরফাভাবে লাভবান হওয়ার এই ট্রানজিট-সুবিধার সূত্রপাত হয় গত বছর প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালে। এ সময় ১৯৮০ সালের নৌ ট্রানজিট প্রটোকল নবায়ন বা সংশোধন করার সময় মাশুল আরোপ তো করাই হয়নি, বরং প্রথমবারের মতো ট্রানজিটের জন্য পোর্ট অব কল হিসেবে আশুগঞ্জকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ বিষয়ে সে সময় অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছিলেন, ‘স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে এটি একটি বিরাট ব্যর্থতা। সরকারের ব্যাখ্যা করা উচিত যে কী বিবেচনায় অতিপুরোনো এই প্রটোকলটি গত বছর (২০১০) নবায়ন করার সময় আশুগঞ্জকে অন্তর্ভুক্ত করা হলো এবং বাংলাদেশ এতে কীভাবে লাভবান হলো।’
৩.
আমি ট্রানজিট-বিশেষজ্ঞ নই। বহু পত্রিকা ঘেঁটে এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত পড়ে আমার মনে সাধারণ নাগরিক হিসেবে চারটি প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে, যার উত্তর সরকারের কোনো মহল থেকে এখনো দেওয়া হয়নি। প্রথমত, ১৯৮০ সালের প্রটোকল অন ওয়াটার ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রেড প্রটোকল নবায়নের সময় কাদের সঙ্গে পরামর্শ করে, কোন বিবেচনায় এবং কেন তড়িঘড়ি করে পর্যাপ্ত অবকাঠামো ছাড়াই আশুগঞ্জকে ভারতের জন্য ট্রানজিট-বন্দর হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হলো? দ্বিতীয়ত, ভারতের জন্য অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত লাভবান আশুগঞ্জ-আখাউড়া-আগরতলা নৌ ও সড়ক ট্রানজিটের বিনিময়ে কেন তখনই বাংলাদেশকে মাশুলের কথা তোলা হয়নি? কেন নিজের দেশকে সম্পূর্ণ যৌক্তিক একটি প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা হলো? কারা, কেন এ চরম দায়িত্বহীন ভূমিকা নিয়েছিল? তৃতীয়ত, পর্যাপ্ত নৌবন্দর ও সড়ক অবকাঠামো নেই—এ কারণে এ ট্রানজিট প্রদান বিলম্বিত করলে ২০১২ সালে প্রটোকলটি নবায়ন করার সময় বাংলাদেশ মাশুল চাওয়ার একটি সুযোগ পেত। তড়িঘড়ি করে কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া বিনা ঘোষণায় এবং বিনা মাশুলে ভারতকে নিয়মিত ট্রানজিট দেওয়ায় এ সুযোগও নষ্ট হলো। এর পেছনে কারা দায়ী, কাদের স্বার্থ দেখার জন্য বাংলাদেশের করদাতাদের অর্থে লালন করা হচ্ছে তাদের? চতুর্থত, ভারতের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন যে বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করার জন্য ভারত ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট ফি দিতে প্রস্তুত আছে। ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রীও বাংলাদেশ সফরকালে আন্তর্জাতিক রীতি অনুসারে ভারত সব চার্জ দিতে প্রস্তুত আছে বলেছিলেন। ভারতের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও কেন তাহলে তা করা সম্ভব হলো না?
আমার শেষ প্রশ্নটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জানি, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে সবচেয়ে বড় যে কারণে, তা হচ্ছে ট্রানজিট। ফলে, ভারতের কাছে বহু পাওনা ও প্রত্যাশা আদায়ে এটি আমাদের সবচেয়ে বড় দর-কষাকষি শক্তি। এসব পাওনা ও প্রত্যাশার প্রায় কোনো কিছু না আদায় করে বিনা মাশুলে ভারতকে ট্রানজিট দিয়ে দেওয়া কেমন ধরনের দায়িত্বশীলতা? রাষ্ট্রের সম্পত্তি আর স্বার্থ বিলিয়ে হাতেম তায়ি সাজার অধিকার বাংলাদেশের মানুষ কি কাউকে দিয়েছে?
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments