মরিয়ম মুরমু হত্যাকাণ্ড এবং কিছু প্রশ্ন by মিথুশিলাক মুরমু
জুলাই মাসের ১১ তারিখে দেশের জাতীয় পর্যায়ের দৈনিক পত্র-পত্রিকার অন্যতম শিরোনাম ছিল, 'খুনের পর আদিবাসী নারীর লাশ গাছে বেঁধে রাখা হলো' (দৈনিক প্রথম আলো); 'গোদাগাড়ীতে আদিবাসী বিধবা খুন, গাছের সঙ্গে বাঁধা বিবস্ত্র লাশ উদ্ধার' (দৈনিক জনকণ্ঠ); 'আদিবাসী মহিলাকে হত্যার পর লাশ গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখল দুর্বৃত্তরা' (দৈনিক আমাদের সময়); 'রাজশাহীতে আদিবাসী নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা' (দৈনিক সমকাল); 'ঝধহঃধষ ড়িসবহ সঁৎফবৎবফ, ষধহফ
ফরংঢ়ঁঃব রিঃয রহ ষধংি ধষষবমবফ' (উধরষু ঝঃধৎ); 'ওহফরমবহড়ঁং ড়িসবহ শরষষবফ রহ জধলংযধযর' (উধরষু ঝঁহ); স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, 'পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ঘটনাস্থল পরিদর্শন, গোদাগাড়ীতে আদিবাসী এক বিধবা মহিলাকে ধর্ষণ করে হত্যা ও বাড়িঘর লুট করেছে দুর্বৃত্তরা' (দৈনিক নতুন প্রভাত); 'গোদাগাড়ীতে স্বামী পরিত্যক্তা আদিবাসীকে ধর্ষণের পর হত্যা' (দৈনিক সানসাইন)।
আমার মেজ বোন মরিয়ম মুরমুকে (৫৮) ৯ জুলাই রাতে কে বা কারা এসে নির্মমভাবে হত্যার পর বিবস্ত্র করে গাছে ঝুলিয়ে রেখে পালিয়ে যায়। বোনের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে আমি ১০ জুলাই হরতালের মধ্যেও ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হই। গ্রামের বাড়ি যখন পেঁৗছলাম, তখন সময় আনুমানিক বিকেল ৪টা। ইতিপূর্বেই রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পোস্টমর্টেমের জন্য লাশ প্রেরণ করা হয়। সন্ধ্যা নাগাদ বোনের লাশ গ্রামে আনা হয় এবং ধর্মীয়ভাবে শেষকৃত্যানুষ্ঠান সম্পন্ন করার পর গ্রামের কবরস্থানে তাঁকে কবরস্থ করা হয়। মরিয়ম মুরমুর হত্যাকাণ্ড জন্ম দিয়েছে অনেক প্রশ্ন, আশঙ্কা এবং ভবিষ্যতের অশনি সংকেত।
আমাদের বাবা রাজেন মুরমুর লিখে যাওয়া পারিবারিক ইতিহাসে মরিয়ম মুরমুর জন্মসাল রয়েছে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দ। ছয় ভাইবোনের মধ্যে মরিয়ম ছিল দ্বিতীয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজশাহী নগরীতে অবস্থিত বোলনপুর মিশন বালিকা বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী ছিলেন মরিয়ম। মুক্তিযুদ্ধের দামামা শুরু হলে পরিবারের সঙ্গেই পার্শ্ববর্তী ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেন। মাতৃভূমি স্বাধীন হলে আমাদের পুরো পরিবার প্রত্যাবর্তন করে এবং রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী থানার শিমলা দিঘিপাড়া গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে। বড় বোন বিহলা মুরমুর বিয়ের পর মরিয়ম মুরমুর বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় একই জেলার তানোর থানার চৈতপুর গ্রামের শীতল মারাণ্ডির পুত্র হোপনা মারাণ্ডির সঙ্গে। পরিবারটিতে নতুন অতিথি হিসেবে উইলসন মারাণ্ডি ও কল্পনা মারাণ্ডির আগমন ঘটে। পারিবারিক অশান্তির কারণে একপর্যায়ে মরিয়ম মুরমু অবুঝ সন্তানদের নিয়ে আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নেন। আমাদের পরিবারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় উইলসন মারাণ্ডি উচ্চ মাধ্যমিক এবং কল্পনা মারাণ্ডি দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করার পরই উইলসন চাকরিতে ঢোকে এবং গোদাগাড়ী থানার তালঠিপাড়া গ্রামের প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা মাতি কিস্কুর মেয়ের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। কল্পনা মারাণ্ডিকে নওগাঁর পত্নীতলা পাটিচরা গ্রামে