ছাত্ররাজনীতি ও আমাদের ভবিষ্যৎ by লুৎফর রহমান রনো
আমাদের দেশে এখন ছাত্ররাজনীতি নিয়ে কোনো কথা বলা ক্ষমাহীন অপরাধের সমান। কারণ সরকারি দল ও প্রধান বিরোধী দল উভয়ই ছাত্ররাজনীতির পক্ষে। আর এই দুই পক্ষের যে কারো সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করা যেন সত্যের অপলাপ।
যা কিছু বাংলাদেশে আজ 'সত্য' বলে স্বীকৃত, তা এই দুটি রাজনৈতিক দলেরই সৃষ্টি বা অনুমোদিত। এর বাইরে কোনো সত্য থাকতে পারে, তেমন চিন্তা করাটাই যেন ভুলে গেছে ছাত্রসমাজ, শিক্ষক বা গুরুজন সবাই। মানব-সমাজতত্ত্ব বা নৃতত্ত্ব পড়াশোনা করলেও জানা যায়, কিংবা অনেকেরই পড়া মিশেল ফুকোর 'প্রতাপতত্ত্ব'। এসব প্রতিবেদনে মানব-ইতিহাসের তথ্য ও সত্য উদ্ঘাটন করে দেখানো হয়েছে, প্রতাপ বা ক্ষমতাই সত্য সৃষ্টি করে। আমাদের সমাজে আজ যেসব মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতা প্রতিষ্ঠিত, তাও ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে ক্ষমতাসীনরা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। সেই ক্ষমতাসীন হতে পারেন ধর্মবেত্তা, রাজা-জমিদার প্রভৃতি। পিতৃতন্ত্র-পুরুষতন্ত্র, এসবের কঠোর নৈতিকতার দ্বারা আমরা জর্জরিত, তবু বলা যাবে না এসব ভ্রান্ত কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তৈরি নীতি। এসবের বিরোধিতা করা যাবে না, কারণ আমাদের সমাজপতি, প্রভাবশালী শ্রেণী ও রাষ্ট্রসংস্থা ওই নীতি-নৈতিকতার প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষক। ঠিক একইভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে ক্ষমতাসীন বিএনপি ও আওয়ামী লীগ তাদের ক্ষমতা-স্বার্থের অনুকূল, দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও অনুসারীদের স্বার্থানুকূল অলিখিত নিয়ম-নীতি-নৈতিকতা তৈরি করেছে_যা আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে সমাজের সর্বত্র এর প্রভাব প্রায় অপ্রতিরোধ্য। এতে সমাজ থেকে মুক্ত ভাবনা-চিন্তা, নিঃস্বার্থ ও দলনিরপেক্ষ দেশাত্মবোধক ভাবনা-চিন্তার পরিসর বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান নেই উলি্লখিত রাজনীতির প্রভাবমুক্ত। কোনো শিক্ষাঙ্গন নেই, যেখানে নিখাদ জ্ঞানচর্চা চলছে নির্বিঘ্নে। যেকোনো শিক্ষালয়ের প্রাথমিক পরিচয় ও নৈতিকতা হলো সরকারি দলের না বিরোধী দলের শিক্ষার্থী। ছাত্রদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কিংবা বঞ্চনা নির্ধারিত হয় রাজনৈতিকভাবে। শিক্ষকরাও সমানভাবে রাজনৈতিক রীতিতে চিহ্নিত। রাজনৈতিক পরিচয় কোনো দোষের নয়। কিন্তু আমাদের দেশে সেই 'নির্দোষ' আদর্শের রাজনীতি নেই। তাই শিক্ষাঙ্গনে নেই শিক্ষা লাভের প্রতিযোগিতা। আছে হল দখলসহ ব্যবসা-বাণিজ্য বাগানোর নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা। এতে সন্দেহ নেই চিন্তা, জ্ঞানচর্চা ও মেধা বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি হয় এবং দেশের বিভিন্ন