নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতাবৃদ্ধি by এ এম এম শওকত আলী
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প হিসেবে নির্বাচন কমিশনকে অধিকতর শক্তিশালী করার বিষয়টি রাজনৈতিক দলসহ নির্বাচন কমিশনও চলমান বিতর্কের একপর্যায়ে বলেছিল। পরবর্তী পর্যায়ে একজন জ্যেষ্ঠ কমিশনার স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, কমিশন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প হতে পারে না। এসব সত্ত্বেও এ বিতর্ক থেমে যায়নি। পুনরায় বিতর্ক শুরু হয়েছে।
কারণ হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার সাংবিধানিকভাবে বিলুপ্ত হওয়ার পর জনমনে আশঙ্কা যে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে নির্বাচনপ্রক্রিয়া প্রভাবিত হতে পারে। এ ধারণারও অবশ্য কারণ রয়েছে। ১৯৯৬ সালে সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েই এ ধরনের সরকারপ্রথার প্রবর্তন করেছিল। কিন্তু তা স্থায়ী হয়নি। বাংলাদেশে সব কিছুরই কেন্দ্রবিন্দু গণতন্ত্র। নিখুঁত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েমের জন্যই তত্ত্বাবধায়ক প্রথা বিলুপ্ত করা হয়েছে, যার জন্য বর্তমানে রাজনৈতিক মতবিরোধ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে।
প্রায় সব দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, নির্বাচন কমিশন বর্তমানে মনে করছে যে আগামী নির্বাচন দলীয় প্রভাবমুক্ত করতে হলে অবশ্যই নির্বাচন কমিশনকে অধিক ক্ষমতা প্রদান করা সংগত হবে। ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন কি সংবিধানসম্মত? তাহলে নির্বাচন কমিশন কেন? সরকারি কাঠামোর মাধ্যমেই কি নির্বাচন হয়? নির্বাচন কমিশনের এখন নিজস্ব নির্বাচন কর্মকর্তা উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত। কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতেই এ-সংক্রান্ত বাহিনীকে নির্বাচনের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কিছু সময়ের জন্য কমিশনের অধীন করা হয়। এটাই কি যথেষ্ট নয়? এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলাসহ নির্বাচনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত মাঠপর্যায়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের বদলি বা পদায়নের ক্ষেত্রেও নির্বাচন কমিশনের যথেষ্ট ক্ষমতা বিদ্যমান আইনে রয়েছে। এ ক্ষমতাও কি যথেষ্ট নয়?
জানা গেছে, অধিকতর ক্ষমতাবৃদ্ধির জন্য কমিশন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আইন) ৪৪ই ধারার সংশোধনের জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব পেশ করবে। প্রস্তাবটির বলে চার মন্ত্রণালয় বা বিভাগকে কমিশনের অধীন করতে হবে। সময়সীমা হবে নির্বাচনের ৯০ দিন আগে থেকে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণের দিন পর্যন্ত। চারটি মন্ত্রণালয় কমিশনের নিয়ন্ত্রণভুক্ত হবে। মন্ত্রণালয় বা বিভাগগুলো হলো মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ, স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন। এ চারটি মন্ত্রণালয় বা বিভাগকে সংশ্লিষ্ট সময়ে কমিশনের পরামর্শ অনুযায়ী সরকারি কার্য সম্পাদন করতে হবে। এ চারটি মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সব কয়টিই কি প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত? এ প্রশ্নের কোনো ব্যাখ্যা কমিশন দেয়নি বা দিলেও প্রতিবেদনে পাওয়া যায়নি।
এ ধরনের প্রস্তাবের অর্থ হলো, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার নির্বাহী অঙ্গকে কমিশনের অধীন করা। সম্পূর্ণ প্রস্তাবটিই সন্দেহভিত্তিক। স্বতঃসিদ্ধভাবে মনে করা হচ্ছে যে ক্ষমতাসীন সরকারের সময়ে (অধীনে নয়) নির্বাচন হলে নির্বাচনপ্রক্রিয়া দলীয় প্রভাবমুক্ত হবে না। অনুরূপ সন্দেহ প্রধান বিরোধী দলেরও। অন্য কিছু দলও একই ধারণা পোষণ করে। বলা বাহুল্য, খুব বেশিদূর না গিয়েও বলা যায়, প্রতিবেশী কোনো রাষ্ট্রের নির্বাচন কমিশনকে এ ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। তা সত্ত্বেও ওই সব দেশের কমিশন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করছে। নগণ্য ক্ষেত্রে এর কিছু ব্যত্যয় হলেও সার্বিকভাবে নির্বাচন সবাই মেনে নেয়। উল্লেখ্য, একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রে মাঠপর্যায়ে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কোনো কর্মকর্তা নেই। প্রতি রাজ্যের প্রশাসনিক কর্মকর্তারাই নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশে এর ব্যতিক্রম হওয়ার প্রধান কারণ প্রশাসনের রাজনৈতিকীকরণ। ক্ষমতাসীন সব দল কমবেশি এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের সব নির্বাচনই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় হয়েছিল। ওই সব নির্বাচনের আগে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ব্যাপকভাবে বদলি করে নতুন করে কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হয়। তা সত্ত্বেও নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক ছিল। যে দল নির্বাচনে জয়লাভ করে, সে দল নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হিসেবেই গ্রহণ করে। আর যে দল হেরে যায়, সে দলের মত সম্পূর্ণ বিপরীত।
