হতাশ জনমনে অস্থিরতা by এ কে এম শাহনাওয়াজ
একটি দেশে যখন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা না থাকে, রাজনীতির নিয়ন্ত্রকদের গোষ্ঠীপ্রীতি ও স্বার্থপরতার কাছে যখন দেশপ্রেম নির্বাসিত হয় তখন আইনের শাসন মুখ থুবড়ে পড়ে। আমাদের দেশের ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো পরিবার এবং এক নেতা-নেত্রী নিয়ন্ত্রিত থাকায় গণতান্ত্রিক কাঠামো নিজস্ব রূপ পায়নি।
এ অবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব যাঁদের থাকে, তাঁরা এক ধরনের বন্দিত্ব বরণ করেন। মুক্ত মনে জনকল্যাণকামী শাসন প্রতিষ্ঠা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয় না। সব ক্ষেত্রে আপস করে চলতে হয়। এই দুর্বলতায় প্রথমেই বিপর্যস্ত হয় আইনের শাসন। বাজারের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা ও সংঘাতময় রাজনীতির বিরূপ প্রভাব পড়ে জনমনে। সমাজজীবন ভারসাম্য হারায়। জনগণের সঙ্গে সরকারের যখন দূরত্ব তৈরি হয় তখন সাধারণ মানুষ যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতায় সরকারি বক্তব্য ও কর্ম প্রকল্পে আস্থা হারাতে থাকে। এ অবস্থায় এক ধরনের হতাশায় নিপতিত হয় দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠী। এই হতাশা থেকেই দেশজুড়ে সৃষ্টি হয় অস্থিরতা।
আওয়ামী লীগের আড়াই বছরের শাসন শেষে দেশে এখন এর সবকটি লক্ষণই স্পষ্ট হচ্ছে। অথচ এ রকমটি প্রত্যাশিত ছিল না। অনন্যোপায় এ দেশের মুক্ত চিন্তার মানুষ যে বিকল্প কোনো রাজনীতির কাছে গিয়ে মুক্তি খুঁজবে সে জায়গায়ও অন্ধকার। সাধারণ মানুষকে হতাশামুক্ত করতে হলে বর্তমান সময়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি। আওয়ামী লীগ সরকার হয়তো ভবিষ্যতে সাফল্য দেখাবে। বিদ্যুতের অভাব মোচন করবে। একটা নয়, দুটো পদ্মা সেতু বানাবে। উড়াল পুল তৈরি করে যানজট কমিয়ে ফেলবে। বন্ধ মিল-কারখানা চালু করে শিল্প উৎপাদনে গতি আনবে। তবে বর্তমানকে অন্ধকার রেখে এসব দূরদর্শী কর্মপ্রয়াসের কোনো খবরই জনগণকে স্বস্তি দেবে না। দেশের মানুষ এখন একটি কঠিন সময় পার করছে। বাজারে গিয়ে প্রতিদিনই দেখতে পাচ্ছে লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি। বাণিজ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী কারো কথার বাস্তবায়ন নেই। সাধারণ মানুষ এখন স্থির সিদ্ধান্তে এসেছে, বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার। সরকার তাদের পরিত্রাণ দিতে পারবে এ আশা আর এখন মানুষের নেই। বোদ্ধা মানুষ এর পরিণতি ভেবে আতঙ্কিত হচ্ছেন।
নাগরিক জীবনের সরকারি সব সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ঘুষ-দুর্নীতির বাড়াবাড়ি দেখে হতাশ মানুষ কটমটে চোখে তাকাচ্ছে সরকারের দিকে। তারা জোট সরকারের আমল থেকে মহাজোট সরকারের শাসন দুর্বলতা আলাদা করতে পারছে না। আইনের শাসনের প্রতি আস্থা তলানিতে এসে দাঁড়িয়েছে। আওয়ামী লীগ নিয়ন্ত্রিত সরকারের কাছে যা কাম্য ছিল না এ দেশবাসীর। আমি চেয়েছিলাম আইনশৃঙ্খলার অবনতির একটা রূপরেখা উপস্থাপন করব এ লেখাটিতে। এই লক্ষ্যে এক মাসে প্রকাশিত সংবাদপত্রে শিরোনাম সংগ্রহ করছিলাম। এর মধ্যে শ্রেণীকরণ করছিলাম খুন, ডাকাতি, ধর্ষণ, সড়ক দুর্ঘটনা, দখলবাজি, রাজনৈতিক সংঘাত ইত্যাদি। যখন দেখি এতে মহাভারত তৈরি হয়ে যাবে_তখন ক্ষান্ত দিয়েছিলাম।
