জলবায়ু পরিবর্তন এবং বাংলাদেশের বিদ্যমান চিত্র by তারেক শামসুর রেহমান
আমাদের পরিবেশমন্ত্রী খুব সৌভাগ্যবান ব্যক্তি। অনেক বাঘা বাঘা নেতা যখন গাড়িতে পতাকা তুলতে পারেননি, তখন ড. হাছান মাহমুদ পতাকা তুলেছেন গাড়িতে। প্রথমে ছিলেন পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী। এখন পূর্ণমন্ত্রী। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্ব যে বড় ধরনের পরিবেশগত সমস্যার সম্মুখীন হতে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে জনমত সৃষ্টির জন্য তিনি যখন এন্টার্কটিকায়, ঠিক তখনই বাংলাদেশে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যাতে বাংলাদেশে পরিবেশ বিপর্যয়ের ব্যাপারটি আরো পোক্ত হয়েছে।
তিনি নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যবান। বোধ করি, তিনিই বাংলাদেশের প্রথম ব্যক্তি, যিনি এন্টার্কটিকা সফরে গেলেন বেশ কয়েকজন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তির সঙ্গে। আল গোর নেতৃত্ব দিচ্ছেন এই টিমের। সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোরকে এখন বিশ্ববাসী জানে একজন পরিবেশবিদ হিসেবে। বই লিখে, ডকুমেন্টারি তৈরি করে তিনি জনসচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন।
ডারবানে কপ-১৭ সম্মেলনে যখন কোনো চুক্তি হলো না, তখন আশঙ্কার মধ্যে বাস করছে বিশ্ববাসী, বিশেষ করে দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো। এটা উপলব্ধি করেই আল গোর একটি সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১০৭ জন বিশিষ্ট নাগরিককে নিয়ে গত ২৯ জানুয়ারি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আয়ারস থেকে রওনা হন দক্ষিণ মেরুর দিকে। সেখানে অবস্থান করেন ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ব্যক্তি ড. হাছান মাহমুদ এখানে আমন্ত্রিত হননি। আমন্ত্রিত হয়েছেন বাংলাদেশের পরিবেশমন্ত্রী হিসেবে। কেননা, সারা বিশ্ব জানে বিশ্বের উষ্ণতা যে হারে বাড়ছে, তাতে আগামী দিনে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতিবছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। সমুদ্রের পানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে প্রতি সাতজনে একজন উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। তাঁরা হচ্ছেন জলবায়ু উদ্বাস্তু। আগামীতে বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ এলাকা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে। বিশ্ববাসী জলবায়ু উদ্বাস্তুর সঙ্গে প্রথম পরিচিত হয় ২০০৫ সালে, যখন বাংলাদেশে ভোলার চরাঞ্চল থেকে পাঁচ লাখ মানুষ অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। ক্রিশ্চিয়ান পেনেনটি (Christian Penenti) তাঁর সদ্য প্রকাশিত হওয়া গ্রন্থ Tropic of Chaos : Climate Change and the New Geography of Violence (2011) এ উল্লেখ করেছেন সে কথা। পেনেনটি আরো উল্লেখ করেছেন, ২০৫০ সালের মধ্যেই ২২ মিলিয়ন, অর্থাৎ দুই কোটি ২০ লাখ মানুষ বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চল থেকে অন্যত্র সরে যেতে বাধ্য হবে। আইপিসিসির রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশের কথা। তাই আল গোর যে বাংলাদেশের পরিবেশমন্ত্রীকে দক্ষিণ মেরুতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাবেন_এটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার কাছে যেটি অবাক করার বিষয়, তা হচ্ছে পরিবেশমন্ত্রী এন্টার্কটিকায় গেলেন বিশ্ব জনমত সৃষ্টির জন্য। কিন্তু বাংলাদেশে দু-দুটি ঘটনায় পরিবেশ যখন বিপর্যয়ের সম্মুখীন, তখন পরিবেশমন্ত্রীর কোনো বক্তব্য নেই! তাঁর নিজ দেশের পরিবেশ আজ বড় ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন, সেখানে পরিবেশমন্ত্রীর কোনো ভূমিকা নেই। এখানেই এসে যায় মূল প্রশ্নটি_বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়কে উপেক্ষা করে বিশ্ব পরিবেশ রক্ষায় আমাদের পরিবেশমন্ত্রী তৎপর! এতে করে আমাদের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হলো? আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো পরিবেশমন্ত্রী ছবি তুলে কিংবা আল গোরের অটগ্রাফ নিয়ে নিজের বাচ্চাদের খুশি করবেন (বাচ্চারা স্ট্যাম্প আর অটোগ্রাফ সংগ্রহ করে) কি না জানি না, কিন্তু তাতে বাংলাদেশের খুব একটা উপকার হবে বলে আমার মনে হয় না। বিদেশে সম্মেলনে অংশগ্রহণের চেয়ে পরিবেশমন্ত্রীর উচিত যেসব কারণে পরিবেশ বিপর্যয় হয়েছে, তা রোধ করা।
