মধ্যপ্রাচ্য-লিবিয়ায় এ নয় আরব বসন্ত by মশিউল আলম
এক. হরর মুভি লিবিয়ার মিসরাতা শহরের এক হিমায়িত মাংসের দোকান। দোকানটির সামনে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে শত শত মানুষ। তারা দোকানটিতে ঢোকার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। খিড়কির দুই পাশে রয়েছে সশস্ত্র প্রহরী; তারা একসঙ্গে বেশি মানুষকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না।
কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত, অর্থনৈতিকভাবে পর্যুদস্ত লিবিয়ার একটি শহরে হঠাৎ এক মাংসের দোকানে এত ভিড় জমে উঠল কেন? আকাশ থেকে কি টাকা ছিটানো হয়েছে, আর সেই টাকা কুড়িয়ে নিয়ে সবাই ছুটেছে মাংসের দোকানে?
না। সে রকম কিছু নয়। বরং অতিশয় অস্বাভাবিক আর নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক একটি দৃশ্যের অবতারণা করা হয়েছে ওই মাংসের দোকানে: সস্তা চাটাইয়ের ওপর পড়ে আছে রক্তমাখা একটি মানবদেহ, পরনে শুধু খাকি ট্রাউজার, পা দুটি খালি। মাথার বাম পাশে ক্ষতচিহ্ন—বুলেটের। বুক ফুটো করে দিয়েছে আরেকটি বুলেট, সেই ফুটো থেকে চুইয়ে আসা লাল রক্ত শুকিয়ে গিয়ে এখন কালচে।
প্রহরীদের অনুমতিক্রমে কয়েকজন করে মানুষ ঢুকছে দোকানটির ভেতরে। ক্ষতবিক্ষত দেহটির পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে তারা, ক্যামেরার সামনে হাত তুলে দুই আঙুলে বানাচ্ছে বিজয়চিহ্ন, আর স্লোগান দিচ্ছে: আল্লাহু আকবর।
স্বৈরশাসকের চূড়ান্ত পতন ‘উদ্যাপনের’ সুযোগ করে দিতে এই আয়োজন করেছে লিবিয়ার বর্তমান কর্তৃপক্ষ। কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফির রক্তমাখা ক্ষতবিক্ষত প্রাণহীন দেহটি এখন এক ঐতিহাসিক স্মারক। গত বৃহস্পতিবার সশস্ত্র বিদ্রোহীরা সিরত শহরে গাদ্দাফিকে আটক করে জীবিত অবস্থায়, তারা তাঁকে টেনেহিঁচড়ে তোলে একটি ট্রাকে। প্রথমে তাঁর ওপর নির্যাতন চালায়, তারপর খুব কাছ থেকে গুলি করে তাঁকে হত্যা করে। সিরত গাদ্দাফির জন্মের শহর, তিনি শেষ আশ্রয়ের জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ওই শহরকে, যেখানে তাঁর অনেক জ্ঞাতিগোষ্ঠীর বাস। বৃহস্পতিবার তাঁর সঙ্গে ছেলে মুতাসিমকেও হত্যা করেছে বিদ্রোহীরা। তারপর গাদ্দাফির মৃতদেহ নিয়ে গেছে মিসরাতা শহরে, সেখানে প্রকাশ্যে ‘বিজয়-প্যারেড’ করেছে তারা; বিজয়ের প্রমাণ হিসেবে প্রদর্শন করেছে গাদ্দাফির মৃতদেহ। গাদ্দাফির জ্ঞাতিগোষ্ঠীর লোকজন গাদ্দাফি ও তাঁর ছেলের লাশ চেয়েছিল ইসলামি পন্থায় সিরতেই কবর দেওয়ার জন্য। কিন্তু লাশ তাদের দেওয়া হয়নি। তারা এমনকি জাতিসংঘ, ওআইসি আর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কাছেও আবেদন জানিয়েছে। কিন্তু লিবিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন শাসকেরা, স্বঘোষিত ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিলের ‘নেতারা’ গাদ্দাফির আত্মীয়স্বজনের আবেদন-নিবেদনের প্রতি কর্ণপাত না করে মাথা ঘামাতে লেগেছেন—এই লাশ নিয়ে কী করা যায়। একটা সিদ্ধান্তে সবাই অটল, গাদ্দাফি বা তাঁর ছেলে মুতাসিমের লাশ তাঁর আত্মীয়স্বজনের কাছে দেওয়া হবে না। তাহলে লাশ নিয়ে কী করা যায়—ত্রিপোলি তাড়াতাড়ি ওই ল্যাঠা চুকিয়ে ফেলতে চায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ জিবরিল ছুটে গেলেন মিসরাতা শহরে, সেখানকার ট্রানজিশনাল কাউন্সিলের নেতাদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করতে। মিসরাতার নেতারা পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, তাঁরা নিজেদের শহরে স্বৈরশাসকের কবর দিতে দেবেন না। এখন পর্যন্ত যা শোনা যাচ্ছে তাতে মনে হয়, গাদ্দাফিকে ভূমিতে কবর দেওয়া হবে না, সাগরে ফেলে দেওয়া হবে তাঁর লাশ, ওসামা বিন লাদেনের বেলায় যেমনটি করা হয়েছে বলে শোনা যায়। জীবিত অবস্থায় নির্যাতন, নিরস্ত্র ও বন্দী অবস্থায় খুন এবং প্রাণহীন অবস্থায় মুয়াম্মার গাদ্দাফির দেহটিকে যেভাবে লাঞ্ছিত-অপমানিত করা হচ্ছে, পশ্চিমের ‘সভ্য দুনিয়া’র লোকেরা তা উপভোগ করছে, যেমন করে তারা উপভোগ করে হলিউডের হরর মুভি।
দুই. বসন্ত নয়, কালবৈশাখী
লিবিয়ার শুকনো মাটি মুয়াম্মার গাদ্দাফির রক্তে ভিজে উঠল। পশ্চিমা শক্তিগুলো আর তাদের সমর্থনপুষ্ট লিবীয় বিদ্রোহীরা মেতে উঠল বিজয়ের উল্লাসে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বললেন, ‘লিবিয়ার ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায়ের [গাদ্দাফি যুগ] অবসান হলো।’ মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির সমর্থক-বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, ‘ওবামা ডকট্রিন’-এর আরেকটি বিজয় অর্জিত হলো লিবিয়ায়। ইরাক বা আফগানিস্তানের মতো হাজার হাজার কোটি ডলার খরচ করতে হলো না, শত শত মার্কিন সেনাকে প্রাণ দিতে হলো না, লিবীয় বিদ্রোহীদের দিয়েই পতন ঘটানো গেল গাদ্দাফির, করে ফেলা হলো ‘রেজিম চেঞ্জ’ বা সরকার পরিবর্তন। এমনই কেউ কেউ বলছেন, আরব বসন্তের সবচেয়ে বড় ফলটি সবার আগেই ফলল লিবিয়ায়, যেখানে বসন্ত এসেছে সবার পরে।
কিন্তু গাদ্দাফির লিবিয়ায় আসলে আরব বসন্তের হাওয়া লাগেনি। ওই দেশে সেই বসন্ত আসেনি, যা এসেছে তিউনিসিয়ায়, মিসরে, সিরিয়ায়, জর্ডানে; এমনকি পেয়েছে ইয়েমেনের মতো দেশেও। তিউনিসিয়ায় ও মিসরে যে বিপুল গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছে, তাতে অংশ নিয়েছে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ। বিশেষত, মিসরে মোবারকবিরোধী বিক্ষোভ-প্রতিবাদে অংশ নিয়েছেন অনেক নারী। আন্দোলনকারীদের হাতে অস্ত্র ছিল না, তাঁরা সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সংঘাত-সংঘর্ষে লিপ্ত হননি। তাঁরা শান্তিপূর্ণ পন্থায় মোবারক সরকারের বিরুদ্ধে তাঁদের অনাস্থা প্রকাশ করেছেন, মোবারকের পদত্যাগের দাবিতে দিন-রাত অবস্থান করেছেন কায়রোর তাহরির স্কয়ারে।
