শিল্প-সাহিত্যের সদর দরোজা ও গলিতত্ত্ব by ফজলুল হক সৈকত
সাহিত্য-শিল্পের
সাধনা, চর্চা কিংবা লালনের সাথে নেশাদ্রব্যের প্রয়োগ (গ্রহণ বা সেবন
অর্থে) অথবা সামান্যতমও সমাচার সম্পৃক্ত আছে কি-না-এ সম্বন্ধে সাধারণের মনে
কিছু সরল জিজ্ঞাসা আছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে সেরকম প্রশ্নের সামনাসামনি
হয়েছি ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক পরিসরে ও বিচিত্র অবসরে। আবার আমার সাধারণ ধারণা
এরকম জিজ্ঞাসার কাছে বিব্রত কিংবা উল্লসিত হতে হয়েছে অনেককেই; অন্তত যারা
শিল্প-সাহিত্যের কারবারের সাথে কোনো-না-কোনোভাবে জড়িত আছেন। সাহিত্যিক
কিংবা শিল্পীকে কি মদ্যপ কিংবা গাঁজাখোর হতে হয়? গঞ্জিকাসেবন বা মদপানের
ফলে কি সাহিত্য-শিল্পসাধনার পথ প্রশস্ত হয়; শিল্পের ওই কারিগর কিংবা
সাহিত্যের সাধক কি বেশি মাত্রায় অথবা উৎকৃষ্ট জাতের শিল্পকর্মের উদ্ভাবন
করছেন? সাহিত্য কি সাধকের মেধা-চিন্তা ও চর্চার সরল পথ ধরে সদর দরোজা দিয়ে
অন্দরে প্রবেশ করছে? না-কি গলির ভেতরে অথবা চিপায় অন্ধকারে সেবনমগ্ন কোনো
গেঁজেল, বা দামি কার্পেটমোড়া বহুতল ভবনের করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো
মদ্যপের মনে ভর করে গোপন কোনো পথ খুঁজে নিচ্ছে সাহিত্য ও শিল্প মাধ্যম?
‘গাঁজা না খেলে ভাব আসে না’, ‘শিল্পের সাধনা করতে গেলে এট্টু-আট্টু গিলতে হয় আর কি’, ‘মাঝে মাঝে মাথা ধরে এলে গঞ্জিকা খানিকটা কাজ দেয়’, ‘মদ না খেলে মাথা খোলে না’- এমন জাতের কিছু কথা এদিক-ওদিক শুনতে পাওয়া যায় বটে। অথচ দেখুন, আমরা বোধ করি সকলেই বিশ্বাস করি যে, মেধা, গডগিফটেড প্রতিভা, অর্জিত জ্ঞান ও চর্চার প্রতিফলন প্রভৃতি সৃজনভার প্রকাশের একটি সাধারণ ধারা। শিল্পীকে প্রতিভাবান হতে হয়। সাধনা করতে হয়। চিন্তা করতে হয়। তবে এই পরিচিত ধারাটির সাথে আরেকটি ধারা আমাদের চোখে পড়ছে। আর তা হলো সাধনার পথ ঠিক রাখতে কিছু লোক গঞ্জিকা বা মদের আশ্রয় নিচ্ছেন (অন্তত তাদের এবং তাদের সমর্থকদের তো সেরকমই দাবি!)। এই যে গেঁজেল বা মাতানো আবেশে ও আবেগে তৈরি অন্য একটি পথ ও রীতি (নাকি মেকি তত্ত্ব!), এটি বোধকরি সবকালে, সারাজাহানে প্রচলিত আছে। এবং কোনটি যথার্থ আর কোনটি বানানো- সাধারণের কাছে তার ঠিক ঠিক হিসাব মেলা ভার। সৃষ্টিশীলতা আর নেশাগ্রস্ততা কি পরস্পরের পরিপূরক? এখানে ফ্রেঞ্চ ভাষায় লেখা ও গাওয়া একটা জনপ্রিয় গানের প্রসঙ্গ তুলতে ইচ্ছে করছে। গানটি এরকম : ‘জ ন পু পা থাভাইয়ে, জ ন পু পা দেজুনে, জ মে উবলিয়ে... জ ফুমে’ (লিরিকটির বাংলা মানে দাঁড়ায় : আমার কোনো কাজে মন বসছে না, দুপুরে খেতেও ভালো লাগছে না, মাথা কেমন যেন আউলিয়ে গেছে... আমি তাই সিগারেট টানছি)। তার মানে কি কাজে মন না থাকলে, মনে অস্থিরতা কাজ করলে বিড়ি-সিগারেট প্রভৃতি কোনো কাজ দেয়? মাথার ভেতরে লুকিয়ে থাকা সৃজনবেদনাকে ঠিকঠাক রাখতে হলে তবে কি ধূমপানের প্রয়োজন পড়ে? চিন্তা ও স্বপ্নময়তায় দোলা লাগায় এসব নেশাদ্রব্য? গঞ্জিকার বাহাদুরিও কি এইরকম ব্যাপারের সাথে সম্পৃক্ত? কারো মতে ‘হ্যাঁ’ আবার কারো মতে ‘না’।
