পরিবেশ-মানুষের গ্রাসে প্রকৃতি by নিতাই দাস
ঢাকা-মাওয়া সড়কটি যখন চালু হয় তখন অনেকটা ঘুর পথে পোস্তগোলা ব্রিজ পাড়ি দিয়ে যেতে হতো ঢাকা থেকে মাওয়া অভিমুখে। ব্রিজ পাড়ি দিলেই বর্ষা আর শরতে বেশ দৃষ্টিনন্দন ছিল পথপাশের অবস্থানগুলো। বিলের জলে শাপলা-শালুকের সমারোহের ফাঁকে ফাঁকে ছবির মতো সবুজ বৃক্ষ আচ্ছাদিত দ্বীপসদৃশ বাড়ি সব যেন হাত নেড়ে একদণ্ড
আতিথেয়তা গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানাতে ব্যস্ত থাকত, মাঝেমধ্যে চোখে পড়ত মাছ ধরার নৌকা কিংবা বড়শির ওঠা-নামা।
বাংলার সেই চিরচেনা প্রকৃতিকে বিক্রমপুরের এই অংশটিতে এখন আর সেভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। বুড়িগঙ্গার ওপর দ্বিতীয় সেতু বাবুবাজার ব্রিজ হয়ে সেদিন সকালে কেরানীগঞ্জ গিয়ে আর বাংলার চিরচেনা মুখটিকে খুঁজে পেলাম না। ইট-কাঠের স্থাপনা প্রকৃতি, পরিবেশ আর মানুষের নিঃশ্বাস ফেলার স্থানটুকুকেও যেন গ্রাস করে ফেলেছে। রাস্তা বেশ মসৃণ, মনে হয় যেন গাড়ির চাকা ভোরের শিশিরে পিছলে যাবে। অবশ্য পিছলে পড়ার কোনো অবকাশ নেই। রাস্তার দুই পাশ নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার বেড়াজালে আবদ্ধ। পথের দুই পাশের প্রকৃতিকে গ্রাস করেছে দোকান, শপিং সেন্টার আর বাণিজ্যিক স্থাপনা। কোথাও আবার গড়ে উঠেছে সুউচ্চ জনবসতি, যাদের মিতালি আকাশের সঙ্গেই বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তবে এসব স্থাপনা মোটেই পরিকল্পিত নয়। মনে হয় দখলের প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে যে যেভাবে পেরেছে সেভাবেই প্রকৃতিকে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে জাহির করেছে নিজেদের ক্ষমতার দম্ভ।
বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর আমরা মূল সড়কের নিশানা খুঁজে পাই। পোস্তগোলা ব্রিজ থেকে এই সড়কটি সোজা গিয়ে আঘাত করেছে মাওয়া ঘাটে পদ্মার বুকে। সেখানেই নদীর স্রোত পদদলিত করে নির্মিত হবে কয়েক কিলোমিটার লম্বা একটি সেতুবন্ধ, যা উত্তর-দক্ষিণ আর পূর্ব-পশ্চিমকে করে দেবে একাকার।
মূল রাস্তাটি আর আগের অবস্থায় নেই এখন। চারপাশে জলের অবাধ অবস্থান কোথায় যেন হারিয়ে গেছে কোনো এক আরব্য রজনীর দেও-দানবের চেরাগি খোঁচায়। তার পরিবর্তে বালুর সাদা সমুদ্র এগিয়ে চলেছে সব কৃষি জমির বুক চিড়ে। মোটা পাইপ দিয়ে সাধারণত জল বা তেল অথবা গ্যাস সরবরাহ করা হয়ে থাকে। কিন্তু বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী আর পদ্মা-যমুনার বালু চলে আসছে পাইপ-বাহিত হয়ে। কী বিচিত্র এই দেশ, সেলুকাস! জলের সঙ্গে মিশে আসছে বালু। জল চলে যাচ্ছে নিচে, আর বালুতে ভরাট হয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির নন্দনকানন। মাওয়া রাস্তার দুই পাশে এখন শুধু পাইপ আর বালুরই মহোৎসব। অবস্থা যা দেখছি, তাতে দু-এক বছর পর আর ফসলের মাঠ, মাছের জলের কিংবা শত বছরের আদিবসতির মালিকের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না এই জলপ্রধান অঞ্চলটিতে।