কিন্তু লিবিয়ায় গাদ্দাফির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের একদম শুরু থেকেই দেখা গেছে ভারী আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার। তিউনিসিয়া বা মিসরের মতো শান্তিপূর্ণ জনসমাবেশ বা মিছিল দেখা যায়নি লিবিয়ার কোনো শহরে, দেখা যায়নি কোনো নারীকেও। সামাজিক প্রতিবাদ-প্রতিরোধ হলে অবশ্যই নারীদের অংশগ্রহণ থাকত, যেমনটি দেখা গেছে তিউনিসিয়ায় ও মিসরে। প্রতিবাদী ব্যানার-ফেস্টুন নয়, একে ৪৭ রাইফেল আর রকেট প্রপেল্ড গ্রেনেডের মতো ভারী ও স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে গাদ্দাফিবিরোধী একদল যুবক ‘বিদ্রোহ’ শুরু করে দেয় বেনগাজি শহর থেকে। এই যুবকেরা এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ কোথায় পেয়েছে? লিবিয়ার মতো কঠোর পুলিশি রাষ্ট্রে, যেখানে গাদ্দাফির সমালোচনা করে একটা শব্দ উচ্চারণ করতেও লোকে ভয় পেত, সেখানে হঠাৎ করে বেশ কিছুসংখ্যক তরুণ-যুবকের হাতে ভারী আগ্নেয়াস্ত্র এসেছিল কোথা থেকে?
এত দিনে আর কোনো সন্দেহ নেই যে পশ্চিমা বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো, বিশেষ করে, ভূরাজনৈতিক অবস্থানের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমধ্যসাগরের ওপারের দেশ ফ্রান্সের একটা বড় হাত ছিল একদম গোড়া থেকেই। ব্রিটিশরাও এসে ফ্রান্সের সঙ্গে হাত মেলায়। আর আটলান্টিকের ওপারের বড় সর্দার যুক্তরাষ্ট্র তো রয়েছেই। তারা লিবিয়ার ‘রেজিম চেঞ্জ’-এর উদ্দেশ্যে বিদ্রোহীদের আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ, গোয়েন্দা তথ্য ও কৌশলগত পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করতে থাকে। কিন্তু গাদ্দাফির বিপুল ও শক্তিশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে তারা যখন পেরে উঠছিল না, তখন ন্যাটো জোটের মাধ্যমে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো দেশটিতে আগ্রাসন শুরু করে দেয়। লিবিয়ার বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদের দিকে তাদের বড্ড লোভ। তিউনিসিয়া-মিসরে যে আরব বসন্ত এসেছে, লিবিয়ায় তা আসবে না জেনে দেশটিতে তারা কালবৈশাখীর আয়োজন করেছিল।
তিন. কে থামাবে এই ঝড়
স্বৈরশাসনের পতন ঘটিয়ে গণতন্ত্র রপ্তানির নামে লিবিয়ায় একদল মানুষের হাতে অস্ত্র, গোলাবারুদ, টাকাপয়সা আর কূটবুদ্ধি দিয়ে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো লিবিয়ায় যে লন্ডভন্ড কাণ্ড ঘটিয়ে দিল, তার পরিণতি কী হতে পারে? অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ একাধিক মানবাধিকার সংস্থা উদ্বেগের সঙ্গে জানিয়েছে, গাদ্দাফির অনুসারী লোকজনের ওপর বর্বরতা শুরু হয়ে গেছে।
