যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচন by ফখরুজ্জামান চৌধুরী
কথা প্রসঙ্গে ম্যাসাচুসেটসের বিখ্যাত ওয়েন্টওয়ার্ম ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির সমাজতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর, গবেষক ও সমাজ সচেতন লড়াকু মানবাধিকার কর্মী জর্জ কাটসিয়াফিকাসকে এক দিন টেলিফোনে বলেছিলাম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা জাগতিক বিষয় নিয়ে যতটা আত্মমগ্ন থাকে, সমাজ কিংবা রাজনীতি নিয়ে যদি তার ছিটেফোঁটা উৎসাহ দেখাতো!
যুক্তরাষ্ট্রে আমার অবস্থান খুব বেশি দিনের নয়। যাকে বলে, বুধে বুধে-সাত দিন। তার পরও পথ চলতে গিয়ে যা দেখেছি, শুনেছি তার আলোকেই এই উক্তি করা। কথাটা মাটিতে পড়ে সারেনি, তৎক্ষণিক জবাব এলো প্রফেসরের কাছ থেকে। যেন বন্দুকে টোঁটা ভরাই ছিল, শুধু ট্রিগার টেপার অপেক্ষা।
তার আগে বরং প্রফেসর জর্জ কাটসিয়াফিকাসের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া যাক। গ্রিক বাবা এবং মিসরীয় মায়ের সন্তান জর্জ আরাম কেদারায় উপবিষ্ট প্রফেসরদের মতো কোনো ব্যক্তি নন। যেখানে নির্যাতিত মানুষ প্রতিবাদে মুখর, সেখানেই উপস্থিতি জর্জের। সাম্প্রতিক মিসরীয় বিপ্লবের ওপর ইতিমধ্যে লেখা তাঁর গবেষণালব্ধ গ্রন্থ 'পিপল পাওয়ার ইন কায়রো', ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১১ সালে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তাঁর প্রামাণ্য গ্রন্থ 'দ্য রিয়েল ইজিপসিয়ান রেভ্যলুশন' এখনো প্রকাশের অপেক্ষায়।
এশিয়ার বিভিন্ন দেশে নানা সময়ে ঘটে যাওয়া অর্ধসমাপ্ত বিপ্লব নিয়ে তিনি গবেষণা করেছেন। গবেষণার উপাত্ত সংগ্রহ করার জন্য ২০১১ সালে সংক্ষিপ্ত সফরে তিনি বাংলাদেশেও গিয়েছিলেন। তাঁর গবেষণালব্ধ ফলাফল নিয়ে দুই খণ্ডে প্রকাশিতব্য গ্রন্থ 'এশিয়াস আননোন আপরাইজিংস' (এশিয়ার অজানা অভ্যুত্থানসমূহ)। তাঁর লেখায় উল্লেখ থাকবে উত্তর কোরিয়ায় ২০ শতকে অনুষ্ঠিত সামাজিক আন্দোলন এবং ফিলিপাইন, মিয়ানমার, তিব্বত, চীন, তাইওয়ান, নেপাল, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়ায় বিভিন্ন সময়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন-সংগ্রামের কথা।
বিখ্যাত পণ্ডিত অধ্যাপক হার্বার্ট মারকুস্যের ছাত্র, ফুলব্রাইট স্কলার জর্জ কাটসিয়াফিকাস নিজেকে এক 'সমাজ সচেতন কর্মী' হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
বাংলাদেশের জন্য তাঁর এক ধরনের মমত্ববোধ আছে, যার কারণ তিনি নিজেও ব্যাখ্যা করতে পারেন না। তাঁর কয়েকটি প্রবন্ধের আমার করা অনুবাদ বাংলাদেশের কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। ছাপার হরফে বাংলা তাঁর অবোধ্য। রসিকতা করে বলেছিলেন, এই যে আমি গ্রিক, সেই আমার কাছেই তোমার ভাষা সত্যি গ্রিক তুল্য। তবু বলেছিলেন, তাঁর ওয়েবসাইটে বাংলা অনুবাদ পোস্ট করবেন।
তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল মার্কিন রাজনীতির বর্তমান ধারা এবং যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রসঙ্গে। বলেছিলাম, মার্কিনিরা রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায় না।