নির্বিরোধ পরিবেশ থেকে পড়তে আসা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিরীহ ছাত্রদের স্বাভাবিক মেধার উৎকর্ষ না ঘটে বিকৃতি ঘটে। জাতি হারাচ্ছে অমূল্য মেধা ও সম্ভাবনা। এই প্রক্রিয়া চলে আসছে সেই ১৯৭৫পরবর্তী সময় থেকে। এই দীর্ঘ সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে মেধা অপচয় ও মেধা বিভ্রান্ত-বিকৃত হয়ে আসার কারণে দেশের কোনো প্রতিষ্ঠানে আজ নিরঙ্কুশ শিক্ষাচর্চা নেই, প্রতিভাবান, আদর্শ-উজ্জ্বল শিক্ষক নেই। এর ফলে সমাজের সর্বস্তরে প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ ও নীতি-আদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ আমলা-কর্মকর্তা-নেতা নেই, নেই দেশপ্রেম। শুধু আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করার চাতুর্য_যখন যে দল এল ক্ষমতায়, সে দলের মুখোশ পরে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন চারদিকে চলছেই।
সব কিছুই আজ প্রাতিষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে চলছে বলে বাইরে থেকে কিছু ঠাহর করা যায় না। প্রতিষ্ঠান, অনুষ্ঠান, পরীক্ষা, প্রতিযোগিতা_সবই চলছে মনে হচ্ছে। কিন্তু এর বদৌলতে এ দেশ-জাতি কী পাচ্ছে, তা ভাবারও অবকাশ নেই কারো। সব কয়টি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠান 'স্বয়ংক্রিয়'ভাবে চলছে আর সবাই অপেক্ষায় থাকে পঞ্চবার্ষিকী নির্বাচনের জুয়া খেলায় কার কপাল খুলবে! কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মূলত দেশের মূল শক্তি। পেশিশক্তির কথা বলছি না। তরুণ-যুবকরা হলো দেশের ভবিষ্যৎ, বর্তমান ও অতীত। তরুণরা অতীতের সঙ্গে বর্তমান ও ভবিষ্যতের সেতু গড়ে তোলে তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। আমাদের তরুণদের অতীত-বর্তমান একই আঁধারে অবরুদ্ধ। তাই 'ভবিষ্যৎ'গুলো বারবারই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে। আর কোনো দলের কথা নাই বা বললাম, আওয়ামী লীগ কি আরো ৫০ বছর পর একজন শেখ মুজিব বা তাজউদ্দীনের মতো নেতা উপহার দিতে পারবে এ জাতিকে? পারবে না, আর তার অবিতর্কিত কারণ একটিই_সত্যিকার শিক্ষা, মুক্তচিন্তা ও মেধা বিকাশের প্রতিবন্ধকতা।
অতএব, আমাদের ভেবে দেখার সময় এখনই। ছাত্রদের স্বাধীন চিন্তা-চেতনার অধিকার অর্জনের সুযোগ করে দিতে হবে। আর সে জন্য স্রেফ দলের দুঃসময়ে ছাত্রদের কাজে লাগানোর হীনচিন্তা পরিহার করতে হবে সবাইকে। তা না হলে বর্তমান রাজনৈতিক সংকীর্ণ সংস্কৃতির পরিস্থিতি কোনোদিন পাল্টাবে না। সামাজিক অবক্ষয়-অস্থিরতা তথা সর্বত্র অন্যায় অপরাধ অনৈতিক কর্মকাণ্ডের দ্বারা যে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে তারও অবসান ঘটবে না। দেশ ও জাতির স্বার্থে রাজনৈতিক শৃঙ্খল থেকে ছাত্রসমাজকে মুক্ত করতে হবে। শিক্ষাঙ্গনকে শিক্ষা ও মেধা বিকাশের উন্মুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক
ronokk1969@gmail.com
No comments