মূক–বধিরের মতোই নিশ্চুপ আরব নেতারা
গাজা শহরের আল-শিফা হাসপাতালের বাইরে ইসরায়েলি হামলায় প্রিয়জন হারানো স্বজনদের আহাজারি। গতকাল তোলা ছবি। এএফপি |
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহতের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বিভিন্ন দেশের অগণিত সাধারণ মানুষ এ হামলার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ জানাচ্ছে। কিন্তু আরব নেতারা একেবারেই নিশ্চুপ। ইসরায়েলের রক্তাক্ত হামলা শুরুর তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও কার্যকর একটি যুদ্ধবিরতির উদ্যোগ নিতে পারেননি তাঁরা। নিউইয়র্ক টাইমস-এর এক বিশ্লেষণে এ কথা বলা হয়েছে। বিশ্লেষণের পর্যবেক্ষণ, আরব নেতাদের চুপ থাকার বিষয়টি আসলে মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডের পতনের পরই ঠিক হয়ে গেছে। ওই সময় থেকেই মূলত মিসর, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ও জর্ডান মিলে একটি বলয় তৈরি হয়েছে। এটি হলো রাজনৈতিক ইসলামি শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বলয়। এটি অবশ্যই ফিলিস্তিনের কট্টরপন্থী দল হামাসের বিরুদ্ধে গেছে। আর পক্ষে গেছে ইসরায়েলের। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক উইলসন সেন্টারের গবেষক অ্যারন ডেভিড মিলার বলেন, ইসলামি রাজনৈতিক শক্তির প্রতি আরব দেশগুলোর ভয় ও অনীহা এতই প্রবল যে এ শক্তির উত্থানকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর চেয়েও গুরুতর মনে করেন তাঁরা। মিলার বলেন, ‘আমি এ ধরনের পরিস্থিতি কখনো দেখিনি, যেখানে অনেক আরব দেশই গাজায় হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের জন্য বরং হামাসের দিকেই অভিযোগের আঙুল তুলছে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আরব নেতারা আসলে মূক-বধিরের মতো নীরবতা পালন করছেন।’ গাজায় এবারের ইসরায়েলি অভিযান শুরু হওয়ার পর মিসর যুদ্ধবিরতির উদ্যোগ নেয়।
ওই উদ্যোগের পর সৌদি বাদশাহ আবদুল্লাহ ফোন করেন মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির কাছে। সিসির কার্যালয় জানায়, বাদশাহ আবদুল্লাহ বলেছেন, গাজার বর্তমান পরিস্থিতির জন্য তিনি ইসরায়েলের কোনো দোষ দেখেননি। আবদুল্লাহ এ-ও বলেছেন, ‘সামরিক সংঘর্ষের ফলে সাধারণ ফিলিস্তিনিরা যে রক্তপাতের শিকার হচ্ছে, তার জন্য ওই ফিলিস্তিনিরা কোনোভাবেই দায়ী নয়।’ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ফেলো খালেদ এলিন্দি বলেন, বাদশাহ আবদুল্লাহর এ কৌশলগত বক্তব্যে ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদি আরবের সমমনা আরব দেশগুলোর অভিন্ন অবস্থানের কথাই প্রতিফলিত হয়েছে। যেখানে ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের স্বার্থ একই বিন্দুতে। খালেদ বলেন, আরব দেশগুলোর বর্তমান বলয়ের নেতৃত্বে থাকা মিসর যেমন রাজনৈতিক ইসলামি শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তেমনি ইসরায়েলও ফিলিস্তিনের ইসলামপন্থী কট্টর গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করছে। আর এখানেই ইসরায়েল ও আরব দেশগুলোর আপাত অভিন্ন অবস্থানের মূল বিষয়টি ফুটে উঠেছে। আরব বসন্তের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও ফিলিস্তিনের অনেক বিশ্লেষকই ধারণা করেছিলেন, এ বসন্ত আরব সরকারগুলোকে নিজ নিজ জনগণের প্রতি আরও দায়বদ্ধ ও জবাবদিহিমূলক করবে, যা ফিলিস্তিনিদের প্রতি আরও সহানুভূতিমূলক ও ইসরায়েলের প্রতি কঠোর অবস্থান নিতে সরকারগুলোকে বাধ্য করবে। কিন্তু মিসরে আরব বসন্তের পরে ক্ষমতায় আসা মুসলিম ব্রাদারহুডের পতনের পর সেই সমীকরণও যেন পাল্টে যায়। মিসরের নেতৃত্বে নতুন বলয় সৃষ্টি হওয়ায় ইসরায়েল নিঃসঙ্গ না হয়ে বরং ফিলিস্তিনের কট্টরপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আরব দেশগুলোর মৌন সমর্থন পাচ্ছে।
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় হতাহত ও ধ্বংসযজ্ঞের জন্য মিসরের কর্মকর্তারাও হামাসকেই দায়ী করছেন। গাজায় খাদ্য ও চিকিৎসা সরঞ্জামের প্রকট অভাব সত্ত্বেও সিসি সরকার মিসর ও গাজার সঙ্গে যোগাযোগের অবৈধ সুড়ঙ্গগুলো বন্ধ করে রেখেছে। বন্ধ করে দিয়েছে সীমান্ত ক্রসিংও। গাজার উত্তরাঞ্চলীয় শহর বেইত লাহিয়ার বাসিন্দা সালহান আল-হিরিস বলেন, ‘সিসি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর চেয়ে খারাপ। মিসর আমাদের বিরুদ্ধে ইহুদিদের চেয়েও জঘন্য ষড়যন্ত্র করছে। সিসি সরকার মিসরে ব্রাদারহুডকে ধ্বংস করছে, এখন হামাসের বিরুদ্ধে লেগেছে।’ ইসরায়েলের সঙ্গে মিসর, সৌদি আরব ও পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর সমমনা অবস্থান সৃষ্টি হওয়ার আরেকটি কারণ হলো ইরানবিরোধী মনোভাব। এই ইরানের বিরুদ্ধে হামাসকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করার অভিযোগ রয়েছে। মিসর শুরুতেই যুদ্ধবিরতির যে প্রস্তাব দিয়েছিল, তা নিয়ে হামাসের সঙ্গে আলোচনা এখনো চলছে বলে খবর রয়েছে। মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক ও মোহাম্মদ মুরসির সময়ে যে আলোচকেরা বিভিন্ন সময়ে হামাসের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন, তাঁরাই এ আলোচনা এগিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তা কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। জেরুজালেমভিত্তিক সালেম কলেজের প্রধান মার্টিন ক্রামার বলেন, মিসরের বর্তমান সরকার এবং সৌদির সমমনা আরব দেশগুলো মনে করে, হামাসকে পরাজিত করতে হলে ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগ পোহাতেই হবে। কারণ তারা চায় না, হামাস ফিলিস্তিনে শক্তিশালী পক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাক।
No comments