সরল গরল-মূষিকের পর্বত প্রসব! by মিজানুর রহমান খান

যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিষয়ে জনগণের কাছে দেওয়া সরকারি প্রেসনোটটি আমাদের বিস্মিত করেছে। শুরুতেই অসত্য বক্তব্য: ‘পদ্মা সেতুর কাজ থেমে নেই।’ এরপর দেওয়া হয়েছে স্থগিত থাকার বিবরণ। এমনকি কমিটির গঠন সম্পর্কেও ভুল তথ্য। প্রেসনোট তৈরিতে অযত্ন এতটাই।


বাংলাদেশের ইতিহাসের বৃহত্তম প্রকল্প যার সঙ্গে কোটি কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা জড়িয়ে আছে, সেটি যে অভিযোগের কারণে স্থগিত হয়ে আছে, এমনকি কখন চালু হবে তা অনিশ্চিত, সে বিষয়ে এতটা হেলাফেলা করে একটা ব্যাখ্যা দেওয়া জনগণের সঙ্গে রসিকতা। বিগত আমলের ‘ক্লেপটোক্রেসি’র ভূত জাতির কাঁধে আবার চেপে বসবে কি না, সেই আশংকায় অনেকেই প্রমাদ গুনতে পারেন।
পদ্মা সেতু না আবুল হোসেনের মন্ত্রিত্ব থাকবে—সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে মনে হবে, প্রয়োজনে পদ্মা সেতুর দরকার নেই। আবুল হোসেনকে মন্ত্রিত্বে যেন রাখতেই হবে। প্রমাণ হলে কঠোর ব্যবস্থা নেবেন। আর প্রমাণ না হলে? ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে অবৈধ স্বার্থ নিয়েছিলেন তাঁর এক ব্যবসায়ী বন্ধু। এটা ফাঁস হওয়ায় প্রতিরক্ষামন্ত্রী কদিন আগে পদত্যাগ করেন। লাল বাহাদুর শাস্ত্রী পদত্যাগ করেছিলেন। ট্রেন দুর্ঘটনার জন্য তিনি দায়ী হয়েছিলেন বলেই?
আবুল হোসেনের কণ্ঠই যে সরকারি কণ্ঠ, সেটাই স্পষ্ট করা হলো। এমনকি তাঁর বিরুদ্ধে হুমকি দিয়ে ঘুষ আদায়ের যে সরাসরি অভিযোগ আনা হয়েছে, সে বিষয়ে প্রেসনোটে বিস্ময় বা কোনো প্রতিক্রিয়া পর্যন্ত দেখানো হয়নি। উপরন্তু প্রধানমন্ত্রী যখন বিএনপির দুর্নীতিকে দোষারোপ করেন, তখন আমরা বুঝি গলদটা কোথায়।
কানাডার কর্তৃপক্ষ তো তার অফিসে হানা দিয়েছে। তদন্ত চালাচ্ছে। সাকোর অফিসে কেউ হানা দেয়নি। তাহলে লাভলিন ঘুষ দেওয়ার ধারণায় শাস্তি পেলে, আবুল হোসেন ধারণাগত ঘুষ গ্রহণে কোনো শাস্তি পাবেন না কেন?
এরশাদের হাতে রক্তের দাগ ছিল না। আবুল হোসেনও বলেছেন, তাঁর হাত দিয়ে দুর্নীতি হয়নি।
বিশ্বব্যাংক চিঠিতে সৈয়দ আবুল হোসেন অ্যান্ড কোম্পানি (সাকো) ঘুষ পকেটে পোরার অভিযোগ করেনি।
সাকোর প্রতিনিধিরা ঘুষ দিতে হুমকি দিয়েছেন। সাক্ষ্যদাতারা দৈহিক ও অর্থনৈতিকভাবে সাকোর প্রতিশোধপরায়ণতার শিকার হতে পারেন। এ রকমের একজন সাক্ষী বলেন, সাকোর এক লোক মন্ত্রী আবুল হোসেনের কাছ থেকে সরাসরি হুকুম পেয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। কন্ট্রাক্ট ভ্যালু বা চুক্তিমূল্যের একটি নির্দিষ্ট পার্সেন্টেস মন্ত্রী হোসেনকে দিতে হবে। আর তা হলে তিনি পদ্মার মূল সেতু চুক্তির জন্য প্রাকযোগ্যতা প্রক্রিয়ায় তাঁর কোম্পানিকে সাহায্য করবে। মন্ত্রী আবুল হোসেনের পক্ষে যে ব্যক্তি এসেছিলেন, তাঁর আলোকচিত্র দেখিয়ে বিশ্বব্যাংক তাঁর পরিচয় শনাক্ত করেছে। দ্বিতীয় সাক্ষী বিস্তারিত তথ্য দিয়ে দাবি করেছেন, সাকো ‘সাইলেন্ট’ এজেন্ট হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কোম্পানি ঘুষ দিয়ে কাজ পেতে অস্বীকার করলে তাকে হুমকি দেওয়া হয়। এরপর বিশ্বব্যাংক বলেছে, ‘সৈয়দ আবুল হোসেন নিজেই প্রতিশোধ গ্রহণের পাল্টা হুমকি দিয়েছিলেন।’ এর সত্যতা যাচাই করতে সাকোর এমন একজন প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, যাঁর পুরো বিষয়টি জানা ছিল। চিঠির ভাষায় সাকোর এ গোপন সাক্ষী গোড়ায় আবুল হোসেনের পক্ষে প্রতিশোধপরায়ণতা এবং চাকরিচ্যুতির আশঙ্কায় কথা বলতেই অস্বীকৃতি জানান। সাকোর প্রতিনিধি বলেন, মন্ত্রী অত্যন্ত শক্তিশালী। পরে তিনি এর সত্যতা নিশ্চিত করেন।
