রজনীগন্ধার চাষাবাদ by আলমগীর সাত্তার

মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করব বলে একাত্তর সালের মে মাসে আমি গিয়ে উপস্থিত হলাম আগরতলায়। ওখানে গিয়ে তিন-চার দিন ছিলাম ওখানকার শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সুজিৎদের বাসায়। ওই সময় একদিন গেলাম সিটিটিআই অর্থাৎ ক্রাফটস টিচারস ট্রেনিং ইন্সটিটিউটের প্রিন্সিপাল নন্দীবাবুর সঙ্গে দেখা করতে। তিনি ছিলেন আমাদের সেক্টর কমান্ডার সিআর দত্তের সম্পর্কে মামা।
প্রিন্সিপাল নন্দীবাবু আমাকে সিটিটিআই-এর মূল ভবনের দোতলায় থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। ওখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য বড় একটি হলঘর ছিল। নন্দীবাবু বললেন, আপনাকে এই হলঘরেই থাকতে হবে। পাশেই ছিল ইন্সটিটিউটের বিশাল লাইব্রেরি ঘর। সংলঘ্ন ছিল খুব পরিচ্ছন্ন বাথরুম। কাছেই ক্রাফটস ইন্সটিটিউটের হোস্টেলে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেমেয়েরা অবস্থান করছিল এবং তারা নিজেদের জন্য একটি মেস পরিচালনা করছিল। আমার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হল ওখানেই।
আমার থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা মোটামুটি ভালো হওয়ার পরও একটা সমস্যা রয়ে গেল। তা হল, আমার তো কোনো বিছানাপত্র ছিল না। তা তো থাকার কথাও ছিল না। যুদ্ধ করতে ভারতে গিয়েছি, সঙ্গে তো কাঁথা-বালিশ নিয়ে যাওয়ার কথা নয়। বিশাল হলঘরের পাখার নিচে দুটি বেঞ্চ একত্র করে ঘুমানোর ব্যবস্থা করেছিলাম। শুধু কাঠের বেঞ্চের ওপর বিছানা ছাড়া ঘুুমাতে অভ্যস্ত না হওয়ায় ব্যাপারটা আমার জন্য কষ্টকরই ছিল।
ক্রাফটস ইন্সটিটিউটে যাওয়ার দুই দিন পর সকাল ১০টার দিকে নন্দীবাবু আমাকে তার অফিসে ডেকে পাঠালেন। ওই অফিসে গিয়ে দেখলাম, নন্দীবাবুর সামনের চেয়ারে বসা ৩০-৩২ বছর বয়সের সুন্দরী এবং সম্ভ্রান্ত একজন মহিলাকে। প্রিন্সিপাল নন্দীবাবু আলাপ করিয়ে দিলেন। তিনি ছিলেন ত্রিপুরা রাজ্যের লেফটেন্যান্ট গভর্নর মি. ডায়াসের স্ত্রী, মিসেস ডায়াস। কিছুক্ষণের আলাপচারিতার পর মিসেস ডায়াস নন্দীবাবুকে সঙ্গে নিয়ে আমার থাকার ব্যবস্থা দেখতে এলেন।
বিছানা ছাড়া শুধু খালি বেঞ্চের ওপর আমার শয়নের ব্যবস্থা দেখে মিসেস ডায়াস দয়াপরবশ হয়ে বললেন, গভর্নর হাউসে ফিরে গিয়ে তিনি আমার জন্য কিছু কম্বল এবং বিছানার চাদর পাঠিয়ে দেবেন। দেখলাম, দয়াশীল মহিলা তার কথা রেখেছেন। দুই ঘণ্টার মধ্যেই তিনি একখানা জিপ গাড়িতে ১০-১২টা কম্বল এবং বেশ কিছু নতুন এবং পুরনো বিছানার চাদর পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আসলে এগুলো ছিল গভর্নর হাউসের গার্ডদের জন্য নির্দিষ্ট।
কম্বল এবং চাদরগুলো পেয়ে আমার ঘুমানোর কষ্ট দূর হল। বেঞ্চ দুটি সরিয়ে কম্বল এবং তার ওপর চাদর বিছিয়ে সুন্দরভাবে বিছানা প্রস্তুত করলাম। বিছানাটা সুন্দর হলেও একটি জিনিসের অভাব রয়ে গেল। বিছানায় শুয়ে মাথায় দেয়ার জন্য কোনো বালিশ ছিল না। মনে মনে ভাবলাম, যা পেয়েছি তাতেই খুশি হওয়া উচিত।
এর একদিন পর হল ঘর সংলগ্ন লাইব্রেরি ঘরে বসে দুপুরের পর বই পড়ছিলাম। ওই লাইব্রেরিতে তিন-চারটা দৈনিক পত্রিকা রাখা হতো। ওখানে বেশ বড়মাপের একটা রেডিওও ছিল।
আমি লাইব্রেরি ঘরে বসে সমরেশ বসুর লেখা ‘বিবর’ নামের উপন্যাসখানা পড়ছিলাম। আমি ওই লেখকের তেমন ভক্ত না। যেহেতু একাত্তর সালের দিকে বইখানা খুব বিতর্কিত এবং আলোচিত ছিল, তাই অনেকটা কৌতূহলের বশে পড়ে দেখছিলাম, বইখানায় এমন কি লেখা হয়েছে, যা নিয়ে এমন বিতর্ক? বইখানার বিষয়বস্তু নাকি অশ্লীলতার দোষে দুষ্ট! বইখানা পড়ে আমার কিন্তু তেমন একটা অশ্লীল বলে কিছু মনে হয়নি। আমরা প্রকৃতির নিয়মে দৈনন্দিন যা করি, অথবা সৃষ্টির বহমানতা রক্ষার্থে যা কিছু ঘটে সেসবের ইঙ্গিত করে কিছু লেখা হয়েছে। আর এতেই বইখানার বক্তব্য অশ্লীল হয়ে গেল!
যাক এসব কথা। বইখানা যখন পড়ছিলাম, তখন লাইব্রেরি ঘরে একজন মহিলা প্রবেশ করল। এর আগেও একাধিকবার তাকে ইন্সটিটিউট ভবনে দেখেছি। দেখতে অতি সাধারণ মানের চেয়ে বেশি সুন্দরী না। তবে খুব খারাপও না। চেহারা অবশ্য ছিল বুদ্ধিদীপ্ত। বয়সটা ৩০-৩২ হওয়ায় তার দেহখানায় পরিপূর্ণতা ছিল। একাত্তর সালের দিকে এবং পরবর্তী সময়ের পর বেশ কিছু দিন ভারতীয় এমনকি বাংলাদেশী মেয়েদের মাঝে হাতাকাটা ব্লাউজ এবং অজন্তা স্টাইলে শাড়ি পরার খুব প্রচলন ছিল। অজন্তা স্টাইলে শাড়ি পরার ধরনটা হল- ব্লাউজ বেশ খাটো, গলার দিকটা বড় অর্থাৎ লোকাট এবং শাড়ি পরতে হবে কোমরের ঢাল বেয়ে নিচু করে। অর্থাৎ শরীরের মধ্যভাগ হবে অনেকখানি দৃশ্যমান। আসলে সে যুগে অজন্তাগুহার নারীদের ছবিগুলো আঁকা হয়েছিল, তখনকার সময় ভারতীয় নারীদের মাঝে ব্লাউজ পরার প্রথা ছিল না। প্রথা ছিল সুদৃশ্য বক্ষবন্ধনীর ব্যবহার। আগত ভদ্রমহিলা হাতাকাটা ব্লাউজ এবং অজন্তা স্টাইলে শাড়ি পরেছিলেন।