মাওয়া রাস্তায় ঢোকার মুখে একটি বড় তোরণ দেখে এসেছিলাম শারদীয় দুর্গোৎসবের। কিছুদূর এগিয়ে দেখি, ডান দিকে মাঠের মধ্যে একটি অস্থায়ী স্থাপনার দুর্গাদেবী ১০ হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছেন সপরিবারে।
আমি চায়ের দোকানটিতে বসি আরও কয়েকজনের পাশে। চা হতে এখনো দেরি আছে, সবে চুলায় আগুন দেওয়া হয়েছে। এই মাঠে কে পূজা করছে? এদিক-ওদিক তাকিয়ে একজনের কণ্ঠে নিম্নকণ্ঠ ভেসে আসে, দলের এক বাবু মাটি ভরাট করে দেবীকে আহ্বান করেছেন এই জনহীন প্রান্তরে। কৌতূহল নিয়ে আমরা এগিয়ে যাই। পথে শুধু মোটা মোটা পাইপ আর পাইপ। মন্দিরের চারপাশ ভরাট হচ্ছে।
কিছুদূর এগোনোর পর দেখা পাওয়া গেল রাজউকের ঝিলিমিলি প্রকল্পের। তারপর ডান-বাঁয়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য বেসরকারি হাউজিং প্রকল্প। কিছুদিন আগে বিপুল উদ্যমে সরকারিভাবে বিভিন্ন হাউজিং প্রকল্পের সাইনবোর্ড উচ্ছেদ করা হয়েছে। কিন্তু ভরাট হওয়া বালু তো আর উচ্ছেদ হয়নি। সেই সঙ্গে সরে যায়নি দানবীয় পাইপ সকল। এখন এসব পাইপ দশভুজার শত হাতে আবার সচল হয়েছে রাস্তার দুই পাশে দিগন্তরেখা অভিমুখে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এ দেশে আর কৃষিজমি কিংবা ধান-চালের প্রয়োজন হবে না। শুধু বালুর বাঁধ দিয়ে হাওয়ায় ভেসে বেড়ালেই জীবনের সব আরাধ্য সাধন হয়ে যাবে। ভাত নয়, বালু আর হাওয়াই যেন হবে আমাদের মুখের গ্রাস।
ডান দিকে মোড় ঘুরে শ্রীনগর পেরিয়ে মনটা আবার শারদীয় প্রভাতের শান্ত সমাহিত রূপ ধারণ করে। বিশাল আড়িয়ল বিল। জলজ উদ্ভিদ সব ভেসে আছে। হংস দল তোলপাড় করছে বাড়িঘরের আশপাশে। কোথাও ছোট্ট নৌকায় মাছ শিকারির আনাগোনা। সেসবই প্রকৃতির আদি আর অকৃত্রিম অংশবিশেষ। রাস্তার দুই পাশে সবুজ গাছের ছায়ায় আমরা গাড়ির জানালা সব খুলে দিয়ে এগিয়ে চলি পূর্ব থেকে পশ্চিমে।
ঢাকা শহরের উত্তর পাশ দখলদারদের দৌরাত্ম্যে বনবাদাড় উজাড় হয়ে কারখানা আর জনবসতির চাপে গিয়ে প্রায় ঠেকেছে ময়মনসিংহ পর্যন্ত। পূর্বদিকে শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী ছাড়িয়ে বালুর সমুদ্র মেঘনাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে চলেছে কুমিল্লা অভিমুখে। পশ্চিম দিক সাভার হয়ে মানিকগঞ্জ ছাড়িয়ে গিয়ে ঠেকেছে যমুনায়। এখন দক্ষিণ দিকও পদ্মা পেরিয়ে এগিয়ে চলেছে সুন্দরবন অভিমুখে। তাহলে কি ফসলি জমি আর মানুষের নিঃশ্বাস ফেলার অক্সিজেন সব নিঃশেষ হয়ে এক মরণসাগর গ্রাস করতে এগিয়ে আসছে দ্রুতলয়ে?
