সময়ের প্রতিবিম্ব-দলের দোহাই শামীমের, নেত্রীর দোয়া আইভীর by এবিএম মূসা
দুই সপ্তাহ ল্যাবএইড হাসপাতালের কেবিনে শুয়ে থাকায় লেখালেখি হয়নি, টেলিভিশনে বকবকানি বন্ধ ছিল। তবে প্রায় সব দৈনিক পত্রিকা পড়ার আর চ্যানেলে খবর-মন্তব্য শোনার অফুরন্ত সময় পেয়েছি। দুই গণমাধ্যমেই অনেক খবরের মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছে খালেদা জিয়ার রোডমার্চ আর প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন সমাবেশে দেওয়া ভাষণ।
তবে সব ছাপিয়ে প্রতিদিনই আলোচিত প্রধান খবর ছিল নারায়ণগঞ্জের সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী প্রচারণার খুঁটিনাটি। পত্রিকার খবরের বিচিত্র সব শিরোনাম আগাম জানান দিচ্ছে, কোন প্রার্থীর মতলব কী, কে নির্বাচনের ফল ঘোষণার আগেই পাঁচ হাজার ভোটে জেতার ব্যবস্থা করে রেখেছে। কোনো এক প্রার্থীর অভিযোগ আভাস দিয়েছে নারায়ণগঞ্জে প্রশাসনের ভূমিকা কী হতে পারে। আরও ছাপা হচ্ছে নির্বাচন নিয়ে নারায়ণগঞ্জবাসীর উদ্দীপনা আর সন্ত্রাস নিয়ে উদ্বেগের সম্ভাব্য খবর। একটি খবরের মনকাড়া শিরোনামটি দিয়েছে প্রথম আলো—‘নেতার শামীম জনতার আইভী’। বার্তা বিভাগের যিনি মানানসই শিরোনামে এককথায় বহু কথা বলে প্রার্থীদের অবস্থান বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁকে অভিনন্দন।
পত্রিকা পড়া এবং খবর শোনা ছাড়াও নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন সম্পর্কে রোগশয্যায় শুয়ে অনেক খোঁজখবর নিয়েছি। আগে একটি প্রতিবেদনে এর কারণ ব্যাখ্যা করেছি। পাঠকদের হয়তো প্রতিবেদনটির বক্তব্য স্মরণে আছে, তবু পুনর্ব্যক্ত করছি। আগামী সাধারণ নির্বাচন যদি দলীয় সরকারের পরোক্ষ তত্ত্বাবধানে হয় তবে কেমন হবে, সেটির আগাম আভাস পাওয়া যাবে নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনে। জনপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুসারে, স্থানীয় নির্বাচনে কোনো দল প্রার্থী দিতে পারেন না। তাই নির্বাচনী বিধিকে পাশ কাটানোর জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের একটি অংশ বলেছেন ‘মনোনয়ন’ নয়, দলীয় ‘সমর্থন’ দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন তাঁদের ‘সতর্ক’ করেনি, যেমনটি করেছিল সাংসদ নাসিম ওসমানকে ভাইয়ের পক্ষে নির্বাচনী তৎপরতার দায়ে। অপরদিকে, একই প্রার্থীর দলীয় সমর্থক বলে পরিচয় দেওয়া আওয়ামী লীগের নেতাদের শুধু ‘অনুরোধ’ করেছেন। মৃদু তিরস্কার করে বলেছেন, ভবিষ্যতে এমনটি করবেন না। বলা বাহুল্য, আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা আর সাংসদ নাসিম ওসমান সতর্কবাণী আর অনুরোধকে পাত্তাই দিচ্ছেন না। উদ্বিগ্ন দুই প্রার্থীর অনুরোধে একটুখানি সাড়া দিয়ে প্রশাসনিক রদবদলও শুধু নমঃ নমঃ করে সেরেছেন।
