স্মরণ-অপারগতার ৪০ বছর
মাশুকুর রহমান তোজো, আমার মামা—তাঁর নামটা উচ্চারণ করা মাত্রই চোখের সামনে স্নিগ্ধ, অথচ তেজি এক দ্যুতির তৈরি অবয়ব দেখতে পাই। আজ ২৩ অক্টোবর। তুমি শহীদ হওয়ার পর ৪০টি বছর পার হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছ তুমি। তোমারই মতো ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি মহান স্বাধীনতা।
মামা, প্রগতিশীল ধারার রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য ছিলে তুমি। নানা (প্রয়াত অ্যাডভোকেট হাবিবুর রহমান) ছিলেন পাকিস্তান হওয়ার আগে যশোরের মুসলিম লীগের প্রধান। পাকিস্তান হওয়ার পর যশোর আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিষ্ঠাতা। ভাষা আন্দোলনে কারাবরণও করেন। তুমিও যোগ দিলে এই প্রগতিশীল রাজনীতির হাল ধরতে। একই সঙ্গে শিক্ষা ও প্রগতিশীল রাজনীতির ভিত শক্ত ও মজবুত হাতে গড়ে তুলে দিলে তুমি।
পরিচ্ছন্ন, নির্মল ও সুস্থ ধারার রাজনীতিতে তোমরা বিশ্বাসী ছিলে। তোমরা বিশ্বাস করতে, এই রাজনীতিই ছিল তোমাদের বিরূপ কোনো শক্তির বিপক্ষে মুক্তির এক উন্মুক্ত পথ। আর আজ আমি অবলীলায় বলতে পারি, ‘রাজনীতি’ নামক শব্দটি যদি কোনো ‘প্রাণী’ হতো, তাহলে এখনকার রাজনীতির স্বরূপ দেখে সে লজ্জা পেত। যেভাবে আজ আমাদের দেশে রাজনীতিকে ব্যবহার করে চলেছে সমাজের সেবক, শাসক ও রক্ষকেরা—তাতে তোমাকে পার্থক্য বা তুলনা করতে বেশি কষ্ট করতে হবে না। একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ আমাদের রাজনীতি। শাসক দল ও বিরোধী দলের ভেতর প্রতি মুহূর্তেই প্রতিযোগিতা চলে, কে কার থেকে বেশি নিকৃষ্ট, কে বেশি ধ্বংসাত্মক, কে বেশি হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত থাকতে পারে। নিজেদের যাচাইয়ের মাপকাঠিও এরা বদলে ফেলেছে। কিন্তু জানো মামা, এরা সার্থক। এরা সার্থক, তোমাদের বিসর্জনকে, তোমাদের অর্জিত স্বাধীনতাকে মূল্যহীন করে তুলতে।
এতগুলো বছর পর অপদার্থ অক্ষমের মতো বলতে বাধ্য হচ্ছি, তোমাদের স্বাধীন করে যাওয়া সেই দেশে তোমাদের খুনি, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দালালগুলো এখনো বাস করে। যে দালালগুলোর পাচার করা গোপন তথ্যের ভিত্তিতে পাকিস্তানি হানাদাররা তোমাকে গুলি করে, বন্দুকের বেয়নেটের খোঁচায় তিলে তিলে মেরেছিল, সেই নৃশংস পাকিস্তানির দালাল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আদৌ হবে কি না, জানি না! যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে এত সংশয় কোথায় তা-ও বুঝি না। নাকি রাজনীতির নামে এও এক প্রহসন? এই স্বাধীনতাবিরোধী, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করা হায়েনাদের যখন টেলিভিশনের পর্দায় দেখি, গা গুলিয়ে আসে। ওদের দেখলে কেন মনে হয় ওরা জানে ওদের শাস্তি হবে না! কে দেবে আমার এত সব প্রশ্নের উত্তর? নিজেকে প্রশ্ন করতে বাধ্য হই বেঁচে আছি তো? নাকি কোনো এক ‘পাপেট শো’র পাপেট আমরা?
১৯৭১ থেকে ২০১১—স্বাধীনতার ৪০ বছর। তোমার, তোমাদের চলে যাওয়ার ৪০ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে না পেরেছি তোমাদের রক্তে স্বাধীন করা দেশটার স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখতে, না পেরেছি তোমাদের খুনিদের শাস্তি দিতে। আজকের এই দিনে শুধু চিৎকার করে একটি মাত্র তীব্র ইচ্ছা জানাই—এই দেশের সরকার, বিরোধী দল থেকে শুরু করে প্রতিটি মানুষের কাছে আমার এই অনুরোধ—এই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করা মানুষগুলোর যেন শাস্তি হয়। কামনা করি, আমাদের দেশের, আমার মতো বাকি সব অক্ষম, অপদার্থগুলোর যেন সংবিৎ ফেরে!
