সংলাপ? এজেন্ডা কী হবে? by আবদুল মান্নান
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ২০১১ সাল থেকে একটিমাত্র বিষয় ঘুরেফিরে এখনো আলোচনায় আসছে, আর তা হচ্ছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি এখনো তাদের সেই দাবি নিয়ে বেশ সোচ্চার। এমনকি ঈদের দিন দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিভিন্ন গণ্যমান্য ব্যক্তি আর দলীয় নেতা-কর্মীদের জন্য দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানেও তাঁর এই দাবির কথা পুনরুল্লেখ করতে ভোলেননি। তিনি সব সময় একই কথার পুনরাবৃত্তি করেন এবং তা হচ্ছে, এ মুহূর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাচন দিয়ে বর্তমান সরকারকে বিদায় নিতে হবে।
মানলাম, বর্তমান সরকার খুবই খারাপ সরকার কিন্তু এমন একটি অসাংবিধানিক ব্যবস্থায় যদি নির্বাচন হয়ও, বেগম জিয়া কীভাবে বুঝলেন, এই ‘খারাপ সরকার’ বিদায় হবে? নাকি তাঁর কাছে এমন কোনো গোপন তথ্য আছে, যা অন্য কারও জানা নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাংলাদেশ আবিষ্কার করেনি। কারণ, এমন ব্যবস্থার অধীনে সদ্য স্বাধীন অনেক দেশে ইতিপূর্বে নির্বাচন হয়েছে। তবে অন্য সব দেশে প্রচলিত সাংবিধানিক নিয়ম অনুযায়ী একটি বিদায়ী সরকারের অধীনেই পরবর্তী সংসদ বা রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়। ১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের আগে আন্দোলনরত তিন জোট এই মর্মে ঘোষণা করেছিল, একবার এরশাদের পতন হলে কমপক্ষে তিনটি নির্বাচন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে এবং সেই সরকারের রূপরেখা কী হবে, তা–ও তিন জোট তাদের রূপরেখায় বর্ণনা করেছিল।
১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এমন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বিএনপি এবং তাদের তখন অঘোষিত মিত্র জামায়াত বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনেই হওয়ার কথা ছিল কিন্তু ১৯৯৪ সালে মাগুরা উপনির্বাচনে বিএনপি ভয়াবহ কারচুপির আশ্রয় নিলে অন্যান্য রাজনৈতিক দল বুঝে ফেলে, বেগম জিয়ার সরকারের আমলে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাদের এই বিশ্বাস আরও পাকাপোক্ত হলো, যখন ১৯৯৫ সালে ঢাকা-১০ আসনে উপনির্বাচনের নামে খোদ রাজধানীতেই একটি নির্বাচনী তামাশার মাধ্যমে বেগম জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা মোসাদ্দেক আলী ফালুকে জেতানো হলো। অথচ এই দুটি নির্বাচন এসব তামাশার মাধ্যমে জেতার কোনো প্রয়োজন ছিল না। কারণ, এই দুই উপনির্বাচনে হারলেও বিএনপির কোনো ক্ষতিই ছিল না। এই দুই নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি গণদাবিতে পরিণত হয় এবং শেষমেশ অনেক টালবাহানা করে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি ভোটারবিহীন একদলীয় নির্বাচন করে বেগম জিয়া সংসদে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন।যেই সংসদে এই সংশোধনী পাস করা হয়, সেই সংসদে বঙ্গবন্ধুর খুনি আবদুর রশীদও সদস্য ছিলেন।
১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো সংসদ নির্বাচনটি এই সংশোধনীর আওতায় করা হয় কিন্তু এই প্রথম নির্বাচনটিও নির্ঝঞ্ঝাটে হয়েছিল বলা যাবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব পালনকালে অনেক বিতর্কিতভাবে সেনাপ্রধানের অগোচরে সেনাবাহিনীতে বিএনপির দলীয় রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস কিছু রদবদল করলে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরের পরিস্থিতি বেশ অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। অনেকে সামরিক অভ্যুত্থানেরও আশঙ্কা করেন। ত্রয়োদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সরকারের সব ক্ষমতা প্রধান উপদেষ্টার হাতে ন্যস্ত করলেও সেনাবাহিনীকে রাষ্ট্রপতির অধীনে রাখা হয়। হঠাৎ সেনাবাহিনীতে রদবদল, পুরো সেনাবাহিনীতে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার পর অনেকের কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে, সংবিধান সংশোধনের সময় একটি বদমতলবে সেনাবাহিনীকে রাষ্ট্রপতির অধীনে রাখার ব্যবস্থা হয়েছিল। কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্দলীয় থাকলেও রাষ্ট্রপতি তো দলীয়ই থাকবেন।