যে চারটি মন্ত্রণালয় বা বিভাগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবে রয়েছে তার প্রায় সব কয়টিই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্বাচনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। মূলত আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও সরকারি কর্মকর্তাদের বদলির জন্য। তবে ভোটকেন্দ্রে নির্বাচন পরিচালনার জন্য বিধি অনুযায়ী কমিশন কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাই প্রিসাইডিং অফিসার ও সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। আবহমানকাল থেকে আইন ও বিধি অনুযায়ী এ পর্যায়ের কর্মকর্তারাই নির্বাচনী দায়িত্ব প্রত্যক্ষভাবে পালন করেন। মাঠপর্যায়ের অর্থাৎ বিভাগীয় প্রধান বা ডিসি ও এসপি এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নন। কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্যই ডিসি ও এসপি দায়িত্বপ্রাপ্ত। এ ক্ষেত্রে সরাসরি দায়িত্ব এসপির। ডিসির প্রধান দায়িত্ব হলো সমন্বয় ও চাহিদা অনুযায়ী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব প্রদান।
মূল কাজটি ডিসি, এসপি ও থানার ওসিদের বদলি। নির্বাচন-পূর্ববর্তী সময়ে নির্বাচন কমিশনের পরামর্শ অনুযায়ী যেকোনো কর্মকর্তাকে সরকার বদলি করে থাকে, যদি কমিশন এ বিষয়ে কোনো প্রস্তাব জনপ্রশাসন বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে। এর জন্য নতুন কোনো প্রস্তাবের প্রয়োজন নেই। সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের সহায়তা প্রদান করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সময়ও নির্বাচন কমিশন কর্তব্যে গাফিলতির জন্য যেকোনো সরকারি কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগকে পরামর্শ দিতে পারে। এসপি প্রয়োজনবোধে তাঁর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য বিভাগীয় মামলা করারও অনুরোধ জানাতে পারেন। এত সব ক্ষমতা সত্ত্বেও কমিশন কী কারণে চারটি মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সরাসরি নিয়ন্ত্রণের জন্য আগ্রহী, তা স্পষ্ট নয়।
এর কারণ হতে পারে যে অতীতে এ ধরনের পরামর্শ দেওয়া সত্ত্বেও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগ প্রয়োজনীয় কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। অভিজ্ঞ মহল মনে করে, এ বিষয়ে কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। ধারণা করা হয়, এসব ক্ষেত্রে ব্যত্যয়ের ঘটনা বিরল। পক্ষান্তরে মাঠপর্যায়ে সরাসরি নির্বাচনের দায়িত্বে নিয়োজিত কিছু কর্মকর্তাকে নির্বাচন কমিশনের মত অনুযায়ী তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে। নগণ্যসংখ্যক ক্ষেত্রে কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও হয়েছে।
গত ২১ জুলাই একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী নির্বাচনের পূর্ববর্তী ও নির্বাচন চলাকালীন 'সব কিছুই' (ঊাবৎুঃযরহম) কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। প্রধানমন্ত্রী কমিশনের পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে। স্মরণ করা যেতে পারে, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাম্প্রতিক বক্তব্য অনুযায়ী নির্বাহী বিভাগ অর্থাৎ সরকার কখনো কমিশনের কাজে হস্তক্ষেপ করেনি। এর পরও কমিশনের প্রস্তাবের যথার্থতা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
মূলত নির্বাচন কমিশনসহ সরকারবহির্ভূত অন্য কিছু সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা পূর্ণ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। এ শব্দটিই তাঁরা বারবার উচ্চারণ করে থাকেন। নির্বাচনসংক্রান্ত প্রচলিত আইন-বিধিতে যে ক্ষমতা রয়েছে, তা প্রয়োগ করলেই যথেষ্ট হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত। নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রে কিছু বিধান সংবিধানে রয়েছে। এর বাইরে সবাই যেতে চায় কেন?
