রাজনীতি-গণতন্ত্র ও আমাদের শিক্ষাঙ্গন by জিল্লুর রহমান খান
তারা যখন দেখে যে, সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে মতের বিনিময় ঘটে না, জাতীয় সংসদে বিরোধী দল যায় না এবং সরকারি দলের আসনের বেশিরভাগ থাকে শূন্য, সংসদে ব্যবসায়ীদের প্রভাব অনেক এবং তারা ব্যক্তিস্বার্থ আদায়ে এ অবস্থানকে কাজে লাগায়_ এ অবস্থায় তারা ধরে নেয় যে, এটাই আদর্শ এবং ভবিষ্যতে তারা এভাবেই চলবে।
আমাদের কাজ হচ্ছে, এর বিপরীত চিত্রই তাদের জন্য তুলে ধরা আমার কর্মজীবনের শুরুতে ঢাকা কলেজে শিক্ষকতা করেছি। পড়াতাম সিভিক্স। একজন খ্যাতিমান আইনজ্ঞের জুনিয়র ক্লার্ক হিসেবে দায়িত্ব পালনেরও সুযোগ হয়েছিল। এরপর পাকিস্তান সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে লাহোরে ট্রেনিং গ্রহণ করি। ব্রিটিশ বা পাকিস্তান আমলে এ ধরনের চাকরিকে মেধাবী শিক্ষার্থী এবং তাদের পরিবার মোক্ষম প্রাপ্তি হিসেবে ধরে নিত। অনেকেই মনে করত_ জীবনে আর কী চাই? অথচ আমি এ মোহ ত্যাগ করে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে উচ্চতর শিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাই।
ঢাকা কলেজে শিক্ষকতার সময় একটি বিষয় অবাক লেগেছিল_ ছাত্রদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত না হওয়া। আমি ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে প্রতিটি ক্লাসে হাজির হতাম এবং সর্বদা শঙ্কা থাকত_ এই বুঝি কোনো মেধাবী শিক্ষার্থী প্রশ্ন করে বিপদে ফেলে দেবে। কোনো ক্লাস কোনো কারণে নেওয়া না গেলে ছাত্ররা কখনও বলেনি_ ফের কবে এ ক্লাসটি হবে? যুক্তরাষ্ট্রে এসে ভিন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হই। এখানে কোনো কারণে বাতিল হওয়া ক্লাস পরে নিতেই হয়। এ ব্যাপারে ছাত্রছাত্রীদের প্রচুর আগ্রহ দেখেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সময়ে শিক্ষার্থীদের জরিপ কাজে অংশগ্রহণ বিষয়ে উৎসাহিত করার চেষ্টা করেছি। তবে এতে উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া মিলেছে_ সেটা বলা যাবে না। এখন কি অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে? এটা ব্যাপকভাবে ঘটুক, এমন আশাবাদ পোষণ করাই যায়। কিন্তু যতটা বুঝি_ প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে ফারাক রয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর আমার কিছু ধারণা শিক্ষার্থীদের দিয়ে হাতেকলমে পরীক্ষার চেষ্টা করি। তাদের বলি_ তত্ত্বের সঙ্গে জীবনের যোগ ঘটাতে হবে। যা শিখছ, বাস্তব রাজনৈতিক পরিবেশে তা কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, সেটা নিজেরাই জেনে আসো মানুষের কাছে গিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এবং মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে জরিপ পরিচালনা করিয়েছি। তাদের জনমত বিশ্লেষণ করতে শেখাই। শিক্ষার্থীদের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে গ্যালপ পোলসহ নির্বাচনকালে যেসব গুরুত্বপূর্ণ জরিপ পরিচালনা হতো_ তা মিলিয়ে দেখা হতো। এভাবেই তাদের চোখ-কান খুলে দেওয়া যায়।
এখন ইন্টারনেট থেকে অনেক সহায়তা মেলে। এ কারণে পাঠ্যবই পড়ার প্রবণতা কমে গেছে বলে অভিমত রয়েছে। মুখস্থ বিদ্যার প্রতি আস্থা অতীতে ছিল, এখনও অনেকের রয়েছে। কিন্তু নির্বাচিত কিছু অংশ নয়, বরং গোটা বই পড়ে ফেলার প্রয়োজনীয়তা সবসময়েই রয়েছে। ইন্টারঅ্যাকটিভ ক্লাসও চাই। এভাবে আমি নিজেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। যখন কোনো সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে যাই, শিক্ষার্থীদের সে বিষয়ে ধারণা দেই এবং তাদের অভিমত জানার চেষ্টা করি। ফিরে এসে তাদের কাছে বিষয়বস্তুর কপি দেই এবং তাদের কাছ থেকে প্রশ্ন আহ্বান করি। এমনকি আমার মতকে চ্যালেঞ্জ করার জন্যও উৎসাহিত করি। গণতন্ত্রের অপরিহার্য শর্ত এটা। আমেরিকান সমাজে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা স্বীকৃত। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের সঙ্গে তুমূল তর্কে লিপ্ত হতে পারে। এ কারণে পরীক্ষায় নম্বর কম মিলবে কিংবা শিক্ষকের বিরাগভাজন হতে হবে_ এমন শঙ্কা সামান্যই থাকে।
