জীবন সম্পর্কে তোমার ধারণা কী ফরীদি? by মামুনুর রশীদ

দিনক্ষণ ঠিক মনে নেই, সম্ভবত ১৯৭৬ সাল, ফরীদির সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। প্রথম সাক্ষাতেই এক প্রশ্নের সম্মুখীন। ঝাঁকড়া চুলটা ঝাঁকিয়ে অত্যন্ত বিশ্বাসের সঙ্গে আমায় প্রশ্ন করল, 'জীবন সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?' প্রশ্নটা হজম করতে করতেই সে বাঁচিয়ে দিল। অন্য একটা প্রসঙ্গে চলে গেল।


সত্তরের দশকের দ্বিতীয় ভাগটি নাটকের জন্যে খুবই একটা রমরমা সময়। সব দল যেন এক সৃজনের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সবাই সবার নাটক দেখে। ঢাকা থিয়েটার তখন শকুন্তলা করছে। শকুন্তলার তক্ষকের চরিত্রে অভিনয় করছে ফরীদি। আঙ্গিক-অভিনয়ে এক নতুন মাত্রা নিয়ে এলো সে। তার পরই কীর্ত্তনখোলার ছায়ারঞ্জন। যাঁরা একবার দেখেছেন তাঁদের আজন্মের স্মৃতি হয়ে থাকবে। এই সময় টেলিভিশনেও এসে গেছে ফরীদি। সেখানেও একটা প্রতিযোগিতা। 'ভাঙনের শব্দ শুনি' আর 'এখানে নোঙর' কাছাকাছি সময়ের নাটক। নাটক দুটোকে গুলিয়ে ফেলত অনেকেই। তারপর 'একটি সেতুর গল্পের' সেই চরিত্রের মুখে যখন ফরীদির সংলাপ_'কাত্যায়ন বধ করো', কে ভুলতে পারবে? এর পর সংশপ্তকের রমজান, যেখান থেকেই মূলত তার চলচ্চিত্র যাত্রা এবং মঞ্চের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি। তার ৬০ বছরের জীবনে মঞ্চনাটকের সঙ্গে সম্পর্ক দীর্ঘদিনের নয় এবং একটা পর্যায়ে সে আর মঞ্চে অভিনয় করতেও পারত না। ঢাকা থিয়েটার চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেনি। কিন্তু ফেরাতে পারেনি।
ফরীদির জীবন সম্পর্কে ধারণা কী ছিল?
ছাত্রজীবনে অনিয়মিত। বেশ কয়েক বছর ভেঙে পুনরায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যাবর্তন। অর্থনীতির ছাত্র। পাঠ্যবইয়ের চেয়ে অপাঠ্য বই পড়তেই আগ্রহ ছিল তার, খুবই স্বাভাবিক। প্রথাগত জীবনের বিপরীতে এক অপ্রথাগত জীবনেই আগ্রহ ছিল তার। অর্থনীতিবিদ না হয়ে সে পেঁৗছে গেল অন্য এক জীবনে। সেই সময়ে সেই জীবনের নূ্যনতম নিরাপত্তা ছিল না। অর্থকষ্ট নিত্যসঙ্গী। সেই দিনগুলোতে আমারও প্রবল অর্থসংকট। টিএসসি, মহিলা সমিতি আর রামপুরার টেলিভিশন ভবন আমাদের সবারই গন্তব্য। মাঝেমধ্যে একটু ব্যবসা, একটু চাকরি করার অপচেষ্টা। চেষ্টাগুলো ব্যর্থ হতো; কারণ সেখানে আমাদের সততা ছিল না। খুঁজছিলাম জীবনের অন্য গন্তব্য। সেই গন্তব্য বিলম্বে হলেও আমরা পেয়েছি। ফরীদির অভিনয় ক্ষমতা প্রবল। চলচ্চিত্রে তার অভিষেকের পরই সে অনন্য হয়ে ওঠে অথবা বলতে পারি খুব প্রয়োজনীয় শিল্পীতে পরিণত হয়ে ওঠে। সে এক জগৎ, বড় মোহনীয়। জনপ্রিয়তার তুঙ্গমুখী আনন্দ, অর্থের প্রচুর সমাগম। কিন্তু জীবনটাকে যে শুষে নেয়, তা বুঝতে পেরেছিল বড় বিলম্বে। টেলিভিশনে ফিরে এলো, কিন্তু তখন সে 'অসুস্থ, ভগ্ন হৃদয়'। আগের মতো চলতে-উঠতে পারত না, তবুও তার উপস্থিতিই পরিচালকদের হৃদয়পূর্ণ করে। দর্শকেরও। কিন্তু সেই অপার সম্ভাবনাময় ছায়ারঞ্জনকে খুঁজে পাওয়া যায় না। ফরীদির কী হয়েছিল? জীবন সম্পর্কে তার ধারণা কি পাল্টে গিয়েছিল? ফরীদি আবেগের কাছে ছিল অসহায়। যেকোনো শিল্পীরই তাই হয়। যাত্রায় অভিনয় করেছে। মঞ্চনাটকে তো বটেই। তার মনের কোণে এ সব মাধ্যম নিয়ে তার স্বপ্ন হয়তো ভেঙেই গিয়েছিল জীবিকার প্রয়োজনে। তারপর যে মাধ্যম তাকে এত অর্থ দিয়েছে, সেই মাধ্যম যে তার জীবনী শক্তিকেও শুষে নিল, তাও ভাবার অবকাশ কি তার হয়েছে?