তিনি বলেছিলেন, ওয়েল, তুমি যদি মার্কিনি বলতে আমার মতো সাধারণ মার্কিনিদের বুঝিয়ে থাকো, তাহলে তোমার ধারণা ঠিক। তবে নির্বাচন নিয়ে তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে দিনরাত, যারা এই নির্বাচনের ফলাফলের স্টেক হোল্ডার। যাদের স্বার্থ জড়িত, তারা পর্দার আড়ালে ঠিকই কাজ করে যাচ্ছে।
তবে মার্কিন শাসনতন্ত্রে এমন কিছু বিধান রেখেছেন রাষ্ট্রপিতারা, যার কারণে এখন মসৃণভাবে অনেক কিছুই হয়ে যায়। নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের মেয়াদকাল চার বছর ঠিক করা আছে শাসনতন্ত্রে। একজন দুবারের বেশি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না, আপৎকালীন জরুরি পরিস্থিতি ছাড়া। ১৯৫১ সালে গৃহীত শাসনতন্ত্রের ২২তম সংশোধনী বলে এক ব্যক্তির তৃতীয় পূর্ণ মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার বিধান লুপ্ত করা হয়েছে। তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার একমাত্র রেকর্ডের অধিকারী হলেন ফ্র্যাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট (জন্ম : ৩০ জানুয়ারি, ১৮৮২, মৃত্যু : ১২ এপ্রিল, ১৯৪৫) যুক্তরাষ্ট্রের ৩২তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত। অভূতপূর্ব এই যে ১২ বছরের প্রেসিডেন্ট হিসেবে এফডিআর নামে জনপ্রিয় ব্যক্তিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনা করেন, তার পটভূমি হিসেবে দায়ী ছিল বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা (তিরিশের মহামন্দা) এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে 'হ্যাপি ডেইজ আর হেয়ার এগেইন' গানটি শুধু সুরের কারণেই নয়, লিরিকের আবেদনেও নির্বাচকদের মন জয় করে।
বিশ্বের মহারণমঞ্চে তখন রুজভেল্টের সহযোগী ছিলেন গ্রেট ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী স্যার উইনস্টোন চার্চিল ও সোভিয়েত ইউনিয়নের একচ্ছত্র নেতা জোসেফ স্টালিন। এই তিন নেতার রণকৌশলের কাছে পর্যুদস্ত হয় অক্ষশক্তি নামে পরিচিত দুর্ধর্ষ জার্মানি, ইতালি ও জাপান। কিন্তু রুজভেল্টের দুর্ভাগ্য, যুদ্ধে মিত্রশক্তির বিজয়ের মাত্র কিছুদিন আগে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মহাশক্তিধর জার্মানির এডলফ হিটলার, ইতালির বেনিনো মুসোলিনি আর জাপানের সম্রাট হিরোহিতো (যুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিল গৌণ) এবং শক্তিধর প্রধানমন্ত্রী জেনারেল হিদেকি তোজোর সম্মিলিত বাহিনী মিত্রবাহিনীর কাছে পরাজয় বরণ করে। রণমঞ্চে ইতিহাসের এক মহাসন্ধিক্ষণে সর্বকালের সেরা সেনাপতিদের সমাবেশ ঘটেছিল মিত্রবাহিনীর পক্ষে। জেনারেল আইজেন হাওয়ার, ফিল্ড মার্শাল স্যার বার্নার্ড ল' মন্টেগোমারি, জেনারেল ওমর ব্র্যাডলি, এয়ার চিফ মার্শাল আর্থার টেডার, অ্যাডমিরাল রামসে প্রমুখের নাম যুদ্ধের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে।
যুক্তরাষ্ট্র তথা মিত্রবাহিনীর পক্ষের দেশগুলো যুদ্ধ শেষে বিজয়ীর মতো দেশ পুনর্গঠনে পূর্ণশক্তি নিয়োগ করে। যুদ্ধ শেষের আগেই এফডিআরের মৃত্যু হলে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৩তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলেন ডেমোক্রেট দলের মনোনীত প্রার্থী হ্যারি এস ট্রুম্যান (১৮৮৪-১৯৭২)। পর পর দুবার তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন ১২ এপ্রিল, ১৯৪৫ থেকে জানুয়ারি ২০, ১৯৫৩ পর্যন্ত।