আগন্তুক ভদ্রমহিলা লাইব্রেরিয়ানকে প্রশ্ন করলেন, ‘বিবর’ বইখানা পাওয়া যাবে কিনা? ‘বিবর’ বইখানার তখন জনপ্রিয়তা এমন ছিল যে, কেউ ওটা পড়ে লাইব্রেরিতে ফেরত দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্য কেউ নিয়ে যেত। ভদ্রমহিলার প্রশ্ন শুনে লাইব্রেরিয়ান আমাকে দেখিয়ে তাকে বললেন, বইখানা আমারই হাতে এবং আমি পড়ছি। আমি বললাম, আজ বইখানা পড়ে কালই লাইব্রেরিতে ফেরত দেব। এটাই তার সঙ্গে আমার প্রথম বলা কথা।
বারবার ভদ্রমহিলা, ভদ্রমহিলা না বলে আমি তার একটা নাম দিচ্ছি। বাস্তব চরিত্র বলেই সত্যিকারের নামের পরিবর্তে অন্য একটি নাম দিচ্ছি। কিন্তু পদবিটা ঠিক রাখছি। মনে করা যাক, তার নাম আতসী বিশ্বাস।
বিকেল তখন চারটে বা সাড়ে চারটে বাজে। লাইব্রেরিয়ান ভদ্রলোক সব বইয়ের আলমারি তালা দিয়ে বন্ধ করে চলে গেলেন। আমি আতসী বিশ্বাসকে বললাম, ‘বিবর’ বইখানা চাইলে আপনি এখনই নিয়ে যেতে পারেন।
তিনি বললেন, না, আগে আপনি পড়ুন, তারপর বইখানা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন শুনব।
কথা বলতে বলতে আতসী বিশ্বাস আমার সঙ্গে থিয়েটার হলঘরে চলে এলেন। আমার বিছানার ওপর বসে বাংলা সাহিত্য নিয়ে অনেক কথা বললেন। দেখলাম, সাহিত্য সম্পর্কে তার জ্ঞান আমার চেয়ে অনেক বেশি। আমি কেবল রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্রের লেখা বইগুলো পড়েছি। ইংরেজিতে অনুবাদ করা কিছু রুশ সাহিত্যও পড়েছি। কিন্তু বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে তার পড়াশোনার ব্যাপকতা অনেক বেশি। চলে যাওয়ার আগে আতসী বিশ্বাস আমার কম্বল ও চাদরের বিছানা দেখিয়ে প্রশ্ন করলেন, আপনার মাথায় দেয়ার বালিশ নেই? বললাম, বিছানার কম্বল ও চাদরগুলো তো মিসেস ডায়াস পাঠিয়েছেন। বালিশের কথা হয়তো তার মনে ছিল না!
দুই দিন পর আবার আতসী বিশ্বাসের দেখা পেলাম। তিনি হাতে দুটো বালিশ নিয়ে এসে বললেন, সিটিটিআই-এর পক্ষ থেকে আপনাকে উপহার দেয়া হল। প্রশ্ন করলাম, সিটিটিআই-এর পক্ষ থেকে, না আপনার পক্ষ থেকে এ উপহার! বললেন, প্রিন্সিপাল নন্দীবাবুর অনুমতি নিয়েই আমি তৈরি করেছি।
একটু রসিকতা করে প্রশ্ন করলাম, আমি মানুষ একটা। একটা বালিশ হলেই চলত। তবে দুটি কেন? আতসী বিশ্বাসও একটু দুষ্টমির হাসি হেসে বললেন, এখন আরেকজন জোগাড় করার চেষ্টা করুন।
আতসী বিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ভবনের নিচের তলায় সিটিটিআই-এর অ্যাকাউন্ট্যান্ট রঞ্জিৎ বিশ্বাসের অফিসে গেলাম। যুদ্ধকালীন সময় বলে সিটিটিআই-এর শিক্ষা-কার্যক্রম বন্ধ ছিল। কিন্তু শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রী এবং অফিসের লোকজন নিয়মিত হাজিরা দিতেন।
২.