বাংলাদেশে গত এক দশকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে। বলা যায়, এখন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা সমান সমান। নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু খুব বেশি গড়ে উঠছে না এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে, এ কারণে অচিরেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে_ তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এটাও জানা যে, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীদের প্রথম পছন্দ থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুয়েট ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ। এমনকি শিক্ষার মানের জন্য স্বল্প সময়েই খ্যাতি অর্জন করা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও পছন্দের তালিকায় পিছিয়ে পড়ে। নিকট ভবিষ্যতে এ পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটবে বলে মনে হয় না। এর একটি কারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উচ্চ গুণগত মান। বিশাল ক্যাম্পাস, গ্রন্থাগার এবং আরও কিছু সুবিধাও এর কারণ। সবচেয়ে বড় কথা, এখানে রয়েছে স্বল্প ব্যয়ে শিক্ষার সুযোগ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রচুর অর্থ নেয় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। বৃত্তির সংখ্যা এসব প্রতিষ্ঠানে হাতেগোনা। যারা এসব প্রতিষ্ঠান স্থাপনে উদ্যোগ নিয়েছেন এবং পরিচালনা পরিষদে যারা থাকেন তাদের সবার অভিন্ন লক্ষ্য_ বাণিজ্যিকভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা। এ কারণে অনেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবেও অভিহিত করে থাকেন। তাদের বিবেচনায়, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যতটা না একাডেমিক উদ্যোগ, তার চেয়ে ঢের বেশি ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি দ্বারা পরিচালিত। পাঠ্যবিষয় নির্বাচনেও এর প্রতিফলন দেখি। মানবিক বিষয়গুলো কার্যত অনুপস্থিত। যেসব বিষয় পড়লে ভালো চাকরি মিলবে কিংবা প্রতিযোগিতায় সুবিধা হবে, কেবল সেগুলোই নির্বাচন করা হয়। শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য কর্মজীবনে তা কাজে লাগানো_ তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে_ বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জ্ঞানের জগৎ খুলে দেওয়ার স্থান। এখানে শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞান-বাণিজ্য সবকিছু থাকতে হবে। ইতিহাস-ভূগোলেরও স্থান নিশ্চিত হতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে যে পড়ছে তাকেও সমাজবিজ্ঞানের পাঠ নিতে হয়। একে কোনোভাবেই অপচয় বলা যাবে না। ন্যায়-নীতি-নৈতিকতার বিষয়েও শিক্ষার্থীদের জানাতে হবে। সমাজ কীভাবে চলছে, চারপাশের পরিবেশ কেমন এবং তা আরও ভালো করা যায় কীভাবে_ এসব শিক্ষাও একজন প্রকৌশলী বা চিকিৎসকের জন্য অপ্রয়োজনীয় বলা যাবে না।
আরেকটি বিষয়ও সেখানে দেখেছি_ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেরা শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করার জন্য বৃত্তিসহ বিভিন্ন ধরনের সুবিধা প্রদান করে। বাংলাদেশে এমনটি হয় বলে এখন পর্যন্ত শুনিনি। শিক্ষাজীবনে মেধা ও কৃতিত্বের স্বাক্ষর যারা রেখেছে তাদের মধ্য থেকে শিক্ষক নিয়োগেও গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষকদের অধিকতর গবেষণা কাজেও কর্তৃপক্ষের সহায়তা থাকা চাই। এ জন্য ব্যয়ের প্রশ্ন রয়েছে। তা যে কেবল শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করতে হবে_ এমন কথা নেই। সাবেক ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে এ অর্থের একটি অংশ সংগ্রহ করা যায়। গবেষণা কাজের পরিধি ও মান বাড়িয়েও আয় হতে পারে।