তবে সে–যাত্রায় জাতি একটি মহাসংকট থেকে নিস্তার পেয়েছিল সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের বিচক্ষণতা আর দূরদর্শিতার কারণে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারে ছিল এবং সময়মতো সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতিতে বিচারপতি লতিফুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। ২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমান সরকার গঠনের আগে থেকেই পুরো প্রশাসনকে তছনছ করা শুরু করেন এবং তাঁর সাথি হন প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু সাঈদ। সেই নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট বিজয়ী হয়। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বেগম জিয়ার মেয়াদকাল ছিল নানাভাবে দেশে এবং দেশের বাইরে আলোচিত-সমালোচিত। নির্বাচনে পরপরই দক্ষিণবঙ্গে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নেমে আসে এক ভয়াবহ দুর্যোগ। ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, উচ্ছেদ, খুন, জখম হয়ে ওঠে নিত্যদিনের ঘটনা। যার ফলে কয়েক হাজার মানুষ ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে অনেকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। বেগম জিয়ার জ্যেষ্ঠপুত্র তারেক রহমান হাওয়া ভবন থেকে চালু করেন একটি বিকল্প প্রশাসন। এই ভবনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে দেশের অর্থনীতিবিধ্বংসী দুর্নীতির এক ভয়াবহ বলয়। বাংলাদেশ হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের একটি অভয়ারণ্য আর অবৈধ অস্ত্র চোরাচালানের একটি নিরাপদ রুট। এসব অপকর্মের মচ্ছবে সরকার থাকে নির্বিকার।
২০০৬ সালের মেয়াদ শেষে পূর্বনির্ধারিত সংসদ নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই অনুষ্ঠেয় এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শুরু হয়ে যায় বিএনপি-জামায়াত জোটের ক্ষমতাকে আরও দীর্ঘায়িত করার নীলনকশা প্রণয়নের কাজ। যখন ২০০৪ সালে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা দুই বছর বাড়ানো হয়, যার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল বিএনপির পছন্দসই একজনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করা। অবশ্য পরবর্তীকালে সেই নির্ধারিত প্রধান বিচারপতি এই পদ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তাঁর সম্মান রক্ষা করেছিলেন। এ জন্য তাঁকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। ২০০৬ সালে কে হবেন প্রধান উপদেষ্টা, যখন এ নিয়ে সারা দেশে এক চরম অশান্তি আর রক্তক্ষরণ, তখন সবাইকে অবাক করে দিয়ে দলীয় রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজেই প্রধান উপদেষ্টা বনে যান। শুরু হয় আরেক সংকট, যার ফলে আসে এক-এগারো। ২০০৮ সালের নির্বাচনটিও একধরনের অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। কারণ, সংবিধানের বাধ্যবাধকতা ছিল এই রকম একটি সরকারের মেয়াদ ছয় মাস থাকবে, যা ছিল দুই বছর।
