আলোকের এই ধরনাধারায় (পর্ব-৩৫)- প্রথম কক্সবাজার ভ্রমণ by আলী যাকের
অনার্সের তৃতীয় বর্ষে গিয়ে আমরা আবার দালান বদল করলাম। এবার এলাম সদ্যোনির্মিত কলা ভবনে। অতএব, তিন বছরে তিন ভবনে ক্লাস করার সৌভাগ্য আমার এবং আমার সহপাঠীদের হয়েছিল। আমাদের সময় সব তরুণের জন্যই বিশ্ববিদ্যালয় ছিল অত্যন্ত বর্ণময় এক বিদ্যাপীঠ।
এখানে এসেই প্রথম আমরা নারীর সানি্নধ্য পেতাম এবং একটি রক্ষণশীল সমাজে এই নৈকট্য প্রত্যেকের মনেই এক অপার আনন্দ এনে দিত। যেকোনো ছাত্রীর সঙ্গে একটি বাক্য বিনিময় হলেই মনে হতো, সে আমার প্রেমে পড়ে গেছে। সত্য হলো এই যে আসলে আমিই তার প্রেমে হাবুডুবু খেতাম। এই সম্পর্ক অবাস্তব ছিল! মনগড়া ছিল! কিন্তু রোমাঞ্চকর ছিল_এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। প্রসঙ্গক্রমে পঞ্চকবির অন্যতম রজনীকান্ত সেনের একটি বিখ্যাত গানের কয়েকটি চরণ মনে এসে গেল_'আমি স্বপনে তাহারে কুড়ায়ে পেয়েছি, রেখেছি স্বপনে ঢাকিয়া...স্বপনে তাহারই মুখখানি নিরখি, সুখ স্বপনেরই লাগিয়া।' এই গানটি বোধ হয় আমাদের প্রজন্মের স্বপ্ন দেখা তরুণদেরই আত্মার গান। এই যে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের এমন রঙিন বিবরণের কিছু অংশ উল্লেখ করলাম, এর চেয়েও বেশি রোমাঞ্চকর ও আনন্দদায়ক হতে পারত আমারও বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন যদি না...! থাক, সে কথা।
১৯৬১ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর, আমি আগেই লিখেছি, আমাদের জীবনটা থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সবচেয়ে আঘাত পেয়েছিলেন আমার মা। বাবাকে ছাড়া জীবন তিনি কখনো কল্পনা করতে পারেননি। বাবা চলে যাওয়ার পর তিনি সব কাজই করতেন প্রায় যন্ত্রচালিতের মতো। মাঝেমধ্যে হঠাৎ হঠাৎ দীর্ঘশ্বাসে বোঝা যেত তাঁর দুঃখের গভীরতা। এই সময় দিদি পরামর্শ দিলেন যে হাওয়া বদলের জন্য আমাদের বাইরে কোথাও যাওয়া দরকার। হাওয়া বদল বিষয়টি আজকাল আর তেমন আলোচিত হতে শোনা যায় না, কিন্তু কিছুদিন আগেও এন্তার শোনা যেত। রবীন্দ্রনাথের অনেক লেখায়ই এই হাওয়া বদলের ব্যাপারটি লেখা হয়েছে। তবে হাওয়া বদলের প্রয়োজন পড়ত শারীরিক কোনো দুরারোগ্য ব্যাধি সেরে ওঠার পর। মনে আছে, একে বলা হতো 'চেঞ্জে যাওয়া'। আমার বোন টাইফয়েডে ভুগে উঠলে আমরা চেঞ্জে গিয়েছিলাম গ্রামের বাড়িতে। যাহোক, দিদি একাই ছিলেন এক শ। কোমর বেঁধে লেগে গেলেন সব আয়োজন সাঙ্গ করতে। ঠিক হলো, আমরা সবাই মিলে কঙ্বাজারে যাব। এর আগে আমরা কঙ্বাজারের নাম শুনেছি বটে। এটাও জানি যে সেখানে গেলে বঙ্গোপসাগরের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, কিন্তু জায়গাটা কেমন, সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। একটা