যুক্তরাষ্ট্রের শাসনভার এখন ডেমোক্রেটদের হাতে। এখন চলছে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য রিপাবলিকান প্রার্থী নির্বাচনের প্রাইমারি পর্যায়।
প্রাইমারি পর্যায়ে মনোনয়ন লাভের প্রতিযোগিতায় ময়দানে নামেন ৯ জন। একে একে নিভিছে দেউটির মতো ইতিমধ্যেই ঝরে পড়ছেন প্রার্থীদের কেউ কেউ।
প্রাইমারি রাউন্ডে প্রার্থিতা ঘোষণা করা এবং কিছুদিন পরে রণে ভঙ্গ দেওয়ার পেছনে থাকে চমকপ্রদ সব ঘটনা, যা এতকাল ছিল অপ্রকাশ্য। পরের বারে ওই বিষয়ে বলা যাবে।
ইতিমধ্যে একটি দুঃখজনক ঘটনায় নির্বাচনের আমেজে ভাটা পড়েছে কিছুটা।
হাউস অব রিপ্রেজেনটোটিভের ডেমোক্র্যাটিক দলীয় সদস্যা গ্যাব্রিয়েল গিফোর্ড (জন্ম : ৮ জুন, ১৯৭০) তাঁর নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্যদের সঙ্গে আরিজোনা রাজ্যের টুসনে (ঞটঝঈঙঘ) খোলামেলাভাবে মতবিনিময় করছিলেন ২০১১ সালের ৮ জানুয়ারি। অকস্মাৎ সেফওয়ে গ্রোসারি স্টোরে ক্ষিপ্ত এক তরুণের আগ্নেয়াস্ত্রের নিক্ষিপ্ত গুলিতে তাৎক্ষণিক মৃত্যু হলো ছয় জনের। আহত হলেন বিশ জন। জেরেড লি লোকনাইর। গ্যাবি গিফোর্ড গুলিবিদ্ধ হলেন মস্তিষ্কে। বুলেট গেঁথে গেল তাঁর মগজে। এক বছর জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে সাহসী লড়াই করে চলি্লশোর্ধ্ব গ্যাবি মার্কিনিদের হৃদয়-মন জয় করেছেন। জীবনযুদ্ধে অকুতোভয় এই নারী তাঁর মহাকাশচারী স্বামী মার্ক ই কেলির নেতৃত্বে মহাকাশ যান এনডেভারের উড়াল দেখার জন্য সশরীরে উপস্থিত হন ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টারে (২০১১ সালের ১৬ মে)।
অকুতোভয় এই নারী ২৫ জানুয়ারি, ২০১২ সালে হাউসে স্বয়ং উপস্থিত থেকে পদত্যাগের কথা ঘোষণা করলেন। বললেন, এখন আমাকে মনোযোগ দিতে হবে শারীরিক সুস্থতা লাভের জন্য।
দলমত নির্বিশেষে সব সদস্য দাঁড়িয়ে করতালির মধ্য দিয়ে বিদায় জানালেন তাঁদের প্রিয় সহকর্মী গ্যাবিকে। সবার চোখে ছিল বাঁধভাঙা অশ্রুর বন্যা। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁকে বললেন, সাহসী এক নারীর প্রতিমূর্তি।
লেখক : কথা সাহিত্যিক ও অনুবাদক
তার আগে বরং প্রফেসর জর্জ কাটসিয়াফিকাসের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া যাক। গ্রিক বাবা এবং মিসরীয় মায়ের সন্তান জর্জ আরাম কেদারায় উপবিষ্ট প্রফেসরদের মতো কোনো ব্যক্তি নন। যেখানে নির্যাতিত মানুষ প্রতিবাদে মুখর, সেখানেই উপস্থিতি জর্জের। সাম্প্রতিক মিসরীয় বিপ্লবের ওপর ইতিমধ্যে লেখা তাঁর গবেষণালব্ধ গ্রন্থ 'পিপল পাওয়ার ইন কায়রো', ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১১ সালে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তাঁর প্রামাণ্য গ্রন্থ 'দ্য রিয়েল ইজিপসিয়ান রেভ্যলুশন' এখনো প্রকাশের অপেক্ষায়।
এশিয়ার বিভিন্ন দেশে নানা সময়ে ঘটে যাওয়া অর্ধসমাপ্ত বিপ্লব নিয়ে তিনি গবেষণা করেছেন। গবেষণার উপাত্ত সংগ্রহ করার জন্য ২০১১ সালে সংক্ষিপ্ত সফরে তিনি বাংলাদেশেও গিয়েছিলেন। তাঁর গবেষণালব্ধ ফলাফল নিয়ে দুই খণ্ডে প্রকাশিতব্য গ্রন্থ 'এশিয়াস আননোন আপরাইজিংস' (এশিয়ার অজানা অভ্যুত্থানসমূহ)। তাঁর লেখায় উল্লেখ থাকবে উত্তর কোরিয়ায় ২০ শতকে অনুষ্ঠিত সামাজিক আন্দোলন এবং ফিলিপাইন, মিয়ানমার, তিব্বত, চীন, তাইওয়ান, নেপাল, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়ায় বিভিন্ন সময়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন-সংগ্রামের কথা।