রঞ্জিৎ বিশ্বাস আমাদের জন্য চা-বিস্কুটের ব্যবস্থা করলেন। চা-পান শেষ হলে আতসী বিশ্বাস উঠে তার বিভাগে চলে গেলেন।
আতসী বিশ্বাস যখন চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে যাচ্ছিলেন, তখন তার দিকে আমি তাকিয়ে ছিলাম। আতসীর বয়স ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যেই হবে। আমারই সমবয়সী হবেন। আমার তখন বয়স ছিল ৩২ বছর। কোনো এক বিখ্যাত লেখক লিখেছেন, ‘ফেমিনিন বিউটি ইজ মেনি সাইডেড’। কোনো কোনো মহিলাকে সামনের দিক থেকে দেখলে ভালো লাগে, আবার কাউকে কাউকে পেছন থেকে দেখলে ভালো লাগে। আতসী বিশ্বাসকে পেছন থেকে দেখেই ভালো লাগল বেশি।
আতসী বিশ্বাস চলে যাওয়ার পর রঞ্জিৎ বিশ্বাস তার সম্পর্কে অনেক কথাই বললেন। বললেন, ভদ্রমহিলা মানুষ হিসেবে বেশ ভালো। কিন্তু তার ভাগ্যটা তেমন ভালো না। বললেন, আতসীর বিবাহিত জীবনের কথা। বললেন, ১০-১২ বছর আগে আতসীর বিয়ে হয়। তার স্বামী আগরতলায় একটি কো-অপারেটিভ ব্যাংকে চাকরি করেন। বিয়ের পাঁচ-ছয় বছর পরেও তার কোনো সন্তান-সন্ততি হয়নি। ওই ছুঁতো ধরে স্বামী আরও একটি বিয়ে করেন সেই পাঁচ-ছয় বছর আগে। দ্বিতীয় বিয়ে করায় আতসী স্বামীকে পরিত্যাগ করে চলে আসেন। এখন থাকেন ভাইয়ের বাসায়। ডিভোর্স হয়নি, কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই। আরও মজার বিষয় হল, দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভেও স্বামী ভদ্রলোকের কোনো সন্তান হয়নি।
আমি বললাম, তাহলে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, স্বামী ভদ্রলোকই সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম।
রঞ্জিৎ দা এরপর বললেন, ভদ্রলোকের দ্বিতীয় স্ত্রীও তাকে ছেড়ে চলে গেছেন। স্বামী এখন আবার আতসীকে ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছেন। কিন্তু স্বামীর কাছে আতসী আর ফিরে যেতে রাজি নয়। যে স্বামী তাকে কোনো সন্তান দিতে পারবেন না, তার কাছে ফিরে যাবে কেন? আমাদের দেশের সামাজিক নিয়মের কারণে সে স্বামীকে ডিভোর্স করছে না। স্বামী আছে, থাক, তার কাছে কোনো দায়বদ্ধতা নেই। এমন অবস্থাটা তো বেশ ভালোই।
বিকাল বেলা লাইব্রেরি ঘরে বসে পত্রিকা পড়ছিলাম। ৫টা বোধ হয় তখন বাজে। আতসী বিশ্বাস এলেন। তাকে ‘বিবর’ বইখানা দিলাম। তিনি প্রশ্ন করলেন, কেমন লাগল বইখানা? বললাম, ভালো লাগেনি।
কেন? বলে আতসী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বললাম, অশ্লীলতার কারণে নয়। অমন বিখ্যাত লেখক! কিন্তু ‘বিবর’ বইয়ের ভাষার মাঝে কেমন যেন একটা চালিয়াতি ভাব আছে। তবে একটা কথা খুব ভালো লেগেছে, ‘ভালোবাসা’ কাকে বলে? যে বাসায় ভালো টয়লেট আছে। বেশ এই পর্যন্ত! আমার কথা শুনে তিনি বেশ হাসলেন।
