প্রতিক্রিয়া-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চাই, বাণিজ্য নয় by মামুনূর রশীদ
সরকার শিক্ষার ব্যাপারে সহযোগী ভূমিকা নেবে_ এটাই স্বাভাবিক। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে যদি সঙ্গত কারণে আইন বদল করা যায়, তাহলে বাস্তবিকতার বিচারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে আইন পরিবর্তন বা শিথিল করতে এত অনীহা কেন? এই যুগের ঢাকা শহরে এক একর, তাও 'অখণ্ড', ক্যাম্পাস নিয়ে জোরাজুরিকি খুব যুক্তিসঙ্গত?
'বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চাই, বাণিজ্য নয়' শিরোনামে গত ২৬ জানুয়ারি প্রকাশিত ড. তারেক শামসুর রেহমানের লেখাটি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ড. রেহমান দেশের স্বনামধন্য একজন শিক্ষাবিদ ও ইউজিসির একজন সাবেক সদস্য। অতএব উচ্চশিক্ষা সম্পর্কিত তার যে কোনো লেখাই আমি গুরুত্বসহকারে পড়ি। এরপরও তিনি আমার মতো সামান্য একজন প্রভাষকের একটি লেখা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন_ এতে আমি এ বিষয়ে চিন্তা করতে আরও উৎসাহিত বোধ করছি। কিন্তু তিনি বলেছেন, আমি নাকি 'টাকার মোহে' বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে কথা বলছি। একজন দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ তার সঙ্গে মতের মিল না হওয়ায় একজন নগণ্য প্রভাষককে এভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণ করায় আমি বিস্মিত ও দুঃখিত। উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে তিনি যেসব কথা বলেছেন, সেখানে কিছু বিষয় আরেকটু খোলাসা করার সুযোগ আছে বলেই এ লেখার অবতারণা।
ড. রেহমান এ বিষয়ে তার দ্বিতীয় লেখায় বিস্তর নতুন বিষয়ের অবতারণা করেছেন। তার অনেক কথাই সঙ্গত; কিন্তু অনেক মন্তব্যই অতিরিক্ত তীব্র ও ঢালাও হওয়ায় সম্পূর্ণ সঠিক নয়। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অতিরিক্ত সুবিধাদানের অভিযোগে একটি রিপোর্টের সূত্র ধরে এটি গোটা আলোচনার সূত্রপাত, কিন্তু বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন অবারিত সুযোগ দান ও তার ফলে কার্যত দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি চরম বৈষম্যের ব্যাপারে ড. রেহমান এক রকম নিশ্চুপ। তার অসংখ্য কথার জবাব দেওয়া বা বিশ্লেষণ করা এ ক্ষুদ্র পরিসরে সম্ভব নয়। তবু তার নেতিবাচক সবচেয়ে কয়েকটি কথার সঙ্গে বাস্তব চিত্রের যে পার্থক্য তা তুলে ধরা বাঞ্ছনীয়।
ড. রেহমান 'খোদ ৫৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট বাণিজ্য' নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন। তিনি কী করে জানলেন প্রত্যেকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ই সার্টিফিকেট বাণিজ্যে জড়িত? অতীতে কখনও এ খাতের ঘোর সমালোচকও এমন অভিযোগ করেননি। যারা এ খাত সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন তারা জানেন যে, এ খাতে এখন দশ-বারোটি প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়ে গেছে। তাদের সেরা ছাত্ররা ভালো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। আরও এক ডজন আছে যারা অত জোরদার না হলেও তারা মান উন্নয়নের ব্যাপারে আন্তরিক। বাকিদের যতই দুর্বলতা থাকুক না কেন, তাদেরও সবাই 'সার্টিফিকেট বাণিজ্যে' দুষ্ট নয়। খুব জোর এক কী দেড় ডজন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যারা আউটার ক্যাম্পাসের নামে, এমনকি মূল ক্যাম্পাস থেকেও, ঠিকমতো ক্লাস-পরীক্ষা ছাড়াই সার্টিফিকেট দিয়ে থাকে। তাদের ব্যাপারে অবশ্যই সরকারের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। তা না করে সরকার কেন 'অখণ্ড এক একর' মাপের স্থায়ী ক্যাম্পাসের ব্যাপারে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চড়াও হয়েছে, এটাই প্রশ্নের ব্যাপার। আবার এ স্থায়ী ক্যাম্পাসের দুরূহ শর্তে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোপুরি ছাড় দেওয়া হচ্ছে। সমকালে এ বিষয়ে একটি রিপোর্টের জবাব দিতে গিয়েই ড. রেহমান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গে চলে যান। এখানে লক্ষণীয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তিনি সঠিক-বেঠিক অনেক মন্তব্য করলেও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়দের বিপুল ছাড় দেওয়ার ব্যাপারে দুটি লেখাতেই নীরব।