এর মধ্যে আমি একটি পরিসংখ্যান পেলাম ২২ জুলাই প্রকাশিত দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার লিড নিউজটিতে। শিরোনাম ছিল 'আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি'। এখানে আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে নৈরাজ্য সৃষ্টির কারণ ব্যাখ্যা করে কয়েকটি পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে। সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিতে সরকারের কোনো কোনো রাজনৈতিক অন্যায় সিদ্ধান্ত দেখে সচেতন মানুষ হায় হায় করেছিল। কর্ণপাত করেনি শেখ হাসিনা সরকার। রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা নাম দিয়ে খালাস করার রায় দিতে বসে যান আইন প্রতিমন্ত্রী। এই সরকারের আমলে সাত হাজারের বেশি অভিযুক্তকে খালাস দেওয়া হয়। এদের অধিকাংশই শাসক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এর মধ্যে শুধু রাজনীতি নয়, খুনের মামলাসহ নানা অপরাধের সঙ্গে যুক্তরাও দলীয় পরিচয়ে মুক্ত হয়ে যায়। জনসাধারণ্যে অভিযোগ রয়েছে, শুধু রাজনীতি নয়, অর্থনীতিও নাকি এই খালাস কার্যক্রমে ভূমিকা রেখেছে। আমরা প্রার্থনা করি নিন্দুকদের কথা ভুল প্রমাণিত হোক। পত্রপত্রিকা থেকে অভিযোগ পাওয়া যায় এসব অপরাধীর অনেকে এখন মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে পুরনো পেশায় ফিরে গেছে। পরিসংখ্যান বলছে, এই সরকারের সময়কালে অপরাধীদের হাতে নিহত হয়েছে পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সরকারের রাজনৈতিক নীতি একই তালে চললে এই সরকারের বাকি আড়াই বছর শেষে এ ক্ষেত্রে কোন পর্যায়ের রেকর্ড গড়বে, তা দেখার জন্য আতঙ্কের সঙ্গে অপেক্ষা করছে দেশবাসী।
ছিনতাই, ডাকাতি, ধর্ষণ, লাঞ্ছনা ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে আত্মহনন, আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানও হয়তো রেকর্ড গড়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিক্ত অভিজ্ঞতায় মানুষ বিশ্বাস করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন রাজনীতি ও অর্থনীতির হুকুমবরদার। আদালত সব ক্ষেত্রে নিজের ইচ্ছায় চলছে বলে মানুষ বিশ্বাস করে না। এ অঞ্চলে প্রতিকার চাওয়া অর্থহীন। একদিকে বিরোধী দলের অসুস্থ রাজনীতির গণবিরোধী কর্মসূচি, অস্থির বাজার, আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের ভারসাম্যহীনতা, ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে নিরাপত্তার ব্যাপারে সংশয়, অন্যদিকে আইনের শাসনের প্রতি আস্থাহীনতা মানুষকে হতাশ ও অস্থির করে তুলেছে। তাই নিজ নিরাপত্তা রক্ষার জন্য আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। এ কারণেই ঘটছে গণপিটুনির মতো রোমহর্ষক ঘটনা। পরিসংখ্যান বলছে, এই সরকারের আড়াই বছরে গণপিটুনিতে ৩৭৭ জন মারা গেছে। সর্বশেষ ঘটনা আমিনবাজার ট্র্যাজেডি। থানার ওসি থেকে