আতসী বিশ্বাস জিজ্ঞেস করলেন, চা খাবেন? বললাম, প্রস্তাবটা খারাপ নয়। বিকাল বেলায় এক কাপ চা পেলে আমি খুশি হব সন্দেহ নেই। আলসেমির জন্য দোকানে গিয়ে চা-পান করা হয়নি।
রঞ্জিৎ বাবুর ওখানে চায়ের সব সরঞ্জাম আছে। তাই তার অফিসে গেলাম। কিন্তু দেখলাম, তিনি বাসায় চলে গেছেন। তখন আমি আতসীকে প্রস্তাব করলাম, চলুন তাহা বাবুর বাসায় যাই।
তাহা বাবুর বাড়ি পশ্চিম বাংলায়। তিনিও ছিলেন ক্রাফটস ইন্সটিটিউশনের শিক্ষক। ছেলেমেয়ের পড়াশোনার ব্যাঘাত হবে বলে তার পরিবার-পরিজন থাকত পশ্চিম বাংলার বাড়িতে। তাহা বাবু ছিলেন মুসলমান। তার বাসাটা ছিল ইন্সটিটিউটের বাইরে কিন্তু প্রাচীর সংলগ্ন। তার বাসাটা ছিল খুবই সুন্দর বাংলো প্যাটার্নের। সামনে ছিল বিশাল পুকুর। আর পুকুরের চারপাশে ছিল নারিকেল, সুপারি, আম-কাঁঠালের বাগান। তাহা বাবু ছিলেন অত্যন্ত ভালো মানুষ।
তাহা বাবুর বাসায় চা খেতে যাওয়ার প্রস্তাবে আতসী খুশি মনেই রাজি হয়ে গেলেন। তিনি চললেন আগে আগে আর আমি পেছনে পেছনে। আমি আগেই বলেছি, আতসী বিশ্বাসকে পেছন থেকে দেখতেই বেশি ভালো লাগে। তাই আমি তার পেছনেই হাঁটছিলাম।
মেয়েদের সৌন্দর্য বিচার করা একটু কঠিন ব্যাপারই বটে। এ প্রসঙ্গে আমি জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রকর রেমব্রান্টের কথা একটু উল্লেখ করতে চাই।
সপ্তদশ শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পী রেমব্রান্ট ৩০ বছর বয়সেই খ্যাতির মধ্যগগনে পৌঁছান। ১৬৩৪ সালে তিনি প্রেম করে সাসকিয়া আলেনবুর্গ নামের খুব সুন্দরী এবং ধনবতী ২০ বছর বয়সের এক মহিলাকে বিয়ে করেন। বিয়ের সাত বছর পরই যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে সাসকিয়া মারা যান। ইতিমধ্যে সাসকিয়ার গর্ভে চারটি সন্তান হয়। এদের মধ্যে টিটুস নামের পুত্র সন্তানটি কেবল বেঁচে ছিল।
শিশুপুত্র টিটুসকে দেখাশোনা করার জন্য প্রথমে ডিরিক্স নামের এক মহিলাকে নিযুক্ত করা হয়। তারপর গৃহকর্মের জন্য এবং টিটুসকে দেখাশোনা করার জন্য হেন্ড্রিকিয়া নামের এক মহিলাকে নিয়োগ দেন রেমব্রান্ট।
অতি সাধারণ ঘরের মেয়ে হেন্ড্রিকিয়াই রেমব্রান্টের মনজয় করে নেন। হেন্ড্রিকিয়ার বয়স ছিল প্রায় ৪০ বছর এবং ছিলেন বেশ মোটাসোটা। সুন্দরী তাকে অবশ্যই বলা যায় না। অভিজাত ঘরের ধনবতী কন্যা সাসকিয়াকে মডেল করে রেমব্রান্ট কয়েকখানা ডেকোরেটিভ ধরনের ছবি এঁকে ছিলেন। কিন্তু অতি বিখ্যাত এবং নগ্ন চিত্রগুলো, যেমন ‘বাথশেবা উইল কিং ডেভিডস লেটার, ওমম্যান বেইজিং’ এসব ছবি এঁকেছিলেন হেন্ড্রিকিয়াকে মডেল করে।