ড. রেহমান আরও লিখেছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল্ড মেডেলধারীদের একজনও নাকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার যোগ্য নয়। আবারও একটি অত্যন্ত ঢালাও মন্তব্য। গত দশকে যে দেড় কি দুইশ' শিক্ষার্থী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গোল্ড মেডেল পেয়েছেন তাদের একজনও পারত না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে? তিনি কি জানেন যে এদের অনেকেই, এমনকি গোল্ড মেডেল না পাওয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক গ্র্যাজুয়েটই, পূর্ণ বৃত্তি নিয়ে হার্ভার্ড, কলাম্বিয়া, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সসহ বিশ্বসেরা নানা প্রতিষ্ঠানে গেছে মাস্টার্স বা পিএইডি করতে? যারা বিশ্ব র্যাংকিংয়ে সেরা দশ থেকে একশ'তে স্থান পাওয়া প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারে, তারা কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে পারত না? এ ধরনের মন্তব্য এ খাতের প্রতি আমাদের অনেক শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীরই অতিরিক্ত যে বিদ্বেষ তার প্রতিফলন দেখা যায়। একই সঙ্গে এও বোঝা যায় যে, ড. রেহমান এ খাতের পরিবর্তনশীল চিত্রের সঙ্গে সম্যক পরিচিত নন। সে রকম পরিচিতি থাকলে তিনি জানতেন যে দেশের অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীই আজকাল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট ও সহিংসতার কারণে তাদের প্রথম পছন্দ হিসেবেই বেছে নেয় সেরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটিকে।
লেখক উল্লেখ করেছেন, আশির দশকে আইবিএ থেকে এমবিএ করা গ্র্যাজুয়েটরা ৩০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতেন, অথচ এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা ১৫ হাজার টাকার নিচে চাকরি শুরু করেন। আশির দশকে আইবিএ থেকে কয়েকজন হাতেগোনা গ্র্যাজুয়েট ৩০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতেন। এখন চাকরির বাজারও বিশাল এবং চাকরি প্রার্থীদের সংখ্যাও অনেক বেশি। এখন একদিকে যেমন অনেকে পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকায় চাকরি শুরু করছে, তেমনি অনেকে পনের হাজার টাকায়ও কাজ শুরু করছে। উভয় শ্রেণীর সংখ্যাই অতীতের চেয়ে অনেক বেশি। কেবল দুর্বলতর শ্রেণীর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট ও তাদের অর্জন সম্পর্কে একটি আংশিক চিত্রকেই পূর্ণ চিত্র হিসেবে উপস্থাপন করাটা যুক্তিসঙ্গত নয়।
ড. রেহমান তার লেখায় এও দাবি করেছেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকি বারো বছরের কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কেউ অধ্যাপক হতে পারে না। নীতিতে তা থাকতে পারে; কিন্তু এ নীতির ব্যতিক্রম অনেকের বিষয় আমি ব্যক্তিগতভাবেই অবগত। খোঁজ নিলে হয়তো আরও অনেক ঘটনাই বের হবে। মূল কথা হলো, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের যেমন অনেক লঙ্ঘন আছে, তেমনি সেশনজট থেকে সহিংসতা, শিক্ষকদের অনুপস্থিতি থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস বা দল বেঁধে ফার্স্ট ক্লাস দেওয়া জাতীয় অনেক কেলেঙ্কারিই আছে। অনিয়ম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একচেটিয়া কোনো ব্যাপার নয়। আমাদের উচিত, সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতেরই ভালো-মন্দ দুই দিকই বিচার করা। কেবল একপক্ষের দুর্বলতমদের অনিয়মের সূত্র ধরে একটি গোটা খাতের অবমাননা গঠনমূলক সমালোচনা বলে মনে হয় না।
কিছুদিন আগে জগন্নাথ বিশ্ববদ্যালয়ে ছাত্র বিক্ষোভের মুখে সরকার তার আইন পরিবর্তন করে সরকারি খরচে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। কুমিল্লা ও কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সরকার শিক্ষার ব্যাপারে সহযোগী ভূমিকা নেবে_ এটাই স্বাভাবিক। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে যদি সঙ্গত কারণে আইন বদল করা যায়, তাহলে বাস্তবিকতার বিচারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে আইন পরিবর্তন বা শিথিল করতে এত অনীহা কেন? এই যুগের ঢাকা শহরে এক একর, তাও 'অখণ্ড', ক্যাম্পাস নিয়ে জোরাজুরি কি খুব যুক্তিসঙ্গত? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে আইনের একটি গোটা ধারাই বাতিল করা গেল, অথচ বেসরকারিগুলোর ক্ষেত্রে 'অখণ্ড'র মতো একটি শব্দও বদলানো যাবে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যেখানে এমন বৈষম্য বিদ্যমান, সেখানে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওই ক্যাম্পাসের প্রশ্নের কেবল ভাড়া বাড়ির শর্তেই আসতে দেওয়া কি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে যায় না?