পুলিশ প্রধানও মানেন দীর্ঘকাল ধরে আমিনবাজারের এই এলাকাটি মাদক ব্যবসায়ীসহ নানা অপরাধীর শক্ত ঘাঁটি। তাঁদের কথায় এক ধরনের অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে কি না জানি না। তবে আমাদের অবাক হতে হয় এই ভেবে যে রাজধানীর নাকের ডগায় একটি ছোট্ট অঞ্চল রাষ্ট্রের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে গেল কিভাবে! জানা সত্ত্বেও রাজধানী লাগোয়া একটি ছোট্ট অঞ্চল অপরাধমুক্ত করতে যদি পুলিশ প্রশাসন বছরের পর বছর ব্যর্থ হতে থাকে তাহলে গোটা দেশের অপরাধ কমাবে কেমন করে। এ অবস্থায় সামাজিক অস্থিরতা না বাড়ার সুযোগ কোথায়? ফলে আশঙ্কা তো হয়ই, আমিনবাজার ট্র্যাজেডির মতো আরো অনেক ট্র্যাজেডি হয়তো মঞ্চায়নের অপেক্ষায় আছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও বিচারব্যবস্থা নিয়ে যখন মানুষ হতাশ তখনই সংবাদ প্রকাশিত হয় লক্ষ্মীপুরের চিহ্নিত খুনির মৃত্যুদণ্ড মহামান্য রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করে দিয়েছেন। যদিও সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি যে কারো দণ্ড ক্ষমা করার অধিকার সংরক্ষণ করেন, তবু জনমনে এ ঘটনার ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। পত্রপত্রিকা আর টেলিভিশন চ্যানেলের টক শোতে এই ক্ষমা ঘোষণা সমালোচিত হতে থাকে। সবার মৌলিক প্রশ্ন, মহামান্য রাষ্ট্রপতির নামে অধিকারের অপব্যবহার করা হলো কি না! অপহরণের পর বিএনপি নেতাকে খুন করে একজন চিহ্নিত শীর্ষ সন্ত্রাসী দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত হয়েছে। সমালোচকদের বিশ্বাস, খুনি আওয়ামী লীগ নেতার পুত্র হওয়ার সুবাদে মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুকম্পা পেল। বিশেষ করে অধিকাংশের বিশ্বাস জন্মাল, ১০ বছর আত্মগোপনে থাকার পর চার মাস আগে আত্মসমর্পণের গ্রিন সিগন্যাল সরকারই দিয়েছিল। এর ধারাবাহিকতায়ই এমন ক্ষমা ঘোষণা। এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কয়েকটি নাটকীয় ঘটনাও ঘটল। দৈনিক জনকণ্ঠের সম্পাদক স্বনামে ২২ জুলাই তাঁর কাগজে ব্যানার হেডিং দিলেন 'রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করতে পারেন'। তিনি প্রধানত রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ক্ষমা করা নিয়ে দেশের পত্রপত্রিকা, টিভি চ্যানেল, সুশীল সমাজ ও রাজনীতিকরা যে সমালোচনা করছেন তার বিরোধিতা করে সবাইকে জানালেন, এ ধরনের ক্ষমা মহামান্য রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিক অধিকারবলে করতে পারেন। একে সমালোচনা করা বিধেয় নয়। সম্পাদক মহোদয় বোধ হয় নিজেও জানেন, এসব সাধারণ তথ্য সবার জানা। তবুও ব্যানার হেডিংয়ে অতিসাধারণ তথ্যে রিপোর্ট প্রকাশ করে এই অবকাশে তিনি বোধ হয় তাঁর পত্রিকার অবস্থান সরকারকে জানাতে চাইলেন। তার চেয়ে বরং বিষয়টি অনেক বেশি স্পষ্ট করলেন একই দিনে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। এই প্রবীণ রাজনীতিক বললেন, 'রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি আর কোনো দলের লোক থাকেন না। সাংবিধানিকভাবে জাতীয় ঐক্যের