স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, অসাম্প্রদায়িক ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত প্রায় প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পুরোধা কাজী আরেফ আহমেদের আজ ত্রয়োদশ মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ষড়যন্ত্রকারীদের সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রে একদল ঘাতকের হাতে প্রাণ দিতে হয় তাকে।


কাজী আরেফ আহমেদের জন্ম ১৯৪২ সালের ৮ এপ্রিল। বাবার নাম কাজী আবদুল কুদ্দুুস, মার নাম বেগম খোদেজা খাতুন। পাঁচ ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ।
কাজী আরেফের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে। এখান থেকেই ১৯৬০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। একই বছর জগন্নাথ কলেজে আইএসসিতে এবং সেখান থেকে বিএসসি ডিগ্রি নেওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোলে এমএসসিতে ভর্তি হন। সরকারবিরোধী আন্দোলনের কারণে কালো তালিকাভুক্ত হওয়ায় তাকে ফাইনাল পরীক্ষা দিতে দেওয়া হয়নি। ছাত্রজীবনে একজন পড়ুয়া ছাত্রের পাশাপাশি খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও সমান মেধার স্বাক্ষর রাখেন তিনি।
ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত হওয়ার আগে তিনি স্থানীয় তরুণদের নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে পুরান ঢাকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মোকাবেলা করেন। এ কারণে পুরান ঢাকার লোকদের খুবই আপন ছিলেন। দেশ ভাগ, হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ভাষা আন্দোলন, বৈষম্যমূলক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, জাতিগত নিপীড়ন প্রভৃতি ঘটনা তাকে প্রতিবাদী রাজনীতিতে টেনে আনে। জগন্নাথ কলেজ থেকেই তিনি ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। তখনকার ঢাকা নগর ছাত্রলীগের সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য থাকাকালে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে গঠিত গোপন সংগঠন 'স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ' বা 'নিউক্লিয়াস'-এর প্রথম দিককার শীর্ষ তিন সদস্যের একজন ছিলেন। ষাটের দশকের সব রাজনৈতিক আন্দোলনে, বিশেষ করে তখনকার দিনে নিষিদ্ধ ছয় দফা আন্দোলনে, জগন্নাথ কলেজের ছাত্রদের জঙ্গি মিছিলে তার সাহসী ভূমিকা ছিল উলেল্গখযোগ্য।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের যাবতীয় নীতিকৌশল এবং গোপন কর্মকাণ্ডের রূপকার 'স্বাধীন বাংলা' বিপ্লবী পরিষদ' বা 'নিউক্লিয়াস'-এর মাধমে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার একটি দৃষ্টান্ত, প্রথম পতাকা তৈরির ঘটনাটি এখানে উল্লেখ করতে চাই। সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ... একটি পতাকার ডিজাইন করতে হবে। এতে অংশগ্রহণ করেন 'নিউক্লিয়াস'-এর সব সদস্য। কাজী আরেফের ভাষায় :"৬ জুন (১৯৭০) সার্জেন্ট জহুরুল হক (তখনকার ইকবাল) হলের ১১৬ নম্বর রুমে মনিরুল ইসলাম (মার্শাল মনি), আ স ম আবদুর রব ও শাজাহান সিরাজকে ডেকে জয় বাংলা ব্যাটালিয়ন ফ্ল্যাগ তৈরি করার প্রয়োজনীয়তার কথা জানালাম এবং এই ফ্ল্যাগই যে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার সম্মান লাভ করবে তাও জানালাম। রব ও মার্শাল মনি বলল, পতাকার 'বটলগ্রিন' জমিনের কথা এবং শাজাহান সিরাজ অনুরোধ জানাল, রক্তলাল একটা কিছু যেন পতাকায় থাকে। আমি তাদের প্রস্তাব গ্রহণ করে বটলগ্রিন জমিনের মাঝখানে গোলাকার রক্ত লাল রঙে উদিত প্রভাত সূর্য এঁকে সবাইকে দেখাই। সবাই একমত হলে... আমি সবাইকে বললাম ওই পতাকার মাঝখানে সোনালি রঙের (বাংলার তৎকালীন অর্থকরী সম্পদ সোনালি আঁশ পাট ও পাকা ধানক্ষেতের রঙ) বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা থাকবে। পতাকায় ভূখণ্ডের মানচিত্র সুনির্দিষ্টভাবে থাকলে জনগণকে বিভ্রান্ত করা সম্ভব হবে না।" তার এই অখণ্ডনীয় যুক্তি এবং সুদূরপ্রসারী চিন্তা সবাই মেনে নেন। তার রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক নীতিনির্ধারণী ও প্রায়োগিক কর্মকাণ্ড নিয়ে এ রকম অসংখ্য কাহিনী উল্লেখ করা যায়।
১৯৭০ সালে 'স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদে'র পক্ষে 'জয় বাংলা বাহিনী' গঠন এবং এর 'ব্যাটালিয়ন ফ্ল্যাগ' ডিজাইন ও তৈরির দায়িত্ব পালন করেন। এই বাহিনী পরে বিএলএফ এবং এই পতাকা জাতীয় পতাকায় রূপান্তরিত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ও ছাত্রলীগের সমন্বয়কের দায়িত্বে নিয়োজিত। ১৯৭২ সালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম একজন ছিলেন। জাতীয় কৃষক লীগের সভাপতি ছিলেন। ১৯৭২_১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যে 'বিপ্লবী গণআন্দোলন' সংগঠিত ও পরিচালনায় নেতৃত্ব দেন। স্বাধীনতার পর জাতীয় দৈনিক পত্রিকা 'গণকণ্ঠ'-এর প্রধান কার্যনির্বাহী ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অবৈধ ক্ষমতা দখল ও সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তার নীতিকৌশলের ভিত্তিতেই মতৈক্যের মাধমে আওয়ামী লীগ ও জাসদ ১৯৮০ সালে দশদলীয় ঐক্যে যোগ দেয়।
১৯৮৭ সালের জুনে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং নয় মাস কারাভোগের পর ১৯৮৮ সালের ২৯ মার্চ তিনি মুক্তি পান। ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন' ও 'ঘাতক-দালাল নির্মূল' জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠনে নেতৃত্ব দেন। তখনকার ঘাতক-দালালবিরোধী লড়াইয়ে ব্যাপক সাড়া জাগানো সংগঠন 'মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র কমান্ড' গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। কাজী আরেফ আহমেদ সংসারধর্মও পালন করেন। তার স্ত্রী ও রাজনৈতিক সহকর্মী বেগম রওশন জাহান সাথী, যশোরের বিখ্যাত রাজনীতিক মরহুম অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেনের জ্যেষ্ঠ কন্যা (দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনিও স্বাধীন বাংলাদেশে, ১৯৭৪ সালে ঘাতকদের হাতে নিহত হন)। তাদের এক মেয়ে জুলি এবং এক ছেলে অরূপ। ঘাতকদের হাতে তার অকাল প্রয়াণের অপূরণীয় ক্ষতি নারীত্বের সহজাত গুণ, সহনশীলতার কারণে সাথী ও জুলি খানিকটা কাটিয়ে উঠতে পারলেও কিশোর অরূপ এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তার অনুপস্থিতি অরূপকে যেম জীবনবিমুখ করে ফেলেছে!
বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে তার অনন্য অবদান জাতি অবশ্যই চিরকাল স্মরণে রাখবে। তার বিদেহী আত্মার প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা এবং সংগ্রামী সালাম।

No comments

Powered by Blogger.