২০০৯ থেকে ২০১৩, এই মেয়াদে সংসদে বিরোধী দল ছিল বিএনপি-জামায়াত কিন্তু তারা তাদের আসন রক্ষার বাধ্যবাধকতার কারণ ছাড়া কখনো সংসদে উপস্থিত থাকেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেওয়ার জন্য বিএনপি-জামায়াত ২০১৩ সালে এত জানমালের ক্ষতি করল, তা তো সরকার নয়, দেশের সর্বোচ্চ আদালত সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে বাতিল করে দিয়েছেন। ১৯৯৯ সালে এম সলিম উল্লাহ নামের একজন আইনজীবী হাইকোর্টে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে চ্যালেঞ্জ করে একটি রিট মামলা করেন।মহামান্য আদালত দীর্ঘ শুনানির পর ২১-০৭-২০০৩ তারিখে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য সুপারিশ করেন। তখন বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায়। প্রকৃতপক্ষে ÿসংবিধানের (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬-এর আইনগত অবস্থান নিরূপণই এই মামলার একমাত্র বিচার্য বিষয় ছিল।২০১১ সালে দীর্ঘ শুনানি, অ্যামিকাস কিউরিদের মতামত ইত্যাদি বিবেচনাপূর্বক মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এই মর্মে ২০১২ সালে রায় প্রদান করেন এবং রায়ে বলেন, ‘তর্কিত সংবিধানের (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬-কে অসাংবিধানিক ও অবৈধ ঘোষণা করা হইল এবং ইহা অবশ্যই অবৈধ।’ এই ছিল মূল মামলার চূড়ান্ত আদেশ বা রায়। বাকি যা আছে তা হলো আদালতের পর্যবেক্ষণ বা মন্তব্য। পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ‘...তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সাময়িকভাবে শুধু পরবর্তী দুইটি সাধারণ নির্বাচনের ক্ষেত্রে থাকিবে কি না সে সম্বন্ধে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জনগণের প্রতিনিধি জাতীয় সংসদ লইতে পারে।’ জাতীয় সংসদ এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়নি এবং যেহেতু জাতীয় সংসদ সার্বভৌম, সেহেতু জাতীয় সংসদের ওপর বাইরের কারও খবরদারি চলে না। রায়ে আরও বলা হয়, জাতীয় সংসদ এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সেখান থেকে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের বাদ দেওয়া বাঞ্ছনীয়। মহামান্য আদালত পর্যবেক্ষণে আরও বলেন, বরং ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার শুধু জনগণের নির্বাচিত জাতীয় সংসদের সদস্যদের দ্বারা গঠিত হইতে পারে, কারণ, জনগণের সার্বভৌমত্ব ও ক্ষমতায়ন, গণতন্ত্র, প্রজাতান্ত্রিকতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের basic structure এবং এই রায়ে উক্ত বিষয়গুলির ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হইয়াছে।’
ওপরের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে বলে, বিএনপি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দাবিতে রাজনৈতিক অঙ্গন অস্থিতিশীল করতে হুমকি দেয়, বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেই ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তা যদি করার চেষ্টা করা হয় এবং তাকে কেন্দ্র করে অন্য আর একজন যদি আদালতের শরণাপন্ন হন, তাহলে কী হবে? আগের অবস্থায় ফিরতে হলে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। এর চেয়ে উন্নত কোনো উপায় দেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞদের জানা থাকলে তা জনগণের সঙ্গে শেয়ার করলে দেশের মানুষ উপকৃত হবেন। আর যদি বিএনপি এবং তার মিত্ররা আন্দোলনের নামে আবার দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, তাহলে সেই ভোগান্তি থেকে তারাও নিস্তার পাবে না। তারা সব সময় সংলাপের কথা বলে। কিন্তু সেই সংলাপের তো একটি অর্থবহ ও বাস্তবমুখী এজেন্ডা থাকতে হবে। শেখ হাসিনা বিগত সময়ে সংলাপের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। আর বিএনপি যদি সামনের নির্বাচনে অংশ নিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে নির্বাচন কমিশনে তাদের নিবন্ধন বাতিল হতে পারে। দেশে গণতন্ত্রের স্বার্থে একাধিক বিরোধী দল থাকাটা বাঞ্ছনীয়। দেশ ও জনগণের বিরুদ্ধে গিয়ে শেষ পর্যন্ত কারও লাভ নেই। কারও আগ্রহ থাকলে ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রায়ের ৩৮৮ পৃষ্ঠার বইটি বাজারে পাওয়া যায়। সংরক্ষণের জন্য একটি অসামান্য দলিল।