ক্যাম্পাসে রাজনীতির ইস্যুটিও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীরা মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে তারা দেশবাসীকে অনুপ্রাণিত করেছে। এখন তারা রাজনীতি করবে কি-না_ সে প্রশ্ন অনেকে করছে। ক্যাম্পাসে সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়ায় প্রশ্নটি গুরুত্ব পাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্বের একটি অংশ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে সরাসরি প্রশ্রয় দেয়। ছাত্র সংগঠনগুলো শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের চেয়ে রাজনীতি নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে। গণতান্ত্রিক চর্চাও কমে গেছে বলে অভিযোগ রয়েছে এবং তা অমূলক নয়। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন বিরোধী পক্ষকে ক্যাম্পাসে সহ্য করে না। যদি মনে করা হয়, ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেওয়া হলে বিরোধীপক্ষের সুবিধা হবে, তাহলে নির্বাচনই দেওয়া হয় না। এ ক্ষেত্রে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে উৎসাহী থাকে না। তারা ক্ষমতাসীন দলের কথা মেনে চলাতেই সচেষ্ট থাকে। গণতন্ত্র চর্চায় তরুণ প্রজন্মকে আগ্রহী করে তুলতে এমন পরিস্থিতি সহায়ক হতে পারে না। ভবিষ্যতের জন্য তারা ভালো শিক্ষা পেতে পারত। কিন্তু কার্যত শিখছে অসহিষ্ণুতা। সবার মতপ্রকাশের সুযোগ কার্যত অনুপস্থিত। যুক্তরাষ্ট্রে দেখেছি, রাষ্ট্রীয়ভাবে সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে নানাভাবে হেয় করা হয়, কিন্তু ক্যাম্পাসে চলে তার অবাধ চর্চা।
ছাত্রছাত্রীরা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ অবশ্যই রাখবে। এমনকি রাজনৈতিক দলের ছাত্র ও যুব শাখা হতেও সমস্যা নেই। এভাবেই ভবিষ্যতের জন্য প্রশিক্ষণ মিলবে। রাজনৈতিক দলের নেতা যারা হতে চায়, যারা দেশের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে চায়_ নিজেদের সে জন্য গড়ে তুলতে পারবে তারা। কিন্তু ক্যাম্পাসের ভেতরে ছাত্র সংগঠন বা ছাত্র সংসদের কাজ হবে ভিন্ন। এখানে শিক্ষার্থীদের সমস্যা নিয়ে তাদের কাজ করতে হবে। সে জন্য নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচন প্রায় দুই যুগ ধরে অনুষ্ঠিত হয় না। এক সময়ে ছাত্র সংগঠন ও ছাত্র সংসদে যারা সক্রিয় কাজ করেছেন, তাদের জন্য এ বিষয়টি অভাবিত। কিন্তু এ জট কে খুলবে? এর দায়িত্ব কেবল ছাত্র সংগঠনের নেতাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া চলে না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেও এককভাবে দায়ী করা চলে না। রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে এর সমাধান খুঁজতে হবে। ছাত্ররাই ভবিষ্যতে রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনের নেতৃত্ব গ্রহণ করবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল করায় তাদের থাকবে অনন্য ভূমিকা। কিন্তু এভাবে তাদের হাত গুটিয়ে বসিয়ে রাখা কেন? তাদের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব বাড়াতে হবে। পেছনে নয় বরং সম্মুখপানে তারা তাকাবে। পড়াশোনার পাশাপাশি এ জন্য শিক্ষা নেবে ক্যাম্পাসে থাকাকালে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে অনেক কথা হয়। ক্যাম্পাসেও দেখা যায় অস্থিরতা। ভবিষ্যৎ নিশ্চিত না থাকলে অনেকেরই কাজে উৎসাহ থাকে না। শিক্ষার্থীদের মধ্যেও তার প্রভাব দেখা যায়। রাজনৈতিক দলগুলোকে এ বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের নিয়ে আমাকে কখনও চিন্তায় পড়তে হয় না। তারা সৃজনশীল ও উদ্যমী। দেশে যারা থাকে, তাদের মধ্যেও একই গুণ রয়েছে। এ জন্য প্রয়োজন সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া। তারা যখন দেখে যে, সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে মতের বিনিময় ঘটে না, জাতীয় সংসদে বিরোধী দল যায় না এবং সরকারি দলের আসনের বেশিরভাগ থাকে শূন্য, সংসদে ব্যবসায়ীদের প্রভাব অনেক এবং তারা ব্যক্তিস্বার্থ আদায়ে এ অবস্থানকে কাজে লাগায়_ এ অবস্থায় তারা ধরে নেয় যে, এটাই আদর্শ এবং ভবিষ্যতে তারা এভাবেই চলবে। আমাদের কাজ হচ্ছে, এর বিপরীত চিত্রই তাদের জন্য তুলে ধরা।
বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে_ এটা এখন মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। কিন্তু আমি বলব, এ দায়িত্ব সবার।
ড. জিল্লুর রহমান খান :যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস প্রফেসর
ঢাকা কলেজে শিক্ষকতার সময় একটি বিষয় অবাক লেগেছিল_ ছাত্রদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত না হওয়া। আমি ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে প্রতিটি ক্লাসে হাজির হতাম এবং সর্বদা শঙ্কা থাকত_ এই বুঝি কোনো মেধাবী শিক্ষার্থী প্রশ্ন করে বিপদে ফেলে দেবে। কোনো ক্লাস কোনো কারণে নেওয়া না গেলে ছাত্ররা কখনও বলেনি_ ফের কবে এ ক্লাসটি হবে? যুক্তরাষ্ট্রে এসে ভিন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হই। এখানে কোনো কারণে বাতিল হওয়া ক্লাস পরে নিতেই হয়। এ ব্যাপারে ছাত্রছাত্রীদের প্রচুর আগ্রহ দেখেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সময়ে শিক্ষার্থীদের জরিপ কাজে অংশগ্রহণ বিষয়ে উৎসাহিত করার চেষ্টা করেছি। তবে এতে উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া মিলেছে_ সেটা বলা যাবে না। এখন কি অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে? এটা ব্যাপকভাবে ঘটুক, এমন আশাবাদ পোষণ করাই যায়। কিন্তু যতটা বুঝি_ প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে ফারাক রয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর আমার কিছু ধারণা শিক্ষার্থীদের দিয়ে হাতেকলমে পরীক্ষার চেষ্টা করি। তাদের বলি_ তত্ত্বের সঙ্গে জীবনের যোগ ঘটাতে হবে। যা শিখছ, বাস্তব রাজনৈতিক পরিবেশে তা কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, সেটা নিজেরাই জেনে আসো মানুষের কাছে গিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এবং মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে জরিপ পরিচালনা করিয়েছি। তাদের জনমত বিশ্লেষণ করতে শেখাই। শিক্ষার্থীদের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে গ্যালপ পোলসহ নির্বাচনকালে যেসব গুরুত্বপূর্ণ জরিপ পরিচালনা হতো_ তা মিলিয়ে দেখা হতো। এভাবেই তাদের চোখ-কান খুলে দেওয়া যায়।
এখন ইন্টারনেট থেকে অনেক সহায়তা মেলে। এ কারণে পাঠ্যবই পড়ার প্রবণতা কমে গেছে বলে অভিমত রয়েছে। মুখস্থ বিদ্যার প্রতি আস্থা অতীতে ছিল, এখনও অনেকের রয়েছে। কিন্তু নির্বাচিত কিছু অংশ নয়, বরং গোটা বই পড়ে ফেলার প্রয়োজনীয়তা সবসময়েই রয়েছে। ইন্টারঅ্যাকটিভ ক্লাসও চাই। এভাবে আমি নিজেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। যখন কোনো সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে যাই, শিক্ষার্থীদের সে বিষয়ে ধারণা দেই এবং তাদের অভিমত জানার চেষ্টা করি। ফিরে এসে তাদের কাছে বিষয়বস্তুর কপি দেই এবং তাদের কাছ থেকে প্রশ্ন আহ্বান করি। এমনকি আমার মতকে চ্যালেঞ্জ করার জন্যও উৎসাহিত করি। গণতন্ত্রের অপরিহার্য শর্ত এটা। আমেরিকান সমাজে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা স্বীকৃত। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের সঙ্গে তুমূল তর্কে লিপ্ত হতে পারে। এ কারণে পরীক্ষায় নম্বর কম মিলবে কিংবা শিক্ষকের বিরাগভাজন হতে হবে_ এমন শঙ্কা সামান্যই থাকে।