লিবিয়া বহু গোত্রে বিভক্ত একটি দেশ, যেখানে আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণাটি এখনো স্বচ্ছ নয়। গণতন্ত্র, আইনের শাসন—এ ধরনের পশ্চিমা ধারণার প্রেক্ষাপটে দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিচার করা যাবে না। ইতিহাসের কোনো কালেই সেখানে গণতন্ত্র ছিল না। কোনো রাজনৈতিক দলও দেশটিতে নেই। যারা গাদ্দাফিকে হটিয়ে দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিয়েছে, তাদের মধ্যে একটা বড় অংশ গুন্ডাপান্ডা ধরনের মানুষ। বিভিন্ন অঞ্চল বিভক্ত বিভিন্ন গোত্রে। মানুষের হাতে হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। আর রাজনৈতিক ওলট-পালটের ফলে অর্থনৈতিক অবস্থা হয়ে পড়েছে বিপর্যস্ত। এসব দেখেশুনে অনেক বিশ্লেষক বলছেন, লিবিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পরের কথা, আগে কীভাবে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা যায়, সেটাই ভাবনার বিষয়।
গাদ্দাফি জবরদস্ত স্বৈরশাসক ছিলেন বটে। কিন্তু তিনি বহু গোত্রে বিভক্ত লিবীয় সমাজকে একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন; লৌহদৃঢ় শাসনদণ্ড ব্যবহার করে হলেও জনজীবনে মোটামুটি শান্তি আনতে পেরেছিলেন। অবশ্য ব্যক্তিস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সে দেশে ছিল না। কিন্তু গাদ্দাফিকে উৎখাত করতে গিয়ে যে রক্তপাতের সূচনা ঘটানো হলো, তা বন্ধ করা খুব সহজ হবে না। এ মাসের ৩১ তারিখের মধ্যে ন্যাটো বাহিনী লিবিয়া ছেড়ে চলে যাবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। স্বঘোষিত ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিল এখন দেশটির এই লন্ডভন্ড পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেবে, সেটাই দেখার বিষয়। ইরাকিদের মতো লিবীয় জনগণের জীবনেও যেন রক্তপাত, নিরাপত্তাহীনতা আর আর্থিক দুর্দশার দীর্ঘ প্রহর নেমে না আসে।
মশিউল আলম: সাংবাদিক
mashiul.alam@gmail.com
না। সে রকম কিছু নয়। বরং অতিশয় অস্বাভাবিক আর নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক একটি দৃশ্যের অবতারণা করা হয়েছে ওই মাংসের দোকানে: সস্তা চাটাইয়ের ওপর পড়ে আছে রক্তমাখা একটি মানবদেহ, পরনে শুধু খাকি ট্রাউজার, পা দুটি খালি। মাথার বাম পাশে ক্ষতচিহ্ন—বুলেটের। বুক ফুটো করে দিয়েছে আরেকটি বুলেট, সেই ফুটো থেকে চুইয়ে আসা লাল রক্ত শুকিয়ে গিয়ে এখন কালচে।