আবদুল মান্নান: বিশ্লেষক ও গবেষক।
মানলাম, বর্তমান সরকার খুবই খারাপ সরকার কিন্তু এমন একটি অসাংবিধানিক ব্যবস্থায় যদি নির্বাচন হয়ও, বেগম জিয়া কীভাবে বুঝলেন, এই ‘খারাপ সরকার’ বিদায় হবে? নাকি তাঁর কাছে এমন কোনো গোপন তথ্য আছে, যা অন্য কারও জানা নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাংলাদেশ আবিষ্কার করেনি। কারণ, এমন ব্যবস্থার অধীনে সদ্য স্বাধীন অনেক দেশে ইতিপূর্বে নির্বাচন হয়েছে। তবে অন্য সব দেশে প্রচলিত সাংবিধানিক নিয়ম অনুযায়ী একটি বিদায়ী সরকারের অধীনেই পরবর্তী সংসদ বা রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়। ১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের আগে আন্দোলনরত তিন জোট এই মর্মে ঘোষণা করেছিল, একবার এরশাদের পতন হলে কমপক্ষে তিনটি নির্বাচন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে এবং সেই সরকারের রূপরেখা কী হবে, তা–ও তিন জোট তাদের রূপরেখায় বর্ণনা করেছিল।
১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এমন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বিএনপি এবং তাদের তখন অঘোষিত মিত্র জামায়াত বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনেই হওয়ার কথা ছিল কিন্তু ১৯৯৪ সালে মাগুরা উপনির্বাচনে বিএনপি ভয়াবহ কারচুপির আশ্রয় নিলে অন্যান্য রাজনৈতিক দল বুঝে ফেলে, বেগম জিয়ার সরকারের আমলে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাদের এই বিশ্বাস আরও পাকাপোক্ত হলো, যখন ১৯৯৫ সালে ঢাকা-১০ আসনে উপনির্বাচনের নামে খোদ রাজধানীতেই একটি নির্বাচনী তামাশার মাধ্যমে বেগম জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা মোসাদ্দেক আলী ফালুকে জেতানো হলো। অথচ এই দুটি নির্বাচন এসব তামাশার মাধ্যমে জেতার কোনো প্রয়োজন ছিল না। কারণ, এই দুই উপনির্বাচনে হারলেও বিএনপির কোনো ক্ষতিই ছিল না। এই দুই নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি গণদাবিতে পরিণত হয় এবং শেষমেশ অনেক টালবাহানা করে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি ভোটারবিহীন একদলীয় নির্বাচন করে বেগম জিয়া সংসদে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন।যেই সংসদে এই সংশোধনী পাস করা হয়, সেই সংসদে বঙ্গবন্ধুর খুনি আবদুর রশীদও সদস্য ছিলেন।
১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো সংসদ নির্বাচনটি এই সংশোধনীর আওতায় করা হয় কিন্তু এই প্রথম নির্বাচনটিও নির্ঝঞ্ঝাটে হয়েছিল বলা যাবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব পালনকালে অনেক বিতর্কিতভাবে সেনাপ্রধানের অগোচরে সেনাবাহিনীতে বিএনপির দলীয় রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস কিছু রদবদল করলে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরের পরিস্থিতি বেশ অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। অনেকে সামরিক অভ্যুত্থানেরও আশঙ্কা করেন। ত্রয়োদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সরকারের সব ক্ষমতা প্রধান উপদেষ্টার হাতে ন্যস্ত করলেও সেনাবাহিনীকে রাষ্ট্রপতির অধীনে রাখা হয়। হঠাৎ সেনাবাহিনীতে রদবদল, পুরো সেনাবাহিনীতে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার পর অনেকের কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে, সংবিধান সংশোধনের সময় একটি বদমতলবে সেনাবাহিনীকে রাষ্ট্রপতির অধীনে রাখার ব্যবস্থা হয়েছিল। কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্দলীয় থাকলেও রাষ্ট্রপতি তো দলীয়ই থাকবেন।