বিয়ে দেওয়া হয়। সন্তানদের প্রতি সামাজিক দায়িত্বের প্রাথমিক ধাপ তিনি অতি সাহসিকতার সঙ্গেই পেরিয়েছেন। স্বামীহারা এক সাঁওতাল নারীর পক্ষে সত্যিই এটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। দুষ্টেরা অদৃষ্টে হাসতে চেয়েছিল কিন্তু ঈশ্বরের করুণায় সে যুদ্ধে মরিয়ম বিজয়ী হয়েছেন। আমার বোন মরিয়ম মুরমুর স্বামী হোপনা মারাণ্ডি ইহলোক ত্যাগ করলে পৈতৃক সম্পত্তিতে পুুত্র উইলসন মারাণ্ডির অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সোচ্চার হয় এবং স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় ক্রমেই তা এগিয়ে যাচ্ছিল। আমরা জেনেছি, মরিয়ম মুরমুর তৎপরতায় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার এবং স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি তাঁর অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে উজ্জীবিত হয়েছিলেন। প্রত্যেকেই বিধবা নারী মরিয়মকে সাহায্যের জন্য দুই হাত প্রসারিত করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। একজন বিধবা সাঁওতাল নারীর এহেন সাহসিকতা অনেককেই মোহিত করেছে। আমাদের বোন মরিয়ম মুরমুর ছিল ভালোবাসাপূর্ণ হৃদয়। তিনি খুবই স্পষ্টভাষী ছিলেন এবং যুক্তিসঙ্গত কথা বলতেন। বিশ্বস্তভাবে টাকা-পয়সা লেনদেন করতেন। যখনই প্রতিবেশীরা তাঁর কাছে পরিবারের প্রয়োজনে ছুটে এসেছেন, তিনি হস্ত প্রসারিত করতে দ্বিধাবোধ করেননি।
এলাকার দুর্বৃত্তরা সূক্ষ্মভাবে হিসাব কষে স্থির করেছে যে উঠতি পরিবারটিকে নিশ্চিহ্ন, সামাজিক বিভক্তি সৃষ্টি, গ্রামের সামগ্রিক উন্নয়ন সাধন বাধাগ্রস্ত এবং এলাকায় ত্রাস ও ভীতির সঞ্চার করতে নিরীহ রাজেন মুরমুর পরিবারকেই বলিরূপে চিহ্নিত করা দরকার। উল্লেখ্য, এ অঞ্চলে শিমলা দিঘিপাড়া একটি উচ্চশিক্ষিত গ্রাম। যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত হলেও আধুনিকতার ছোঁয়া রয়েছে গ্রামটিতে। দুর্বৃত্তরা নিখুঁত হিসাব কষে, আতঙ্ক ছড়াতে মরিয়ম মুরমুকে নৃশংসভাবে হত্যার পর উলঙ্গ করে গাছের ডালের সঙ্গে ফাঁসির ঘটনা সাজিয়েছে। আমরা মনে করি, এই দুর্বৃত্তরা শতভাগ সফল হয়েছে। মরিয়ম মুরমুকে লজ্জাজনক মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে পরিবারের বৃদ্ধ মা-বাবাকে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। পরিবারের আলোচনা সাপেক্ষে তৃতীয় বোন দুলালী মুরমুর শ্বশুরবাড়ি একই থানার দোগাছি গ্রামে বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পুরো পরিবারটি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন এবং স্থানচ্যুত হয়েছে, শিমলা দিঘিপাড়া গ্রামের অধিবাসীরা বহুধা বিভক্ত; সেখানে উন্নয়নের চাকা স্থবির করা হয়েছে। বাংলাদেশের নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে ভয়ভীতি ও অনিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তার অভাববোধ প্রচণ্ডভাবে দেখা দিয়েছে। রাজশাহীর গোদাগাড়ী-তানোর থানা এলাকায় এ বছর নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন তৎপরতা চালালেও আসামিদের একজনকেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বিচারের রায় শোনানো হয়নি। নৃ-গোষ্ঠীগুলো প্রচণ্ডভাবে আতঙ্কিত, ভীতসন্ত্রস্ত। আমাদের পরিবার অসহায়ের মতো স্থানত্যাগ করেছে। পুলিশ প্রশাসনের প্রতি আমাদের করজোড়ে নিবেদন, দয়া করে একটি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি বিধানের ক্ষেত্র তৈরি করুন, প্রভাব-প্রতিপত্তির কাছে নতজানু নয়, ন্যায় প্রতিষ্ঠায় আপনাদের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করি।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক
No comments