রদবদল নিয়ে দুই প্রার্থী বলেছেন, জেলা প্রশাসককে অপসারিত নয়, দূরে সরিয়ে দিয়ে তাঁরই বশংবদ একজনকে তাঁর যা করার করতে রেখে গেছেন। তাঁরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, চারটি থানায় আছেন একজন প্রার্থীর দীর্ঘদিনের বশংবদ কর্মকর্তা। কী হবে নির্বাচনের দিন তাঁদের ভূমিকা, তা অনুমান করে তাঁরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। পত্রিকার খবর হচ্ছে, অতি উৎসাহী হয়ে পুলিশ আইভীর পোস্টার ছিঁড়ছে। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা শুধু নালিশই শুনে যাচ্ছেন। জনতার দাবি মেনে নির্বাচন কমিশন শেষ পর্যন্ত সেনা মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মোতায়েন মানে ‘স্ট্রাইকিং ফোর্স’, কেন্দ্রের বাইরের সন্ত্রাস বা সন্ত্রাস প্রতিরোধ করবে। দুই প্রার্থী বলছেন যা ঘটার তা তো ঘটবে ভেতরে। তাঁদের ব্যাখ্যা, সেখানে ব্যালট ছিনতাই, এজেন্টদের হুমকি দেওয়া ইত্যাকার অঘটন রোধের দায়িত্বে থাকবেন একজন প্রার্থীর দীর্ঘদিনের অনুগ্রহভাজন সুবিধাভোগী কতিপয় স্থানীয় প্রশাসনিক আর পুলিশ কর্মকর্তা। তাঁরা এখনই স্কেল আর ফিতা দিয়ে শুধু আইভীর পোস্টারের মাপজোখ করছেন। শামীমের বড় পোস্টারের নিচ দিয়ে মাথা সরিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। এতসবের মধ্যে একটি খবর পড়ে মজা পেলাম। আইভীর পোস্টার ছেঁড়ার অভিযোগের জবাবে শামীম বলেছেন, এসব বৃষ্টিতে ভিজে ছিঁড়ে গেছে। তাহলে প্রকৃতিও পক্ষপাতিত্ব করছে—আইভীর প্রতি বৈরী, তাই শুধু বেছে বেছে তাঁর পোস্টারগুলো ভিজিয়ে দিচ্ছে!
বিভিন্ন সূত্রে আরও অনেক খবর হাসপাতালে শয্যাশায়ীর কাছে পৌঁছেছে। এমনি একটি অকিঞ্চিৎকর খবর হলো, নারায়ণগঞ্জে মেশিনে ভোট দেওয়া পদ্ধতিটি নিয়ে মৃদু আপত্তি। নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণে আগেই ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) ব্যবহারের মহড়া দেখেছি। আমি তাদের বলেছিলাম, নতুন ভালো কিছু করতে গেলে এমন খুঁতখুঁতি শুনতে হয়। যেমন সত্তরের নির্বাচনেই অমুক মার্কা বাক্সে ব্যালটের বদলে এল ব্যালট পেপারে অমুক মার্কায় ছাপ দেওয়ার ব্যবস্থা। সেদিন যাঁরা আপত্তি করেছিলেন, তাঁরাই বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিলেন। তাই ছহুল-সাখাওয়াত ভাইদের বলেছিলাম, ‘করে ফেলেন। অন্তত পদ্ধতিটির একটি যাচাই তো করা হবে।’ তার পরও যন্ত্রটির স্থাপনা নিয়ে একটি পত্রিকার ছোট্ট খবর আমাকে বিভ্রান্তিতে ফেলেছে। নারায়ণগঞ্জ থেকে আমাকে দেখতে হাসপাতালে এসেছিলেন বহুদিনের পরিচিত তোলারাম কলেজের একজন আইভীভক্ত অধ্যাপক। ইভিএম নিয়ে আলোচনায় তিনি সেদিনের একটি পত্রিকার বিশেষ খবর নজরে আনলেন। যে নয়টি ওয়ার্ডে পদ্ধতিটির পরীক্ষা হবে, এর সব কটিতেই তার হিসাব অনুযায়ী আইভীর সমর্থকদের সংখ্যা বেশি। তার মানে, মেশিন বসানো নয়, সেটি বসানোর স্থান নির্ধারণ নিয়ে অনেকের মনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।