উনিশ শতকে ইউরোপ-আমেরিকার ইতিবাচক পরিবর্তনের যে হাওয়া ভারতে প্রবেশ করেছিল, তার বাতাসে ভর করে বাঙালি চিন্তাবিদ ও স্বপ্নবাজদের আবির্ভাবের কথা বোধকরি আমাদের মনে আছে। সেদিনের সেই বিপ্লব ও উন্নয়নের ধারায় বাঙালিকে যুক্ত করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ চট্টোপাধ্যায়ের মতো অগ্রসর মানুষেরা। সমাজে তখন দুটি ধারা প্রবাহিত ছিল। একটি ধারা পাশ্চাত্য-অনুসরণে চিন্তার লালন এবং কর্ম ও আচারের আভিজাত্যে নিজেদের অগ্রসর নাগরিকরূপে তৈরি করছিল। আর অন্যরা ওই পাশ্চাত্যেরই পন্থায় মদ প্রভৃতি নেশায় ও বিচিত্র অনাচারে জড়িয়ে পড়ছিল। ঠিক সাহিত্য-শিল্পের সাধনায় ও পরিচর্যায় লেগে থাকা দুটি বিপরীতভাবের ধারার মতো। মধুসূদন বাঙালির চিন্তার ও স্বপ্নের মুক্তিদাতা হয়েও বোতলের টান পরিহার করতে পারেননি। তিনি মদ খেতেন বলে কি সৃষ্টিশীল কাজ করতে পারতেন? না-কি সৃষ্টিজনিত ক্লান্তি দূর করতে গিলতেন মদ? মাথার কিংবা মনের কর্মক্ষমতা কি এভাবে বাড়িয়ে তোলা যায়? কি ভাবতেন আসলে মাইকেল? বোতলে হাতই বা রাখতেন কেন? অথবা চুমুকে চুমুকে কি প্রেরণা পেতেন তিনি? আরো পরে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অতিমাত্রায় নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ায় শেষদিকে তার সৃষ্টির শিল্পমান ধরে রাখতে পারেননি- এ কথা তো অনেকেরই জানা। আমাদের কানে এ সংবাদও পৌঁছেছে যে, অস্ট্রেলিয়ার প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী নামাৎজিরাকে মদ্যপ হওয়ার অপরাধে নাগরিকত্ব হারাতে হয়েছে। তার মানে কি দাঁড়ায়? দাঁড়ায় এটা- চিন্তা ও স্বপ্নময়তায় অবগাহনের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিক ও সামাজিক অগ্রগতি অর্জনের পথ নির্মিত হয়। মেধা কিংবা প্রতিভা আর সাধনার দৃঢ়তা ওই সড়ককে প্রসারিত করে। সদর দরোজা পর্যন্ত পৌঁছতে সহায়তা করে। আর আলগা ভাব কিংবা গোপন গলি-ফর্মুলা (আড়ালে-আবডালে নেশায় বুঁদ হয়ে শিল্পের পথে হাঁটবার বাহানা!) কোনো-কোনো ক্ষেত্রে খানিকটা চমক সৃষ্টি করতে পারলেও আদতে ওটা কেবল ‘ভাব’ বৈ তো অন্য কিছু নয়।