অতিসম্প্রতি দুটি বড় ধরনের ঘটনা ঘটেছে, যেখানে মারাত্মকভাবে পরিবেশ বিপর্যয় হয়েছে। এক. তিতাস নদীতে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এই বাঁধের ছবি ছাপা হয়েছে কোনো কোনো পত্রিকায়। শুধু তাই নয়, তিতাসসহ আরো ছোট ছোট ১৮ নদীতেও বাঁধ দেওয়া হয়েছে, যাতে করে ভারতীয় ১৪০ চাকার যান এই নদী অতিক্রম করতে পারে। ইতিমধ্যে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে এবং হাইকোর্ট নদীতে বাঁধ দেওয়ার বিষয়টি কেন সংবিধান ও আইন পরিপন্থী হিসেবে ঘোষণা করা হবে না, সে ব্যাপারে কারণ দর্শাও নোটিশ জারি করেছেন। বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর এবং মহামান্য হাইকোর্ট এ ব্যাপারে যখন একটি রুল ইস্যু করেন, তখন বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের পরিবেশমন্ত্রী অত্যন্ত বিজ্ঞ মানুষ। একটি পিএইচডি ডিগ্রি তাঁর আছে। শুনেছি মন্ত্রী হয়েও নাকি কোনো একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিয়েছেন কিছুদিন (বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কি তাঁর 'অবস্থান'কে ব্যবহার করতে চেয়েছে!)। পরিবেশসংক্রান্ত দেশি, বিদেশি আইন তাঁর জানার কথা। মাননীয় মন্ত্রী, দয়া করে কি জানাবেন পৃথিবীর কোথাও এভাবে নদীতে বাঁধ দিয়ে কোনো নদীর 'মৃত্যু' ঘটানো হয়েছে কি না? কোনো একটি দৃষ্টান্ত যদি দিতে পারেন, আমি নদীতে বাঁধ দেওয়ার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে আপনার পাশে এসে দাঁড়াব। মাননীয় মন্ত্রী, আমার জানতে ইচ্ছে করছে, জীববৈচিত্র্য কনভেনশনের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ কিংবা জলাভূমিবিষয়ক কনভেনশনের (রামসার কনভেনশন) ৫ নম্বর অনুচ্ছেদ কি তিতাস নদীর বাঁধ দেওয়ার ঘটনাকে সমর্থন করে? বিশ্ব পরিবেশ রক্ষায় আপনি সোচ্চার! কানকুন, ডারবান কিংবা এরও আগে কোপেনহেগেনে (কপ সম্মেলন) আপনি গেছেন। পরিবেশ রক্ষায় ফাস্ট স্টার্ট ফান্ডে পাওয়া টাকার (বাংলাদেশের জন্য ১৩০ মিলিয়ন ডলার) ব্যাপারে আপনি সন্তুষ্ট নন। আরো টাকা চাই। সেটা হয়তো ঠিক আছে। কিন্তু তিতাসকে হত্যা করে আমরা নিজেরই (এর জন্য বিদেশিরা দায়ী নয়) যে বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলাম, তার কী হবে? দুই. বাগেরহাটের রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে গত ২৯ জানুয়ারি। বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা ব্যবহার করা হবে। এ জন্য বছরে চার মিলিয়ন টন কয়লা আমদানি করতে হবে। বিদ্যুৎ আমাদের দরকার_সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু কয়লা পুড়িয়ে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে এবং তাতে যে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে, তা কি আমরা বিবেচনায় নিয়েছি? না, নিইনি। ভারতীয় ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ারের সঙ্গে একটি চুক্তি হয়েছে বটে, কিন্তু পরিবেশের প্রভাব নিরূপণের জন্য ইআইএ সমীক্ষা_তা করা হয়নি। রামপালের গৌরম্ভর কৈকরদশ কাঠি ও সাতমারি মৌজায় এক হাজার ৮৪৭ একর জমিতে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত হবে, যা সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরে। কয়লা পোড়ানো হলে কার্বন ডাই-অঙ্াইড, সালফার, নাইট্রিক এসিড বায়ুমণ্ডলে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে। এতে করে এসিড বৃষ্টি হবে। পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে। সুন্দরবনের গাছ, উদ্ভিদ মরে যাবে। পশুপাখির প্রজনন বাধাগ্রস্ত হবে। ধ্বংস হয়ে যাবে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কি অন্যত্র স্থানান্তরিত করা যেত না? আমাদের গর্ব এই সুন্দরবন। ইতিমধ্যে সুন্দরবনকে গ্লোবাল হেরিটেজ হিসেবে গোষণা করা হয়েছে। আমরা এমন কিছু করতে পারি না যেখানে বিশ্বের বৃহত্তম এ প্যারাবনের অস্তিত্ব হুমকির সৃষ্টি করে।
রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে সুন্দরবনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে আমরা আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ-সংক্রান্ত ইউনেস্কো কনভেনশন লঙ্ঘন করেছি। মাননীয় মন্ত্রী, এ ব্যাপারে আপনি কী বলবেন? সরকারের সিদ্ধান্ত আপনি চ্যালেঞ্জ করতে পারেন না, জানি। কিন্তু একজন বিবেকবান মন্ত্রী হিসেবে আপনি যখন পরিবেশ নিয়ে কথা বলার জন্য আন্তর্জাতিক আসরে যান, যখন সুদূর এন্টার্কটিকায় জনমত সৃষ্টি করার জন্য যান, তখন আপনাকে আমি সমর্থন করতে পারি না। কেননা, বাংলাদেশের পরিবেশ রক্ষায় আপনি যথেষ্ট তৎপর নন। তিতাস নদীকে আমরা 'হত্যা' করতে চলেছি। সুন্দরবনকেও ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিলাম। খুলনার দাকোপ, কয়রা আর পাইকগাছায় আইলার কারণে যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা আমরা দুই বছরেও সমাধান করতে পারিনি। মাননীয় মন্ত্রী, আপনি যখন দক্ষিণ মেরুতে পা রাখছেন, আপনার গর্ব অনুভব করারই কথা। কিন্তু ২০১২ সালের এনভায়রনমেন্ট পারফরম্যান্স সূচকে (ইপিআই) বাংলাদেশকে যখন ১৩২টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বায়ু দূষণকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তখন আপনার এন্টার্কটিকা 'সফর' নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। আদৌ কি এর কোনো যৌক্তিকতা আছে? বলা ভালো ইপিআই পরিচালিত হয় দি ইয়েল সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল ল অ্যান্ড পলিসি এবং কলাম্বিয়ার সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল আর্থ সায়েন্স ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক কর্তৃক।
'দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বায়ুদূষণকারী' একটি দেশের একজন পরিবেশমন্ত্রী অ্যান্টার্কটিকা সফরে গিয়ে বাংলাদেশের জন্য আদৌ কোনো 'সম্মান' বয়ে আনতে পেরেছেন কি? বরং তিতাস 'হত্যা'র মতো ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে আর না ঘটে, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া বাঞ্ছনীয়। একই সঙ্গে রামপাল থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়াও প্রয়োজন।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tareque.rahman@acl.com
ডারবানে কপ-১৭ সম্মেলনে যখন কোনো চুক্তি হলো না, তখন আশঙ্কার মধ্যে বাস করছে বিশ্ববাসী, বিশেষ করে দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো। এটা উপলব্ধি করেই আল গোর একটি সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১০৭ জন বিশিষ্ট নাগরিককে নিয়ে গত ২৯ জানুয়ারি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আয়ারস থেকে রওনা হন দক্ষিণ মেরুর দিকে। সেখানে অবস্থান করেন ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ব্যক্তি ড. হাছান মাহমুদ এখানে আমন্ত্রিত হননি। আমন্ত্রিত হয়েছেন বাংলাদেশের পরিবেশমন্ত্রী হিসেবে। কেননা, সারা বিশ্ব জানে বিশ্বের উষ্ণতা যে হারে বাড়ছে, তাতে আগামী দিনে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতিবছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। সমুদ্রের পানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে প্রতি সাতজনে একজন উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। তাঁরা হচ্ছেন জলবায়ু উদ্বাস্তু। আগামীতে বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ এলাকা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে। বিশ্ববাসী জলবায়ু উদ্বাস্তুর সঙ্গে প্রথম পরিচিত হয় ২০০৫ সালে, যখন বাংলাদেশে ভোলার চরাঞ্চল থেকে পাঁচ লাখ মানুষ অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। ক্রিশ্চিয়ান পেনেনটি (Christian Penenti) তাঁর সদ্য প্রকাশিত হওয়া গ্রন্থ Tropic of Chaos : Climate Change and the New Geography of Violence (2011) এ উল্লেখ করেছেন সে কথা। পেনেনটি আরো উল্লেখ করেছেন, ২০৫০ সালের মধ্যেই ২২ মিলিয়ন, অর্থাৎ দুই কোটি ২০ লাখ মানুষ বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চল থেকে অন্যত্র সরে যেতে বাধ্য হবে। আইপিসিসির রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশের কথা। তাই আল গোর যে বাংলাদেশের পরিবেশমন্ত্রীকে দক্ষিণ মেরুতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাবেন_এটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার কাছে যেটি অবাক করার বিষয়, তা হচ্ছে পরিবেশমন্ত্রী এন্টার্কটিকায় গেলেন বিশ্ব জনমত সৃষ্টির জন্য। কিন্তু বাংলাদেশে দু-দুটি ঘটনায় পরিবেশ যখন বিপর্যয়ের সম্মুখীন, তখন পরিবেশমন্ত্রীর কোনো বক্তব্য নেই! তাঁর নিজ দেশের পরিবেশ আজ বড় ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন, সেখানে পরিবেশমন্ত্রীর কোনো ভূমিকা নেই। এখানেই এসে যায় মূল প্রশ্নটি_বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়কে উপেক্ষা করে বিশ্ব পরিবেশ রক্ষায় আমাদের পরিবেশমন্ত্রী তৎপর! এতে করে আমাদের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হলো? আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো পরিবেশমন্ত্রী ছবি তুলে কিংবা আল গোরের অটগ্রাফ নিয়ে নিজের বাচ্চাদের খুশি করবেন (বাচ্চারা স্ট্যাম্প আর অটোগ্রাফ সংগ্রহ করে) কি না জানি না, কিন্তু তাতে বাংলাদেশের খুব একটা উপকার হবে বলে আমার মনে হয় না। বিদেশে সম্মেলনে অংশগ্রহণের চেয়ে পরিবেশমন্ত্রীর উচিত যেসব কারণে পরিবেশ বিপর্যয় হয়েছে, তা রোধ করা।
অতিসম্প্রতি দুটি বড় ধরনের ঘটনা ঘটেছে, যেখানে মারাত্মকভাবে পরিবেশ বিপর্যয় হয়েছে। এক. তিতাস নদীতে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এই বাঁধের ছবি ছাপা হয়েছে কোনো কোনো পত্রিকায়। শুধু তাই নয়, তিতাসসহ আরো ছোট ছোট ১৮ নদীতেও বাঁধ দেওয়া হয়েছে, যাতে করে ভারতীয় ১৪০ চাকার যান এই নদী অতিক্রম করতে পারে। ইতিমধ্যে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে এবং হাইকোর্ট নদীতে বাঁধ দেওয়ার বিষয়টি কেন সংবিধান ও আইন পরিপন্থী হিসেবে ঘোষণা করা হবে না, সে ব্যাপারে কারণ দর্শাও নোটিশ জারি করেছেন। বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর এবং মহামান্য হাইকোর্ট এ ব্যাপারে যখন একটি রুল ইস্যু করেন, তখন বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের পরিবেশমন্ত্রী অত্যন্ত বিজ্ঞ মানুষ। একটি পিএইচডি ডিগ্রি তাঁর আছে। শুনেছি মন্ত্রী হয়েও নাকি কোনো একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিয়েছেন কিছুদিন (বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কি তাঁর 'অবস্থান'কে ব্যবহার করতে চেয়েছে!)। পরিবেশসংক্রান্ত দেশি, বিদেশি আইন তাঁর জানার কথা। মাননীয় মন্ত্রী, দয়া করে কি জানাবেন পৃথিবীর কোথাও এভাবে নদীতে বাঁধ দিয়ে কোনো নদীর 'মৃত্যু' ঘটানো হয়েছে কি না? কোনো একটি দৃষ্টান্ত যদি দিতে পারেন, আমি নদীতে বাঁধ দেওয়ার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে আপনার পাশে এসে দাঁড়াব। মাননীয় মন্ত্রী, আমার জানতে ইচ্ছে করছে, জীববৈচিত্র্য কনভেনশনের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ কিংবা জলাভূমিবিষয়ক কনভেনশনের (রামসার কনভেনশন) ৫ নম্বর অনুচ্ছেদ কি তিতাস নদীর বাঁধ দেওয়ার ঘটনাকে সমর্থন করে? বিশ্ব পরিবেশ রক্ষায় আপনি সোচ্চার! কানকুন, ডারবান কিংবা এরও আগে কোপেনহেগেনে (কপ সম্মেলন) আপনি গেছেন। পরিবেশ রক্ষায় ফাস্ট স্টার্ট ফান্ডে পাওয়া টাকার (বাংলাদেশের জন্য ১৩০ মিলিয়ন ডলার) ব্যাপারে আপনি সন্তুষ্ট নন। আরো টাকা চাই। সেটা হয়তো ঠিক আছে। কিন্তু তিতাসকে হত্যা করে আমরা নিজেরই (এর জন্য বিদেশিরা দায়ী নয়) যে বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলাম, তার