সদয় প্রকৃতির নির্দয় সতর্কবার্তা byশেখ রোকন
এপিক সেন্টার সিকিমসহ আশপাশের অঞ্চল_ আসাম, অরুণাচল, ভুটান, নেপাল ও তিব্বত থেকে এখনও রোববারের ভূমিকম্পের ক্ষতচিহ্ন মুছে যায়নি। অথচ মাত্র আগের রোববারেরই গ্যাংটকে ভারত-বাংলাদেশের এক যৌথ সেমিনারে সিকিম ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ড. মাহেন্দ্র পি লামা বলছিলেন 'প্রকৃতি এখন সদয়'।
অন্যান্য বছর সেপ্টেম্বরের গোড়ার দিকে সিকিমে তুমুল বৃষ্টিপাত ও অহরহ ভূমিধস হয়। চীন, ভুটান, নেপালের সঙ্গে প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে দুর্গম সীমান্তরেখায় সাড়ে তিন দিক থেকে আবদ্ধ সিকিম থেকে বাইরের বিশ্বে যাতায়াতের একমাত্র সড়কপথটি তখন বন্ধ হয়ে যায়। প্রশাসনিক ও সামরিক কাজে যদিও আর্মি কপ্টার ব্যবহার হয়; অন্যদের অপেক্ষা করতে হয় বিভিন্ন স্থানে ধসের শিকার সড়কপথটি না খোলা পর্যন্ত। এবার গ্যাংটকের ঘরে ও বারান্দায় পেঁজা পেঁজা মেঘের আনাগোনা এবং পশলা বৃষ্টিপাত ছিল ঠিকই; তা ভূমিধসানোর মতো নয়। অধ্যাপক লামা সে ইঙ্গিতই করেছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।
ভূমিকম্পে সিকিমেই মৃতের সংখ্যা একশ' ছাড়িয়েছে; নিরাপদ দূরত্বে থাকলেও কেঁপে উঠতে হয়েছে ওই সেমিনারে অংশ নেওয়া প্রায় সবাইকে। তাদের একজন, ভারতীয় ইংরেজি দৈনিক দ্য হিন্দুর বিশেষ প্রতিনিধি সুশান্ত তালুকদারকে ফের ওই অঞ্চলে গিয়ে প্রতিবেদনও লিখতে হয়েছে। তিনি জানাচ্ছেন, এবারের ভূমিকম্পে তিস্তার উজান অংশে নির্মাণাধীন দুটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সেখানে কর্মরত অন্তত ১৬ শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছে। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে সাইট অফিস, শ্রমিক কলোনি, অ্যাপ্রোচ রোড ও খোদ জলবিদ্যুৎ স্থাপনার। আতঙ্কিত শ্রমিক-কর্মচারীর বেশিরভাগ সাইট ছেড়ে পালিয়েছে। প্রতিবেদনের সঙ্গে ছাপা আলোকচিত্রে দেখা যাচ্ছে একদল কর্মী ব্যাগ-বোঁচকা নিয়ে পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে হাঁটছে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে।
সিকিমের 'লাইফলাইন' তিস্তায় এমন পাঁচটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ চলছে। আরও কয়েকটির কাজ শুরু হবে কিছুদিনের মধ্যে। সব মিলিয়ে ২৯টি। কেবল সিকিম নয়, উত্তর-পূর্ব ভারতের সাত বোন রাজ্যে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বান ডেকেছে। বান ডেকেছে ভুটান, নেপাল, চীন ও পাকিস্তানেও।
খাড়া ঢাল ও পর্যাপ্ত প্রবাহের হিমালয়বাহিত নদীগুলো জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে বিশেষ উপযোগী। ভারত ও চীনের জ্বালানি ক্ষুধা মেটাতে সেগুলোতে বাঁধ নির্মাণের হিড়িক পড়েছে। ভারত, পাকিস্তান, ভুটান, নেপাল_ চার দেশ আগামী ২০ বছরে জলবিদ্যুৎ থেকে দেড় লাখ মেগাওয়াট পেতে চায়। চীন আরও আগ্রাসী ভূমিকায়।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা 'ইন্টারন্যাশনাল রিভাসর্' এ নিয়ে সমীক্ষা চালিয়েছিল। তবে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান ছাড়া চীনে প্রবেশ করতে পারেনি। 'মাউন্টস অব কংক্রিট' বা নিরেট পর্বত শিরোনামের ওই সমীক্ষা নয়াদিলিল্গতে প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে। হিমালয় অঞ্চলে জলবিদ্যুৎ আগ্রাসনের ভয়াবহ চিত্র ধরা পড়েছে সমীক্ষাটিতে_ চীন বাদে দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশেই ৫৫২টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প রয়েছে!