ড. রেহমান তার লেখায় অসংখ্য নতুন কথা টেনে এনেছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য অনেক নতুন নীতির প্রস্তাব করেছেন। এত কথার বিশ্লেষণ এ ক্ষুদ্র লেখায় সম্ভব নয়। তার অনেক প্রস্তাব নিশ্চয়ই বিবেচনাযোগ্য। তবে এসব নীতির আড়ালে আছে এক ধরনের 'সেন্ট্রাল প্ল্যানিং' বা 'কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ'-এর মানসিকতা। এ ধরনের প্লানিং খুব কম দেশেই খুব কম খাতেই দীর্ঘমেয়াদে মঙ্গলকর হয়েছে। বিশেষ করে জ্ঞানভিত্তিক খাতে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ কাম্য নয়। অতিরিক্ত সরকারি খবরদারি যে সাধারণত দুর্নীতিরই অনুপ্রবেশ বা বিস্তার ঘটায় এটাও সুবিদিত। অতএব, ভালো নীতিমালা অবশ্যই বিবেচনাযোগ্য; কিন্তু সেটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খাতের চরিত্র ক্ষুণ্ন না করে এবং এ খাত সম্পর্কে সম্যক ধারণার ভিত্তিতে, যথাযথ মর্যাদা ও সহানুভূতির সঙ্গে প্রণীত হওয়া জরুরি।
সর্বশেষ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তো অনেক কথা হলো; কিন্তু যে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে এ আলাপের সূত্রপাত, তাদের দেশিগুলোর তুলনায় স্থায়ী ক্যাম্পাসসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিপুল ছাড় দিয়ে নীতিমালা প্রণয়নের ব্যাপারে ড. রেহমান একবারও কেন কোনো আপত্তি করলেন না, সেটা না জানাই থেকে গেল।
মামুনূর রশীদ : প্রভাষক, ইতিহাস বিভাগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
ড. রেহমান এ বিষয়ে তার দ্বিতীয় লেখায় বিস্তর নতুন বিষয়ের অবতারণা করেছেন। তার অনেক কথাই সঙ্গত; কিন্তু অনেক মন্তব্যই অতিরিক্ত তীব্র ও ঢালাও হওয়ায় সম্পূর্ণ সঠিক নয়। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অতিরিক্ত সুবিধাদানের অভিযোগে একটি রিপোর্টের সূত্র ধরে এটি গোটা আলোচনার সূত্রপাত, কিন্তু বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন অবারিত সুযোগ দান ও তার ফলে কার্যত দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি চরম বৈষম্যের ব্যাপারে ড. রেহমান এক রকম নিশ্চুপ। তার অসংখ্য কথার জবাব দেওয়া বা বিশ্লেষণ করা এ ক্ষুদ্র পরিসরে সম্ভব নয়। তবু তার নেতিবাচক সবচেয়ে কয়েকটি কথার সঙ্গে বাস্তব চিত্রের যে পার্থক্য তা তুলে ধরা বাঞ্ছনীয়।
ড. রেহমান 'খোদ ৫৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট বাণিজ্য' নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন। তিনি কী করে জানলেন প্রত্যেকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ই সার্টিফিকেট বাণিজ্যে জড়িত? অতীতে কখনও এ খাতের ঘোর সমালোচকও এমন অভিযোগ করেননি। যারা এ খাত সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন তারা জানেন যে, এ খাতে এখন দশ-বারোটি প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়ে গেছে। তাদের সেরা ছাত্ররা ভালো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। আরও এক ডজন আছে যারা অত জোরদার না হলেও তারা মান উন্নয়নের ব্যাপারে আন্তরিক। বাকিদের যতই দুর্বলতা থাকুক না কেন, তাদেরও সবাই 'সার্টিফিকেট বাণিজ্যে' দুষ্ট নয়। খুব জোর এক কী দেড় ডজন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যারা আউটার ক্যাম্পাসের নামে, এমনকি মূল ক্যাম্পাস থেকেও, ঠিকমতো ক্লাস-পরীক্ষা ছাড়াই সার্টিফিকেট দিয়ে থাকে। তাদের ব্যাপারে অবশ্যই সরকারের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। তা না করে সরকার কেন 'অখণ্ড এক একর' মাপের স্থায়ী ক্যাম্পাসের ব্যাপারে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চড়াও হয়েছে, এটাই প্রশ্নের ব্যাপার। আবার এ স্থায়ী ক্যাম্পাসের দুরূহ শর্তে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোপুরি ছাড় দেওয়া হচ্ছে। সমকালে এ বিষয়ে একটি রিপোর্টের জবাব দিতে গিয়েই ড. রেহমান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গে চলে যান। এখানে লক্ষণীয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তিনি সঠিক-বেঠিক অনেক মন্তব্য করলেও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়দের বিপুল ছাড় দেওয়ার ব্যাপারে দুটি লেখাতেই নীরব।
ড. রেহমান আরও লিখেছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল্ড মেডেলধারীদের একজনও নাকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার যোগ্য নয়। আবারও একটি অত্যন্ত ঢালাও মন্তব্য। গত দশকে যে দেড় কি দুইশ' শিক্ষার্থী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গোল্ড মেডেল পেয়েছেন তাদের একজনও পারত না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে? তিনি কি জানেন যে এদের অনেকেই, এমনকি গোল্ড মেডেল না পাওয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক গ্র্যাজুয়েটই, পূর্ণ বৃত্তি নিয়ে হার্ভার্ড, কলাম্বিয়া, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সসহ বিশ্বসেরা নানা প্রতিষ্ঠানে গেছে মাস্টার্স বা পিএইডি করতে? যারা বিশ্ব র্যাংকিংয়ে সেরা দশ থেকে একশ'তে স্থান পাওয়া প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারে, তারা কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে পারত না? এ ধরনের মন্তব্য এ খাতের প্রতি আমাদের অনেক শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীরই অতিরিক্ত যে বিদ্বেষ তার প্রতিফলন দেখা যায়। একই সঙ্গে এও বোঝা যায় যে, ড. রেহমান এ খাতের পরিবর্তনশীল চিত্রের সঙ্গে সম্যক পরিচিত নন। সে রকম পরিচিতি থাকলে তিনি জানতেন যে দেশের অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীই আজকাল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট ও সহিংসতার কারণে তাদের প্রথম পছন্দ হিসেবেই বেছে নেয় সেরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটিকে।
লেখক উল্লেখ করেছেন, আশির দশকে আইবিএ থেকে এমবিএ করা গ্র্যাজুয়েটরা ৩০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতেন, অথচ এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা ১৫ হাজার টাকার নিচে চাকরি শুরু করেন। আশির দশকে আইবিএ থেকে কয়েকজন হাতেগোনা গ্র্যাজুয়েট ৩০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতেন। এখন চাকরির বাজারও বিশাল এবং চাকরি প্রার্থীদের সংখ্যাও অনেক বেশি। এখন একদিকে যেমন অনেকে পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকায় চাকরি শুরু করছে, তেমনি অনেকে পনের হাজার টাকায়ও কাজ শুরু করছে। উভয় শ্রেণীর সংখ্যাই অতীতের চেয়ে অনেক বেশি। কেবল দুর্বলতর শ্রেণীর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট ও তাদের অর্জন সম্পর্কে একটি আংশিক চিত্রকেই পূর্ণ চিত্র হিসেবে উপস্থাপন করাটা যুক্তিসঙ্গত নয়।