ফরীদির স্বভাবসুলভ একটা সারল্য ছিল, আবার এই সারল্যই তাকে কি কোন মোহের কাছে পরাজিত করেছিল? জীবনের মোহ তাকে আচ্ছন্ন করেনি, করলে সে শরীরটাকে মানত। শারীরিক কোনো অনুশাসন সে মানেনি। বন্ধু, আত্মীয়, চিকিৎসক_কারও কথা না।
তাহলে কোন ভূতে পেয়েছিল তাকে?
সে কি সব সময়ই একটা অন্য জগতে বসবাস করত, যে জীবন শালিকের বা দোয়েলের?
অসম্ভব নয়। কারণ যেকোনো অভিনয়েই সে একটা নতুন মাত্রা যোগ করতে পারত। যেখানে অভিনেতারা শুধু সংলাপ মুখস্থ করে তাই ঢেলে দেয়; যেখানে মুখস্থবিদ্যা অভিনয়ের একটা বড় গুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে কষ্ট করে নতুন মাত্রা বা আঙ্গিকে অভিনয় কে খুঁজতে যায়?
বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রেও ফরীদিকে দেখা গেছে একটা নতুন মাত্রা বের করে নিয়ে আসতে। চরিত্রটি ওহঃবৎবংঃরহম করে তুলত।
ফরীদি একসময় ছাত্ররাজনীতি করত, সেও বিভ্রান্তিকালের রাজনীতি। সেই রাজনীতিও কি তার মধ্যে এক ধরনের দীর্ঘস্থায়ী হতাশার বীজ বুনেছিল? জীবন সম্পর্কে ভাবনার একটা পরিবর্তন ঘটেছিল? বাংলাদেশের নিয়মিত নাট্যযাত্রায় হুমায়ুন ফরীদি এক নতুন আখ্যানের সূচনা করেছিল। চলচ্চিত্রেও তাই। কিন্তু অন্য ধরনের চলচ্চিত্র এসে একেবারেই সে সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দিল। অন্য সব ভালো অভিনেতা, টেকিনিশিয়ানদের মতো তাকেও সরে দাঁড়াতে হয়েছিল। কিন্তু এখানেই প্রশ্ন, টেলিভিশনে ফিরে আসার পর সে দেখেছিল, তার জায়গাটি খালিই পড়ে আছে। শুধু তাই নয়, এখানে আর আগের মতো অভাব নেই বরং অনেক শিল্পীই অভিনয়কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে পারছে।
আবারও প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে, ফরীদির জীবন সম্পর্কে এই সময় ধারণাটি কী হয়েছিল? টেলিভিশনকে জীবিকা করে মঞ্চের কাজটিও চালিয়ে যেতে পারত। মঞ্চনাটকে তার অগনিত ভক্ত ও উত্তরসূরি নতুন করে উজ্জীবিত হতে পারত। কিন্তু ফরীদি সেভাবে এলো না।
আমাদের মঞ্চের অনেক প্রতিভা টেলিভিশনে চলে গেছে। আবার নতুন করে গড়তে হচ্ছে। আমরা যারা ছোট ছোট কারিগর, তাদের কষ্টের সীমা নেই। কিন্তু ফরীদির উপস্থিতিই তো কারিগরের ভূমিকা পালন করতে পারত।
কী পারত, কী হতো তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে হয়তো কোনো লাভ নেই। ফরীদি আমাদের জিজ্ঞাসাবাদের ঊধর্ে্ব চলে গেছে। তবে তার সঙ্গে দেখা হলেই এসব কথা তুলে তুমুল তর্কে মেতে উঠতাম। একটি মঞ্চনাটকে ফরীদি আমার পরিচালক ছিল; পরিচালক হিসেবেও দেখেছি সে বেশ দক্ষ এবং দায়িত্ববান। তার মানে থিয়েটারের সবটাই সে ঘুরে দেখতে চেয়েছে।
তার ৬০ বছর পূর্তিতে আমরা 'বালাই ষাট' বলে একটি জন্মদিনের অনুষ্ঠানে করেছিলাম। বিপুল সংখ্যক অনুরাগী, শিল্পীর সমাগম হয়েছিল। ফরীদি প্রাণখুলে হেসেও ছিল। কিন্তু হাসিটি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারল না।
জীবন সম্পর্কে ধারণার একটা প্রবল পরিবর্তন হলো কি? তার শেষ দিনগুলোতে মনে হলো একটা উবঢ়ৎবংংরড়হ তার শরীরটাকে দখল করেছে। উবঢ়ৎবংংরড়হ বাড়তেই থাকল এবং শেষ পর্যন্ত সেই জয়ী হলো। পরাজিত হলাম আমরা এবং হুমায়ুন ফরীদি।
জীবন সম্পর্কে ধারণাটা এখন কি দাঁড়াল ফরীদি?

লেখক : বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.