প্রতীকে পরিণত হন। আর প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া অন্য সব কাজ তিনি সরকারের করা সুপারিশ অনুযায়ী বাস্তবায়ন করেন। এ দায়িত্ব পালন করতে তিনি সাংবিধানিকভাবে বাধ্য। বিপ্লবের মৃত্যুদণ্ড মওকুফের দায় রাষ্ট্রপতির নয়। সুতরাং সমালোচনা করতে হলে সরকারের বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সমালোচনা করতে হবে, রাষ্ট্রপতির নয়।' তিনি আরো বলেন, 'স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল আইন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ নেওয়া। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেটা করেনি।' এই বক্তব্যেই স্পষ্ট হয়ে গেছে, কোন প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতিকে স্বাক্ষর করতে হয়েছে। কিন্তু যেভাবেই হোক এ ঘটনা সাধারণ মানুষকে আহত করেছে। আইনের শাসনের বারবার পরাজয় দেখে তাদের হতাশার অন্ধকার আরো গাঢ় হয়েছে। সরকার আর মোসাহেবরা যেভাবেই বলুক মানুষ দেখেছে একই রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে গামা হত্যা মামলার সাজা পাওয়া আরো একুশজনের দণ্ড মওকুফ করানো হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তিনি দলীয় না থাকলেও কাকতালীয়ভাবে তাঁর ক্ষমা লাভ করা ভাগ্যবানরা সবাই আওয়ামী লীগ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। পাশাপাশি ২০ জুলাই দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় কাশিমপুর ও পাবনা কারাগারে দুজন অপরাধীর ফাঁসি কার্যকরের খবর ছাপা হয়েছে। একই কাগজে সেদিনই প্রথম বিপ্লবের দণ্ড ক্ষমার কথাও প্রকাশিত হয়। রিপোর্টে জানা যায়, এই দুই আসামিও প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছিলেন মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে। কিন্তু তা নামঞ্জুর হয়। এখন হতাশ মানুষ যদি বলে এই হতভাগ্য অপরাধীরা কেন অপরাধ করার আগে যোগ্য রাজনৈতিক দলে নাম লেখাননি, তবে তাদের অন্যায় কতটুকু হবে?
রাজনীতিকদের কপটতা প্রতিদিন হতাশ ও ক্ষুব্ধ করছে সাধারণ মানুষকে। ২০০৫ সালে বিএনপির সে সময়ের আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ দুই খুনের জন্য মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি জিন্টুকে মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে ক্ষমা করিয়েছিলেন। সচেতন দেশবাসী ভেবেছিল, এবার তিনি হয়তো মুখ বন্ধ রাখবেন। কিন্তু লজ্জাকে প্রিজারভেটিভ দিয়ে (বিজ্ঞাপনের ভাষা) বলে ফেললেন সেটি ক্যাঙ্গারু কোর্টের বিচার ছিল বলে তিনি সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু দেশবাসীর মতো মওদুদও জানতেন জিন্টু সন্ত্রাসী ও খুনি ছিল। সৌভাগ্যক্রমে এই সন্ত্রাসীও বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল। এসব অঘটন দেখে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস জন্মেছে, এ দেশের ক্ষমতার রাজনীতির সফল দলগুলোর কোনো একটার সঙ্গে যুক্ত না থাকলে সবাই সেন রাজাদের বর্ণপ্রথার শূদ্র। অর্থাৎ পতিত। তাই রাষ্ট্র পরিচালনায় সুশাসনের অভাব, অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থা, আইনের