নিতাই দাস: লেখক ও উন্নয়নকর্মী।
বাংলার সেই চিরচেনা প্রকৃতিকে বিক্রমপুরের এই অংশটিতে এখন আর সেভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। বুড়িগঙ্গার ওপর দ্বিতীয় সেতু বাবুবাজার ব্রিজ হয়ে সেদিন সকালে কেরানীগঞ্জ গিয়ে আর বাংলার চিরচেনা মুখটিকে খুঁজে পেলাম না। ইট-কাঠের স্থাপনা প্রকৃতি, পরিবেশ আর মানুষের নিঃশ্বাস ফেলার স্থানটুকুকেও যেন গ্রাস করে ফেলেছে। রাস্তা বেশ মসৃণ, মনে হয় যেন গাড়ির চাকা ভোরের শিশিরে পিছলে যাবে। অবশ্য পিছলে পড়ার কোনো অবকাশ নেই। রাস্তার দুই পাশ নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার বেড়াজালে আবদ্ধ। পথের দুই পাশের প্রকৃতিকে গ্রাস করেছে দোকান, শপিং সেন্টার আর বাণিজ্যিক স্থাপনা। কোথাও আবার গড়ে উঠেছে সুউচ্চ জনবসতি, যাদের মিতালি আকাশের সঙ্গেই বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তবে এসব স্থাপনা মোটেই পরিকল্পিত নয়। মনে হয় দখলের প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে যে যেভাবে পেরেছে সেভাবেই প্রকৃতিকে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে জাহির করেছে নিজেদের ক্ষমতার দম্ভ।
বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর আমরা মূল সড়কের নিশানা খুঁজে পাই। পোস্তগোলা ব্রিজ থেকে এই সড়কটি সোজা গিয়ে আঘাত করেছে মাওয়া ঘাটে পদ্মার বুকে। সেখানেই নদীর স্রোত পদদলিত করে নির্মিত হবে কয়েক কিলোমিটার লম্বা একটি সেতুবন্ধ, যা উত্তর-দক্ষিণ আর পূর্ব-পশ্চিমকে করে দেবে একাকার।
মূল রাস্তাটি আর আগের অবস্থায় নেই এখন। চারপাশে জলের অবাধ অবস্থান কোথায় যেন হারিয়ে গেছে কোনো এক আরব্য রজনীর দেও-দানবের চেরাগি খোঁচায়। তার পরিবর্তে বালুর সাদা সমুদ্র এগিয়ে চলেছে সব কৃষি জমির বুক চিড়ে। মোটা পাইপ দিয়ে সাধারণত জল বা তেল অথবা গ্যাস সরবরাহ করা হয়ে থাকে। কিন্তু বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী আর পদ্মা-যমুনার বালু চলে আসছে পাইপ-বাহিত হয়ে। কী বিচিত্র এই দেশ, সেলুকাস! জলের সঙ্গে মিশে আসছে বালু। জল চলে যাচ্ছে নিচে, আর বালুতে ভরাট হয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির নন্দনকানন। মাওয়া রাস্তার দুই পাশে এখন শুধু পাইপ আর বালুরই মহোৎসব। অবস্থা যা দেখছি, তাতে দু-এক বছর পর আর ফসলের মাঠ, মাছের জলের কিংবা শত বছরের আদিবসতির মালিকের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না এই জলপ্রধান অঞ্চলটিতে।