বাংলাদেশে গত এক দশকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে। বলা যায়, এখন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা সমান সমান। নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু খুব বেশি গড়ে উঠছে না এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে, এ কারণে অচিরেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে_ তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এটাও জানা যে, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীদের প্রথম পছন্দ থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুয়েট ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ। এমনকি শিক্ষার মানের জন্য স্বল্প সময়েই খ্যাতি অর্জন করা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও পছন্দের তালিকায় পিছিয়ে পড়ে। নিকট ভবিষ্যতে এ পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটবে বলে মনে হয় না। এর একটি কারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উচ্চ গুণগত মান। বিশাল ক্যাম্পাস, গ্রন্থাগার এবং আরও কিছু সুবিধাও এর কারণ। সবচেয়ে বড় কথা, এখানে রয়েছে স্বল্প ব্যয়ে শিক্ষার সুযোগ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রচুর অর্থ নেয় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। বৃত্তির সংখ্যা এসব প্রতিষ্ঠানে হাতেগোনা। যারা এসব প্রতিষ্ঠান স্থাপনে উদ্যোগ নিয়েছেন এবং পরিচালনা পরিষদে যারা থাকেন তাদের সবার অভিন্ন লক্ষ্য_ বাণিজ্যিকভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা। এ কারণে অনেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবেও অভিহিত করে থাকেন। তাদের বিবেচনায়, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যতটা না একাডেমিক উদ্যোগ, তার চেয়ে ঢের বেশি ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি দ্বারা পরিচালিত। পাঠ্যবিষয় নির্বাচনেও এর প্রতিফলন দেখি। মানবিক বিষয়গুলো কার্যত অনুপস্থিত। যেসব বিষয় পড়লে ভালো চাকরি মিলবে কিংবা প্রতিযোগিতায় সুবিধা হবে, কেবল সেগুলোই নির্বাচন করা হয়। শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য কর্মজীবনে তা কাজে লাগানো_ তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে_ বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জ্ঞানের জগৎ খুলে দেওয়ার স্থান। এখানে শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞান-বাণিজ্য সবকিছু থাকতে হবে। ইতিহাস-ভূগোলেরও স্থান নিশ্চিত হতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে যে পড়ছে তাকেও সমাজবিজ্ঞানের পাঠ নিতে হয়। একে কোনোভাবেই অপচয় বলা যাবে না। ন্যায়-নীতি-নৈতিকতার বিষয়েও শিক্ষার্থীদের জানাতে হবে। সমাজ কীভাবে চলছে, চারপাশের পরিবেশ কেমন এবং তা আরও ভালো করা যায় কীভাবে_ এসব শিক্ষাও একজন প্রকৌশলী বা চিকিৎসকের জন্য অপ্রয়োজনীয় বলা যাবে না।
আরেকটি বিষয়ও সেখানে দেখেছি_ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেরা শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করার জন্য বৃত্তিসহ বিভিন্ন ধরনের সুবিধা প্রদান করে। বাংলাদেশে এমনটি হয় বলে এখন পর্যন্ত শুনিনি। শিক্ষাজীবনে মেধা ও কৃতিত্বের স্বাক্ষর যারা রেখেছে তাদের মধ্য থেকে শিক্ষক নিয়োগেও গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষকদের অধিকতর গবেষণা কাজেও কর্তৃপক্ষের সহায়তা থাকা চাই। এ জন্য ব্যয়ের প্রশ্ন রয়েছে। তা যে কেবল শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করতে হবে_ এমন কথা নেই। সাবেক ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে এ অর্থের একটি অংশ সংগ্রহ করা যায়। গবেষণা কাজের পরিধি ও মান বাড়িয়েও আয় হতে পারে।
