রঙ্গব্যঙ্গ-আকাশে যত তারা পুলিশের তত ধারা by মোস্তফা কামাল
পুলিশ বাহিনীকে নিয়ে গল্পের শেষ নেই। কখনো পুলিশ গল্পের নায়ক কিংবা ভিলেন হয়। আবার কখনো পুলিশ কাউকে কাউকে নায়ক বা ভিলেন বানায়। প্রিয় পাঠক, এ বিষয়ে দুটি গল্প বলছি। গল্প-১ : আমিনবাজার এলাকার বড়দেশী গ্রাম। গ্রামটি মাদকের গ্রাম হিসেবে পরিচিত। অধিকাংশ মানুষ মাদক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত।
ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের এলাকার মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রিত হয় বড়দেশী গ্রাম থেকে। পেছন থেকে মাদক ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করে পুলিশ। বিনিময়ে তারা মোটা অঙ্কের মাসোহারা পায়।
মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে মারামারি-কাটাকাটি হয়। শেষে টিকে থাকে সবচেয়ে বেশি পেশিশক্তির অধিকারী ব্যক্তিটি। কথায় আছে না, জোর যার মুল্লুক তার। বড়দেশী গ্রামে সেই প্রবাদটিই যেন সত্য। এখানে জোর যার বড়দেশী তার। এই গ্রামে যা কিছুই ঘটে, তার মূলে হচ্ছে মাদক ব্যবসা। অন্য কোনো ইস্যু এখানে নেই।
যদিও এর মধ্যে আমরা কিছু কল্পকাহিনী শুনেছি। বলা হয়েছে, প্রতিদিন ডাকাতি হয় বলে বড়দেশী গ্রামের লোকেরা পালাক্রমে রাত জেগে পাহারা দেয়। এটা স্রেফ কল্পকথা। আসলে মাদক ব্যবসায়ীরা ভেবেছিল, তাদের প্রতিপক্ষ গ্রুপ মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নিতে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
১৭ জুলাই রাতটি ছিল শবেবরাতের রাত। রাতে শবেবরাতের নামাজ আদায় করে কয়েকজন ছাত্র ঘুরতে বের হয়। ঘুরতে ঘুরতে আমিনবাজার এলাকায় চলে যায়। সেখান থেকে শখের বশে অথবা অন্য কোনো কারণে বড়দেশী গ্রামের মাঠে যায়। সেখানে গিয়ে ইব্রাহীম খলিল পলাশকে উদ্দেশ করে বলল, পলাশ, এই এলাকায় গাঁজা পাওয়া যায় না?
পলাশ ইতিবাচক মাথা নেড়ে বলল, হুম।
টিপু বলল, মানুষে বলে, গাঁজার নৌকা নাকি পাহাড়ের ওপর দিয়া যায়। দেখিস, গাঁজা খেয়ে যেন সে অবস্থা না হয়!
তারপর জমে ওঠে আড্ডা। চলতে থাকে রাজা-উজির মারার গল্প। আর অন্যদিকে এলাকায় যুবক ছেলেদের দেখে বড়দেশী গ্রামের কিছু লোক জড়ো হতে থাকে। তাদের ধারণা ছিল, প্রতিপক্ষের লোকেরা এলাকার মাদকের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে এসেছে। এই খবর মোবাইলে মোবাইলে চলে গেল পুরো গ্রামে। দলে দলে লোক আসতে থাকে সেখানে। আসে পুলিশও। পুলিশের সামনেই গ্রামের লোকেরা ছাত্রদের ওপর হামলা চালায়। ছাত্র পরিচয় দেওয়ার পরও তারা কেউ দমল না। নিরুপায় ছাত্ররা পুলিশের কাছে অনুনয়-বিনয় করে বলল, আমরা ছাত্র, আমাদের বাঁচান!
পুলিশ বলল, এই! তোরা কিসের ছাত্র, তোরা ডাকাত!
না না, আমরা ডাকাত না। আমরা ছাত্র। বিশ্বাস করেন, আমরা ছাত্র।
আরে রাখ! বিশ্বাসের মা মারা গেছে! তোরা ডাকাত_এটাই সত্য।
অবশেষে গণপিটুনিতে প্রাণ হারাল ছয় ছাত্র। যে ছেলেটি ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেল তার বিরুদ্ধে হলো ডাকাতি মামলা। তবে তারা যে ডাকাত ছিল না, ছাত্র ছিল; তার প্রমাণ পাওয়া গেল তাদের মৃত্যুর পর।
গল্প-২ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগের মেধাবী ছাত্র আবদুল কাদের। ঢাকার সেগুনবাগিচা এলাকার নিরিবিলি রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন। কোথাও যাচ্ছিলেন হয়তো। কিন্তু সেই রাস্তাটি যে তাঁর জন্য নিরাপদ ছিল না তা তিনি চিন্তাও করেননি। হঠাৎ সাদা পোশাকের কয়েকজন পুলিশ পেছন থেকে তাঁর দুই হাত চেপে ধরল। তারপর চোখে কালো কাপড় বেঁধে বলল, চল আমাদের সঙ্গে।
আতঙ্কিত কাদের শুকনো গলায় বলল, আপনারা কারা?