ভাসা ভাসা জ্ঞান ছিল যে স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য কঙ্বাজার সৈকতে অনেকেই সাম্প্রতিককালে গিয়ে থাকেন। মায়ের কাছে মাঝেমধ্যে কঙ্বাজার সম্পর্কে দু-একবার শুনেছি বটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে যখন আমার জন্ম হয়, আমার বাবা তখন চট্টগ্রাম সদরের মহকুমা হাকিম। তখন অজস্র বাঙালি শরণার্থী জাপানিদের ভয়ে বর্মা ছেড়ে সড়কপথে টেকনাফ, কঙ্বাজার হয়ে চট্টগ্রামের দিকে আসত। এই জনস্রোতের দেখভাল করার দায়িত্ব পড়েছিল ব্রিটিশ সরকারের হাতে। বাবা প্রায়ই কঙ্বাজারে যেতেন তাঁকে বরাদ্দকৃত জিপে চড়ে। বাবার কাছেই কঙ্বাজারের নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলির গল্প শুনেছিলেন মা।
কঙ্বাজারে আমাদের যাওয়া হয়েছিল ১৯৬২ সালে জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে। তখনকার বিস্তারিত স্মৃতি প্রায় ধূসর হয়ে এসেছে। তবে যত দূর মনে পড়ে, আমাদের থাকার কথা ছিল একেবারে সমুদ্রসৈকতে অবস্থিত সরকারি কোনো গেস্টহাউসে। যখন ট্রেনে করে চট্টগ্রাম এবং অতি জীর্ণ একটি বাসে করে কঙ্বাজারে পেঁৗছলাম, তখন শোনা গেল, সেই অতিথিশালায় জায়গা নেই। অতএব, আমাদের বিকল্প ব্যবস্থা করে নিতে হবে। আমাদের গ্রাম সম্পর্কীয় এক আত্মীয় তখন সরকারি কর্মসূত্রে কঙ্বাজার নিবাসী। তাঁরাই আমাদের খবর দিলেন যে পাকিস্তান পর্যটন করপোরেশনের উদ্যোগে একটি অতিথিশালা সম্প্রতি নির্মিত হয়েছে শহর থেকে দূরে সাগরতটে, যার নাম 'লাবনী'। এই লাবনীকে হোটেল না বলে মোটেল বলা হয়। আমাদের মধ্যে অনেকেই মোটেল শব্দটি নিয়ে অনেক হাসিঠাট্টা করল। তবে আমি কিন্তু তখন মার্কিন কমিকসের সৌজন্যে মোটেল নামক পান্থশালা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানার্জন করে ফেলেছি। মোটেল এক ধরনের হোটেল, যেখানে অতিথিদের একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ঘর দেওয়া হয়, যার সঙ্গে সংলগ্ন থাকে একটি শৌচাগার ও একটি ছোট্ট রান্নাঘর।
অর্থাৎ মোটেলে কোনো রেস্তোরাঁ থাকে না। সেখানেই আমাদের জায়গা হলো। আমরা দুটি কামরা ভাড়া করলাম। প্রতিটি কামরার সঙ্গেই একটি বাথরুম এবং একটি ছোট রান্নাঘর ছিল। আমাদের দলে মা, আমরা চার ভাইবোন এবং আমাদের সংসারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, দীর্ঘদিনের পাচক শামসু ভাই। শামসু ভাইয়ের কোলেপিঠে আমরা মানুষ হয়েছিলাম। মা সযত্নে শামসু ভাইকে নানা রকম রান্নাবান্না শিখিয়েছিলেন। আরো ছিলেন আমাদের সংসারের আরেক সদস্য আমাদের সবার বড় জ্যাঠাতো ভাই, যাঁকে আমরা ছোড়দা বলে ডাকতাম। দিন চারেক ছিলাম আমরা কঙ্বাজারে। অপার আনন্দে কেটেছিল সেই দিনগুলো।
(চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments