সমবায়-সংস্কারের ইতিবাচক উদ্যোগ
সমবায় এখন দেশে একটি রুগ্ণ খাত হিসেবেই চিহ্নিত। অথচ নিকট অতীতেও সমবায় সমিতিগুলোর অবস্থা ছিল রমরমা। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সমবায় সমিতিগুলোর ইতিবাচক ভূমিকাও ছিল। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, দেশের প্রায় ৮০ হাজার সমবায় বন্ধ হয়ে গেছে।
শতকরা হিসাবে প্রায় ৪৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্বই নেই। সমবায়ের এই দুরবস্থার পেছনের কারণও এই সমীক্ষায় বেরিয়ে এসেছে। সমিতিগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও দলাদলির প্রসঙ্গ বিশেষভাবে উলি্লখিত হয়েছে। গবেষকরা মনে করেন_ সমবায় আন্দোলনের রুগ্ণ দশায় উপনীত হওয়ার পেছনে আছে আরও বেশ কিছু কারণ। ব্যাংকিং খাতের বিকাশের ফলে ব্যাংকগুলোই অনিবার্য বিকল্প হয়ে উঠেছে গ্রাহকদের কাছে। অনেক ক্ষেত্রেই সমবায় পুরনো ধারণা হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। আগে ছোট ব্যবসায়ী, পেশাজীবী গোষ্ঠীর মধ্যে যে সমবায় উদ্যোগগুলোর কথা শোনা যেত তা এখন আর দেখা যায় না। ফলে সমবায় আন্দোলন এখন স্তিমিত। অনেক ক্ষেত্রে সমবায় সমিতিগুলো আবার ব্যাংকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে এমন বেশ কিছু উদাহরণ দেখা গেছে, যেখানে সমবায় সমিতিগুলো যেনতেন প্রকারে আমানত সংগ্রহ করে ব্যাংকগুলোর মতো ঋণ-ব্যবসা শুরু করেছে। এর ফলে সমবায়গুলো তার দায়িত্ব থেকে সরে গিয়ে তাৎক্ষণিক মুনাফা সংগ্রহের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রেও সমবায়গুলোর ঝোঁক বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে। ছোট বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণের আগ্রহ বেশ কম। এ প্রবণতা সমবায়ের মূল উদ্দেশ্যকেই ব্যাহত করছে। ফলে একটি যুগোপযোগী আইনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছিল দীর্ঘদিন ধরে। এবার সরকার আমানত সংগ্রহের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে কঠোর আইন করার উদ্যোগ নিয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এর মাধ্যমে যেনতেন প্রক্রিয়ায় আমানত সংগ্রহ ও ব্যাংকিং ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব হবে। সমবায়গুলো সদস্যদের বাইরে আমানত সংগ্রহ করতে পারবে না। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে খাতগুলো চিহ্নিত করা ও আইনগত বাধ্যবাধকতা তৈরিও সমবায়গুলোকে প্রত্যাশিত ভূমিকা পালনে সহায়তা করবে আশা করা যায়। নতুন আইন প্রণয়নের জন্য সরকারের এমন উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়। সমবায়কে তার আওতা ও দায়িত্বের মধ্যে ফিরিয়ে আনার জন্য উদ্যোগগুলো অব্যাহত রাখতে হবে। সারা পৃথিবীতেই যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সমবায় ধারণায় পরিবর্তন এসেছে। অথচ নতুন ধারণাগুলোর প্রয়োগ আমাদের সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলোতে হয়নি। হিসাব ব্যবস্থাপনা ও অডিট প্রক্রিয়াতেও দুর্বলতা দেখা দিয়েছে। সমবায় অধিদফতরও একটি পিছিয়ে পড়া প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ভিত্তিতে আধুনিক সমবায় ব্যবস্থাপনা রপ্ত হলে অধিদফতর হয়তো এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারত। সমবায় ব্যবস্থা নতুন করে গড়ে তোলার জন্য এখন অধিদফতরে সংস্কার দরকার। আশার কথা, অধিদফতরের প্রয়োজনীয় সংস্কারের ব্যাপারে সরকার উদ্যোগী হয়েছে। নতুন আইনে এগুলোর বিষয়ে সরকারের মনোযোগের প্রমাণ মিলছে। আমরা আশা করি, নতুন আইন প্রণয়নের পর তা প্রয়োগের ব্যাপারে সরকার উদ্যোগী হবে। নতুন আইনের মাধ্যমে এ ক্ষেত্রে চলমান অনিয়ম যেমন দূর হবে, তেমনি সমবায় আন্দোলনে যে স্তিমিত ভাব কাজ করছিল তা দূর হবে। ছোট ছোট সঞ্চয় একত্রিত করে বড় অর্থনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে সমবায়ের বিকল্প নেই। শুধু সঞ্চয় নয়, নাগরিকদের মধ্যে ঐক্য, সংহতি ও নিকট সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে সমবায়ের রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। এসব দিকে সমবায় আন্দোলনের গতিমুখ ফেরাতে পারলে সেটি বৃহত্তর কল্যাণ বয়ে আনবে।
No comments