আরেকটি কথা- মানুষ আত্মহত্যা করে কেন? মানসিক যন্ত্রণার কারণে? অনেকে না-কি (শুনেছি) কষ্ট থেকে রেহাই পেতে মদ বা গঞ্জিকার দ্বারস্থ হয়? আবার অন্যের দ্বারা কেউ কেউ প্রভাবিত হয়, অথবা স্রেফ অপরের ক্ষতি করে এমন কথাও আমাদের কানে ও গোচরে আসে। আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে, সূর্যমুখীকে আ্ত্মহননের পথে পাঠালেন না বঙ্কিম। আবার ঠিকই কুন্দকে বিষের বাটি হাতে তুলে দিলেন। এই দ্বৈতচিন্তার সমাবেশ ঘটল কি করে? এখানে শিল্পীর কি লাভ-ক্ষতি? রোহিনীকে গুলি করে মেরে কার লাভ- গোবিন্দলালের না-কি বঙ্কিমের? সাহিত্যচর্চা কি পেশা? তাহলে অন্য পেশার লোকেরা যদি নেশায় বুঁদ হয়, তখন আমরা ব্যাপারটিকে কোন নিক্তিতে পরিমাপ করতে পারি? আজকাল মধ্যে মধ্যে শুনতে পাই- নেশা ছাড়া না-কি মানুষ হয় না। কথাটার মানে দাঁড়ায়- মানুষ মাত্রেই নেশার দাস। যেমন ‘মানুষ অভ্যাসের দাস’। আবার ‘অভ্যাসও কিন্তু মানুষের দাস’। কাজেই নেশায় মগ্ন হয়ে পড়া যেমনটা স্বাভাবিক, তেমনি নেশাকে নিয়ন্ত্রণ করা বা নেশাদ্রব্য থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার কৌশলও মানুষের জানা। অতএব, মানুষ নেশা দ্বারা পরিচালিত নয়। মানুষের সৃষ্টিকর্ম- সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়াদিও নেশার ওপর নির্ভরশীল নয় কিছুতেই। কাজেই ‘আপনার কি কোনো নেশা আছে?’ বা ‘গাঁজা-টাজার অভ্যাস আছে না-কি?’- এই জাতীয় জিজ্ঞাসার উত্তর হয়তো সব সময় ঠিকঠাক মতো পাওয়া যায় না। তাতে অবশ্য শিল্প কিংবা সাহিত্যের কোনো ক্ষতি নেই। শিল্পীকে আঁকতে গেলে বা মঞ্চে দাঁড়াতে গেলে গলায় কিছুটা ঢেলে নিতে হবে। অথবা লিখতে বসলে খানিকটা টেনে নিলে ভালো হয়- এসবের কোনো মানে থাকতে পারে না।
সাহিত্য কি সদর দরোজা দিয়ে বাজারে কিংবা অন্দরে প্রবেশ করে? সাহিত্যের বাজার বলতে আসলে কী বোঝায়? সাহিত্য বাজারে ভালো কাটলে (কেটে কুচি কুচি নয়- বিক্রি-বাট্টা অর্থে) তা বাজার দখল করে। তখন কি সেটা বাজারি হয়ে যায়? আর ‘বাজারি সাহিত্য’ কিংবা ‘বাহারি শিল্প’ কি সকলে গ্রহণ করে? ব্যাপারগুলো মোটেও সরল নয়। এবং সে কারণেই শিল্প-সাহিত্যের সদর দরোজার প্রবেশের ঘটনাটাও একেবারে সোজাসাপটা কাজ নয়। আর গলি-ঘুঁজিতে যে সাহিত্যের চর্চা ও সমাদর- তার কি দশা? প্রকাশ্যে যে শিল্পভুবন আলো ছড়ায় না- তার বিকাশের জন্য যখন দরকার হয়ে পড়ে গলির নীরবতা অথবা গোপনতা, তাকে কি আমরা জাতীয় সাহিত্য-শিল্প বলতে পারি? গাঁজার টানে টানে কিংবা মাদকের মাদকতায় আওড়ানো কথামালা, গেঁজেলের মাতানো কল্পনা ও সৃজনভাবনায় যে শিল্পময়তার বুনন, তাকে আমরা কি নামে ডাকবো? সাহিত্যের বিকাশের জন্য কিংবা শিল্পের পরিচর্যার জন্য গলিতত্ত্বের প্রসঙ্গ ও প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারটা তাহলে আমাদের গোচরে বা অগোচরে, কীভাবে জায়গা করে নিল? এসব সৃষ্টিরই কি বাজার ভালো? হতে পারে। এসবে এক ধরনের মানুষ মাতানোর বিশেষ প্রবণতা থাকে বটে!