রেমব্রান্ট হেন্ডিকিয়াকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছিলেন, কিন্তু বিয়ে করতে পারেননি। সাসকিয়া মৃত্যুর আগে উইল করে গিয়েছিলেন যে, তার মৃত্যুর পর বিয়ে করলে রেমব্রান্ট সাসকিয়ার সহায় সম্পত্তির উত্তরাধিকারিত্ব থেকে বঞ্চিত হবেন। হেন্ড্রিকিয়ার গর্ভে রেমব্রান্টের একটি মেয়ে সন্তান জন্ম নেয়। তিনি তার নাম রেখেছিলেন কর্নেলিয়া। রেমব্রান্টের মায়ের নামও ছিল কর্নেলিয়া।
রেমব্রান্টের মতো খ্যাতিমান মানুষ অভিজাত ঘরের যে কোনো সুন্দরীকে বিয়ে করতে পারতেন। অথচ তিনি তার মনপ্রাণ সঁপে দিয়েছিলেন ঘরের কাজের মেয়েকে, যে কিনা আবার তেমন সুন্দরীও ছিলেন না। আসলেই মেয়েদের সৌন্দর্য ‘মেনি সাইডেড’। কে কার মনকে উদ্দীপ্ত করতে পারে সেটাই হল আসল কথা।
তাহা বাবুর বাসায় গেলাম যখন তিনি তখন বেশ খুশিমনে আমাদের আপ্যায়ন করলেন। টোস্ট বিস্কুট সহকারে চা পান করলাম। এরপর আমরা গল্প করছিলাম। খুব তাড়াতাড়ি সময় পেরিয়ে গেল। তখন রাত ৮টা বাজে। আমি বললাম, এবার তো আমার যেতে হবে। ছাত্র ইউনিয়নের হোস্টেলে পঙ্কজ ভট্টাচার্য খুব সুরালো কণ্ঠে এখনই ডাক দেবেন, আপনারা খেতে আসুন। সময়মতো না পৌঁছলে রাতটা আমাকে উপোষ করে কাটাতে হবে। এই বলে আমি ইন্সটিটিউট ভবনের দিকে চললাম। আতসী বিশ্বাস চলে গেলেন তার বাসায়।
রাতে খেয়েদেয়ে এসে ক্র্যাফটস ভবনের সিঁড়ির ওপর বসলাম। রাত তখন ১০টা হবে। ক্র্যাফটস ভবন তখন খুব নির্জন। অন্ধকার রাতে আকাশের তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হল, আজ যেন তারা-নক্ষত্র সব বেশি উজ্জ্বল। ভাবছিলাম, গ্রহ-নক্ষত্র না-কি মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে। মনে মনে বললাম- হে, গ্রহ-তারা, তোমরা আমার ভাগ্যে কী নির্ধারণ করেছ, তা তো আমার জানা নেই। আমি বর্বর পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছি। আতসী বিশ্বাস, বিজন বাবুর শালি বা অমন কারও সঙ্গে প্রেম করতে আসিনি। আজ সকাল বেলায় দুই নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ডা. সুজিৎদের বাসায়।
আমি খালেদ মোশাররফকে অনুরোধ করলাম, আমাকে কলকাতায় যাওয়ার একটা ব্যবস্থা করে দেন। আমাকে কিন্তু একখানা পরিচয়পত্রও লিখে দিতে হবে। কলকাতায় গিয়ে আমি চলে যাব পলাশী নামের স্থানে। ওখানে নৌ-কমান্ডোদের প্রথম ব্যাচের ট্রেনিং শুরু হয়েছে। আমি সাঁতারে খুবই দক্ষ। বরিশালের মানুষ। খুব খরসে াতা নদীতেও দুই-তিন মাইল সাঁতারে আমার কষ্ট হয় না।
ছিলাম পিআইএ-এর পাইলট। সারাটা দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা হোটেলের সুইমিংপুলে সাঁতার কাটতাম। পলাশীর নৌকমান্ডো ট্রেনিং সেন্টারে গিয়ে পরিচয় দিলে ক্যাম্প কমান্ডার সহজেই আমাকে দলভুক্ত করে নেবেন বলেই আমার বিশ্বাস। প্রথম ব্যাচে সুযোগ না পেলে দ্বিতীয় ব্যাচে ট্রেনিং করব।