প্রায় সব দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, নির্বাচন কমিশন বর্তমানে মনে করছে যে আগামী নির্বাচন দলীয় প্রভাবমুক্ত করতে হলে অবশ্যই নির্বাচন কমিশনকে অধিক ক্ষমতা প্রদান করা সংগত হবে। ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন কি সংবিধানসম্মত? তাহলে নির্বাচন কমিশন কেন? সরকারি কাঠামোর মাধ্যমেই কি নির্বাচন হয়? নির্বাচন কমিশনের এখন নিজস্ব নির্বাচন কর্মকর্তা উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত। কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতেই এ-সংক্রান্ত বাহিনীকে নির্বাচনের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কিছু সময়ের জন্য কমিশনের অধীন করা হয়। এটাই কি যথেষ্ট নয়? এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলাসহ নির্বাচনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত মাঠপর্যায়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের বদলি বা পদায়নের ক্ষেত্রেও নির্বাচন কমিশনের যথেষ্ট ক্ষমতা বিদ্যমান আইনে রয়েছে। এ ক্ষমতাও কি যথেষ্ট নয়?
জানা গেছে, অধিকতর ক্ষমতাবৃদ্ধির জন্য কমিশন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আইন) ৪৪ই ধারার সংশোধনের জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব পেশ করবে। প্রস্তাবটির বলে চার মন্ত্রণালয় বা বিভাগকে কমিশনের অধীন করতে হবে। সময়সীমা হবে নির্বাচনের ৯০ দিন আগে থেকে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণের দিন পর্যন্ত। চারটি মন্ত্রণালয় কমিশনের নিয়ন্ত্রণভুক্ত হবে। মন্ত্রণালয় বা বিভাগগুলো হলো মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ, স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন। এ চারটি মন্ত্রণালয় বা বিভাগকে সংশ্লিষ্ট সময়ে কমিশনের পরামর্শ অনুযায়ী সরকারি কার্য সম্পাদন করতে হবে। এ চারটি মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সব কয়টিই কি প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত? এ প্রশ্নের কোনো ব্যাখ্যা কমিশন দেয়নি বা দিলেও প্রতিবেদনে পাওয়া যায়নি।
এ ধরনের প্রস্তাবের অর্থ হলো, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার নির্বাহী অঙ্গকে কমিশনের অধীন করা। সম্পূর্ণ প্রস্তাবটিই সন্দেহভিত্তিক। স্বতঃসিদ্ধভাবে মনে করা হচ্ছে যে ক্ষমতাসীন সরকারের সময়ে (অধীনে নয়) নির্বাচন হলে নির্বাচনপ্রক্রিয়া দলীয় প্রভাবমুক্ত হবে না। অনুরূপ সন্দেহ প্রধান বিরোধী দলেরও। অন্য কিছু দলও একই ধারণা পোষণ করে। বলা বাহুল্য, খুব বেশিদূর না গিয়েও বলা যায়, প্রতিবেশী কোনো রাষ্ট্রের নির্বাচন কমিশনকে এ ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। তা সত্ত্বেও ওই সব দেশের কমিশন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করছে। নগণ্য ক্ষেত্রে এর কিছু ব্যত্যয় হলেও সার্বিকভাবে নির্বাচন সবাই মেনে নেয়। উল্লেখ্য, একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রে মাঠপর্যায়ে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কোনো কর্মকর্তা নেই। প্রতি রাজ্যের প্রশাসনিক কর্মকর্তারাই নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশে এর ব্যতিক্রম হওয়ার প্রধান কারণ প্রশাসনের রাজনৈতিকীকরণ। ক্ষমতাসীন সব দল কমবেশি এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের সব নির্বাচনই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় হয়েছিল। ওই সব নির্বাচনের আগে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ব্যাপকভাবে বদলি করে নতুন করে কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হয়। তা সত্ত্বেও নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক ছিল। যে দল নির্বাচনে জয়লাভ করে, সে দল নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হিসেবেই গ্রহণ করে। আর যে দল হেরে যায়, সে দলের মত সম্পূর্ণ বিপরীত।
