চারদিক-ব্র্যাক স্কুলের মেয়েরা

মিতু খাতুনের বাবা একজন দিনমজুর। জামালপুরের একটি ইটভাটায় শ্রমিকের কাজ করেন তিনি। বছরের যে কয়েক মাস কাজ থাকে, তা দিয়ে কোনোক্রমে পরিবারের সবাইকে নিয়ে তাঁর দিন চলে। তবে বছরের অনেকটা সময়ই তাঁকে বেকার থাকতে হয়। এ রকম একটি পরিবারের মেয়ে মিতু বিবিএ পড়তে ভারতে যাচ্ছেন।


তাঁদের কাছে পুরো বিষয়টিই যেন স্বপ্নের মতো। মিতুর ভাষায়, ‘পরিবারে অভাব থাকা সত্ত্বেও বাবা আমাকে লেখাপড়া শিখিয়েছে। আজ সেই কষ্ট সার্থক হয়েছে।’
মিতুর মতো ১০ জন শিক্ষার্থীর স্বপ্ন পূরণ করেছে ‘ব্র্যাক মেধাবিকাশ’ ও রাই ফাউন্ডেশনের ‘মেধাবী কিশোরী স্কলারশিপ’। তাঁরা এ স্কলারশিপের আওতায় ভারতের সিকিম ও রাজস্থানে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন। এ সুযোগ কাজে লাগাতে কয়েক দিন আগে তাঁরা প্রতিবেশী দেশের উদ্দেশে উড়াল দিয়েছেন। এর আগে তাঁরা কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছিলেন ব্র্যাকের চেয়ারপারসন ফজলে হাসান আবেদের কাছে। তখন কথা হয় তাঁদের সঙ্গে।
কুমিল্লার নাসরিন আখতার জানান, তাঁর বাবা একজন বর্গাচাষি। মা গৃহিণী। দুই ভাই ও দুই বোন নিয়ে তাঁদের অভাবের পরিবার। তার পরও তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক উভয় পরীক্ষায়ই জিপিএ-৫ পেয়েছেন। এ অসাধারণ কৃতিত্বের পথ ধরে তিনিও এ বছর রাই ফাউন্ডেশনের বৃত্তি পেয়ে সিকিমে পড়তে যাচ্ছেন। তাঁর ভাষায়, ‘এই বৃত্তি আমাদের সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায়।’ নাসরিনের ইচ্ছা, তিনি প্রকৌশলী হয়ে পরিবারের কষ্ট ঘোচাবেন।
২০০৮ সাল থেকে প্রতিবছর ব্র্যাক ও রাই ফাউন্ডেশন যৌথভাবে দরিদ্র মেধাবী কিশোরী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার জন্য স্কলারশিপ দিয়ে আসছে। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন গেছেন তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে পড়ালেখা করতে সিকিমের ইলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং রাজস্থানের রাই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়বেন অপর পাঁচজন। গত তিন বছরে তাঁদের মতো আরও ২৬ জন মেধাবী শিক্ষার্থী এই স্কলারশিপ নিয়ে ভারতে পড়ালেখা করতে গেছেন।
চতুর্থ ব্যাচ হিসেবে এবারের ২০১১ সালের বৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীরা হলেন: মুন্সিগঞ্জের টুম্পা আখতার ও রুবী আখতার, কুমিল্লার নাসরিন আখতার, গাইবান্ধার জ্যোৎস্না আখতার, মানিকগঞ্জের তাসলিমা আখতার, বগুড়ার জাফরিন সুলতানা, জামালপুরের মিতু খাতুন, লালমনিরহাটের আয়েশা খাতুন, নরসিংদীর নুসরাত জাহান ও শেরপুরের আফিউন্নাহার।
তাঁদের মধ্যে পাঁচজনেরই লেখাপড়া শুরু হয়েছে এক রুম, এক শিক্ষক নিয়ে গড়া ব্র্যাক স্কুলে। তারপর ধীরে ধীরে একটার পর একটা ধাপ পাড়ি দিয়ে আজ তাঁদের এতদূর আসা। এ পথে দুজনকে আবার চলতে হয়েছে মা-বাবাহারা এতিম অবস্থায়। তবে নির্বাচিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে নয়জনই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক উভয় পরীক্ষায়ই জিপিএ-৫ পেয়েছেন। একজন একটু কম পেলেও যেহেতু তিনি ব্র্যাক স্কুল থেকে উত্তীর্ণ ও অভাবী পরিবারের সদস্য, তাই তাঁর বৃত্তি পেতে আর কোনো অসুবিধা হয়নি।
মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় শিক্ষার্থীরা তাঁদের পরিবারের কথা, পড়তে যাওয়ার অনুভূতি ও ব্র্যাক স্কুলের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে চেয়ারপারসনকে জানান। চেয়ারপারসন তাঁদের সাহস দিয়ে বলেন, ‘কষ্ট যতই হোক, তোমাদের পড়ালেখা শেষ করতেই হবে। দেশের জন্য তোমাদের অনেক কিছু করার আছে।’ ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক মাহবুব হোসেন বলেন, ‘ওখানে তোমরা একা যাচ্ছ না, দেশের নাম সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছ। আমরা আশা করি, তোমরা দেশের নাম আরও উজ্জ্বল করবে। তোমাদের ইচ্ছা কী? দেশে ফিরে আসবে, নাকি ওখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করবে?’ এই প্রশ্নের জবাবে সবাই দৃঢ়প্রত্যয়ে ব্যক্ত করেন, ‘পড়া শেষে অবশ্যই দেশে ফিরে আসব এবং দেশের জন্য কাজ করব।’
মাধ্যমিক পর্যায়ে গোল্ডেন জিপিএ পাওয়া আফিউন্নাহারের বাবা শেরপুরে বিমা কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত। দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষার জন্য যাওয়া নিয়ে আনন্দের পাশাপাশি নানা উদ্বেগও কাজ করছে। কী কী বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে জানতে চাইলে আফিউন্নাহার বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কেমন হবে, সবার সঙ্গে মিশতে পারব কি না—এগুলো নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে।’ তাঁর সঙ্গে অন্যরাও একমত হন। একজন বলেন, ‘শিক্ষকেরা কেমন হবেন, তা নিয়ে ভাবছি।’ পড়ালেখা কঠিন লাগবে কি না, তা নিয়েও ভাবনা হচ্ছে অনেকের। এরই মধ্যে একজন বলে উঠলেন, ‘খাবারদাবার নিয়ে সবচেয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে। খেতে পারব তো অন্য রকম রান্না করা খাবার।’ সবাই হেসে তাতে সম্মতি জানান।
চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হওয়ার পর ব্র্যাকের মেধাবিকাশ কর্মসূচির আওতায় মেয়েদের দুই মাস কোনো প্রত্যন্ত জেলায় থাকতে হয়েছে। এসব জেলার মধ্যে রয়েছে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও সিলেটের হাওর অঞ্চলে। এ সময় তাঁরা ব্র্যাক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের পাঠদান করেছেন।
তাঁদের জন্য এত সব কিছু আয়োজনের পেছনে রয়েছে ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচির আওতায় মেধাবিকাশের উদ্যোগ।
উচ্চশিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের বিদেশে পাঠানো ছাড়াও এ উদ্যোগের আওতায় অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার জন্য এইচএসসি ও স্নাতক পর্যায়ে বৃত্তি দেওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি ও কম্পিউটারে দক্ষতা অর্জনের প্রশিক্ষণ। তবে এ বৃত্তি তাঁরা পাবেন, যাঁদের মা, বাবা কিংবা পরিবারের প্রধান শ্রমজীবী। আর শিক্ষার্থীদের এসএসসি কিংবা এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে মেধার পরিচয় দিতে হবে। তবে পাওয়া যাবে এ রকম সুবর্ণ সুযোগ।
তন্বী নওশীন

No comments

Powered by Blogger.