চারদিক-একটি ভালো উদ্যোগ

দুনিয়ার শীর্ষস্থানীয় দুই ধনী ব্যক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিল গেটস ও ওয়ারেন বাফেট বিভিন্ন দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে একটি অভিনব মহতী উদ্যোগ চালিয়ে যাচ্ছেন কয়েক বছর ধরে। তাঁদের প্রত্যেকেরই প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলারের মতো সম্পদ আছে।


বাংলাদেশেও এমন কিছু কোটিপতি আছেন। প্রতি ডলার ৭৪ টাকা হিসাবে এক বিলিয়নে সাত হাজার ৪০০ কোটি টাকা হয়। সাত হাজার ৪০০ কোটি টাকার ধনসম্পদ আমাদের দেশের বেশ কয়েকজনের আছে বলে আমার ধারণা।
৫০ বছর আগে পাকিস্তানের কোটিপতিরা বিভিন্ন নামের ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে এসব ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সাহিত্য- সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করেছেন, বৃত্তি দিয়ে গরিব মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেছেন। আদমজী ফাউন্ডেশন, দাউদ ফাউন্ডেশন, সায়গল ফাউন্ডেশন প্রচুরসংখ্যক বৃত্তি দিত প্রতিবছর।
আমাদের বাংলাদেশে এই আদমজী ইস্পাহানীদের প্রতিষ্ঠিত স্কুল, কলেজ ও হাসপাতাল এখনো চলছে। সেই সময়ে বাঙালিদের মধ্যে আর পি সাহা প্রতিষ্ঠিত কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট, টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে ভারতেশ্বরী হোমস, কুমুদিনী হাসপাতালের কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে সেই আমলের জেলা, মহকুমা শহরগুলোতে হিন্দু জমিদার ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদের প্রতিষ্ঠিত কলেজগুলো এবং করটিয়ার মুসলমান জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নীর করটিয়া সা’দত কলেজের কথাও। আমাদের স্বাধীনতার পর কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে শিল্পপতি জহুরুল ইসলামের প্রতিষ্ঠিত বাজিতপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল ছাড়া জাতীয়ভাবে পরিচিত আর কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না।
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক কয়েক বছর ধরে প্রতিবছর প্রায় ১০০ কোটি টাকা স্কুল-কলেজের গরিব মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্য বৃত্তি হিসেবে দিয়ে আসছে। ডাচ্-বাংলা ব্যাংককে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। পোশাকশিল্পে হঠাৎ রাতারাতি কোটিপতি বনে যাওয়া মানুষগুলো এককভাবে বা সামগ্রিকভাবে কোথায় কী সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন করছেন, তা চোখে পড়ে না।
এই ভোগবিলাসী মানুষগুলোর বিপরীত কিছু মানুষ সীমিত পরিসরে, স্থানীয়ভাবে অনুসরণীয় কিছু জনকল্যাণমূলক কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে একজন ম্যাডোনা গ্রুপের চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামানের কথা এই মুহূর্তে বেশি মনে পড়ছে।
গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর ভিন্ন একটি দৈনিক পত্রিকায় ‘মুক্তিযোদ্ধারা রিকশা চালাচ্ছে আর অমানুষগুলো টাকায় ভাসছে’ শিরোনামে আমার একটি লেখায় আমি গোপালগঞ্জের ছরোয়ার নামের একজন মুক্তিযোদ্ধাকে তাঁর প্রবীণ বয়সে যশোর শহরে রিকশা চালানোর করুণ কাহিনি বর্ণনা করেছিলাম।
