স্মরণ-একজন রতন সেন by গৌরাঙ্গ নন্দী
মার্কসবাদী আদর্শের সৈনিক হিসেবে তিনি জীবন শুরু করেন। জীবন দিয়েছেনও সেই আদর্শের পতাকা সমুন্নত রেখে। অনেকেই তাঁর রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন, তবে তাঁর ত্যাগী জীবনাদর্শ সম্পর্কে কেউ ভিন্নমত পোষণ করেন না। তিনি নিজের জন্য কিছুই চাননি, কিছুই করেননি, জীবন যাপন করেছেন একেবারে অনাড়ম্বরভাবে, মানুষের কাছে শতভাগ দায়বদ্ধ ছিলেন।
অর্থনৈতিক-সামাজিক শোষণ থেকে মানুষ কিভাবে মুক্তি পেতে পারে, সেটাই ছিল তাঁর একমাত্র ভাবনা। তবু স্বার্থান্বেষী মানুষের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে তাঁকে ছুরিকাহত হয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়। সেই মানুষটি রাজনীতিক রতন সেন। আর কালো দিনটি ১৯৯২ সালের ৩১ জুলাই।
বলা যায়, খুলনার রাজনৈতিক নেতা হত্যাকাণ্ডের সেই শুরু। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় একটি মামলা হয়েছিল। পুলিশ যথারীতি তদন্ত করে চার্জশিট দিয়েছিল। বিচারও হয়েছিল। কিন্তু কেউই সাজা পায়নি। কারণ অপরাধী চিহ্নিত-প্রমাণিত হয়নি। সাম্যবাদী আদর্শ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের একজন সৈনিক হিসেবে রতন সেন নিজেকে অনন্য হিসেবে গড়ে তোলেন। রতন সেনের পারিবারিক নাম ছিল সুনীল সেনগুপ্ত। বরিশালের এক সচ্ছল পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৩ সালের ৩ এপ্রিল। বাবা নরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। খুলনার দৌলতপুর বিএল কলেজে বাবার চাকরির সুবাদে তিনি এখানে আসেন। ১৯৩৮ সালে দৌলতপুর মহসীন স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৪২ সালে বিএল কলেজ থেকে ডিস্টিঙ্কশনসহ বিএ পাস করেন। স্কুলজীবনে যশোর-খুলনা যুবসংঘের নেতৃস্থানীয় কর্মী বড় ভাই মোহিত সেনগুপ্তের হাত ধরে রতন সেনের রাজনৈতিক জীবন শুরু। পরে ১৯৪৫ সালে পার্টির নির্দেশনায় খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার বয়ারভাঙ্গা বিশ্বম্ভর হাই স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। উদ্দেশ্য ছিল গ্রামের কৃষকদের সংগঠিত করা। সারা দিন স্কুলে দায়িত্ব পালন করে রাতে কৃষকদের সঙ্গে রতন সেন সভা করতেন। সামাজিক মালিকানার গুরুত্ব, সমাজ পরিবর্তন ও মার্কসবাদের শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করে কৃষকদের রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতেন। কমিউনিস্ট পার্টির খুলনা ও যশোরের ইউনিট তখন পিকিং অনুসারীদের পক্ষাবলম্বন করে। বলতে গেলে মস্কো অনুসারী নেতা-সংগঠক পর্যায়ের কেউই ছিল না। রতন সেন মস্কো অনুসারী হয়ে পার্টি-সংগঠন গড়ে তোলার দায়িত্ব নেন। সেই সময় রতন সেন তাঁর মেধা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও আদর্শের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-সংগঠকদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেন। গড়ে তোলেন পার্টি গ্রুপ। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি তাঁর অনুসারীদের নিয়ে ভারতে যান, সেখানে দলের নীতি-অনুসারীদের সিদ্ধান্তের আলোকে গেরিলা বাহিনী সংগঠনে ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সিপিবি গড়ে তোলায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি খুলনা জেলা শাখার সম্পাদক, সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সিপিবিতে রূপান্তরপন্থীদের উদ্ভব এবং দল বিভক্ত হয়ে যাওয়ায় তিনি খুবই কষ্ট পান। কিন্তু তাঁর অবিচল আস্থা ছিল মার্কসবাদে।
সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের সঙ্গে রতন সেনের ছিল নিবিড় সম্পর্ক। রূপসার পালেরহাট বাজারের কাছে যে বাড়িতে তিনি থাকতেন, তার আশপাশের অনেককে ছোটখাটো ব্যবসা করার জন্য সহযোগিতা করেছেন। অনেককে রিকশা-ভ্যান কিনে দিয়েছেন। যাঁদের রিকশা-ভ্যান দিয়েছিলেন, তাঁরাই তাঁকে (রতন সেন) নদীর ঘাট থেকে আনা-নেওয়া করতেন এবং শহরের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতেন। শহরের তেমনই এক পরিচিত রিকশায় তিনি উঠেছিলেন ১৯৯২ সালের ৩১ জুলাই। রিকশাটি ডিসি ও এসপি অফিসের সামনে এলে অজ্ঞাতপরিচয় দুবর্ৃৃত্তরা তাঁকে ছুরিকাঘাতে খুন করে। সেদিনও তিনি নিজের হাতে পরিষ্কার করা সুতির মোটা কাপড়ের পাজামা-পাঞ্জাবি পরে নদীর অপর পার থেকে খুলনা শহরে এসেছিলেন। যাচ্ছিলেন বাগেরহাটে সাংগঠনিক কাজে। ঘাতকের আঘাতে রাস্তায় রক্ত ঝরে এই মানুষটির মৃত্যু হয়। থেমে যায় সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনের এক সৈনিকের জীবন চলা।