ক্যাম্পাসে রাজনীতির ইস্যুটিও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীরা মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে তারা দেশবাসীকে অনুপ্রাণিত করেছে। এখন তারা রাজনীতি করবে কি-না_ সে প্রশ্ন অনেকে করছে। ক্যাম্পাসে সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়ায় প্রশ্নটি গুরুত্ব পাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্বের একটি অংশ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে সরাসরি প্রশ্রয় দেয়। ছাত্র সংগঠনগুলো শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের চেয়ে রাজনীতি নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে। গণতান্ত্রিক চর্চাও কমে গেছে বলে অভিযোগ রয়েছে এবং তা অমূলক নয়। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন বিরোধী পক্ষকে ক্যাম্পাসে সহ্য করে না। যদি মনে করা হয়, ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেওয়া হলে বিরোধীপক্ষের সুবিধা হবে, তাহলে নির্বাচনই দেওয়া হয় না। এ ক্ষেত্রে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে উৎসাহী থাকে না। তারা ক্ষমতাসীন দলের কথা মেনে চলাতেই সচেষ্ট থাকে। গণতন্ত্র চর্চায় তরুণ প্রজন্মকে আগ্রহী করে তুলতে এমন পরিস্থিতি সহায়ক হতে পারে না। ভবিষ্যতের জন্য তারা ভালো শিক্ষা পেতে পারত। কিন্তু কার্যত শিখছে অসহিষ্ণুতা। সবার মতপ্রকাশের সুযোগ কার্যত অনুপস্থিত। যুক্তরাষ্ট্রে দেখেছি, রাষ্ট্রীয়ভাবে সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে নানাভাবে হেয় করা হয়, কিন্তু ক্যাম্পাসে চলে তার অবাধ চর্চা।
ছাত্রছাত্রীরা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ অবশ্যই রাখবে। এমনকি রাজনৈতিক দলের ছাত্র ও যুব শাখা হতেও সমস্যা নেই। এভাবেই ভবিষ্যতের জন্য প্রশিক্ষণ মিলবে। রাজনৈতিক দলের নেতা যারা হতে চায়, যারা দেশের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে চায়_ নিজেদের সে জন্য গড়ে তুলতে পারবে তারা। কিন্তু ক্যাম্পাসের ভেতরে ছাত্র সংগঠন বা ছাত্র সংসদের কাজ হবে ভিন্ন। এখানে শিক্ষার্থীদের সমস্যা নিয়ে তাদের কাজ করতে হবে। সে জন্য নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচন প্রায় দুই যুগ ধরে অনুষ্ঠিত হয় না। এক সময়ে ছাত্র সংগঠন ও ছাত্র সংসদে যারা সক্রিয় কাজ করেছেন, তাদের জন্য এ বিষয়টি অভাবিত। কিন্তু এ জট কে খুলবে? এর দায়িত্ব কেবল ছাত্র সংগঠনের নেতাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া চলে না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেও এককভাবে দায়ী করা চলে না। রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে এর সমাধান খুঁজতে হবে। ছাত্ররাই ভবিষ্যতে রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনের নেতৃত্ব গ্রহণ করবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল করায় তাদের থাকবে অনন্য ভূমিকা। কিন্তু এভাবে তাদের হাত গুটিয়ে বসিয়ে রাখা কেন? তাদের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব বাড়াতে হবে। পেছনে নয় বরং সম্মুখপানে তারা তাকাবে। পড়াশোনার পাশাপাশি এ জন্য শিক্ষা নেবে ক্যাম্পাসে থাকাকালে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে অনেক কথা হয়। ক্যাম্পাসেও দেখা যায় অস্থিরতা। ভবিষ্যৎ নিশ্চিত না থাকলে অনেকেরই কাজে উৎসাহ থাকে না। শিক্ষার্থীদের মধ্যেও তার প্রভাব দেখা যায়। রাজনৈতিক দলগুলোকে এ বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের নিয়ে আমাকে কখনও চিন্তায় পড়তে হয় না। তারা সৃজনশীল ও উদ্যমী। দেশে যারা থাকে, তাদের মধ্যেও একই গুণ রয়েছে। এ জন্য প্রয়োজন সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া। তারা যখন দেখে যে, সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে মতের বিনিময় ঘটে না, জাতীয় সংসদে বিরোধী দল যায় না এবং সরকারি দলের আসনের বেশিরভাগ থাকে শূন্য, সংসদে ব্যবসায়ীদের প্রভাব অনেক এবং তারা ব্যক্তিস্বার্থ আদায়ে এ অবস্থানকে কাজে লাগায়_ এ অবস্থায় তারা ধরে নেয় যে, এটাই আদর্শ এবং ভবিষ্যতে তারা এভাবেই চলবে। আমাদের কাজ হচ্ছে, এর বিপরীত চিত্রই তাদের জন্য তুলে ধরা।
বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে_ এটা এখন মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। কিন্তু আমি বলব, এ দায়িত্ব সবার।
ড. জিল্লুর রহমান খান :যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস প্রফেসর
No comments