তবে সে–যাত্রায় জাতি একটি মহাসংকট থেকে নিস্তার পেয়েছিল সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের বিচক্ষণতা আর দূরদর্শিতার কারণে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারে ছিল এবং সময়মতো সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতিতে বিচারপতি লতিফুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। ২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমান সরকার গঠনের আগে থেকেই পুরো প্রশাসনকে তছনছ করা শুরু করেন এবং তাঁর সাথি হন প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু সাঈদ। সেই নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট বিজয়ী হয়। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বেগম জিয়ার মেয়াদকাল ছিল নানাভাবে দেশে এবং দেশের বাইরে আলোচিত-সমালোচিত। নির্বাচনে পরপরই দক্ষিণবঙ্গে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নেমে আসে এক ভয়াবহ দুর্যোগ। ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, উচ্ছেদ, খুন, জখম হয়ে ওঠে নিত্যদিনের ঘটনা। যার ফলে কয়েক হাজার মানুষ ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে অনেকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। বেগম জিয়ার জ্যেষ্ঠপুত্র তারেক রহমান হাওয়া ভবন থেকে চালু করেন একটি বিকল্প প্রশাসন। এই ভবনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে দেশের অর্থনীতিবিধ্বংসী দুর্নীতির এক ভয়াবহ বলয়। বাংলাদেশ হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের একটি অভয়ারণ্য আর অবৈধ অস্ত্র চোরাচালানের একটি নিরাপদ রুট। এসব অপকর্মের মচ্ছবে সরকার থাকে নির্বিকার।
২০০৬ সালের মেয়াদ শেষে পূর্বনির্ধারিত সংসদ নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই অনুষ্ঠেয় এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শুরু হয়ে যায় বিএনপি-জামায়াত জোটের ক্ষমতাকে আরও দীর্ঘায়িত করার নীলনকশা প্রণয়নের কাজ। যখন ২০০৪ সালে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা দুই বছর বাড়ানো হয়, যার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল বিএনপির পছন্দসই একজনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করা। অবশ্য পরবর্তীকালে সেই নির্ধারিত প্রধান বিচারপতি এই পদ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তাঁর সম্মান রক্ষা করেছিলেন। এ জন্য তাঁকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। ২০০৬ সালে কে হবেন প্রধান উপদেষ্টা, যখন এ নিয়ে সারা দেশে এক চরম অশান্তি আর রক্তক্ষরণ, তখন সবাইকে অবাক করে দিয়ে দলীয় রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজেই প্রধান উপদেষ্টা বনে যান। শুরু হয় আরেক সংকট, যার ফলে আসে এক-এগারো। ২০০৮ সালের নির্বাচনটিও একধরনের অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। কারণ, সংবিধানের বাধ্যবাধকতা ছিল এই রকম একটি সরকারের মেয়াদ ছয় মাস থাকবে, যা ছিল দুই বছর।
২০০৯ থেকে ২০১৩, এই মেয়াদে সংসদে বিরোধী দল ছিল বিএনপি-জামায়াত কিন্তু তারা তাদের আসন রক্ষার বাধ্যবাধকতার কারণ ছাড়া কখনো সংসদে উপস্থিত থাকেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেওয়ার জন্য বিএনপি-জামায়াত ২০১৩ সালে এত জানমালের ক্ষতি করল, তা তো সরকার নয়, দেশের সর্বোচ্চ আদালত সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে বাতিল করে দিয়েছেন। ১৯৯৯ সালে এম সলিম উল্লাহ নামের একজন আইনজীবী হাইকোর্টে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে চ্যালেঞ্জ করে একটি রিট মামলা করেন।