এখন আলোচনা করা যাক ‘মনোনয়ন’ আর ‘সমর্থন’ শব্দদ্বয়ের মারপ্যাঁচ, যা আমার আজকের প্রতিবেদনের শিরোনামটি ব্যাখ্যা করবে। আওয়ামী লীগের দলীয় ‘সমর্থন’ নিয়ে দু-চারজন সিনিয়র নেতা কমিশনের সঙ্গে লুকোচুরি খেলেছেন। নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর আমি কথা বলেছিলাম আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত দুই নেতার সঙ্গে। দলটির নতুন বর্তমান নেতৃত্বের সবাইকে চিনি না, তবে দুজনের প্রজ্ঞা ও দলীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনায় দক্ষতা ও আন্তরিকতা সম্পর্কে অবহিত আছি। একজন বাহাউদ্দিন নাছিম, দলের সব প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দলনেত্রীর সকল দুঃসময়ে অতি কাছে থাকেন যিনি। দ্বিতীয়জন হচ্ছেন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হানিফ, সরকারের বাইরে থেকে যিনি দলকে গুছিয়ে রাখার প্রশংসনীয় কর্তব্য পালন করে যাচ্ছেন। দলীয় কর্মকাণ্ডকে আন্তরিকতার সঙ্গে সচল রেখেছেন। সরকারের মধ্যে দলকে হারিয়ে যেতে দেননি। উভয়ের সঙ্গেই আমার নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর আইভীর প্রার্থিতা নিয়ে কথা হয়েছিল। দুজনই জানিয়ে দিলেন, তাঁরা নিজেরা কিংবা দল কাউকে সমর্থন দেবে না, আইন অনুসরণে মনোনয়নের প্রশ্নই ওঠে না। দুই দিন না যেতেই কোন কাঠির ছোঁয়ায় তাঁদের অবস্থান পাল্টে গেল, সেই রহস্য না হয় অনুদ্ঘাটিত থাকুক। কিন্তু মনোনয়ন আর সমর্থনের লুকোচুরিতে দায়িত্বশীল দুই নেতার ভূমিকা আমাকে বিস্মিত ও ব্যথিত করেছে। নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে নারায়ণগঞ্জের দলীয় কর্মীদের করেছে বিভক্ত ও বিভ্রান্ত।
শামীমকে তথাকথিত দলীয় সমর্থনের আরেকটি অধ্যায়। নির্বাচনের আগে আইভী আর শামীম দুজনই গিয়েছিলেন দলীয় নেত্রীর কাছে। শামীম চাইলেন সমর্থন, আইভী চাইলেন দোয়া, যেমনটি চেয়েছিলেন তাঁর বাবা চুনকা বঙ্গবন্ধুর কাছে। কাহিনিটি খণ্ডিত আকারে বর্ণনা করেছেন প্রতিবেদক আসিফ হোসেন গত বৃহস্পতিবারের প্রথম আলোয়। সে সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ছিল বর্তমানের জাতীয় সংসদ। অধিবেশন চলাকালে চুনকা গিয়েছিলেন সংসদ ভবনে প্রধানমন্ত্রীর কক্ষে। আমি তখন আওয়ামী লীগের সাংসদ, চুনকার সঙ্গে কক্ষে আমিও ছিলাম। চুনকাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘জানি কী জন্য আসছিস। কিন্তু দলের প্রার্থী তো খোকা, মনোনয়ন তো দিতে পারব না। তবে দোয়া করে দিলাম।’ ইতিহাসের কী চমকপ্রদ পুনরাবৃত্তি! দলের কথিত সমর্থন পেলেন শামীম আর দলনেত্রী দোয়া করলেন বঙ্গবন্ধুর প্রিয়ভাজন চুনকার মেয়ে আইভীকে। আমার ধারণা, ‘যদি’ সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হয় ৩০ অক্টোবর, শেখ হাসিনাও আইভীকে বুকে জড়িয়ে বলবেন, ‘আমি জানতাম, তুমিই জিতবে।’ সম্ভাব্য এই দৃশ্য উপস্থাপনের স্বপ্ন যদি কেউ দেখেন, তাঁকে ওপরের বাক্যের ‘যদি’ শব্দটিকে গুরুত্ব দিতে হবে। আস্থা রাখতে হবে নির্বাচন কমিশনের ওপর।
এই ‘সমর্থন’ আর ‘দোয়ার’ দ্বন্দ্ব আমাকে মনে করিয়ে দিল মহাভারতের একটি কাহিনি। সেই কাহিনির পশ্চাৎপটে নারায়ণগঞ্জ থেকে পাওয়া একটি অস্বস্তিকর খবর। সেখানে নাকি আওয়ামী লীগের চিরাচরিত সমর্থক সংখ্যালঘুদের কথিত দলীয় প্রার্থীর পরিচয় বিভ্রান্ত করছে, আবার হুমকি-ধমকিও দেওয়া হচ্ছে। কাহিনিটি হচ্ছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রাক-মুহূর্তে দুরাচারী দুর্যোধন আর ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির গেলেন শ্রীকৃষ্ণের সমর্থন যাচনা করতে। দুর্যোধন প্রথমে কক্ষে ঢুকে দেখেন শ্রীকৃষ্ণ ঘুমাচ্ছেন। তিনি বসে রইলেন মাথার কাছে। একটু পরে যুধিষ্ঠির এসে বসলেন পদপ্রান্তে। চিৎ হয়ে শোওয়া শ্রীকৃষ্ণ চোখ মেলেই প্রথমে দেখলেন পায়ের কাছে যুধিষ্ঠিরকে। তাঁকে আশীর্বাদ জানালেন, সমর্থনও দেবেন বললেন। অতঃপর দুর্যোধন জানালেন তাঁর আরজি। তার পরের কাহিনি সংক্ষেপে বলছি। উভয়ের যাচনা মঞ্জুর করে শ্রীকৃষ্ণ দুর্যোধনকে দিলেন নিজের অক্ষৌহিণী যোদ্ধা বাহিনী। যুধিষ্ঠিরকে জানালেন, তিনি স্বয়ং ধর্মযুদ্ধে তাঁর পক্ষে অবস্থান নেবেন। তবে নিজের বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবেন না। মধ্যম পাণ্ডব অর্জুনের রথের সারথি হয়ে ধর্মযুদ্ধে অংশ নেবেন। কুরুক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে কীভাবে ধর্মযুদ্ধে অটল রেখেছিলেন তাঁরা যেন তা গীতায় পড়ে নেন।
উপরিউক্ত কাহিনির মাজেজা নারায়ণগঞ্জের সংখ্যালঘু ভোটারদের ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তবে উপাখ্যানটি বর্ণনা করার কারণ অধ্যাপকের অন্য একটি প্রশ্নের উত্তরে দিয়েছি। তিনি জানতে চাইলেন, নারায়ণগঞ্জের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নির্বাচন নিয়ে আতঙ্কে আছে, তাদের শঙ্কা কীভাবে দূর করা যাবে? আমি তাঁকে বললাম, ‘তোমার স্বজাতীয়দের আমার হয়ে রবীন্দ্রনাথের একটি চরণ পৌঁছে দিয়ো। চরণটি হচ্ছে, “ধর্ম যবে শঙ্খরবে করিবে আহ্বান—নীরব হয়ে নম্র হয়ে পণ করিও প্রাণ”।’
প্রতিবেদনটি দীর্ঘ করব না। মহাজাতকের একটি গল্প দিয়ে উপসংহার টানছি। আগে একটু বলে নিই, আমাদের ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ে ঈশপের গল্প আর মহাজাতকের গল্পচ্ছলে বলা হিতবাণী পড়তে হতো।
জাতকের গল্পটি হচ্ছে, একজন মুনি আর একটি ইঁদুরের। একদিন ইঁদুরটি বিড়ালের তাড়া খেয়ে ধ্যানরত মুনির কোঁচড়ে আশ্রয় নিল। মুনি ইঁদুরের ভীতির কারণ জেনে তার গায়ে কমণ্ডলুর জল ছিটিয়ে বললেন, ‘এবার তুই বিড়াল হয়ে যা।’ কয়েক দিন পর সেই বিড়াল বাঘের তাড়া খেয়ে আবার মুনির আশ্রয়ে এল। এবার মুনি বললেন, ‘বাঘ হয়ে বাঘের সঙ্গে লড়াই কর।’ ইঁদুর প্রথমে বিড়াল, তারপর বাঘ হয়ে তেড়ে গেল মুনিকে খাওয়ার জন্য। মুনি এবার কমণ্ডলুর জল ছিটিয়ে বললেন, ‘পুনর্মূষিক ভবঃ—আবার ইঁদুর হয়ে যা।’
নারায়ণগঞ্জের নাগরিক ভোটারদের জন্য আমার প্রার্থনা, ৩০ অক্টোবরের পর তাদের যেন দিবারাত্রি ‘পুনর্মূষিক ভবঃ’ মন্ত্রটি জপ করতে না হয়।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