গৌরাঙ্গ নন্দী
বলা যায়, খুলনার রাজনৈতিক নেতা হত্যাকাণ্ডের সেই শুরু। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় একটি মামলা হয়েছিল। পুলিশ যথারীতি তদন্ত করে চার্জশিট দিয়েছিল। বিচারও হয়েছিল। কিন্তু কেউই সাজা পায়নি। কারণ অপরাধী চিহ্নিত-প্রমাণিত হয়নি। সাম্যবাদী আদর্শ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের একজন সৈনিক হিসেবে রতন সেন নিজেকে অনন্য হিসেবে গড়ে তোলেন। রতন সেনের পারিবারিক নাম ছিল সুনীল সেনগুপ্ত। বরিশালের এক সচ্ছল পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৩ সালের ৩ এপ্রিল। বাবা নরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। খুলনার দৌলতপুর বিএল কলেজে বাবার চাকরির সুবাদে তিনি এখানে আসেন। ১৯৩৮ সালে দৌলতপুর মহসীন স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৪২ সালে বিএল কলেজ থেকে ডিস্টিঙ্কশনসহ বিএ পাস করেন। স্কুলজীবনে যশোর-খুলনা যুবসংঘের নেতৃস্থানীয় কর্মী বড় ভাই মোহিত সেনগুপ্তের হাত ধরে রতন সেনের রাজনৈতিক জীবন শুরু। পরে ১৯৪৫ সালে পার্টির নির্দেশনায় খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার বয়ারভাঙ্গা বিশ্বম্ভর হাই স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। উদ্দেশ্য ছিল গ্রামের কৃষকদের সংগঠিত করা। সারা দিন স্কুলে দায়িত্ব পালন করে রাতে কৃষকদের সঙ্গে রতন সেন সভা করতেন। সামাজিক মালিকানার গুরুত্ব, সমাজ পরিবর্তন ও মার্কসবাদের শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করে কৃষকদের রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতেন। কমিউনিস্ট পার্টির খুলনা ও যশোরের ইউনিট তখন পিকিং অনুসারীদের পক্ষাবলম্বন করে। বলতে গেলে মস্কো অনুসারী নেতা-সংগঠক পর্যায়ের কেউই ছিল না। রতন সেন মস্কো অনুসারী হয়ে পার্টি-সংগঠন গড়ে তোলার দায়িত্ব নেন। সেই সময় রতন সেন তাঁর মেধা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও আদর্শের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-সংগঠকদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেন। গড়ে তোলেন পার্টি গ্রুপ। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি তাঁর অনুসারীদের নিয়ে ভারতে যান, সেখানে দলের নীতি-অনুসারীদের সিদ্ধান্তের আলোকে গেরিলা বাহিনী সংগঠনে ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সিপিবি গড়ে তোলায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি খুলনা জেলা শাখার সম্পাদক, সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সিপিবিতে রূপান্তরপন্থীদের উদ্ভব এবং দল বিভক্ত হয়ে যাওয়ায় তিনি খুবই কষ্ট পান। কিন্তু তাঁর অবিচল আস্থা ছিল মার্কসবাদে।
সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের সঙ্গে রতন সেনের ছিল নিবিড় সম্পর্ক। রূপসার পালেরহাট বাজারের কাছে যে বাড়িতে তিনি থাকতেন, তার আশপাশের অনেককে ছোটখাটো ব্যবসা করার জন্য সহযোগিতা করেছেন। অনেককে রিকশা-ভ্যান কিনে দিয়েছেন। যাঁদের রিকশা-ভ্যান দিয়েছিলেন, তাঁরাই তাঁকে (রতন সেন) নদীর ঘাট থেকে আনা-নেওয়া করতেন এবং শহরের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতেন। শহরের তেমনই এক পরিচিত রিকশায় তিনি উঠেছিলেন ১৯৯২ সালের ৩১ জুলাই। রিকশাটি ডিসি ও এসপি অফিসের সামনে এলে অজ্ঞাতপরিচয় দুবর্ৃৃত্তরা তাঁকে ছুরিকাঘাতে খুন করে। সেদিনও তিনি নিজের হাতে পরিষ্কার করা সুতির মোটা কাপড়ের পাজামা-পাঞ্জাবি পরে নদীর অপর পার থেকে খুলনা শহরে এসেছিলেন। যাচ্ছিলেন বাগেরহাটে সাংগঠনিক কাজে। ঘাতকের আঘাতে রাস্তায় রক্ত ঝরে এই মানুষটির মৃত্যু হয়। থেমে যায় সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনের এক সৈনিকের জীবন চলা।
গৌরাঙ্গ নন্দী
No comments