মহামান্য আদালত দীর্ঘ শুনানির পর ২১-০৭-২০০৩ তারিখে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য সুপারিশ করেন। তখন বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায়। প্রকৃতপক্ষে ÿসংবিধানের (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬-এর আইনগত অবস্থান নিরূপণই এই মামলার একমাত্র বিচার্য বিষয় ছিল।২০১১ সালে দীর্ঘ শুনানি, অ্যামিকাস কিউরিদের মতামত ইত্যাদি বিবেচনাপূর্বক মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এই মর্মে ২০১২ সালে রায় প্রদান করেন এবং রায়ে বলেন, ‘তর্কিত সংবিধানের (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬-কে অসাংবিধানিক ও অবৈধ ঘোষণা করা হইল এবং ইহা অবশ্যই অবৈধ।’ এই ছিল মূল মামলার চূড়ান্ত আদেশ বা রায়। বাকি যা আছে তা হলো আদালতের পর্যবেক্ষণ বা মন্তব্য। পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ‘...তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সাময়িকভাবে শুধু পরবর্তী দুইটি সাধারণ নির্বাচনের ক্ষেত্রে থাকিবে কি না সে সম্বন্ধে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জনগণের প্রতিনিধি জাতীয় সংসদ লইতে পারে।’ জাতীয় সংসদ এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়নি এবং যেহেতু জাতীয় সংসদ সার্বভৌম, সেহেতু জাতীয় সংসদের ওপর বাইরের কারও খবরদারি চলে না। রায়ে আরও বলা হয়, জাতীয় সংসদ এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সেখান থেকে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের বাদ দেওয়া বাঞ্ছনীয়। মহামান্য আদালত পর্যবেক্ষণে আরও বলেন, বরং ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার শুধু জনগণের নির্বাচিত জাতীয় সংসদের সদস্যদের দ্বারা গঠিত হইতে পারে, কারণ, জনগণের সার্বভৌমত্ব ও ক্ষমতায়ন, গণতন্ত্র, প্রজাতান্ত্রিকতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের basic structure এবং এই রায়ে উক্ত বিষয়গুলির ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হইয়াছে।’
ওপরের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে বলে, বিএনপি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দাবিতে রাজনৈতিক অঙ্গন অস্থিতিশীল করতে হুমকি দেয়, বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেই ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তা যদি করার চেষ্টা করা হয় এবং তাকে কেন্দ্র করে অন্য আর একজন যদি আদালতের শরণাপন্ন হন, তাহলে কী হবে? আগের অবস্থায় ফিরতে হলে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। এর চেয়ে উন্নত কোনো উপায় দেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞদের জানা থাকলে তা জনগণের সঙ্গে শেয়ার করলে দেশের মানুষ উপকৃত হবেন। আর যদি বিএনপি এবং তার মিত্ররা আন্দোলনের নামে আবার দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, তাহলে সেই ভোগান্তি থেকে তারাও নিস্তার পাবে না। তারা সব সময় সংলাপের কথা বলে। কিন্তু সেই সংলাপের তো একটি অর্থবহ ও বাস্তবমুখী এজেন্ডা থাকতে হবে। শেখ হাসিনা বিগত সময়ে সংলাপের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। আর বিএনপি যদি সামনের নির্বাচনে অংশ নিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে নির্বাচন কমিশনে তাদের নিবন্ধন বাতিল হতে পারে। দেশে গণতন্ত্রের স্বার্থে একাধিক বিরোধী দল থাকাটা বাঞ্ছনীয়। দেশ ও জনগণের বিরুদ্ধে গিয়ে শেষ পর্যন্ত কারও লাভ নেই। কারও আগ্রহ থাকলে ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রায়ের ৩৮৮ পৃষ্ঠার বইটি বাজারে পাওয়া যায়। সংরক্ষণের জন্য একটি অসামান্য দলিল।
আবদুল মান্নান: বিশ্লেষক ও গবেষক।
No comments