খালেদ মোশাররফ বললেন, শুনেছি, মুক্তিবাহিনী এয়ারফোর্স গঠিত হতে যাচ্ছে। তা গঠিত হলে ওই এয়ারফোর্সের পাইলট হিসেবে তুমি বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। এসব কথা চিন্তা করতে করতে গিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।
পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্ট করলাম, রাস্তার পাড়ের একটি রেস্তরাঁয়। দুপুরের কিছু আগে গেলাম ছাত্র ইউনিয়নের হোস্টেলে। ওইদিন বেলা ১০টার দিকে কোনো একটি বিদেশী সাহায্য সংস্থা হোস্টেলের ছেলেমেয়েদের মাঝে বেশ কিছু কাপড়-চোপড় বিতরণ করেছে। হোস্টেলের কেউ একজন সাহায্য সংস্থার লোকদের কাছ থেকে আমার জন্য একটি ট্রাউজার এবং একখানা ধুতি চেয়ে রেখেছিল। আমার জন্য যে শুভাকাক্সক্ষী ওগুলো চেয়ে রেখেছিল, তার নামটা আজ আর মনে করতে পারছি না।
আমার আস্তানায় ফিরে এসে ট্রাউজারটা পরে দেখলাম, আমার এমনভাবে ফিটিং হয়েছে যে, ভালো দর্জিও অমন করে আমার জন্য ট্রাউজার তৈরি করে দিতে পারত না। এবার ধুতি পরার পালা। ধুতি পরতে আমি অভ্যস্ত ছিলাম না। তাই গেলাম রঞ্জিৎ বাবুর কাছে। তিনি আমাকে ধুতি পরার কৌশল শিখিয়ে দিলেন। দুই-তিনবার ট্রায়াল দিয়ে কৌশলটা রপ্ত করে নিলাম।
যুদ্ধ করার জন্য ভারতে গেলেও সঙ্গে আমার অন্যান্য জামাকাপড়ের সঙ্গে গরদের একটি পাঞ্জাবিও ছিল। ধুতি এবং গরদের পাঞ্জাবি পরে নিজের কাছেই নিজেকে মনে হল ভালো মানিয়েছে। তবে ধুতি এবং পাঞ্জাবির সঙ্গে এমন জুতা খুব মানানসই নয়। এ কথা চিন্তা করে রিকশা নিয়ে গেলাম আগরতলার কামান চৌমোহনীতে। ওখানকার জুতার দোকান থেকে একজোড়া স্যান্ডেল কিনলাম।
দুপুরবেলা ছাত্র ইউনিয়নের হোস্টেল থেকে খেয়েদেয়ে এসে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে এসে রঞ্জিৎ বাবুর অফিসে গেলাম। অল্প সময় পরেই সেখানে আতসী বিশ্বাস এলেন। তিনি আমার বেশভূষা দেখে খুব তারিফ করে বললেন, বাহ, বেশ মানিয়েছে। তিনি বললেন, এবার আর আপনাকে শরণার্থী মনে হয় না, মনে হয় এপার বাংলার কোনো অভিজাত ঘরের মানুষ। আমি প্রতিবাদ করে বললাম, আমি শরণার্থী নয়। আমি এসেছি যুদ্ধ করতে। কয়েক দিনের মধ্যে যুদ্ধক্ষেত্রে হবে আমার স্থান। মুক্তিযোদ্ধাদের শরণার্থী কেউ বলে না। আমার কথা শুনে বেশ রসিকতা করে আতসী গান গাইলেন :
‘যাবার আগে যাওগে আমায় জাগিয়ে দিয়ে,
রক্তে মোর চরণ-দোলা লাগিয়ে দিয়ে।’
বিকাল চারটে বাজে। রঞ্জিৎ বাবু চা পরিবেশন করলেন। তারপর আরও কিছুক্ষণ গল্প করলাম। বিকাল ৫টায় রঞ্জিৎ বাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে বললেন এবার তিনি বাসায় যাবেন। আতসীও বললেন, তিনিও এবার বাসায় যাবেন। আমি প্রশ্ন করলাম, আপনার বাসা কোথায়?
