রাষ্ট্র-জামায়াতি জঙ্গিবাদ এবং ইতিহাস নির্মাণের ধারা by শাহমান মৈশান
বাংলাদেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবির কাছে বেশ কয়েক বছর আগে আমরা কয়েকজন তরুণ গিয়েছিলাম তার বাম থেকে ডানে ঘুরে যাওয়া জীবন নিয়ে কিছু কৌতূহলী জিজ্ঞাসা নিয়ে। কবির সঙ্গে আলাপ জমে উঠেছিল; কারণ ভিন্নমতের অবতারণা করেও তর্ক চালিয়ে যাব বলে দু'পক্ষ সূচনাতেই একমত হয়েছিলাম।
কবি এর নাম দেন 'প্রগতিশীল পুঁচকেদের সঙ্গে আড্ডা'। একপর্যায়ে তিনি আমাদের বুদ্ধিদীপ্ত ও রসিক তরুণ-তুর্কি হিসেবেও আখ্যায়িত করেন। আমাদের মতো তরুণরাই তার কবিতার সত্যিকারের পাঠক ও সমালোচক বলে কবি ভাবেন। কেননা গোঁড়া মতবাদীরা কখনোই তার কবিতায় সৃজিত প্রেম-যৌনানুভূতি এবং কৃষিজীবী-শ্রমজীবী মানুষের দ্রোহের চেতনাকে নিজের অন্ধত্বের কারণেই অনুধাবন করতে পারবে না। এমনকি অন্ধ মতাদর্শিক কারণে কবির এই প্রেম, এই কাম, সাম্যবাদী বিপ্লবের এই আকাঙ্ক্ষা তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গোঁড়া মতবাদীরা কখনও ধারণ-লালন করতেও সক্ষম হবে না। কবির প্রতি আমাদের মুগ্ধতা, তিনিই তো বলেছিলেন :'আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন।'
সেই কবি কেমন করে, এ দেশের চিরায়ত লোকধর্মে ভেদাভেদ পত্তনকারী জামায়াত-শিবিরের জোব্বার ভেতরে মুখ লুকালেন? বাংলাদেশের কবিদের রাজনীতি-সংশ্লিষ্টতার ইতিহাসে এই প্রশ্ন এখনও অমীমাংসিত। সেদিন আমরাও সহসা সাহস করে সেই প্রশ্নটিই কবিকে করে ফেলেছিলাম। এই সওয়ালের বিপরীতে কবির হঠাৎ খুলে যাওয়া জবানে চমকে গিয়েছিলাম। প্রত্যক্ষ উত্তর নয়; প্রকৃত কবির মতোই মেটাফর তৈরি করে বলেছিলেন, 'যদি জামায়াত-শিবির ক্ষমতায় আসে তাহলে এ দেশের একটি সবুজ পাতাও আর সবুজ থাকবে না। প্রতিটি সবুজ পাতা লাল হয়ে যাবে।'
সবুজ পাতার লালে রূপান্তরের প্রক্রিয়াটি যে রক্তপাত, সন্ত্রাস, সহিংসতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির মধ্য দিয়েই জামায়াত-শিবির ঘটাবে সেই ইঙ্গিতই কবি আমাদের দিয়েছিলেন। তিনি যেহেতু কবি তাই কপটতা না করে বরং সত্য সন্দর্শন করেছিলেন। সেই সত্যের শিখা আবার গত সোমবার ঢাকার রাজপথে লকলক করে উঠেছে। জামায়াত-শিবির যখন বিএনপির আঁচল ধরে ২০০১ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভাগ পায় তখনও ধর্মীয় সংখ্যালঘু নিরীহ মানুষের ওপর বীভৎস উৎপীড়ন, সম্পদ লুট ও নারী ধর্ষণ এ দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। ১৯৭১ সালেও বাঙালি জাতি যখন এ দেশের অন্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলো নিয়ে স্বাধীনতার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ, তখনও এই জামায়াত-শিবিরই এই জনপদে বিভেদের আগুন জ্বালিয়ে সংঘটিত করেছে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধ। গত ৪০ বছর ধরে জামায়াতি দাবদাহে জ্বলছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভেতরে বিভক্তির বীজ বুনে জামায়াত আজ বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছে।
দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তি অস্বীকারের লড়াইয়ের ভেতর থেকে বাংলাদেশের উদ্ভব। আর জামায়াত-শিবির অন্ধভাবে আঁকড়ে আছে দ্বিজাতিতত্ত্ব। গণতন্ত্র, সাম্য আর ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনৈতিক মূলনীতি নিয়ে বাংলাদেশ যখন স্বাধীন রাষ্ট্রসত্তা হিসেবে এগিয়ে যেতে চায়, তখনই জঙ্গিবাদ ও সহিংস রাজনীতি দিয়ে জামায়াত-শিবির এ দেশকে একাত্তর-পূর্ব পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোর দিকে পিছিয়ে নিতে চায়। পেছনে নিক্ষেপ করার এই জামায়াতি তৎপরতা '৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের মুক্তিকামী ইচ্ছার কাছে পরাস্ত হয়েছিল। এই পরাজয়ে না ডরে বরং জামায়াত গত ৪০ বছরে বুকের ভেতরে প্রতিশোধের সহিংস বাসনাকে আরও দগদগে ও লক্ষ্যভেদী করে তুলেছে। এই