সাহিত্যের সদর দরোজার সামনের পথে কি স্রষ্টা ও ভোক্তার মানসিক প্রশান্তি প্রলেপ-মলম বিছানো থাকে? যদি এমনটিই হয়, তাহলে বুঝতে হবে যিনি সৃষ্টি করবেন এবং যার জন্য সৃষ্টি হবে উভয়কেই থাকতে হবে সতেজ ও সামর্থ্যবান। কেউ মাতাল বা গেঁজেল হলে সে সৃজনশিল্পী বা গ্রহণদার যে-ই হোন না কেন, সৃষ্টির সৌন্দর্যটা শেষ পর্যন্ত আর থাকে না। থাকতে পারে না। মানসিক প্রশান্তি সৃষ্টিকারীর মানসিক অবস্থাও থাকে প্রত্যাশিত প্রশান্ত-পরিস্থিতির খুব কাছাকাছি। মিথ্যা দিয়ে তো সত্য রচনা চলে না! সদর দরোজা দিয়ে ঢুকতে হলে সাহস লাগে। গলি-ঘুঁজির ভেতরে ঢুকতে ও পথ-চলতে যে সাহস লাগে না- তা নয়। তবে ব্যাপারটা হলো স্পষ্টতা আর গোপনীয়তার। স্পষ্টতায় ফাঁক থাকে না। গোপনীয়তায় অনেক জোড়াতালি থাকে। গোঁজামিলের দরকার পড়ে। ভান ধরলে আসলটা হারিয়ে যায়। সত্য আর মিথ্যা যেমন আলাদা, তেমনই সদর দরোজার শিল্প ও সাহিত্য আর গলির ভেতরে জন্ম নেওয়া শিল্প ও সাহিত্য ভিন্ন ভিন্ন ভুবনের উপাদান। গাঁজার আড্ডায় তৈরি হওয়া কিংবা গলির অন্ধকার পথের ধারা থেকে উঠে আসা সাহিত্য কিংবা শিল্প কতটা গ্রহণযোগ্যতা পায়? শেষ পর্যন্ত কি এগুলো বাজারি হয়ে কিছুকাল ইতি-উতি করে কেটে পড়ে? না-কি থাকে সাহিত্যধারার অনুষঙ্গী হয়ে? এসব বিবেচনায় নানা বিবেচকের চোখ পড়েছে। আজও পড়ছে। আর যতই এসব বিবেচনা আমাদের সতর্ক চোখের সামনে টেবিলে সাজানো থাক-না-কেন, সমাজে ও কালে এবং বোধকরি উত্তরকালেও এসব গেঁজেল সাহিত্যের ভারে আমরা ক্লান্ত হতে থাকবো।
মাঝে মধ্যে উপন্যাস প্রভৃতিকে ‘গল্পের বই’ বলতে শুনি। আগেকার দিনের মানুষ সিনেমাকে না-কি বলতো ‘বই’। সম্ভবত বই-এর কাহিনী অবলম্বনে সেলুলয়েডের ফিতায় কাহিনীর পদার্পণ ছিল বলে এমন নামে ডাক পড়ত। আর আকজাল চিত্রকর্মেরও বই বেরিয়েছে। সঙ্গীত প্রভৃতি জনপ্রিয় ধারা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দুনিয়ার প্রান্তে ও প্রান্তরে; গলি থেকে সদর দরোজা হয়ে সোজা আকাশ পথ ধরে মানুষের চেতন-ভুবনে। কাজেই মেকি গলিতত্ত্ব বা গঞ্জিকানির্ভর শিল্পচর্চার কাল এবং সাহিত্যসাধনার সময় ফুরিয়েছে। আঙুলের চাপে চাপে চলছে চিন্তা-কল্পনা ও স্বপ্নের কারবার। শিল্প এবং সাহিত্যও পেয়েছে বিচিত্র সদর পথের সন্ধান। ভান বা বাহানা কিংবা অজুহাত এখন বহুহাত দূরে সরে গেছে।