ড. রেহমান তার লেখায় এও দাবি করেছেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকি বারো বছরের কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কেউ অধ্যাপক হতে পারে না। নীতিতে তা থাকতে পারে; কিন্তু এ নীতির ব্যতিক্রম অনেকের বিষয় আমি ব্যক্তিগতভাবেই অবগত। খোঁজ নিলে হয়তো আরও অনেক ঘটনাই বের হবে। মূল কথা হলো, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের যেমন অনেক লঙ্ঘন আছে, তেমনি সেশনজট থেকে সহিংসতা, শিক্ষকদের অনুপস্থিতি থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস বা দল বেঁধে ফার্স্ট ক্লাস দেওয়া জাতীয় অনেক কেলেঙ্কারিই আছে। অনিয়ম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একচেটিয়া কোনো ব্যাপার নয়। আমাদের উচিত, সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতেরই ভালো-মন্দ দুই দিকই বিচার করা। কেবল একপক্ষের দুর্বলতমদের অনিয়মের সূত্র ধরে একটি গোটা খাতের অবমাননা গঠনমূলক সমালোচনা বলে মনে হয় না।
কিছুদিন আগে জগন্নাথ বিশ্ববদ্যালয়ে ছাত্র বিক্ষোভের মুখে সরকার তার আইন পরিবর্তন করে সরকারি খরচে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। কুমিল্লা ও কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সরকার শিক্ষার ব্যাপারে সহযোগী ভূমিকা নেবে_ এটাই স্বাভাবিক। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে যদি সঙ্গত কারণে আইন বদল করা যায়, তাহলে বাস্তবিকতার বিচারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে আইন পরিবর্তন বা শিথিল করতে এত অনীহা কেন? এই যুগের ঢাকা শহরে এক একর, তাও 'অখণ্ড', ক্যাম্পাস নিয়ে জোরাজুরি কি খুব যুক্তিসঙ্গত? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে আইনের একটি গোটা ধারাই বাতিল করা গেল, অথচ বেসরকারিগুলোর ক্ষেত্রে 'অখণ্ড'র মতো একটি শব্দও বদলানো যাবে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যেখানে এমন বৈষম্য বিদ্যমান, সেখানে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওই ক্যাম্পাসের প্রশ্নের কেবল ভাড়া বাড়ির শর্তেই আসতে দেওয়া কি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে যায় না?
ড. রেহমান তার লেখায় অসংখ্য নতুন কথা টেনে এনেছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য অনেক নতুন নীতির প্রস্তাব করেছেন। এত কথার বিশ্লেষণ এ ক্ষুদ্র লেখায় সম্ভব নয়। তার অনেক প্রস্তাব নিশ্চয়ই বিবেচনাযোগ্য। তবে এসব নীতির আড়ালে আছে এক ধরনের 'সেন্ট্রাল প্ল্যানিং' বা 'কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ'-এর মানসিকতা। এ ধরনের প্লানিং খুব কম দেশেই খুব কম খাতেই দীর্ঘমেয়াদে মঙ্গলকর হয়েছে। বিশেষ করে জ্ঞানভিত্তিক খাতে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ কাম্য নয়। অতিরিক্ত সরকারি খবরদারি যে সাধারণত দুর্নীতিরই অনুপ্রবেশ বা বিস্তার ঘটায় এটাও সুবিদিত। অতএব, ভালো নীতিমালা অবশ্যই বিবেচনাযোগ্য; কিন্তু সেটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খাতের চরিত্র ক্ষুণ্ন না করে এবং এ খাত সম্পর্কে সম্যক ধারণার ভিত্তিতে, যথাযথ মর্যাদা ও সহানুভূতির সঙ্গে প্রণীত হওয়া জরুরি।
সর্বশেষ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তো অনেক কথা হলো; কিন্তু যে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে এ আলাপের সূত্রপাত, তাদের দেশিগুলোর তুলনায় স্থায়ী ক্যাম্পাসসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিপুল ছাড় দিয়ে নীতিমালা প্রণয়নের ব্যাপারে ড. রেহমান একবারও কেন কোনো আপত্তি করলেন না, সেটা না জানাই থেকে গেল।
মামুনূর রশীদ : প্রভাষক, ইতিহাস বিভাগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
No comments