কর্কশ কণ্ঠে পুলিশের একজন সদস্য বলল, আমরা আইনের লোক।
বিস্ময়ের সঙ্গে কাদের বলল, আইনের লোক! আমাকে ধরলেন কেন?
তুই ডাকাত।
ডাকাত! আমি তো ছাত্র।
আরে রাখ! কিসের ছাত্র?
জি, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই বেশি ডাকাতি করে। তুই ডাকাত। চল আমাদের সঙ্গে।
না, আমি ডাকাত না। আমি ছাত্র।
আমরা বলছি তুই ডাকাত। কাজেই তুই ডাকাত।
তারপর পুলিশ কাদেরের হাতে একটি অস্ত্র ধরিয়ে দিয়ে বলে, এই অস্ত্রটা তোর কাছে ছিল।
কোথায় আমার হাতে অস্ত্র ছিল! আমি অস্ত্র পাব কোথায়!
এই যে দিলাম। এটাই তোর হাতে ছিল। কোর্টে যদি জিজ্ঞেস করে তোর হাতে অস্ত্র ছিল কি না? তুই বলবি, ছিল।
কাদের পুলিশের এই সাজানো রহস্যময় কাহিনীর অর্থ বোঝেন না। তিনি ভয়ে-আতঙ্কে একেবারে কুঁকড়ে যান। তাকে গাড়িতে ওঠানো হয়। গাড়িতে উঠিয়েই তাঁকে মারধর করা হয়। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় খিলগাঁও থানায়। সেখানে নেওয়ার পর খোদ থানার ওসিও তাঁকে মারধর করেন। কাদের জানেন না কী তাঁর অপরাধ! কেন তাঁকে ডাকাত বানানো হলো তা-ও বুঝতে পারেন না। অথচ এই নিরপরাধ মেধাবী ছাত্রের বিরুদ্ধেই থানায় ডাকাতি ও অস্ত্র আইনে দুটি মামলা হয়।
এভাবেই নিরীহ-নিরপরাধ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা সাজায় পুলিশ। পুলিশের ফাঁদে পড়ে নিরীহ মানুষ হয়ে যায় দাগি আসামি। অথচ অপরাধীরা আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসে। তার পরও পুলিশের ছত্রছায়ায় থেকে অপরাধের পর অপরাধ করে। পুলিশের চোখে অপরাধীরা হয় নিরপরাধ! হায়রে পুলিশ! এই জন্যই তো মানুষ বলে, আকাশে যত তারা, পুলিশের তত ধারা।
প্রিয় পাঠক, সত্য ঘটনাও কখনো কখনো গল্প হয়ে ওঠে। ওপরের গল্প দুটির কাহিনীও সত্য। কিন্তু এ সত্য আমাদের মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। সভ্য সমাজ এটাকে মেনে নিতে পারে না। তাই আমরা কাল্পনিক গল্প বলে ধরে নিচ্ছি। সবাইকে শুভ কামনা।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে মারামারি-কাটাকাটি হয়। শেষে টিকে থাকে সবচেয়ে বেশি পেশিশক্তির অধিকারী ব্যক্তিটি। কথায় আছে না, জোর যার মুল্লুক তার। বড়দেশী গ্রামে সেই প্রবাদটিই যেন সত্য। এখানে জোর যার বড়দেশী তার। এই গ্রামে যা কিছুই ঘটে, তার মূলে হচ্ছে মাদক ব্যবসা। অন্য কোনো ইস্যু এখানে নেই।
যদিও এর মধ্যে আমরা কিছু কল্পকাহিনী শুনেছি। বলা হয়েছে, প্রতিদিন ডাকাতি হয় বলে বড়দেশী গ্রামের লোকেরা পালাক্রমে রাত জেগে পাহারা দেয়। এটা স্রেফ কল্পকথা। আসলে মাদক ব্যবসায়ীরা ভেবেছিল, তাদের প্রতিপক্ষ গ্রুপ মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নিতে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
১৭ জুলাই রাতটি ছিল শবেবরাতের রাত। রাতে শবেবরাতের নামাজ আদায় করে কয়েকজন ছাত্র ঘুরতে বের হয়। ঘুরতে ঘুরতে আমিনবাজার এলাকায় চলে যায়। সেখান থেকে শখের বশে অথবা অন্য কোনো কারণে বড়দেশী গ্রামের মাঠে যায়। সেখানে গিয়ে ইব্রাহীম খলিল পলাশকে উদ্দেশ করে বলল, পলাশ, এই এলাকায় গাঁজা পাওয়া যায় না?
পলাশ ইতিবাচক মাথা নেড়ে বলল, হুম।
টিপু বলল, মানুষে বলে, গাঁজার নৌকা নাকি পাহাড়ের ওপর দিয়া যায়। দেখিস, গাঁজা খেয়ে যেন সে অবস্থা না হয়!