মামা, তোমরা কি এখনো সেই দূর থেকে চেয়ে আছ? অপেক্ষা করছ? ভাবছ, এই বুঝি কালরাত্রির শেষ হলো? কোনো এক অন্ধকার সময়ের অতল গহ্বর থেকে হঠাৎ জন্ম নেবে কোনো এক ‘স্পার্টাকাস’ বা তোমাদের মতোই আরেকজন, মাশুকুর রহমান তোজো, পরিবর্তিত এই সময়ের, এই দাসত্বের বেড়াজাল ছিন্নভিন্ন করে, রৌদ্রোজ্জ্বল কোনো এক সকাল দেখাবে আমাদের। আমরাও অধীর অপেক্ষা করছি মামা, চুপি চুপি, দুরু দুরু বুকে ছোট্ট কোনো এক আশার ঢিমেতালে জ্বলা প্রদীপটি এখনো বলে চলেছে—পরিবর্তন হবে, কোনো এক উদ্ভাসিত আলোয় কেটে যাবে নিকষ কালো অন্ধকার, সব জঞ্জাল-কালিমা মুছে নতুন করে শুরু করতে, আসবে কোনো এক দেবদূত, অতলে হারিয়ে যাওয়া ঘুমন্ত এই জাতিকে জাগিয়ে তুলতে চিৎকার করে বলবে—জাগো বাহে, কোনঠে সবায়।
সোহানা নূর
পরিচ্ছন্ন, নির্মল ও সুস্থ ধারার রাজনীতিতে তোমরা বিশ্বাসী ছিলে। তোমরা বিশ্বাস করতে, এই রাজনীতিই ছিল তোমাদের বিরূপ কোনো শক্তির বিপক্ষে মুক্তির এক উন্মুক্ত পথ। আর আজ আমি অবলীলায় বলতে পারি, ‘রাজনীতি’ নামক শব্দটি যদি কোনো ‘প্রাণী’ হতো, তাহলে এখনকার রাজনীতির স্বরূপ দেখে সে লজ্জা পেত। যেভাবে আজ আমাদের দেশে রাজনীতিকে ব্যবহার করে চলেছে সমাজের সেবক, শাসক ও রক্ষকেরা—তাতে তোমাকে পার্থক্য বা তুলনা করতে বেশি কষ্ট করতে হবে না। একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ আমাদের রাজনীতি। শাসক দল ও বিরোধী দলের ভেতর প্রতি মুহূর্তেই প্রতিযোগিতা চলে, কে কার থেকে বেশি নিকৃষ্ট, কে বেশি ধ্বংসাত্মক, কে বেশি হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত থাকতে পারে। নিজেদের যাচাইয়ের মাপকাঠিও এরা বদলে ফেলেছে। কিন্তু জানো মামা, এরা সার্থক। এরা সার্থক, তোমাদের বিসর্জনকে, তোমাদের অর্জিত স্বাধীনতাকে মূল্যহীন করে তুলতে।
এতগুলো বছর পর অপদার্থ অক্ষমের মতো বলতে বাধ্য হচ্ছি, তোমাদের স্বাধীন করে যাওয়া সেই দেশে তোমাদের খুনি, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দালালগুলো এখনো বাস করে। যে দালালগুলোর পাচার করা গোপন তথ্যের ভিত্তিতে পাকিস্তানি হানাদাররা তোমাকে গুলি করে, বন্দুকের বেয়নেটের খোঁচায় তিলে তিলে মেরেছিল, সেই নৃশংস পাকিস্তানির দালাল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আদৌ হবে কি না, জানি না! যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে এত সংশয় কোথায় তা-ও বুঝি না। নাকি রাজনীতির নামে এও এক প্রহসন? এই স্বাধীনতাবিরোধী, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করা হায়েনাদের যখন টেলিভিশনের পর্দায় দেখি, গা গুলিয়ে আসে। ওদের দেখলে কেন মনে হয় ওরা জানে ওদের শাস্তি হবে না! কে দেবে আমার এত সব প্রশ্নের উত্তর? নিজেকে প্রশ্ন করতে বাধ্য হই বেঁচে আছি তো? নাকি কোনো এক ‘পাপেট শো’র পাপেট আমরা?
১৯৭১ থেকে ২০১১—স্বাধীনতার ৪০ বছর। তোমার, তোমাদের চলে যাওয়ার ৪০ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে না পেরেছি তোমাদের রক্তে স্বাধীন করা দেশটার স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখতে, না পেরেছি তোমাদের খুনিদের শাস্তি দিতে। আজকের এই দিনে শুধু চিৎকার করে একটি মাত্র তীব্র ইচ্ছা জানাই—এই দেশের সরকার, বিরোধী দল থেকে শুরু করে প্রতিটি মানুষের কাছে আমার এই অনুরোধ—এই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করা মানুষগুলোর যেন শাস্তি হয়। কামনা করি, আমাদের দেশের, আমার মতো বাকি সব অক্ষম, অপদার্থগুলোর যেন সংবিৎ ফেরে!
মামা, তোমরা কি এখনো সেই দূর থেকে চেয়ে আছ? অপেক্ষা করছ? ভাবছ, এই বুঝি কালরাত্রির শেষ হলো? কোনো এক অন্ধকার সময়ের অতল গহ্বর থেকে হঠাৎ জন্ম নেবে কোনো এক ‘স্পার্টাকাস’ বা তোমাদের মতোই আরেকজন, মাশুকুর রহমান তোজো, পরিবর্তিত এই সময়ের, এই দাসত্বের বেড়াজাল ছিন্নভিন্ন করে, রৌদ্রোজ্জ্বল কোনো এক সকাল দেখাবে আমাদের। আমরাও অধীর অপেক্ষা করছি মামা, চুপি চুপি, দুরু দুরু বুকে ছোট্ট কোনো এক আশার ঢিমেতালে জ্বলা প্রদীপটি এখনো বলে চলেছে—পরিবর্তন হবে, কোনো এক উদ্ভাসিত আলোয় কেটে যাবে নিকষ কালো অন্ধকার, সব জঞ্জাল-কালিমা মুছে নতুন করে শুরু করতে, আসবে কোনো এক দেবদূত, অতলে হারিয়ে যাওয়া ঘুমন্ত এই জাতিকে জাগিয়ে তুলতে চিৎকার করে বলবে—জাগো বাহে, কোনঠে সবায়।
সোহানা নূর
No comments