আবুল হোসেন বলেন, অভিযোগ অনুমাননির্ভর। কাজ না পেয়ে লোকেরা এমনই রটায়। যদি তা-ই হবে তবে তিনি কেন বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ করছেন না। বিএনপির আমলে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সঙ্গে একটি অন্যায় দায়মুক্তি চুক্তি করেছিল বলে খবর চাউর আছে। অনেকে তো মনে করেন এটা বাতিল করা উচিত। আবুল হোসেন নিশ্চয় মানবেন, বিশ্বব্যাংক তাঁর মানহানি করেছে। ভবিষ্যতে আরও হয়তো তারা করতে পারে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না। এটা তো চলতে পারে না। সুতরাং আপনি আবুল হোসেন মামলা ঠুকুন।
বিশ্বব্যাংক নিশ্চয়ই জানত, তারা কত গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন করছে। সে কারণেই কি তারা উল্লেখ করেছে যে আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে আরও ১১ জন গোপনীয় সাক্ষী একই ধরনের অসততা বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন? তাহলে বিশ্বব্যাংকের ভিত্তিহীন অনুমান তো তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার কথা। আমরা তো কত ধরনের গোয়েন্দা পুষে থাকি। তারা তো খপ করে ধরে ফেলার কথা। তাহলে কেন এমন হুমকির মতো ফৌজদারি অপরাধ দুদকের দেখার কথা নয়। অভিযোগের বিবরণে ঘুষের চেয়ে হুমকিই বড়। সাক্ষীরা সবাই ভীত, হুমকিগ্রস্ত।
এত দিন এটা ছিল যোগাযোগমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কৈফিয়ত দেওয়ার মধ্যেই সীমিত। প্রধানমন্ত্রী যখন গোড়াতেই এ বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন, তখন আমরা আশায় বুক বেঁধেছিলাম। সরকারই এটা তদন্ত করতে পারে। কিন্তু প্রেসনোটে দুদকের মুলো ঝোলালো।
পিলখানার ঘটনায় যদি এফবিআইকে আনা যায়, তাহলে এখানে এফবিআইকে ডাকা হচ্ছে না কেন? বিশ্বব্যাংক যে অভিযোগ করেছে তা খতিয়ে দেখার মুরোদ ও সামর্থ্য আমাদের দুদক বা অন্যরা কতটা রাখে তা-ও এক বড় জিজ্ঞাসা।
গরু যদি নদীতীরে ঘাস খায়, তাহলে তাকে নদীতে ঠেলে ফেলা যায়। নদী ও গরু নিয়ে বস্তাপচা গল্পেরও একটা প্লট থাকে। কিন্তু সরকারি প্রেসনোটের সেটুকুও নেই। পড়ে বোঝা যায় না আবুল হোসেন বিতর্কের কোথায় দাঁড়িয়ে, আর তাঁকে কোথায় সরিয়ে দেওয়া হলো। জনগণের কাছে জবাবদিহিরই বা কি হলো। প্রেসনোটের সারকথা হচ্ছে, আপনারা আল্লাহর ওয়াস্তে দুদকের দিকে তাকিয়ে থাকুন।
বিশ্বব্যাংক যদিও বলেছে, লাভলিনের কাজ পাওয়ার সঙ্গে তাদের আনা অভিযোগের সম্পর্ক নেই। লাভলিন নির্মাণ তদারকির জন্য পরামর্শক নিয়োগ হতে চলছিল। আর দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে মূল সেতু নির্মাণে দরদাতা বাছাইয়ে। তবে শুনেছি যে লাভলিন পাকাপাকি কাজ পেতে বাংলাদেশে টাকা ঢেলেছিল। সেটা কার পকেটে গেছে, তা এখনো রহস্য।
কানাডীয় অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভলিনকে কালো তালিকাভুক্ত করার পরামর্শ দেওয়া হলো এমন সময়ে যখন তারা নাকি নিজেরাই দৌড় থেকে সরে দাঁড়িয়েছিল। আবুল হোসেন ইতিমধ্যে যথেষ্ট অপরিচ্ছন্ন কাজ করেছেন। তিনি চমক সৃষ্টির জন্য সম্প্রতি দুদকের সততা সনদ এবং আরেকটি সনদের আশায় টিআইবিকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমরা মনে করি, টিআইবি দূরদর্শিতা দেখিয়েছিল। তারা প্রকারান্তরে পর্যবেক্ষক হতে চেয়েছিল। এই উপাখ্যানটির যদি একটি তদন্ত হয়, তাহলে যে ফল আসবে তাতে আমরা নিশ্চিন্তে বলতে পারি, দ্বিতীয়বারের মতো তাঁর অপসারণ অপরিহার্য বলে প্রতীয়মান হতে পারে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের কাছে বিষয়টি গতকাল শোনা। তারা ২০০৯ সালের জুনে সততার রূপরেখা চুক্তি বা ইন্টেগ্রিটি প্যাক্ট করার প্রস্তাব দেন শুধু আবুল হোসেনের সঙ্গে। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান ও প্রতিবেশী ভারত এ ধরনের বড় প্রকল্পের স্বচ্ছতা বজায় রাখতে টিআইর সঙ্গে চুক্তি করে সুফল পেয়েছে। পদ্মা সেতু নিয়ে ওই প্যাক্ট করতে আবুল হোসেন নীরব থাকেন। দ্বিতীয়বার তাঁর হাতে দেওয়ার পরে সেটি তিনি হারিয়ে ফেলেন। তৃতীয়বার তাঁকে দেওয়ার পরে তিনি নীরব আছেন। আর তিনি যে চমক সৃষ্টি করেছিলেন, সে বিষয়ে টিআইবি থেকে তাঁকে পাল্টা প্রস্তাব দেওয়া হলে তিনি চুপসে যান।
আমরা বিশ্বাস করতে রাজি আছি, পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ভিন্ন কোনো মতলবও থাকতে পারে। কারণ তারা ধোয়া তুলসীপাতা নয়। আবুল হোসেনের শুধু হুমকির কথা জেনেই তারা পদ্মা সেতুর কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। ডাবল স্ট্যান্ডার্ড বা তাদের দ্বিচারিতার নমুনা আমরা এখানেও দেখি। কারণ কানাডীয় লাভলিন যখন এখানে খেলতে এসেছিল, তখন তাদের বিষয়ে তারা নীরব থেকেছিল। কেলেঙ্কারির জন্য লাভলিন ২০০৪ সালে কালো তালিকাভুক্ত হয়েছিল। কেরালায় তারা বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরিতে দুর্নীতিতে জড়িয়েছিল। সেই কেলেঙ্কারির তদন্তে নামতে সিবিআইকে নির্দেশ দিয়েছিলেন কেরালা হাইকোর্ট। সেটা বেশিদিন আগের কথা নয়। ওয়ান-ইলেভেনের পরপরই। সিবিআই কেরালা হাইকোর্টকে জানায়। সাবেক বিদ্যুৎমন্ত্রী পিনারি অভিযুক্ত হন। লাভলিনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্টও অভিযুক্ত হয়েছিলেন।
সিবিআই তদন্ত করেছে তাতেও হয়নি। কেরালা সরকারই বালান্দানের নেতৃত্বে আরেকটি কমিটি করে। সিবিআই প্রমাণ করে দেয় যে বিজন লাভলিনের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে তিনি তার সরকারি পদমর্যাদার অপব্যবহার করেছিলেন। লাভলিনকে কাজ পাইয়ে দিতে অবৈধভাবে প্রভাব খাটিয়েছিলেন। এ ঘটনায় কেরালা সরকারের ৩৭৪ কোটি টাকার ক্ষতি হয়।
আসলে যে অভিযোগ বিশ্বব্যাংক এনেছে তা দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধের মধ্যেও পড়ে না। কারণ অর্থের বাস্তব লেনদেন ঘটেওনি। মন্ত্রীর সরাসরি হুমকি দণ্ডবিধির ৩৮৩ থেকে ৩৮৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য। এ জন্য ভুক্তভোগীর এফআইআর লাগবে। সেটি অন্তত এই আবহাওয়ায় মিলবে না। সুতরাং যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, সেটি আইনের পথে অধরা ও অস্পষ্টই থেকে যাবে।
আবুল হোসেনই হয়তো পদ্মায় সেতু বাস্তবায়নের একমাত্র বাধা নন। তবে তাঁকে ঘিরে যে আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে, সেটা তাঁকে বহাল রেখে সুরাহা করা কঠিন। প্রেসনোটে তার প্রতিফলন ঘটেনি। এর আগে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকার বিগ ফাইটে যাবে কি না, সে বিষয়ে ভাবতে প্রেসনোট দিতে দেরি হচ্ছে। কিন্তু এটা বিগ ফাইট, না গোল্লাছুট? তবে এটা এতটাই উদ্ভট যে এটা পর্বতের মূষিক প্রসবও নয়, মূষিকের পর্বত প্রসব। সেই পর্বতচূড়ায় বসে আছেন একজন আবুল হোসেন।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.