মাওয়া রাস্তায় ঢোকার মুখে একটি বড় তোরণ দেখে এসেছিলাম শারদীয় দুর্গোৎসবের। কিছুদূর এগিয়ে দেখি, ডান দিকে মাঠের মধ্যে একটি অস্থায়ী স্থাপনার দুর্গাদেবী ১০ হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছেন সপরিবারে।
আমি চায়ের দোকানটিতে বসি আরও কয়েকজনের পাশে। চা হতে এখনো দেরি আছে, সবে চুলায় আগুন দেওয়া হয়েছে। এই মাঠে কে পূজা করছে? এদিক-ওদিক তাকিয়ে একজনের কণ্ঠে নিম্নকণ্ঠ ভেসে আসে, দলের এক বাবু মাটি ভরাট করে দেবীকে আহ্বান করেছেন এই জনহীন প্রান্তরে। কৌতূহল নিয়ে আমরা এগিয়ে যাই। পথে শুধু মোটা মোটা পাইপ আর পাইপ। মন্দিরের চারপাশ ভরাট হচ্ছে।
কিছুদূর এগোনোর পর দেখা পাওয়া গেল রাজউকের ঝিলিমিলি প্রকল্পের। তারপর ডান-বাঁয়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য বেসরকারি হাউজিং প্রকল্প। কিছুদিন আগে বিপুল উদ্যমে সরকারিভাবে বিভিন্ন হাউজিং প্রকল্পের সাইনবোর্ড উচ্ছেদ করা হয়েছে। কিন্তু ভরাট হওয়া বালু তো আর উচ্ছেদ হয়নি। সেই সঙ্গে সরে যায়নি দানবীয় পাইপ সকল। এখন এসব পাইপ দশভুজার শত হাতে আবার সচল হয়েছে রাস্তার দুই পাশে দিগন্তরেখা অভিমুখে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এ দেশে আর কৃষিজমি কিংবা ধান-চালের প্রয়োজন হবে না। শুধু বালুর বাঁধ দিয়ে হাওয়ায় ভেসে বেড়ালেই জীবনের সব আরাধ্য সাধন হয়ে যাবে। ভাত নয়, বালু আর হাওয়াই যেন হবে আমাদের মুখের গ্রাস।
ডান দিকে মোড় ঘুরে শ্রীনগর পেরিয়ে মনটা আবার শারদীয় প্রভাতের শান্ত সমাহিত রূপ ধারণ করে। বিশাল আড়িয়ল বিল। জলজ উদ্ভিদ সব ভেসে আছে। হংস দল তোলপাড় করছে বাড়িঘরের আশপাশে। কোথাও ছোট্ট নৌকায় মাছ শিকারির আনাগোনা। সেসবই প্রকৃতির আদি আর অকৃত্রিম অংশবিশেষ। রাস্তার দুই পাশে সবুজ গাছের ছায়ায় আমরা গাড়ির জানালা সব খুলে দিয়ে এগিয়ে চলি পূর্ব থেকে পশ্চিমে।
ঢাকা শহরের উত্তর পাশ দখলদারদের দৌরাত্ম্যে বনবাদাড় উজাড় হয়ে কারখানা আর জনবসতির চাপে গিয়ে প্রায় ঠেকেছে ময়মনসিংহ পর্যন্ত। পূর্বদিকে শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী ছাড়িয়ে বালুর সমুদ্র মেঘনাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে চলেছে কুমিল্লা অভিমুখে। পশ্চিম দিক সাভার হয়ে মানিকগঞ্জ ছাড়িয়ে গিয়ে ঠেকেছে যমুনায়। এখন দক্ষিণ দিকও পদ্মা পেরিয়ে এগিয়ে চলেছে সুন্দরবন অভিমুখে। তাহলে কি ফসলি জমি আর মানুষের নিঃশ্বাস ফেলার অক্সিজেন সব নিঃশেষ হয়ে এক মরণসাগর গ্রাস করতে এগিয়ে আসছে দ্রুতলয়ে?
নিতাই দাস: লেখক ও উন্নয়নকর্মী।
No comments