তিনি বললেন, বেশ কাছেই। ক্রাফটস ভবনের গেট দিয়ে বেরিয়ে ডান দিকে যাবেন। ১০০ গজ পরেই ইন্সটিটিউটের হোস্টেল, আরও খানিকটা এগিয়ে গেলে রাস্তার শেষ মাথায় জেলখানার গেট। এবার বাম দিকের রাস্তা ধরে হাঁটলে পাঁচ মিনিট পরেই আমাদের বাসা।
আমি বললাম, প্রতিদিন সকাল-বিকাল আমি তো ওই দিকেই হাঁটতে যাই।
আমি এবং আতসী বিশ্বাস হাঁটতে হাঁটতে ওইদিকেই গেলাম। আমরা তাদের বাসা ছাড়িয়ে আরও কিছুটা দূরে গেলাম। ওখানে একটা টিলার মতো খানিকটা উঁচু জায়গা। তারপর বিস্তীর্ণ এলাকায় কৃষিভূমি। উঁচু জায়গাটায় আছে অনেক লিচু গাছ।
আমরা একটা লিচু গাছের নিচে বসে গল্প করছিলাম। লিচু গাছগুলো দেখিয়ে আতসীকে বললাম, আপনাকে একটা গল্প বলব, একটু মনোযোগ দিয়ে শুনবেন।
বললাম, গী দ্য মপাসাঁর লেখা একটা গল্পে পড়েছি, একবার তিনি প্যারিস থেকে বেশ দূরের একটি পাহাড়ি শহরে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ওখানে অবস্থান করার সময় তিনি পাহাড়ি উপত্যকা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটি গ্রামে গিয়ে পৌঁছলেন। তখন দেখলেন, ওখানকার কয়েকটি গ্রামে প্রচুর কাজুবাদামের গাছ। ওখানকার গ্রামের একজন মানুষকে তিনি প্রশ্ন করলেন, এ অঞ্চলে এত কাজুবাদামের গাছ কেন? লোকটি বলল, আমাদের গির্জার ধর্মযাজক খুব ভালো মানুষ। তিনি নিয়ম করে দিয়েছেন, গ্রামের কোনো মেয়ে বা ছেলে অবৈধ প্রেম করলে তার শাস্তি হল প্রেমিক-প্রেমিকা উভয়কে একটি করে কাজুবাদাম গাছের চারা রোপণ করতে হবে। আমাদের এখানকার মানুষ এত প্রেমিক বলে এত কাজুবাদামের গাছ দেখছেন।
গল্পটা বলে আতসী বিশ্বাসকে প্রশ্ন করলাম, আপনাদের এখানে কেউ অবৈধ প্রেম করলে কি তাকে লিচু গাছ রোপণ করতে হয়? নতুবা আগরতলায় এত লিচু গাছ দেখছি কেন?
বেশ সম্প্রতিভভাবেই আতসী উত্তর দিলেন- হ্যাঁ, আমাদের এখানে লিচু অথবা কাঁঠাল গাছের চারা রোপণ করতে হয়। দেখছেন না, এখানে কাঁঠাল গাছের সংখ্যাও কম না।
আমি বললাম, আসলে কাঁঠাল অথবা লিচু গাছ না লাগিয়ে রজনীগন্ধা ফুলের চারা রোপণ করা উচিত। রবিঠাকুর কিন্তু রজনীগন্ধা ফুলকে প্রেমের প্রতীক হিসেবে দেখতেন। তাই তার লেখায় তিনি বারবার রজনীগন্ধা ফুলের কথা লিখেছেন। আতসী বিশ্বাস আমার সঙ্গে একমত পোষণ করে বললেন, তাহলে রজনীগন্ধা ফুলের চাষাবাদ ভালোই হতো। মাত্র একদিন পরের কথা। দিনটা ছিল শনিবার। বিকাল বেলা, ভারতীয় সামরিক বাহিনীর একজন মেজর পদমর্যাদার অফিসার ক্রাফটস ভবন অফিসে এসে আমাকে বললেন, আগামী দিন দুপুর বেলায় ক্যাপ্টেন খালেক, ক্যাপ্টেন শাহাব উদ্দিন এবং আমাকে কোথাও যেতে হবে। পরের দিন ঠিক বেলা ২টায় তিনি আমাদের নিতে আসবেন। পরের দিন ঠিক সময়মতো মেজর সাহেব একখানা জিপ গাড়ি নিয়ে এলেন। আমরা তার সঙ্গে আগরতলা বিমানবন্দরে গেলাম। তারপর ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সে করে গেলাম কলকাতা। সেখান থেকে দিল্লি। শেষ পর্যন্ত গন্তব্য হল নাগাল্যান্ডের রাজধানী ডিমাপুর। শুরু হল আকাশ যুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রশিক্ষণ। হতে চেয়েছিলাম, জলযুদ্ধের নৌকমান্ডো। কিন্তু গ্রহ-নক্ষত্র নির্দিষ্ট করে রেখেছিল, আমাকে হতে হবে আকাশ যুদ্ধের সৈনিক। যুদ্ধের ডামাডোলে ভুলে গেলাম রজনীগন্ধা ফুলের চাষাবাদের কথা।

No comments

Powered by Blogger.