পত্রিকা পড়া এবং খবর শোনা ছাড়াও নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন সম্পর্কে রোগশয্যায় শুয়ে অনেক খোঁজখবর নিয়েছি। আগে একটি প্রতিবেদনে এর কারণ ব্যাখ্যা করেছি। পাঠকদের হয়তো প্রতিবেদনটির বক্তব্য স্মরণে আছে, তবু পুনর্ব্যক্ত করছি। আগামী সাধারণ নির্বাচন যদি দলীয় সরকারের পরোক্ষ তত্ত্বাবধানে হয় তবে কেমন হবে, সেটির আগাম আভাস পাওয়া যাবে নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনে। জনপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুসারে, স্থানীয় নির্বাচনে কোনো দল প্রার্থী দিতে পারেন না। তাই নির্বাচনী বিধিকে পাশ কাটানোর জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের একটি অংশ বলেছেন ‘মনোনয়ন’ নয়, দলীয় ‘সমর্থন’ দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন তাঁদের ‘সতর্ক’ করেনি, যেমনটি করেছিল সাংসদ নাসিম ওসমানকে ভাইয়ের পক্ষে নির্বাচনী তৎপরতার দায়ে। অপরদিকে, একই প্রার্থীর দলীয় সমর্থক বলে পরিচয় দেওয়া আওয়ামী লীগের নেতাদের শুধু ‘অনুরোধ’ করেছেন। মৃদু তিরস্কার করে বলেছেন, ভবিষ্যতে এমনটি করবেন না। বলা বাহুল্য, আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা আর সাংসদ নাসিম ওসমান সতর্কবাণী আর অনুরোধকে পাত্তাই দিচ্ছেন না। উদ্বিগ্ন দুই প্রার্থীর অনুরোধে একটুখানি সাড়া দিয়ে প্রশাসনিক রদবদলও শুধু নমঃ নমঃ করে সেরেছেন।
রদবদল নিয়ে দুই প্রার্থী বলেছেন, জেলা প্রশাসককে অপসারিত নয়, দূরে সরিয়ে দিয়ে তাঁরই বশংবদ একজনকে তাঁর যা করার করতে রেখে গেছেন। তাঁরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, চারটি থানায় আছেন একজন প্রার্থীর দীর্ঘদিনের বশংবদ কর্মকর্তা। কী হবে নির্বাচনের দিন তাঁদের ভূমিকা, তা অনুমান করে তাঁরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। পত্রিকার খবর হচ্ছে, অতি উৎসাহী হয়ে পুলিশ আইভীর পোস্টার ছিঁড়ছে। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা শুধু নালিশই শুনে যাচ্ছেন। জনতার দাবি মেনে নির্বাচন কমিশন শেষ পর্যন্ত সেনা মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মোতায়েন মানে ‘স্ট্রাইকিং ফোর্স’, কেন্দ্রের বাইরের সন্ত্রাস বা সন্ত্রাস প্রতিরোধ করবে। দুই প্রার্থী বলছেন যা ঘটার তা তো ঘটবে ভেতরে। তাঁদের ব্যাখ্যা, সেখানে ব্যালট ছিনতাই, এজেন্টদের হুমকি দেওয়া ইত্যাকার অঘটন রোধের দায়িত্বে থাকবেন একজন প্রার্থীর দীর্ঘদিনের অনুগ্রহভাজন সুবিধাভোগী কতিপয় স্থানীয় প্রশাসনিক আর পুলিশ কর্মকর্তা। তাঁরা এখনই স্কেল আর ফিতা দিয়ে শুধু আইভীর পোস্টারের মাপজোখ করছেন। শামীমের বড় পোস্টারের নিচ দিয়ে মাথা সরিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। এতসবের মধ্যে একটি খবর পড়ে মজা পেলাম। আইভীর পোস্টার ছেঁড়ার অভিযোগের জবাবে শামীম বলেছেন, এসব বৃষ্টিতে ভিজে ছিঁড়ে গেছে। তাহলে প্রকৃতিও পক্ষপাতিত্ব করছে—আইভীর প্রতি বৈরী, তাই শুধু বেছে বেছে তাঁর পোস্টারগুলো ভিজিয়ে দিচ্ছে!