আমার এই লেখা পড়ে আখতারুজ্জামান বিচলিত হয়ে পড়েন এবং আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে এই বিপন্ন মুক্তিযোদ্ধার জন্য তাঁর পছন্দমতো গোপালগঞ্জ বা যশোরে তাঁর খরচে এক টুকরা জমি এবং এই জমির ওপর ছোটখাটো একটি ঘর নির্মাণের জন্য ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন। ওই কাজ মাস খানেক আগে সম্পন্ন হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা ছরোয়ার এখন যশোর শহরে সাফ কবলামূলে এক টুকরা জমির মালিক এবং এখানে একটি ঘরও শিগগির উঠবে বলে আশা করছি।
আখতারুজ্জামান গত ৯ জুনে আরেকটি অনুসরণীয় কাজ করেছেন। ঢাকার কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে এসএসসির ফলাফলে যে কিছু অদম্য গরিব মেধাবী ছাত্রছাত্রীর কাহিনি প্রকাশিত হয়, সেগুলো সংগ্রহ করে তিনি ১৩০ জনের মতো ছাত্রছাত্রীর প্রত্যেককে সেদিন আট হাজার টাকা করে বৃত্তি দিয়েছেন। এই আট হাজার টাকার মধ্যে পাঁচ হাজার টাকা কলেজের ভর্তি খরচ, দুই হাজার টাকা বই কেনার জন্য এবং বাকি এক হাজার টাকা একজন অভিভাবক বা শিক্ষককে নিয়ে ঢাকায় আসা-যাওয়ার ভাড়া হিসেবে তিনি দিয়েছেন। অনুষ্ঠানে প্রতিবন্ধী এক ছাত্রীকে দেখলাম, এক ছাত্রী তার মা কেমন কষ্ট করে, এখানে ওখানে কয়েকটি বাসাবাড়িতে কাজ করে লেখাপড়ার খরচ জুগিয়েছেন, এর বর্ণনা দিতে গিয়ে কেঁদে ফেলে। তার এ বর্ণনা শুনে আমাদের চোখেও পানি এসেছিল। অনুষ্ঠানের আগে-পরে এবং দুপুরে মাছ-ভাতের আয়োজনে এ কিশোর-কিশোরীদের দাপাদাপি, দৌড়াদৌড়ি ও প্রাণচাঞ্চল্য দেখে মুগ্ধ হলাম। নিজের ম্যাট্রিক পাসের খবর পাওয়ার দিনটির কথাও বিশেষভাবে মনে পড়ল তখন।
প্রচারবিমুখ আখতারুজ্জামান সেদিন তাঁর এই অনুষ্ঠানের খবর গণমাধ্যমকে দেননি। তবু কিছু টিভি রিপোর্টার ও পত্রিকার সাংবাদিক সেদিন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। সেদিন সন্ধ্যায় একটি টিভি চ্যানেল, পরদিন দৈনিক প্রথম আলোসহ কয়েকটি দৈনিক পত্রিকায় এ খবর আমি দেখেছি। সব প্রতিবেদনেই তাঁর ‘তারিফ’ করা হয়েছে। তারিফ করার কথাই তো।
বাংলাদেশের সব উপজেলাতেই এখন একাধিক কোটিপতি আছেন। এই কোটিপতিরা যদি তাঁদের নিজ নিজ উপজেলার দরিদ্র অদম্য মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার দায়িত্বটা নিতে পারতেন, তাহলে দারিদ্র্য বিমোচনে তাঁদের ভূমিকা প্রশংসিত হতো।
সবশেষে প্রথম আলোকে ধন্যবাদ জানাই। যতটুকু মনে পড়ে, প্রথম আলোই কয়েক বছর আগে এই অদম্য মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের করুণ কাহিনি প্রথম প্রকাশ করে এবং পরের বছরগুলোতে তা অব্যাহতও রাখে। প্রথম আলোর দেখাদেখি অন্য পত্রিকাগুলোও তা এখন করছে প্রতিবছর এসএসসি ও এইচএসসির ফল প্রকাশের পর।
প্রথম আলোকে অন্য পত্রপত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলো অনুসরণ করছে। ছোটখাটো একজন শিল্পপতি আখতারুজ্জামানকেও অন্য শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা অনুসরণ করবেন, এই আশা আমাদের সবার।
মহিউদ্দিন আহমদ, সাবেক সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

No comments

Powered by Blogger.