প্রহরীদের অনুমতিক্রমে কয়েকজন করে মানুষ ঢুকছে দোকানটির ভেতরে। ক্ষতবিক্ষত দেহটির পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে তারা, ক্যামেরার সামনে হাত তুলে দুই আঙুলে বানাচ্ছে বিজয়চিহ্ন, আর স্লোগান দিচ্ছে: আল্লাহু আকবর।
স্বৈরশাসকের চূড়ান্ত পতন ‘উদ্যাপনের’ সুযোগ করে দিতে এই আয়োজন করেছে লিবিয়ার বর্তমান কর্তৃপক্ষ। কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফির রক্তমাখা ক্ষতবিক্ষত প্রাণহীন দেহটি এখন এক ঐতিহাসিক স্মারক। গত বৃহস্পতিবার সশস্ত্র বিদ্রোহীরা সিরত শহরে গাদ্দাফিকে আটক করে জীবিত অবস্থায়, তারা তাঁকে টেনেহিঁচড়ে তোলে একটি ট্রাকে। প্রথমে তাঁর ওপর নির্যাতন চালায়, তারপর খুব কাছ থেকে গুলি করে তাঁকে হত্যা করে। সিরত গাদ্দাফির জন্মের শহর, তিনি শেষ আশ্রয়ের জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ওই শহরকে, যেখানে তাঁর অনেক জ্ঞাতিগোষ্ঠীর বাস। বৃহস্পতিবার তাঁর সঙ্গে ছেলে মুতাসিমকেও হত্যা করেছে বিদ্রোহীরা। তারপর গাদ্দাফির মৃতদেহ নিয়ে গেছে মিসরাতা শহরে, সেখানে প্রকাশ্যে ‘বিজয়-প্যারেড’ করেছে তারা; বিজয়ের প্রমাণ হিসেবে প্রদর্শন করেছে গাদ্দাফির মৃতদেহ। গাদ্দাফির জ্ঞাতিগোষ্ঠীর লোকজন গাদ্দাফি ও তাঁর ছেলের লাশ চেয়েছিল ইসলামি পন্থায় সিরতেই কবর দেওয়ার জন্য। কিন্তু লাশ তাদের দেওয়া হয়নি। তারা এমনকি জাতিসংঘ, ওআইসি আর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কাছেও আবেদন জানিয়েছে। কিন্তু লিবিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন শাসকেরা, স্বঘোষিত ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিলের ‘নেতারা’ গাদ্দাফির আত্মীয়স্বজনের আবেদন-নিবেদনের প্রতি কর্ণপাত না করে মাথা ঘামাতে লেগেছেন—এই লাশ নিয়ে কী করা যায়। একটা সিদ্ধান্তে সবাই অটল, গাদ্দাফি বা তাঁর ছেলে মুতাসিমের লাশ তাঁর আত্মীয়স্বজনের কাছে দেওয়া হবে না। তাহলে লাশ নিয়ে কী করা যায়—ত্রিপোলি তাড়াতাড়ি ওই ল্যাঠা চুকিয়ে ফেলতে চায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ জিবরিল ছুটে গেলেন মিসরাতা শহরে, সেখানকার ট্রানজিশনাল কাউন্সিলের নেতাদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করতে। মিসরাতার নেতারা পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, তাঁরা নিজেদের শহরে স্বৈরশাসকের কবর দিতে দেবেন না। এখন পর্যন্ত যা শোনা যাচ্ছে তাতে মনে হয়, গাদ্দাফিকে ভূমিতে কবর দেওয়া হবে না, সাগরে ফেলে দেওয়া হবে তাঁর লাশ, ওসামা বিন লাদেনের বেলায় যেমনটি করা হয়েছে বলে শোনা যায়। জীবিত অবস্থায় নির্যাতন, নিরস্ত্র ও বন্দী অবস্থায় খুন এবং প্রাণহীন অবস্থায় মুয়াম্মার গাদ্দাফির দেহটিকে যেভাবে লাঞ্ছিত-অপমানিত করা হচ্ছে, পশ্চিমের ‘সভ্য দুনিয়া’র লোকেরা তা উপভোগ করছে, যেমন করে তারা উপভোগ করে হলিউডের হরর মুভি।
দুই. বসন্ত নয়, কালবৈশাখী