বিভিন্ন সূত্রে আরও অনেক খবর হাসপাতালে শয্যাশায়ীর কাছে পৌঁছেছে। এমনি একটি অকিঞ্চিৎকর খবর হলো, নারায়ণগঞ্জে মেশিনে ভোট দেওয়া পদ্ধতিটি নিয়ে মৃদু আপত্তি। নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণে আগেই ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) ব্যবহারের মহড়া দেখেছি। আমি তাদের বলেছিলাম, নতুন ভালো কিছু করতে গেলে এমন খুঁতখুঁতি শুনতে হয়। যেমন সত্তরের নির্বাচনেই অমুক মার্কা বাক্সে ব্যালটের বদলে এল ব্যালট পেপারে অমুক মার্কায় ছাপ দেওয়ার ব্যবস্থা। সেদিন যাঁরা আপত্তি করেছিলেন, তাঁরাই বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিলেন। তাই ছহুল-সাখাওয়াত ভাইদের বলেছিলাম, ‘করে ফেলেন। অন্তত পদ্ধতিটির একটি যাচাই তো করা হবে।’ তার পরও যন্ত্রটির স্থাপনা নিয়ে একটি পত্রিকার ছোট্ট খবর আমাকে বিভ্রান্তিতে ফেলেছে। নারায়ণগঞ্জ থেকে আমাকে দেখতে হাসপাতালে এসেছিলেন বহুদিনের পরিচিত তোলারাম কলেজের একজন আইভীভক্ত অধ্যাপক। ইভিএম নিয়ে আলোচনায় তিনি সেদিনের একটি পত্রিকার বিশেষ খবর নজরে আনলেন। যে নয়টি ওয়ার্ডে পদ্ধতিটির পরীক্ষা হবে, এর সব কটিতেই তার হিসাব অনুযায়ী আইভীর সমর্থকদের সংখ্যা বেশি। তার মানে, মেশিন বসানো নয়, সেটি বসানোর স্থান নির্ধারণ নিয়ে অনেকের মনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।
এখন আলোচনা করা যাক ‘মনোনয়ন’ আর ‘সমর্থন’ শব্দদ্বয়ের মারপ্যাঁচ, যা আমার আজকের প্রতিবেদনের শিরোনামটি ব্যাখ্যা করবে। আওয়ামী লীগের দলীয় ‘সমর্থন’ নিয়ে দু-চারজন সিনিয়র নেতা কমিশনের সঙ্গে লুকোচুরি খেলেছেন। নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর আমি কথা বলেছিলাম আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত দুই নেতার সঙ্গে। দলটির নতুন বর্তমান নেতৃত্বের সবাইকে চিনি না, তবে দুজনের প্রজ্ঞা ও দলীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনায় দক্ষতা ও আন্তরিকতা সম্পর্কে অবহিত আছি। একজন বাহাউদ্দিন নাছিম, দলের সব প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দলনেত্রীর সকল দুঃসময়ে অতি কাছে থাকেন যিনি। দ্বিতীয়জন হচ্ছেন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হানিফ, সরকারের বাইরে থেকে যিনি দলকে গুছিয়ে রাখার প্রশংসনীয় কর্তব্য পালন করে যাচ্ছেন। দলীয় কর্মকাণ্ডকে আন্তরিকতার সঙ্গে সচল রেখেছেন। সরকারের মধ্যে দলকে হারিয়ে যেতে দেননি। উভয়ের সঙ্গেই আমার নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর আইভীর প্রার্থিতা নিয়ে কথা হয়েছিল। দুজনই জানিয়ে দিলেন, তাঁরা নিজেরা কিংবা দল কাউকে সমর্থন দেবে না, আইন অনুসরণে মনোনয়নের প্রশ্নই ওঠে না। দুই দিন না যেতেই কোন কাঠির ছোঁয়ায় তাঁদের অবস্থান পাল্টে গেল, সেই রহস্য না হয় অনুদ্ঘাটিত থাকুক। কিন্তু মনোনয়ন আর সমর্থনের লুকোচুরিতে দায়িত্বশীল দুই নেতার ভূমিকা আমাকে বিস্মিত ও ব্যথিত করেছে। নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে নারায়ণগঞ্জের দলীয় কর্মীদের করেছে বিভক্ত ও বিভ্রান্ত।
শামীমকে তথাকথিত দলীয় সমর্থনের আরেকটি অধ্যায়। নির্বাচনের আগে আইভী আর শামীম দুজনই গিয়েছিলেন দলীয় নেত্রীর কাছে। শামীম চাইলেন সমর্থন, আইভী চাইলেন দোয়া, যেমনটি চেয়েছিলেন তাঁর বাবা চুনকা বঙ্গবন্ধুর কাছে। কাহিনিটি খণ্ডিত আকারে বর্ণনা করেছেন প্রতিবেদক আসিফ হোসেন গত বৃহস্পতিবারের প্রথম আলোয়। সে সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ছিল বর্তমানের জাতীয় সংসদ। অধিবেশন চলাকালে চুনকা গিয়েছিলেন সংসদ ভবনে প্রধানমন্ত্রীর কক্ষে। আমি তখন আওয়ামী লীগের সাংসদ, চুনকার সঙ্গে কক্ষে আমিও ছিলাম। চুনকাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘জানি কী জন্য আসছিস। কিন্তু দলের প্রার্থী তো খোকা, মনোনয়ন তো দিতে পারব না। তবে দোয়া করে দিলাম।’ ইতিহাসের কী চমকপ্রদ পুনরাবৃত্তি! দলের কথিত সমর্থন পেলেন শামীম আর দলনেত্রী দোয়া করলেন বঙ্গবন্ধুর প্রিয়ভাজন চুনকার মেয়ে আইভীকে। আমার ধারণা, ‘যদি’ সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হয় ৩০ অক্টোবর, শেখ হাসিনাও আইভীকে বুকে জড়িয়ে বলবেন, ‘আমি জানতাম, তুমিই জিতবে।’ সম্ভাব্য এই দৃশ্য উপস্থাপনের স্বপ্ন যদি কেউ দেখেন, তাঁকে ওপরের বাক্যের ‘যদি’ শব্দটিকে গুরুত্ব দিতে হবে। আস্থা রাখতে হবে নির্বাচন কমিশনের ওপর।
এই ‘সমর্থন’ আর ‘দোয়ার’ দ্বন্দ্ব আমাকে মনে করিয়ে দিল মহাভারতের একটি কাহিনি। সেই কাহিনির পশ্চাৎপটে নারায়ণগঞ্জ থেকে পাওয়া একটি অস্বস্তিকর খবর। সেখানে নাকি আওয়ামী লীগের চিরাচরিত সমর্থক সংখ্যালঘুদের কথিত দলীয় প্রার্থীর পরিচয় বিভ্রান্ত করছে, আবার হুমকি-ধমকিও দেওয়া হচ্ছে। কাহিনিটি হচ্ছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রাক-মুহূর্তে দুরাচারী দুর্যোধন আর ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির গেলেন শ্রীকৃষ্ণের সমর্থন যাচনা করতে। দুর্যোধন প্রথমে