যে চারটি মন্ত্রণালয় বা বিভাগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবে রয়েছে তার প্রায় সব কয়টিই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্বাচনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। মূলত আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও সরকারি কর্মকর্তাদের বদলির জন্য। তবে ভোটকেন্দ্রে নির্বাচন পরিচালনার জন্য বিধি অনুযায়ী কমিশন কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাই প্রিসাইডিং অফিসার ও সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। আবহমানকাল থেকে আইন ও বিধি অনুযায়ী এ পর্যায়ের কর্মকর্তারাই নির্বাচনী দায়িত্ব প্রত্যক্ষভাবে পালন করেন। মাঠপর্যায়ের অর্থাৎ বিভাগীয় প্রধান বা ডিসি ও এসপি এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নন। কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্যই ডিসি ও এসপি দায়িত্বপ্রাপ্ত। এ ক্ষেত্রে সরাসরি দায়িত্ব এসপির। ডিসির প্রধান দায়িত্ব হলো সমন্বয় ও চাহিদা অনুযায়ী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব প্রদান।
মূল কাজটি ডিসি, এসপি ও থানার ওসিদের বদলি। নির্বাচন-পূর্ববর্তী সময়ে নির্বাচন কমিশনের পরামর্শ অনুযায়ী যেকোনো কর্মকর্তাকে সরকার বদলি করে থাকে, যদি কমিশন এ বিষয়ে কোনো প্রস্তাব জনপ্রশাসন বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে। এর জন্য নতুন কোনো প্রস্তাবের প্রয়োজন নেই। সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের সহায়তা প্রদান করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সময়ও নির্বাচন কমিশন কর্তব্যে গাফিলতির জন্য যেকোনো সরকারি কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগকে পরামর্শ দিতে পারে। এসপি প্রয়োজনবোধে তাঁর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য বিভাগীয় মামলা করারও অনুরোধ জানাতে পারেন। এত সব ক্ষমতা সত্ত্বেও কমিশন কী কারণে চারটি মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সরাসরি নিয়ন্ত্রণের জন্য আগ্রহী, তা স্পষ্ট নয়।
এর কারণ হতে পারে যে অতীতে এ ধরনের পরামর্শ দেওয়া সত্ত্বেও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগ প্রয়োজনীয় কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। অভিজ্ঞ মহল মনে করে, এ বিষয়ে কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। ধারণা করা হয়, এসব ক্ষেত্রে ব্যত্যয়ের ঘটনা বিরল। পক্ষান্তরে মাঠপর্যায়ে সরাসরি নির্বাচনের দায়িত্বে নিয়োজিত কিছু কর্মকর্তাকে নির্বাচন কমিশনের মত অনুযায়ী তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে। নগণ্যসংখ্যক ক্ষেত্রে কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও হয়েছে।
গত ২১ জুলাই একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী নির্বাচনের পূর্ববর্তী ও নির্বাচন চলাকালীন 'সব কিছুই' (ঊাবৎুঃযরহম) কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। প্রধানমন্ত্রী কমিশনের পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে। স্মরণ করা যেতে পারে, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাম্প্রতিক বক্তব্য অনুযায়ী নির্বাহী বিভাগ অর্থাৎ সরকার কখনো কমিশনের কাজে হস্তক্ষেপ করেনি। এর পরও কমিশনের প্রস্তাবের যথার্থতা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
মূলত নির্বাচন কমিশনসহ সরকারবহির্ভূত অন্য কিছু সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা পূর্ণ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। এ শব্দটিই তাঁরা বারবার উচ্চারণ করে থাকেন। নির্বাচনসংক্রান্ত প্রচলিত আইন-বিধিতে যে ক্ষমতা রয়েছে, তা প্রয়োগ করলেই যথেষ্ট হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত। নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রে কিছু বিধান সংবিধানে রয়েছে। এর বাইরে সবাই যেতে চায় কেন?
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও কলামিস্ট
No comments