বিখ্যাত পণ্ডিত অধ্যাপক হার্বার্ট মারকুস্যের ছাত্র, ফুলব্রাইট স্কলার জর্জ কাটসিয়াফিকাস নিজেকে এক 'সমাজ সচেতন কর্মী' হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
বাংলাদেশের জন্য তাঁর এক ধরনের মমত্ববোধ আছে, যার কারণ তিনি নিজেও ব্যাখ্যা করতে পারেন না। তাঁর কয়েকটি প্রবন্ধের আমার করা অনুবাদ বাংলাদেশের কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। ছাপার হরফে বাংলা তাঁর অবোধ্য। রসিকতা করে বলেছিলেন, এই যে আমি গ্রিক, সেই আমার কাছেই তোমার ভাষা সত্যি গ্রিক তুল্য। তবু বলেছিলেন, তাঁর ওয়েবসাইটে বাংলা অনুবাদ পোস্ট করবেন।
তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল মার্কিন রাজনীতির বর্তমান ধারা এবং যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রসঙ্গে। বলেছিলাম, মার্কিনিরা রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায় না।
তিনি বলেছিলেন, ওয়েল, তুমি যদি মার্কিনি বলতে আমার মতো সাধারণ মার্কিনিদের বুঝিয়ে থাকো, তাহলে তোমার ধারণা ঠিক। তবে নির্বাচন নিয়ে তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে দিনরাত, যারা এই নির্বাচনের ফলাফলের স্টেক হোল্ডার। যাদের স্বার্থ জড়িত, তারা পর্দার আড়ালে ঠিকই কাজ করে যাচ্ছে।
তবে মার্কিন শাসনতন্ত্রে এমন কিছু বিধান রেখেছেন রাষ্ট্রপিতারা, যার কারণে এখন মসৃণভাবে অনেক কিছুই হয়ে যায়। নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের মেয়াদকাল চার বছর ঠিক করা আছে শাসনতন্ত্রে। একজন দুবারের বেশি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না, আপৎকালীন জরুরি পরিস্থিতি ছাড়া। ১৯৫১ সালে গৃহীত শাসনতন্ত্রের ২২তম সংশোধনী বলে এক ব্যক্তির তৃতীয় পূর্ণ মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার বিধান লুপ্ত করা হয়েছে। তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার একমাত্র রেকর্ডের অধিকারী হলেন ফ্র্যাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট (জন্ম : ৩০ জানুয়ারি, ১৮৮২, মৃত্যু : ১২ এপ্রিল, ১৯৪৫) যুক্তরাষ্ট্রের ৩২তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত। অভূতপূর্ব এই যে ১২ বছরের প্রেসিডেন্ট হিসেবে এফডিআর নামে জনপ্রিয় ব্যক্তিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনা করেন, তার পটভূমি হিসেবে দায়ী ছিল বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা (তিরিশের মহামন্দা) এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে 'হ্যাপি ডেইজ আর হেয়ার এগেইন' গানটি শুধু সুরের কারণেই নয়, লিরিকের আবেদনেও নির্বাচকদের মন জয় করে।
বিশ্বের মহারণমঞ্চে তখন রুজভেল্টের সহযোগী ছিলেন গ্রেট ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী স্যার উইনস্টোন চার্চিল ও সোভিয়েত ইউনিয়নের একচ্ছত্র নেতা জোসেফ স্টালিন। এই তিন নেতার রণকৌশলের কাছে পর্যুদস্ত হয় অক্ষশক্তি নামে পরিচিত দুর্ধর্ষ জার্মানি, ইতালি ও জাপান। কিন্তু রুজভেল্টের দুর্ভাগ্য, যুদ্ধে মিত্রশক্তির বিজয়ের মাত্র কিছুদিন আগে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মহাশক্তিধর