তারপর জমে ওঠে আড্ডা। চলতে থাকে রাজা-উজির মারার গল্প। আর অন্যদিকে এলাকায় যুবক ছেলেদের দেখে বড়দেশী গ্রামের কিছু লোক জড়ো হতে থাকে। তাদের ধারণা ছিল, প্রতিপক্ষের লোকেরা এলাকার মাদকের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে এসেছে। এই খবর মোবাইলে মোবাইলে চলে গেল পুরো গ্রামে। দলে দলে লোক আসতে থাকে সেখানে। আসে পুলিশও। পুলিশের সামনেই গ্রামের লোকেরা ছাত্রদের ওপর হামলা চালায়। ছাত্র পরিচয় দেওয়ার পরও তারা কেউ দমল না। নিরুপায় ছাত্ররা পুলিশের কাছে অনুনয়-বিনয় করে বলল, আমরা ছাত্র, আমাদের বাঁচান!
পুলিশ বলল, এই! তোরা কিসের ছাত্র, তোরা ডাকাত!
না না, আমরা ডাকাত না। আমরা ছাত্র। বিশ্বাস করেন, আমরা ছাত্র।
আরে রাখ! বিশ্বাসের মা মারা গেছে! তোরা ডাকাত_এটাই সত্য।
অবশেষে গণপিটুনিতে প্রাণ হারাল ছয় ছাত্র। যে ছেলেটি ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেল তার বিরুদ্ধে হলো ডাকাতি মামলা। তবে তারা যে ডাকাত ছিল না, ছাত্র ছিল; তার প্রমাণ পাওয়া গেল তাদের মৃত্যুর পর।
গল্প-২ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগের মেধাবী ছাত্র আবদুল কাদের। ঢাকার সেগুনবাগিচা এলাকার নিরিবিলি রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন। কোথাও যাচ্ছিলেন হয়তো। কিন্তু সেই রাস্তাটি যে তাঁর জন্য নিরাপদ ছিল না তা তিনি চিন্তাও করেননি। হঠাৎ সাদা পোশাকের কয়েকজন পুলিশ পেছন থেকে তাঁর দুই হাত চেপে ধরল। তারপর চোখে কালো কাপড় বেঁধে বলল, চল আমাদের সঙ্গে।
আতঙ্কিত কাদের শুকনো গলায় বলল, আপনারা কারা?
কর্কশ কণ্ঠে পুলিশের একজন সদস্য বলল, আমরা আইনের লোক।
বিস্ময়ের সঙ্গে কাদের বলল, আইনের লোক! আমাকে ধরলেন কেন?
তুই ডাকাত।
ডাকাত! আমি তো ছাত্র।
আরে রাখ! কিসের ছাত্র?
জি, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই বেশি ডাকাতি করে। তুই ডাকাত। চল আমাদের সঙ্গে।
না, আমি ডাকাত না। আমি ছাত্র।
আমরা বলছি তুই ডাকাত। কাজেই তুই ডাকাত।
তারপর পুলিশ কাদেরের হাতে একটি অস্ত্র ধরিয়ে দিয়ে বলে, এই অস্ত্রটা তোর কাছে ছিল।
কোথায় আমার হাতে অস্ত্র ছিল! আমি অস্ত্র পাব কোথায়!
এই যে দিলাম। এটাই তোর হাতে ছিল। কোর্টে যদি জিজ্ঞেস করে তোর হাতে অস্ত্র ছিল কি না? তুই বলবি, ছিল।
কাদের পুলিশের এই সাজানো রহস্যময় কাহিনীর অর্থ বোঝেন না। তিনি ভয়ে-আতঙ্কে একেবারে কুঁকড়ে যান। তাকে গাড়িতে ওঠানো হয়। গাড়িতে উঠিয়েই তাঁকে মারধর করা হয়। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় খিলগাঁও থানায়। সেখানে নেওয়ার পর খোদ থানার ওসিও তাঁকে মারধর করেন। কাদের জানেন না কী তাঁর অপরাধ! কেন তাঁকে ডাকাত বানানো হলো তা-ও বুঝতে পারেন না। অথচ এই নিরপরাধ মেধাবী ছাত্রের বিরুদ্ধেই থানায় ডাকাতি ও অস্ত্র আইনে দুটি মামলা হয়।
এভাবেই নিরীহ-নিরপরাধ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা সাজায় পুলিশ। পুলিশের ফাঁদে পড়ে নিরীহ মানুষ হয়ে যায় দাগি আসামি। অথচ অপরাধীরা আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসে। তার পরও পুলিশের ছত্রছায়ায় থেকে অপরাধের পর অপরাধ করে। পুলিশের চোখে অপরাধীরা হয় নিরপরাধ! হায়রে পুলিশ! এই জন্যই তো মানুষ বলে, আকাশে যত তারা, পুলিশের তত ধারা।
প্রিয় পাঠক, সত্য ঘটনাও কখনো কখনো গল্প হয়ে ওঠে। ওপরের গল্প দুটির কাহিনীও সত্য। কিন্তু এ সত্য আমাদের মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। সভ্য সমাজ এটাকে মেনে নিতে পারে না। তাই আমরা কাল্পনিক গল্প বলে ধরে নিচ্ছি। সবাইকে শুভ কামনা।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
No comments