কী হবে? দুই. বাগেরহাটের রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে গত ২৯ জানুয়ারি। বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা ব্যবহার করা হবে। এ জন্য বছরে চার মিলিয়ন টন কয়লা আমদানি করতে হবে। বিদ্যুৎ আমাদের দরকার_সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু কয়লা পুড়িয়ে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে এবং তাতে যে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে, তা কি আমরা বিবেচনায় নিয়েছি? না, নিইনি। ভারতীয় ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ারের সঙ্গে একটি চুক্তি হয়েছে বটে, কিন্তু পরিবেশের প্রভাব নিরূপণের জন্য ইআইএ সমীক্ষা_তা করা হয়নি। রামপালের গৌরম্ভর কৈকরদশ কাঠি ও সাতমারি মৌজায় এক হাজার ৮৪৭ একর জমিতে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত হবে, যা সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরে। কয়লা পোড়ানো হলে কার্বন ডাই-অঙ্াইড, সালফার, নাইট্রিক এসিড বায়ুমণ্ডলে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে। এতে করে এসিড বৃষ্টি হবে। পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে। সুন্দরবনের গাছ, উদ্ভিদ মরে যাবে। পশুপাখির প্রজনন বাধাগ্রস্ত হবে। ধ্বংস হয়ে যাবে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কি অন্যত্র স্থানান্তরিত করা যেত না? আমাদের গর্ব এই সুন্দরবন। ইতিমধ্যে সুন্দরবনকে গ্লোবাল হেরিটেজ হিসেবে গোষণা করা হয়েছে। আমরা এমন কিছু করতে পারি না যেখানে বিশ্বের বৃহত্তম এ প্যারাবনের অস্তিত্ব হুমকির সৃষ্টি করে।
রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে সুন্দরবনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে আমরা আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ-সংক্রান্ত ইউনেস্কো কনভেনশন লঙ্ঘন করেছি। মাননীয় মন্ত্রী, এ ব্যাপারে আপনি কী বলবেন? সরকারের সিদ্ধান্ত আপনি চ্যালেঞ্জ করতে পারেন না, জানি। কিন্তু একজন বিবেকবান মন্ত্রী হিসেবে আপনি যখন পরিবেশ নিয়ে কথা বলার জন্য আন্তর্জাতিক আসরে যান, যখন সুদূর এন্টার্কটিকায় জনমত সৃষ্টি করার জন্য যান, তখন আপনাকে আমি সমর্থন করতে পারি না। কেননা, বাংলাদেশের পরিবেশ রক্ষায় আপনি যথেষ্ট তৎপর নন। তিতাস নদীকে আমরা 'হত্যা' করতে চলেছি। সুন্দরবনকেও ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিলাম। খুলনার দাকোপ, কয়রা আর পাইকগাছায় আইলার কারণে যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা আমরা দুই বছরেও সমাধান করতে পারিনি। মাননীয় মন্ত্রী, আপনি যখন দক্ষিণ মেরুতে পা রাখছেন, আপনার গর্ব অনুভব করারই কথা। কিন্তু ২০১২ সালের এনভায়রনমেন্ট পারফরম্যান্স সূচকে (ইপিআই) বাংলাদেশকে যখন ১৩২টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বায়ু দূষণকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তখন আপনার এন্টার্কটিকা 'সফর' নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। আদৌ কি এর কোনো যৌক্তিকতা আছে? বলা ভালো ইপিআই পরিচালিত হয় দি ইয়েল সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল ল অ্যান্ড পলিসি এবং কলাম্বিয়ার সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল আর্থ সায়েন্স ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক কর্তৃক।
'দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বায়ুদূষণকারী' একটি দেশের একজন পরিবেশমন্ত্রী অ্যান্টার্কটিকা সফরে গিয়ে বাংলাদেশের জন্য আদৌ কোনো 'সম্মান' বয়ে আনতে পেরেছেন কি? বরং তিতাস 'হত্যা'র মতো ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে আর না ঘটে, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া বাঞ্ছনীয়। একই সঙ্গে রামপাল থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়াও প্রয়োজন।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tareque.rahman@acl.com
No comments