শাসনের ভূলুণ্ঠিত দশায় জীবনের নিরাপত্তাহীনতা মানুষের মনে যে হতাশার জন্ম দিচ্ছে আমরা মনে করি এর বহিঃপ্রকাশ হিসেবে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে অস্থিরতা ক্রমে ছড়িয়ে যাচ্ছে। সামাজিক এই বিপর্যয়ের দায় আমাদের রাজনীতিকরা এড়াতে পারবেন না। তার পরও আশাবাদী আমরা প্রার্থনা করব, মনের কোনো এক গোপন জায়গা থেকে হলেও মানবিকতা খুঁজে এনে নষ্ট রাজনীতির ঊধর্ে্ব উঠে সরকারি ও বিরোধীদলীয় ক্ষমতাবান রাজনীতিকরা বিপন্ন দশা থেকে মানুষ ও সমাজকে রক্ষা করুন।
লেখক : অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
আওয়ামী লীগের আড়াই বছরের শাসন শেষে দেশে এখন এর সবকটি লক্ষণই স্পষ্ট হচ্ছে। অথচ এ রকমটি প্রত্যাশিত ছিল না। অনন্যোপায় এ দেশের মুক্ত চিন্তার মানুষ যে বিকল্প কোনো রাজনীতির কাছে গিয়ে মুক্তি খুঁজবে সে জায়গায়ও অন্ধকার। সাধারণ মানুষকে হতাশামুক্ত করতে হলে বর্তমান সময়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি। আওয়ামী লীগ সরকার হয়তো ভবিষ্যতে সাফল্য দেখাবে। বিদ্যুতের অভাব মোচন করবে। একটা নয়, দুটো পদ্মা সেতু বানাবে। উড়াল পুল তৈরি করে যানজট কমিয়ে ফেলবে। বন্ধ মিল-কারখানা চালু করে শিল্প উৎপাদনে গতি আনবে। তবে বর্তমানকে অন্ধকার রেখে এসব দূরদর্শী কর্মপ্রয়াসের কোনো খবরই জনগণকে স্বস্তি দেবে না। দেশের মানুষ এখন একটি কঠিন সময় পার করছে। বাজারে গিয়ে প্রতিদিনই দেখতে পাচ্ছে লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি। বাণিজ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী কারো কথার বাস্তবায়ন নেই। সাধারণ মানুষ এখন স্থির সিদ্ধান্তে এসেছে, বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার। সরকার তাদের পরিত্রাণ দিতে পারবে এ আশা আর এখন মানুষের নেই। বোদ্ধা মানুষ এর পরিণতি ভেবে আতঙ্কিত হচ্ছেন।
নাগরিক জীবনের সরকারি সব সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ঘুষ-দুর্নীতির বাড়াবাড়ি দেখে হতাশ মানুষ কটমটে চোখে তাকাচ্ছে সরকারের দিকে। তারা জোট সরকারের আমল থেকে মহাজোট সরকারের শাসন দুর্বলতা আলাদা করতে পারছে না। আইনের শাসনের প্রতি আস্থা তলানিতে এসে দাঁড়িয়েছে। আওয়ামী লীগ নিয়ন্ত্রিত সরকারের কাছে যা কাম্য ছিল না এ দেশবাসীর। আমি চেয়েছিলাম আইনশৃঙ্খলার অবনতির একটা রূপরেখা উপস্থাপন করব এ লেখাটিতে। এই লক্ষ্যে এক মাসে প্রকাশিত সংবাদপত্রে শিরোনাম সংগ্রহ করছিলাম। এর মধ্যে শ্রেণীকরণ করছিলাম খুন, ডাকাতি, ধর্ষণ, সড়ক দুর্ঘটনা, দখলবাজি, রাজনৈতিক সংঘাত ইত্যাদি। যখন দেখি এতে মহাভারত তৈরি হয়ে যাবে_তখন ক্ষান্ত দিয়েছিলাম।