হিংসাত্মক বাসনা বাস্তবায়িত করতেই কয়েক দশক ধরে তাদের শাখা সংঘ ছাত্রশিবির অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঐতিহ্যবাহী কলেজগুলোতে প্রকাশ্যে সহিংস-সামরিক রাজনীতির ফ্রন্ট খুলে বহুমাত্রিক সন্ত্রাসের হিংসাত্মক সংস্কৃতি কায়েম করে চলেছে। আর গত সোমবার দেশের প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে ঢাকাসহ সারাদেশের রাজপথে প্রজাতন্ত্রের পুলিশকে আচমকা উপর্যুপরি আক্রমণের মাধ্যমে জামায়াত যেন এক ক্যু করে ফেলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পড়ে। রাজপথে এই জামায়াতি সন্ত্রাসের নেপথ্যে ক্রিয়াশীল কমপক্ষে দুটি কারণকে সাদা চোখেই চিহ্নিত করা যায়। প্রথমত, মডারেট বিএনপিকে নমনীয় আন্দোলনের ধারা থেকে বেরিয়ে এসে রাজপথের চিতাবাঘ হয়ে রক্তপাতে অংশ নিতে প্রলুব্ধ করা। দ্বিতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য কারাবন্দি জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচার প্রক্রিয়াকে বানচাল করা।
এখন প্রশ্ন হলো, বিএনপি কি গণতন্ত্রের আবহে সত্যিকারের ইস্যুভিত্তিক গঠনমূলক রাজনীতির অনুশীলন করবে, নাকি চিনির প্রলেপ মাখা জামায়াতি বিষের বড়ি খেয়ে রাজপথের রক্তলোলুপ চিতাবাঘে পরিণত হওয়ার আত্মঘাতী ফাঁদে পা দেবে? যদিও এই দু'দলের রাজনৈতিক দোস্তি খুবই ঐতিহাসিক। তথাপি বিএনপি কি কখনোই নিজেদের বদলাবে না? বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দর্শনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ রাজনৈতিক চরিত্র নির্মাণের লক্ষ্যে সন্ধানী হবে না?
নাগরিক হিসেবে অবশ্যই আমরা চাই ভিন্নমত প্রকাশ ও চর্চার জন্য একটি মুক্ত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। আর সেই মুক্ত পরিসর কেবল মুক্তিযুদ্ধ-প্রসূত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দর্শনের অবিরাম বিকাশের ধারাতেই সম্ভব। তাই জামায়াত-শিবিরের অস্তিত্ব ও তৎপরতাকে তরুণ প্রজন্মকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে। নইলে বিশ্বায়িত এই করপোরেট পুঁজিবাদী পৃথিবীতে এক সমৃদ্ধ আত্মপরিচয় নিয়ে আমরা অস্তিত্ব রক্ষা করতে কি পারব? এই দেশের প্রতিটি নতুন প্রভাত অবগাহনের জন্য জরুরি হলো, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতিহাস নির্মাণের ধারায় আত্মপরিচয় নির্মাণের দৈনন্দিন চিন্তা ও কর্মের অবিরাম ধারা জারি রাখা।
শাহমান মৈশান : প্রভাষক, নাট্যকলা বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ; খণ্ডকালীন শিক্ষক, নাট্যকলা বিভাগ, ঢাবি
সেই কবি কেমন করে, এ দেশের চিরায়ত লোকধর্মে ভেদাভেদ পত্তনকারী জামায়াত-শিবিরের জোব্বার ভেতরে মুখ লুকালেন? বাংলাদেশের কবিদের রাজনীতি-সংশ্লিষ্টতার ইতিহাসে এই প্রশ্ন এখনও অমীমাংসিত। সেদিন আমরাও সহসা সাহস করে সেই প্রশ্নটিই কবিকে করে ফেলেছিলাম। এই সওয়ালের বিপরীতে কবির হঠাৎ খুলে যাওয়া জবানে চমকে গিয়েছিলাম। প্রত্যক্ষ উত্তর নয়; প্রকৃত কবির মতোই মেটাফর তৈরি করে বলেছিলেন, 'যদি জামায়াত-শিবির ক্ষমতায় আসে তাহলে এ দেশের একটি সবুজ পাতাও আর সবুজ থাকবে না। প্রতিটি সবুজ পাতা লাল হয়ে যাবে।'
সবুজ পাতার লালে রূপান্তরের প্রক্রিয়াটি যে রক্তপাত, সন্ত্রাস, সহিংসতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির মধ্য দিয়েই জামায়াত-শিবির ঘটাবে সেই ইঙ্গিতই কবি আমাদের দিয়েছিলেন। তিনি যেহেতু কবি তাই কপটতা না করে বরং সত্য সন্দর্শন করেছিলেন। সেই সত্যের শিখা আবার গত সোমবার ঢাকার রাজপথে লকলক করে উঠেছে। জামায়াত-শিবির যখন বিএনপির আঁচল ধরে ২০০১ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভাগ পায় তখনও ধর্মীয় সংখ্যালঘু নিরীহ মানুষের ওপর বীভৎস উৎপীড়ন, সম্পদ লুট ও নারী ধর্ষণ এ দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। ১৯৭১ সালেও বাঙালি জাতি যখন এ দেশের অন্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলো নিয়ে স্বাধীনতার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ, তখনও এই জামায়াত-শিবিরই এই জনপদে বিভেদের আগুন জ্বালিয়ে সংঘটিত করেছে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধ। গত ৪০ বছর ধরে জামায়াতি দাবদাহে জ্বলছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভেতরে বিভক্তির বীজ বুনে জামায়াত আজ বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছে।
দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তি অস্বীকারের লড়াইয়ের ভেতর থেকে বাংলাদেশের উদ্ভব। আর জামায়াত-শিবির অন্ধভাবে আঁকড়ে আছে দ্বিজাতিতত্ত্ব। গণতন্ত্র, সাম্য আর ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনৈতিক মূলনীতি নিয়ে বাংলাদেশ যখন স্বাধীন রাষ্ট্রসত্তা হিসেবে এগিয়ে যেতে চায়, তখনই জঙ্গিবাদ ও সহিংস রাজনীতি দিয়ে জামায়াত-শিবির এ দেশকে একাত্তর-পূর্ব পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোর দিকে পিছিয়ে নিতে চায়। পেছনে নিক্ষেপ করার এই জামায়াতি তৎপরতা '৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের মুক্তিকামী ইচ্ছার কাছে পরাস্ত হয়েছিল। এই পরাজয়ে না ডরে বরং জামায়াত গত ৪০ বছরে বুকের ভেতরে প্রতিশোধের সহিংস বাসনাকে আরও দগদগে ও লক্ষ্যভেদী করে তুলেছে। এই হিংসাত্মক বাসনা বাস্তবায়িত করতেই কয়েক দশক ধরে তাদের শাখা সংঘ ছাত্রশিবির অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঐতিহ্যবাহী কলেজগুলোতে প্রকাশ্যে সহিংস-সামরিক রাজনীতির ফ্রন্ট খুলে বহুমাত্রিক সন্ত্রাসের হিংসাত্মক সংস্কৃতি কায়েম করে চলেছে। আর গত সোমবার দেশের প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে ঢাকাসহ সারাদেশের রাজপথে প্রজাতন্ত্রের পুলিশকে আচমকা উপর্যুপরি আক্রমণের মাধ্যমে জামায়াত যেন এক ক্যু করে ফেলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পড়ে। রাজপথে এই জামায়াতি সন্ত্রাসের নেপথ্যে ক্রিয়াশীল কমপক্ষে দুটি কারণকে সাদা চোখেই চিহ্নিত করা যায়। প্রথমত, মডারেট বিএনপিকে নমনীয় আন্দোলনের ধারা থেকে বেরিয়ে এসে রাজপথের চিতাবাঘ হয়ে রক্তপাতে অংশ নিতে প্রলুব্ধ করা। দ্বিতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য কারাবন্দি জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচার প্রক্রিয়াকে বানচাল করা।
এখন প্রশ্ন হলো, বিএনপি কি গণতন্ত্রের আবহে সত্যিকারের ইস্যুভিত্তিক গঠনমূলক রাজনীতির অনুশীলন করবে, নাকি চিনির প্রলেপ মাখা জামায়াতি বিষের বড়ি খেয়ে রাজপথের রক্তলোলুপ চিতাবাঘে পরিণত হওয়ার আত্মঘাতী ফাঁদে পা দেবে? যদিও এই দু'দলের রাজনৈতিক দোস্তি খুবই ঐতিহাসিক। তথাপি বিএনপি কি কখনোই নিজেদের বদলাবে না? বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দর্শনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ রাজনৈতিক চরিত্র নির্মাণের লক্ষ্যে সন্ধানী হবে না?
নাগরিক হিসেবে অবশ্যই আমরা চাই ভিন্নমত প্রকাশ ও চর্চার জন্য একটি মুক্ত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। আর সেই মুক্ত পরিসর কেবল মুক্তিযুদ্ধ-প্রসূত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দর্শনের অবিরাম বিকাশের ধারাতেই সম্ভব। তাই জামায়াত-শিবিরের অস্তিত্ব ও তৎপরতাকে তরুণ প্রজন্মকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে। নইলে বিশ্বায়িত এই করপোরেট পুঁজিবাদী পৃথিবীতে এক সমৃদ্ধ আত্মপরিচয় নিয়ে আমরা অস্তিত্ব রক্ষা করতে কি পারব? এই দেশের প্রতিটি নতুন প্রভাত অবগাহনের জন্য জরুরি হলো, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতিহাস নির্মাণের ধারায় আত্মপরিচয় নির্মাণের দৈনন্দিন চিন্তা ও কর্মের অবিরাম ধারা জারি রাখা।
শাহমান মৈশান : প্রভাষক, নাট্যকলা বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ; খণ্ডকালীন শিক্ষক, নাট্যকলা বিভাগ, ঢাবি
No comments