কক্ষে ঢুকে দেখেন শ্রীকৃষ্ণ ঘুমাচ্ছেন। তিনি বসে রইলেন মাথার কাছে। একটু পরে যুধিষ্ঠির এসে বসলেন পদপ্রান্তে। চিৎ হয়ে শোওয়া শ্রীকৃষ্ণ চোখ মেলেই প্রথমে দেখলেন পায়ের কাছে যুধিষ্ঠিরকে। তাঁকে আশীর্বাদ জানালেন, সমর্থনও দেবেন বললেন। অতঃপর দুর্যোধন জানালেন তাঁর আরজি। তার পরের কাহিনি সংক্ষেপে বলছি। উভয়ের যাচনা মঞ্জুর করে শ্রীকৃষ্ণ দুর্যোধনকে দিলেন নিজের অক্ষৌহিণী যোদ্ধা বাহিনী। যুধিষ্ঠিরকে জানালেন, তিনি স্বয়ং ধর্মযুদ্ধে তাঁর পক্ষে অবস্থান নেবেন। তবে নিজের বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবেন না। মধ্যম পাণ্ডব অর্জুনের রথের সারথি হয়ে ধর্মযুদ্ধে অংশ নেবেন। কুরুক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে কীভাবে ধর্মযুদ্ধে অটল রেখেছিলেন তাঁরা যেন তা গীতায় পড়ে নেন।
উপরিউক্ত কাহিনির মাজেজা নারায়ণগঞ্জের সংখ্যালঘু ভোটারদের ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তবে উপাখ্যানটি বর্ণনা করার কারণ অধ্যাপকের অন্য একটি প্রশ্নের উত্তরে দিয়েছি। তিনি জানতে চাইলেন, নারায়ণগঞ্জের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নির্বাচন নিয়ে আতঙ্কে আছে, তাদের শঙ্কা কীভাবে দূর করা যাবে? আমি তাঁকে বললাম, ‘তোমার স্বজাতীয়দের আমার হয়ে রবীন্দ্রনাথের একটি চরণ পৌঁছে দিয়ো। চরণটি হচ্ছে, “ধর্ম যবে শঙ্খরবে করিবে আহ্বান—নীরব হয়ে নম্র হয়ে পণ করিও প্রাণ”।’
প্রতিবেদনটি দীর্ঘ করব না। মহাজাতকের একটি গল্প দিয়ে উপসংহার টানছি। আগে একটু বলে নিই, আমাদের ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ে ঈশপের গল্প আর মহাজাতকের গল্পচ্ছলে বলা হিতবাণী পড়তে হতো।
জাতকের গল্পটি হচ্ছে, একজন মুনি আর একটি ইঁদুরের। একদিন ইঁদুরটি বিড়ালের তাড়া খেয়ে ধ্যানরত মুনির কোঁচড়ে আশ্রয় নিল। মুনি ইঁদুরের ভীতির কারণ জেনে তার গায়ে কমণ্ডলুর জল ছিটিয়ে বললেন, ‘এবার তুই বিড়াল হয়ে যা।’ কয়েক দিন পর সেই বিড়াল বাঘের তাড়া খেয়ে আবার মুনির আশ্রয়ে এল। এবার মুনি বললেন, ‘বাঘ হয়ে বাঘের সঙ্গে লড়াই কর।’ ইঁদুর প্রথমে বিড়াল, তারপর বাঘ হয়ে তেড়ে গেল মুনিকে খাওয়ার জন্য। মুনি এবার কমণ্ডলুর জল ছিটিয়ে বললেন, ‘পুনর্মূষিক ভবঃ—আবার ইঁদুর হয়ে যা।’
নারায়ণগঞ্জের নাগরিক ভোটারদের জন্য আমার প্রার্থনা, ৩০ অক্টোবরের পর তাদের যেন দিবারাত্রি ‘পুনর্মূষিক ভবঃ’ মন্ত্রটি জপ করতে না হয়।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
No comments