লিবিয়ার শুকনো মাটি মুয়াম্মার গাদ্দাফির রক্তে ভিজে উঠল। পশ্চিমা শক্তিগুলো আর তাদের সমর্থনপুষ্ট লিবীয় বিদ্রোহীরা মেতে উঠল বিজয়ের উল্লাসে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বললেন, ‘লিবিয়ার ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায়ের [গাদ্দাফি যুগ] অবসান হলো।’ মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির সমর্থক-বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, ‘ওবামা ডকট্রিন’-এর আরেকটি বিজয় অর্জিত হলো লিবিয়ায়। ইরাক বা আফগানিস্তানের মতো হাজার হাজার কোটি ডলার খরচ করতে হলো না, শত শত মার্কিন সেনাকে প্রাণ দিতে হলো না, লিবীয় বিদ্রোহীদের দিয়েই পতন ঘটানো গেল গাদ্দাফির, করে ফেলা হলো ‘রেজিম চেঞ্জ’ বা সরকার পরিবর্তন। এমনই কেউ কেউ বলছেন, আরব বসন্তের সবচেয়ে বড় ফলটি সবার আগেই ফলল লিবিয়ায়, যেখানে বসন্ত এসেছে সবার পরে।
কিন্তু গাদ্দাফির লিবিয়ায় আসলে আরব বসন্তের হাওয়া লাগেনি। ওই দেশে সেই বসন্ত আসেনি, যা এসেছে তিউনিসিয়ায়, মিসরে, সিরিয়ায়, জর্ডানে; এমনকি পেয়েছে ইয়েমেনের মতো দেশেও। তিউনিসিয়ায় ও মিসরে যে বিপুল গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছে, তাতে অংশ নিয়েছে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ। বিশেষত, মিসরে মোবারকবিরোধী বিক্ষোভ-প্রতিবাদে অংশ নিয়েছেন অনেক নারী। আন্দোলনকারীদের হাতে অস্ত্র ছিল না, তাঁরা সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সংঘাত-সংঘর্ষে লিপ্ত হননি। তাঁরা শান্তিপূর্ণ পন্থায় মোবারক সরকারের বিরুদ্ধে তাঁদের অনাস্থা প্রকাশ করেছেন, মোবারকের পদত্যাগের দাবিতে দিন-রাত অবস্থান করেছেন কায়রোর তাহরির স্কয়ারে।
কিন্তু লিবিয়ায় গাদ্দাফির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের একদম শুরু থেকেই দেখা গেছে ভারী আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার। তিউনিসিয়া বা মিসরের মতো শান্তিপূর্ণ জনসমাবেশ বা মিছিল দেখা যায়নি লিবিয়ার কোনো শহরে, দেখা যায়নি কোনো নারীকেও। সামাজিক প্রতিবাদ-প্রতিরোধ হলে অবশ্যই নারীদের অংশগ্রহণ থাকত, যেমনটি দেখা গেছে তিউনিসিয়ায় ও মিসরে। প্রতিবাদী ব্যানার-ফেস্টুন নয়, একে ৪৭ রাইফেল আর রকেট প্রপেল্ড গ্রেনেডের মতো ভারী ও স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে গাদ্দাফিবিরোধী একদল যুবক ‘বিদ্রোহ’ শুরু করে দেয় বেনগাজি শহর থেকে। এই যুবকেরা এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ কোথায় পেয়েছে? লিবিয়ার মতো কঠোর পুলিশি রাষ্ট্রে, যেখানে গাদ্দাফির সমালোচনা করে একটা শব্দ উচ্চারণ করতেও লোকে ভয় পেত, সেখানে হঠাৎ করে বেশ কিছুসংখ্যক তরুণ-যুবকের হাতে ভারী আগ্নেয়াস্ত্র এসেছিল কোথা থেকে?