জার্মানির এডলফ হিটলার, ইতালির বেনিনো মুসোলিনি আর জাপানের সম্রাট হিরোহিতো (যুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিল গৌণ) এবং শক্তিধর প্রধানমন্ত্রী জেনারেল হিদেকি তোজোর সম্মিলিত বাহিনী মিত্রবাহিনীর কাছে পরাজয় বরণ করে। রণমঞ্চে ইতিহাসের এক মহাসন্ধিক্ষণে সর্বকালের সেরা সেনাপতিদের সমাবেশ ঘটেছিল মিত্রবাহিনীর পক্ষে। জেনারেল আইজেন হাওয়ার, ফিল্ড মার্শাল স্যার বার্নার্ড ল' মন্টেগোমারি, জেনারেল ওমর ব্র্যাডলি, এয়ার চিফ মার্শাল আর্থার টেডার, অ্যাডমিরাল রামসে প্রমুখের নাম যুদ্ধের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে।
যুক্তরাষ্ট্র তথা মিত্রবাহিনীর পক্ষের দেশগুলো যুদ্ধ শেষে বিজয়ীর মতো দেশ পুনর্গঠনে পূর্ণশক্তি নিয়োগ করে। যুদ্ধ শেষের আগেই এফডিআরের মৃত্যু হলে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৩তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলেন ডেমোক্রেট দলের মনোনীত প্রার্থী হ্যারি এস ট্রুম্যান (১৮৮৪-১৯৭২)। পর পর দুবার তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন ১২ এপ্রিল, ১৯৪৫ থেকে জানুয়ারি ২০, ১৯৫৩ পর্যন্ত।
যুক্তরাষ্ট্রের শাসনভার এখন ডেমোক্রেটদের হাতে। এখন চলছে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য রিপাবলিকান প্রার্থী নির্বাচনের প্রাইমারি পর্যায়।
প্রাইমারি পর্যায়ে মনোনয়ন লাভের প্রতিযোগিতায় ময়দানে নামেন ৯ জন। একে একে নিভিছে দেউটির মতো ইতিমধ্যেই ঝরে পড়ছেন প্রার্থীদের কেউ কেউ।
প্রাইমারি রাউন্ডে প্রার্থিতা ঘোষণা করা এবং কিছুদিন পরে রণে ভঙ্গ দেওয়ার পেছনে থাকে চমকপ্রদ সব ঘটনা, যা এতকাল ছিল অপ্রকাশ্য। পরের বারে ওই বিষয়ে বলা যাবে।
ইতিমধ্যে একটি দুঃখজনক ঘটনায় নির্বাচনের আমেজে ভাটা পড়েছে কিছুটা।
হাউস অব রিপ্রেজেনটোটিভের ডেমোক্র্যাটিক দলীয় সদস্যা গ্যাব্রিয়েল গিফোর্ড (জন্ম : ৮ জুন, ১৯৭০) তাঁর নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্যদের সঙ্গে আরিজোনা রাজ্যের টুসনে (ঞটঝঈঙঘ) খোলামেলাভাবে মতবিনিময় করছিলেন ২০১১ সালের ৮ জানুয়ারি। অকস্মাৎ সেফওয়ে গ্রোসারি স্টোরে ক্ষিপ্ত এক তরুণের আগ্নেয়াস্ত্রের নিক্ষিপ্ত গুলিতে তাৎক্ষণিক মৃত্যু হলো ছয় জনের। আহত হলেন বিশ জন। জেরেড লি লোকনাইর। গ্যাবি গিফোর্ড গুলিবিদ্ধ হলেন মস্তিষ্কে। বুলেট গেঁথে গেল তাঁর মগজে। এক বছর জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে সাহসী লড়াই করে চলি্লশোর্ধ্ব গ্যাবি মার্কিনিদের হৃদয়-মন জয় করেছেন। জীবনযুদ্ধে অকুতোভয় এই নারী তাঁর মহাকাশচারী স্বামী মার্ক ই কেলির নেতৃত্বে মহাকাশ যান এনডেভারের উড়াল দেখার জন্য সশরীরে উপস্থিত হন ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টারে (২০১১ সালের ১৬ মে)।
অকুতোভয় এই নারী ২৫ জানুয়ারি, ২০১২ সালে হাউসে স্বয়ং উপস্থিত থেকে পদত্যাগের কথা ঘোষণা করলেন। বললেন, এখন আমাকে মনোযোগ দিতে হবে শারীরিক সুস্থতা লাভের জন্য।
দলমত নির্বিশেষে সব সদস্য দাঁড়িয়ে করতালির মধ্য দিয়ে বিদায় জানালেন তাঁদের প্রিয় সহকর্মী গ্যাবিকে। সবার চোখে ছিল বাঁধভাঙা অশ্রুর বন্যা। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁকে বললেন, সাহসী এক নারীর প্রতিমূর্তি।
লেখক : কথা সাহিত্যিক ও অনুবাদক
No comments