এর মধ্যে আমি একটি পরিসংখ্যান পেলাম ২২ জুলাই প্রকাশিত দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার লিড নিউজটিতে। শিরোনাম ছিল 'আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি'। এখানে আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে নৈরাজ্য সৃষ্টির কারণ ব্যাখ্যা করে কয়েকটি পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে। সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিতে সরকারের কোনো কোনো রাজনৈতিক অন্যায় সিদ্ধান্ত দেখে সচেতন মানুষ হায় হায় করেছিল। কর্ণপাত করেনি শেখ হাসিনা সরকার। রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা নাম দিয়ে খালাস করার রায় দিতে বসে যান আইন প্রতিমন্ত্রী। এই সরকারের আমলে সাত হাজারের বেশি অভিযুক্তকে খালাস দেওয়া হয়। এদের অধিকাংশই শাসক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এর মধ্যে শুধু রাজনীতি নয়, খুনের মামলাসহ নানা অপরাধের সঙ্গে যুক্তরাও দলীয় পরিচয়ে মুক্ত হয়ে যায়। জনসাধারণ্যে অভিযোগ রয়েছে, শুধু রাজনীতি নয়, অর্থনীতিও নাকি এই খালাস কার্যক্রমে ভূমিকা রেখেছে। আমরা প্রার্থনা করি নিন্দুকদের কথা ভুল প্রমাণিত হোক। পত্রপত্রিকা থেকে অভিযোগ পাওয়া যায় এসব অপরাধীর অনেকে এখন মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে পুরনো পেশায় ফিরে গেছে। পরিসংখ্যান বলছে, এই সরকারের সময়কালে অপরাধীদের হাতে নিহত হয়েছে পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সরকারের রাজনৈতিক নীতি একই তালে চললে এই সরকারের বাকি আড়াই বছর শেষে এ ক্ষেত্রে কোন পর্যায়ের রেকর্ড গড়বে, তা দেখার জন্য আতঙ্কের সঙ্গে অপেক্ষা করছে দেশবাসী।
ছিনতাই, ডাকাতি, ধর্ষণ, লাঞ্ছনা ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে আত্মহনন, আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানও হয়তো রেকর্ড গড়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিক্ত অভিজ্ঞতায় মানুষ বিশ্বাস করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন রাজনীতি ও অর্থনীতির হুকুমবরদার। আদালত সব ক্ষেত্রে নিজের ইচ্ছায় চলছে বলে মানুষ বিশ্বাস করে না। এ অঞ্চলে প্রতিকার চাওয়া অর্থহীন। একদিকে বিরোধী দলের অসুস্থ রাজনীতির গণবিরোধী কর্মসূচি, অস্থির বাজার, আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের ভারসাম্যহীনতা, ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে নিরাপত্তার ব্যাপারে সংশয়, অন্যদিকে আইনের শাসনের প্রতি আস্থাহীনতা মানুষকে হতাশ ও অস্থির করে তুলেছে। তাই নিজ নিরাপত্তা রক্ষার জন্য আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। এ কারণেই ঘটছে গণপিটুনির মতো রোমহর্ষক ঘটনা। পরিসংখ্যান বলছে, এই সরকারের আড়াই বছরে গণপিটুনিতে ৩৭৭ জন মারা গেছে। সর্বশেষ ঘটনা আমিনবাজার ট্র্যাজেডি। থানার ওসি থেকে পুলিশ প্রধানও মানেন দীর্ঘকাল ধরে আমিনবাজারের এই এলাকাটি মাদক ব্যবসায়ীসহ নানা অপরাধীর শক্ত ঘাঁটি। তাঁদের কথায় এক ধরনের অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে কি না জানি না। তবে আমাদের অবাক হতে হয় এই ভেবে যে রাজধানীর নাকের ডগায় একটি ছোট্ট অঞ্চল রাষ্ট্রের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে গেল কিভাবে! জানা সত্ত্বেও রাজধানী লাগোয়া একটি ছোট্ট অঞ্চল অপরাধমুক্ত করতে যদি পুলিশ প্রশাসন বছরের পর বছর ব্যর্থ হতে থাকে তাহলে গোটা দেশের অপরাধ কমাবে কেমন করে। এ অবস্থায় সামাজিক অস্থিরতা না বাড়ার সুযোগ কোথায়? ফলে আশঙ্কা তো