এত দিনে আর কোনো সন্দেহ নেই যে পশ্চিমা বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো, বিশেষ করে, ভূরাজনৈতিক অবস্থানের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমধ্যসাগরের ওপারের দেশ ফ্রান্সের একটা বড় হাত ছিল একদম গোড়া থেকেই। ব্রিটিশরাও এসে ফ্রান্সের সঙ্গে হাত মেলায়। আর আটলান্টিকের ওপারের বড় সর্দার যুক্তরাষ্ট্র তো রয়েছেই। তারা লিবিয়ার ‘রেজিম চেঞ্জ’-এর উদ্দেশ্যে বিদ্রোহীদের আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ, গোয়েন্দা তথ্য ও কৌশলগত পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করতে থাকে। কিন্তু গাদ্দাফির বিপুল ও শক্তিশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে তারা যখন পেরে উঠছিল না, তখন ন্যাটো জোটের মাধ্যমে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো দেশটিতে আগ্রাসন শুরু করে দেয়। লিবিয়ার বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদের দিকে তাদের বড্ড লোভ। তিউনিসিয়া-মিসরে যে আরব বসন্ত এসেছে, লিবিয়ায় তা আসবে না জেনে দেশটিতে তারা কালবৈশাখীর আয়োজন করেছিল।
তিন. কে থামাবে এই ঝড়
স্বৈরশাসনের পতন ঘটিয়ে গণতন্ত্র রপ্তানির নামে লিবিয়ায় একদল মানুষের হাতে অস্ত্র, গোলাবারুদ, টাকাপয়সা আর কূটবুদ্ধি দিয়ে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো লিবিয়ায় যে লন্ডভন্ড কাণ্ড ঘটিয়ে দিল, তার পরিণতি কী হতে পারে? অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ একাধিক মানবাধিকার সংস্থা উদ্বেগের সঙ্গে জানিয়েছে, গাদ্দাফির অনুসারী লোকজনের ওপর বর্বরতা শুরু হয়ে গেছে।
লিবিয়া বহু গোত্রে বিভক্ত একটি দেশ, যেখানে আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণাটি এখনো স্বচ্ছ নয়। গণতন্ত্র, আইনের শাসন—এ ধরনের পশ্চিমা ধারণার প্রেক্ষাপটে দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিচার করা যাবে না। ইতিহাসের কোনো কালেই সেখানে গণতন্ত্র ছিল না। কোনো রাজনৈতিক দলও দেশটিতে নেই। যারা গাদ্দাফিকে হটিয়ে দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিয়েছে, তাদের মধ্যে একটা বড় অংশ গুন্ডাপান্ডা ধরনের মানুষ। বিভিন্ন অঞ্চল বিভক্ত বিভিন্ন গোত্রে। মানুষের হাতে হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। আর রাজনৈতিক ওলট-পালটের ফলে অর্থনৈতিক অবস্থা হয়ে পড়েছে বিপর্যস্ত। এসব দেখেশুনে অনেক বিশ্লেষক বলছেন, লিবিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পরের কথা, আগে কীভাবে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা যায়, সেটাই ভাবনার বিষয়।
গাদ্দাফি জবরদস্ত স্বৈরশাসক ছিলেন বটে। কিন্তু তিনি বহু গোত্রে বিভক্ত লিবীয় সমাজকে একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন; লৌহদৃঢ় শাসনদণ্ড ব্যবহার করে হলেও জনজীবনে মোটামুটি শান্তি আনতে পেরেছিলেন। অবশ্য ব্যক্তিস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সে দেশে ছিল না। কিন্তু গাদ্দাফিকে উৎখাত করতে গিয়ে যে রক্তপাতের সূচনা ঘটানো হলো, তা বন্ধ করা খুব সহজ হবে না। এ মাসের ৩১ তারিখের মধ্যে ন্যাটো বাহিনী লিবিয়া ছেড়ে চলে যাবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। স্বঘোষিত ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিল এখন দেশটির এই লন্ডভন্ড পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেবে, সেটাই দেখার বিষয়। ইরাকিদের মতো লিবীয় জনগণের জীবনেও যেন রক্তপাত, নিরাপত্তাহীনতা আর আর্থিক দুর্দশার দীর্ঘ প্রহর নেমে না আসে।
মশিউল আলম: সাংবাদিক
mashiul.alam@gmail.com
No comments