কে না জানে, ভূতাত্তি্বক ফাটলের কারণে হিমালয় অঞ্চলে এমনিতেই ভূমিকম্পপ্রবণ। টেকটোনিক পেল্গটের অবস্থানের দিক থেকেও নাজুক_ ভারতীয় পেল্গট উত্তর এশীয় পেল্গটের নিচে ঢোকা অব্যাহত রেখেছে। এর ওপর সেখানে বাঁধের মতো শত শত ভারী স্থাপনা নির্মিত হলে ভূমিকম্পের ঝুঁকি নিঃসন্দেহে কয়েকগুণ বেড়ে যায়। প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যেভাবে পাহাড় কাটা, নদীপ্রবাহ ঘুরিয়ে দেওয়া, বনভূমিতে সরোবর তৈরি করা হচ্ছে, তাতেও ভূমিকম্প বেড়ে যেতে পারে। ভূমিকম্প ঝুঁকি এলাকায় বাঁধ নির্মাণ খোদ প্রকল্পের জন্যও যে ঝুঁকিপূর্ণ, তিস্তার ক্ষতিগ্রস্ত প্রকল্প দুটিই তার প্রমাণ।
অধ্যাপক লামা ঠিকই বলেছেন, প্রকৃতি আমাদের প্রতি বরাবরই সদয়। পশ্চিমে আফগানিস্তান থেকে পূর্বে মিয়ানমার এবং উত্তরে তিব্বত মালভূমি থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত ২০০ কোটিরও বেশি মানুষের জীবন-জীবিকা, কৃষি, সেচ, পরিবেশগত ভারসাম্য, জীববৈচিত্র্য, যোগাযোগ, সংস্কৃতি টিকিয়ে রেখেছে হিমালয়বাহিত নদীগুলো। আমরা সেগুলোকে বাঁধ দিয়ে নির্দয়ভাবে বেঁধে ফেলছি। তার প্রতিক্রিয়ায় যদি ভূমিকম্প দেখা দেয়, কাকে দোষ দেব?
skrokon@gmail.com
ভূমিকম্পে সিকিমেই মৃতের সংখ্যা একশ' ছাড়িয়েছে; নিরাপদ দূরত্বে থাকলেও কেঁপে উঠতে হয়েছে ওই সেমিনারে অংশ নেওয়া প্রায় সবাইকে। তাদের একজন, ভারতীয় ইংরেজি দৈনিক দ্য হিন্দুর বিশেষ প্রতিনিধি সুশান্ত তালুকদারকে ফের ওই অঞ্চলে গিয়ে প্রতিবেদনও লিখতে হয়েছে। তিনি জানাচ্ছেন, এবারের ভূমিকম্পে তিস্তার উজান অংশে নির্মাণাধীন দুটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সেখানে কর্মরত অন্তত ১৬ শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছে। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে সাইট অফিস, শ্রমিক কলোনি, অ্যাপ্রোচ রোড ও খোদ জলবিদ্যুৎ স্থাপনার। আতঙ্কিত শ্রমিক-কর্মচারীর বেশিরভাগ সাইট ছেড়ে পালিয়েছে। প্রতিবেদনের সঙ্গে ছাপা আলোকচিত্রে দেখা যাচ্ছে একদল কর্মী ব্যাগ-বোঁচকা নিয়ে পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে হাঁটছে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে।
সিকিমের 'লাইফলাইন' তিস্তায় এমন পাঁচটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ চলছে। আরও কয়েকটির কাজ শুরু হবে কিছুদিনের মধ্যে। সব মিলিয়ে ২৯টি। কেবল সিকিম নয়, উত্তর-পূর্ব ভারতের সাত বোন রাজ্যে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বান ডেকেছে। বান ডেকেছে ভুটান, নেপাল, চীন ও পাকিস্তানেও।
খাড়া ঢাল ও পর্যাপ্ত প্রবাহের হিমালয়বাহিত নদীগুলো জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে বিশেষ উপযোগী। ভারত ও চীনের জ্বালানি ক্ষুধা মেটাতে সেগুলোতে বাঁধ নির্মাণের হিড়িক পড়েছে। ভারত, পাকিস্তান, ভুটান, নেপাল_ চার দেশ আগামী ২০ বছরে জলবিদ্যুৎ থেকে দেড় লাখ মেগাওয়াট পেতে চায়। চীন আরও আগ্রাসী ভূমিকায়।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা 'ইন্টারন্যাশনাল রিভাসর্' এ নিয়ে সমীক্ষা চালিয়েছিল। তবে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান ছাড়া চীনে প্রবেশ করতে পারেনি। 'মাউন্টস অব কংক্রিট' বা নিরেট পর্বত শিরোনামের ওই সমীক্ষা নয়াদিলিল্গতে প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে। হিমালয় অঞ্চলে জলবিদ্যুৎ আগ্রাসনের ভয়াবহ চিত্র ধরা পড়েছে সমীক্ষাটিতে_ চীন বাদে দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশেই ৫৫২টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প রয়েছে!
কে না জানে, ভূতাত্তি্বক ফাটলের কারণে হিমালয় অঞ্চলে এমনিতেই ভূমিকম্পপ্রবণ। টেকটোনিক পেল্গটের অবস্থানের দিক থেকেও নাজুক_ ভারতীয় পেল্গট উত্তর এশীয় পেল্গটের নিচে ঢোকা অব্যাহত রেখেছে। এর ওপর সেখানে বাঁধের মতো শত শত ভারী স্থাপনা নির্মিত হলে ভূমিকম্পের ঝুঁকি নিঃসন্দেহে কয়েকগুণ বেড়ে যায়। প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যেভাবে পাহাড় কাটা, নদীপ্রবাহ ঘুরিয়ে দেওয়া, বনভূমিতে সরোবর তৈরি করা হচ্ছে, তাতেও ভূমিকম্প বেড়ে যেতে পারে। ভূমিকম্প ঝুঁকি এলাকায় বাঁধ নির্মাণ খোদ প্রকল্পের জন্যও যে ঝুঁকিপূর্ণ, তিস্তার ক্ষতিগ্রস্ত প্রকল্প দুটিই তার প্রমাণ।
অধ্যাপক লামা ঠিকই বলেছেন, প্রকৃতি আমাদের প্রতি বরাবরই সদয়। পশ্চিমে আফগানিস্তান থেকে পূর্বে মিয়ানমার এবং উত্তরে তিব্বত মালভূমি থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত ২০০ কোটিরও বেশি মানুষের জীবন-জীবিকা, কৃষি, সেচ, পরিবেশগত ভারসাম্য, জীববৈচিত্র্য, যোগাযোগ, সংস্কৃতি টিকিয়ে রেখেছে হিমালয়বাহিত নদীগুলো। আমরা সেগুলোকে বাঁধ দিয়ে নির্দয়ভাবে বেঁধে ফেলছি। তার প্রতিক্রিয়ায় যদি ভূমিকম্প দেখা দেয়, কাকে দোষ দেব?
skrokon@gmail.com
No comments