হয়ই, আমিনবাজার ট্র্যাজেডির মতো আরো অনেক ট্র্যাজেডি হয়তো মঞ্চায়নের অপেক্ষায় আছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও বিচারব্যবস্থা নিয়ে যখন মানুষ হতাশ তখনই সংবাদ প্রকাশিত হয় লক্ষ্মীপুরের চিহ্নিত খুনির মৃত্যুদণ্ড মহামান্য রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করে দিয়েছেন। যদিও সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি যে কারো দণ্ড ক্ষমা করার অধিকার সংরক্ষণ করেন, তবু জনমনে এ ঘটনার ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। পত্রপত্রিকা আর টেলিভিশন চ্যানেলের টক শোতে এই ক্ষমা ঘোষণা সমালোচিত হতে থাকে। সবার মৌলিক প্রশ্ন, মহামান্য রাষ্ট্রপতির নামে অধিকারের অপব্যবহার করা হলো কি না! অপহরণের পর বিএনপি নেতাকে খুন করে একজন চিহ্নিত শীর্ষ সন্ত্রাসী দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত হয়েছে। সমালোচকদের বিশ্বাস, খুনি আওয়ামী লীগ নেতার পুত্র হওয়ার সুবাদে মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুকম্পা পেল। বিশেষ করে অধিকাংশের বিশ্বাস জন্মাল, ১০ বছর আত্মগোপনে থাকার পর চার মাস আগে আত্মসমর্পণের গ্রিন সিগন্যাল সরকারই দিয়েছিল। এর ধারাবাহিকতায়ই এমন ক্ষমা ঘোষণা। এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কয়েকটি নাটকীয় ঘটনাও ঘটল। দৈনিক জনকণ্ঠের সম্পাদক স্বনামে ২২ জুলাই তাঁর কাগজে ব্যানার হেডিং দিলেন 'রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করতে পারেন'। তিনি প্রধানত রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ক্ষমা করা নিয়ে দেশের পত্রপত্রিকা, টিভি চ্যানেল, সুশীল সমাজ ও রাজনীতিকরা যে সমালোচনা করছেন তার বিরোধিতা করে সবাইকে জানালেন, এ ধরনের ক্ষমা মহামান্য রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিক অধিকারবলে করতে পারেন। একে সমালোচনা করা বিধেয় নয়। সম্পাদক মহোদয় বোধ হয় নিজেও জানেন, এসব সাধারণ তথ্য সবার জানা। তবুও ব্যানার হেডিংয়ে অতিসাধারণ তথ্যে রিপোর্ট প্রকাশ করে এই অবকাশে তিনি বোধ হয় তাঁর পত্রিকার অবস্থান সরকারকে জানাতে চাইলেন। তার চেয়ে বরং বিষয়টি অনেক বেশি স্পষ্ট করলেন একই দিনে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। এই প্রবীণ রাজনীতিক বললেন, 'রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি আর কোনো দলের লোক থাকেন না। সাংবিধানিকভাবে জাতীয় ঐক্যের প্রতীকে পরিণত হন। আর প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া অন্য সব কাজ তিনি সরকারের করা সুপারিশ অনুযায়ী বাস্তবায়ন করেন। এ দায়িত্ব পালন করতে তিনি সাংবিধানিকভাবে বাধ্য। বিপ্লবের মৃত্যুদণ্ড মওকুফের দায় রাষ্ট্রপতির নয়। সুতরাং সমালোচনা করতে হলে সরকারের বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সমালোচনা করতে হবে, রাষ্ট্রপতির নয়।' তিনি আরো বলেন, 'স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল আইন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ নেওয়া। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেটা করেনি।' এই বক্তব্যেই স্পষ্ট হয়ে গেছে, কোন প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতিকে স্বাক্ষর করতে হয়েছে। কিন্তু যেভাবেই হোক এ ঘটনা সাধারণ মানুষকে আহত করেছে। আইনের শাসনের বারবার পরাজয় দেখে তাদের হতাশার অন্ধকার আরো গাঢ় হয়েছে। সরকার আর মোসাহেবরা যেভাবেই বলুক মানুষ দেখেছে একই রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে গামা হত্যা মামলার সাজা পাওয়া আরো একুশজনের দণ্ড মওকুফ করানো হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তিনি দলীয় না থাকলেও কাকতালীয়ভাবে তাঁর ক্ষমা লাভ করা ভাগ্যবানরা সবাই আওয়ামী লীগ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। পাশাপাশি ২০ জুলাই দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় কাশিমপুর ও পাবনা কারাগারে দুজন অপরাধীর ফাঁসি কার্যকরের খবর ছাপা হয়েছে। একই কাগজে সেদিনই প্রথম বিপ্লবের দণ্ড ক্ষমার কথাও প্রকাশিত হয়। রিপোর্টে জানা যায়, এই দুই আসামিও প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছিলেন মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে। কিন্তু তা নামঞ্জুর হয়। এখন হতাশ মানুষ যদি বলে এই হতভাগ্য অপরাধীরা কেন অপরাধ করার আগে যোগ্য রাজনৈতিক দলে নাম লেখাননি, তবে তাদের অন্যায় কতটুকু হবে?
রাজনীতিকদের কপটতা প্রতিদিন হতাশ ও ক্ষুব্ধ করছে সাধারণ মানুষকে। ২০০৫ সালে বিএনপির সে সময়ের আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ দুই খুনের জন্য মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি জিন্টুকে মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে ক্ষমা করিয়েছিলেন। সচেতন দেশবাসী ভেবেছিল, এবার তিনি হয়তো মুখ বন্ধ রাখবেন। কিন্তু লজ্জাকে প্রিজারভেটিভ দিয়ে (বিজ্ঞাপনের ভাষা) বলে ফেললেন সেটি ক্যাঙ্গারু কোর্টের বিচার ছিল বলে তিনি সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু দেশবাসীর মতো মওদুদও জানতেন জিন্টু সন্ত্রাসী ও খুনি ছিল। সৌভাগ্যক্রমে এই সন্ত্রাসীও বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল। এসব অঘটন দেখে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস জন্মেছে, এ দেশের ক্ষমতার রাজনীতির সফল দলগুলোর কোনো একটার সঙ্গে যুক্ত না থাকলে সবাই সেন রাজাদের বর্ণপ্রথার শূদ্র। অর্থাৎ পতিত। তাই রাষ্ট্র পরিচালনায় সুশাসনের অভাব, অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থা, আইনের শাসনের ভূলুণ্ঠিত দশায় জীবনের নিরাপত্তাহীনতা মানুষের মনে যে হতাশার জন্ম দিচ্ছে আমরা মনে করি এর বহিঃপ্রকাশ হিসেবে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে অস্থিরতা ক্রমে ছড়িয়ে যাচ্ছে। সামাজিক এই বিপর্যয়ের দায় আমাদের রাজনীতিকরা এড়াতে পারবেন না। তার পরও আশাবাদী আমরা প্রার্থনা করব, মনের কোনো এক গোপন জায়গা থেকে হলেও মানবিকতা খুঁজে এনে নষ্ট রাজনীতির ঊধর্ে্ব উঠে সরকারি ও বিরোধীদলীয় ক্ষমতাবান রাজনীতিকরা বিপন্ন দশা থেকে মানুষ ও সমাজকে রক্ষা করুন।
লেখক : অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments