স্মরণ-বিদ্যাসাগর : একজন সফল শিক্ষানুরাগী ও সমাজসংস্কারক by ইতি চক্রবর্তী
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মেদিনীপুর জেলায় এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই তিনি কলকাতায় নিজ বাড়িতে পরলোকগমন করেন। ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভগবতী দেবীর সন্তান ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর চরম দারিদ্র্যের মধ্যে তাঁর শৈশব ও কৈশোর অতিবাহিত করেন।
তবু শিক্ষাজীবনের শুরুতেই তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন এবং পরে উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় চলে যান। সেখানে গিয়েও তিনি অসাধারণ মেধার পরিচয় দেন। তাঁর মেধার স্বীকৃতিস্বরূপ ইংরেজ সরকার তাঁকে 'বিদ্যাসাগর' উপাধি দেয়। ১৮৪১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। এরপর তিনি ১৮৫১ সালে সংস্কৃত কলেজে অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। ১৮৫৫ সালের জানুয়ারি মাসে 'বিধবা বিবাহ উচিত কি না' বিষয়ে প্রস্তাবসংক্রান্ত প্রথম বই লেখেন। তিনি তাঁর ওই বইয়ে বিভিন্ন শাস্ত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে দেখান যে কলিযুগে বিধবা বিবাহ পুরোপুরি শাস্ত্রসম্মত। বইটিতে বিদ্যাসাগরের তুলে ধরা শাস্ত্রবচন এবং সেগুলোর ব্যাখ্যা এমন যুক্তিসিদ্ধ ও অকাট্য ছিল যে এর ফলে রক্ষণশীল পণ্ডিতরা রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। অন্যদিকে বিধবা বিবাহের সমর্থকরা এই বইয়ে খুঁজে পান তাঁদের বক্তব্যের অখণ্ডনীয় শাস্ত্রীয় সমর্থন। এ বই একাধারে রক্ষণশীল পণ্ডিতদের মনে ব্যাপক উত্তেজনা, অন্যদিকে প্রগতিশীলদের মনে বিপুল উৎসাহের জন্ম দেয়। এই বইয়ের প্রতিবাদে রক্ষণশীল পণ্ডিতরা অনেক বই লেখেন। সেগুলোর উত্তর বিদ্যাসাগর ১৮৫৫ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত বিধবা বিবাহ বিষয়ক দ্বিতীয় বই রচনার মধ্য দিয়ে দেন। তার পরও রক্ষণশীলরা থেমে থাকেননি। তাঁরাও আবার পাল্টা বই রচনা শুরু করেন এবং এর সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০-এ। বিদ্যাসাগরের দ্বিতীয় বই বেরোনোর পর তাঁর যুক্তি ও তথ্যের দৃঢ়তার জন্য বিরোধী পণ্ডিতরা বেকায়দায় পড়ে যান। বিধবা বিবাহের পক্ষে সামাজিক আন্দোলন ব্যাপক জোরদার হয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কেবল এর পক্ষে বই লিখেই ক্ষান্ত হননি, এ বিষয়ে আইন প্রণয়নের চেষ্টায়ও তিনি তৎপর হয়ে ওঠেন। সমাজের সুপরিচিত ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বেশির ভাগই আইন প্রণয়নের পক্ষে থাকায় ব্যবস্থাপক সভা ১৮৫৬ সালের ১৯ জুলাই বিধবা বিবাহ আইন পাস করে। গভর্নর জেনারেল আইনটি অনুমোদন করেন ১৮৫৬ সালের ২৫ জুলাই। কিন্তু আইন হলেও বাস্তবে বিধবা বিবাহ প্রচলন সহজ হয়নি। নোয়াখালী, মেদিনীপুর ও শান্তিপুরে বিধবা বিবাহের পক্ষে ব্যাপক সমর্থন মিললেও বাস্তবে তা রূপ দেওয়া কঠিনই থেকে যায়। তবু প্রচেষ্টা থেমে থাকেনি। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৫৬ সালের ৭ ডিসেম্বর আইন প্রণয়নের প্রায় সাড়ে চার মাস পর সমর্থকদের প্রচেষ্টায় প্রথম আইনসম্মত বিধবা বিবাহ হয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, 'বেঁচে থাক বিদ্যাসাগর'_এমন গান তখনকার দিনে মানুষের মুখে মুখে শোনা যেত। ১৮৬৭ সাল পর্যন্ত ৬০টি বিধবা বিবাহ দিতে গিয়ে বিদ্যাসাগর ৫০ হাজার টাকা ঋণ করেন। নারীশিক্ষার জন্য বিদ্যাসাগর আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। ১৮৫৭-৫৮ সালের মধ্যে তিনি ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। তাঁর অকুতোভয় ও নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা হিন্দুসমাজ তথা উপমহাদেশের সমাজ সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। পত্রপত্রিকা সম্পাদনা ও পরিচালনার ক্ষেত্রেও তাঁর ব্যাপক ভূমিকা ছিল। 'সর্বশুভকরী', 'তত্ত্ববোধিনী', 'সোমপ্রকাশ' প্রভৃতি তাঁর সম্পাদনারই ফসল। এ ছাড়া বিদ্যাসাগর রচনা করে গেছেন আরো বেশ কিছু অনবদ্য গ্রন্থ। এই রচনাগুলোর মধ্যে 'বেতাল পঞ্চবিংশতি' (১৮৪৭), 'বাংলার ইতিহাস' (১৮৪৮), 'জীবনচরিত' (১৮৪৯), 'বোধোদয়' (১৮৫১), 'শকুন্তলার উপাখ্যান' (১৮৫৪) 'বিধবা বিবাহ' (১৮৫৫) ও 'ভ্রান্তিবিলাস' (১৮৬৯) উল্লেখযোগ্য। তিনি তাঁর কৃতকর্মের জন্য উপমহাদেশের সবার মনে আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন। গভীর শ্রদ্ধায় তাঁকে স্মরণ করি।
ইতি চক্রবর্তী
ইতি চক্রবর্তী
No comments