‘গাঁজা না খেলে ভাব আসে না’, ‘শিল্পের সাধনা করতে গেলে এট্টু-আট্টু গিলতে হয় আর কি’, ‘মাঝে মাঝে মাথা ধরে এলে গঞ্জিকা খানিকটা কাজ দেয়’, ‘মদ না খেলে মাথা খোলে না’- এমন জাতের কিছু কথা এদিক-ওদিক শুনতে পাওয়া যায় বটে। অথচ দেখুন, আমরা বোধ করি সকলেই বিশ্বাস করি যে, মেধা, গডগিফটেড প্রতিভা, অর্জিত জ্ঞান ও চর্চার প্রতিফলন প্রভৃতি সৃজনভার প্রকাশের একটি সাধারণ ধারা। শিল্পীকে প্রতিভাবান হতে হয়। সাধনা করতে হয়। চিন্তা করতে হয়। তবে এই পরিচিত ধারাটির সাথে আরেকটি ধারা আমাদের চোখে পড়ছে। আর তা হলো সাধনার পথ ঠিক রাখতে কিছু লোক গঞ্জিকা বা মদের আশ্রয় নিচ্ছেন (অন্তত তাদের এবং তাদের সমর্থকদের তো সেরকমই দাবি!)। এই যে গেঁজেল বা মাতানো আবেশে ও আবেগে তৈরি অন্য একটি পথ ও রীতি (নাকি মেকি তত্ত্ব!), এটি বোধকরি সবকালে, সারাজাহানে প্রচলিত আছে। এবং কোনটি যথার্থ আর কোনটি বানানো- সাধারণের কাছে তার ঠিক ঠিক হিসাব মেলা ভার। সৃষ্টিশীলতা আর নেশাগ্রস্ততা কি পরস্পরের পরিপূরক? এখানে ফ্রেঞ্চ ভাষায় লেখা ও গাওয়া একটা জনপ্রিয় গানের প্রসঙ্গ তুলতে ইচ্ছে করছে। গানটি এরকম : ‘জ ন পু পা থাভাইয়ে, জ ন পু পা দেজুনে, জ মে উবলিয়ে... জ ফুমে’ (লিরিকটির বাংলা মানে দাঁড়ায় : আমার কোনো কাজে মন বসছে না, দুপুরে খেতেও ভালো লাগছে না, মাথা কেমন যেন আউলিয়ে গেছে... আমি তাই সিগারেট টানছি)। তার মানে কি কাজে মন না থাকলে, মনে অস্থিরতা কাজ করলে বিড়ি-সিগারেট প্রভৃতি কোনো কাজ দেয়? মাথার ভেতরে লুকিয়ে থাকা সৃজনবেদনাকে ঠিকঠাক রাখতে হলে তবে কি ধূমপানের প্রয়োজন পড়ে? চিন্তা ও স্বপ্নময়তায় দোলা লাগায় এসব নেশাদ্রব্য? গঞ্জিকার বাহাদুরিও কি এইরকম ব্যাপারের সাথে সম্পৃক্ত? কারো মতে ‘হ্যাঁ’ আবার কারো মতে ‘না’।
উনিশ শতকে ইউরোপ-আমেরিকার ইতিবাচক পরিবর্তনের যে হাওয়া ভারতে প্রবেশ করেছিল, তার বাতাসে ভর করে বাঙালি চিন্তাবিদ ও স্বপ্নবাজদের আবির্ভাবের কথা বোধকরি আমাদের মনে আছে। সেদিনের সেই বিপ্লব ও উন্নয়নের ধারায় বাঙালিকে যুক্ত করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ চট্টোপাধ্যায়ের মতো অগ্রসর মানুষেরা। সমাজে তখন দুটি ধারা প্রবাহিত ছিল। একটি ধারা পাশ্চাত্য-অনুসরণে চিন্তার লালন এবং কর্ম ও আচারের আভিজাত্যে নিজেদের অগ্রসর নাগরিকরূপে তৈরি করছিল। আর অন্যরা ওই পাশ্চাত্যেরই পন্থায় মদ প্রভৃতি নেশায় ও বিচিত্র অনাচারে জড়িয়ে পড়ছিল। ঠিক সাহিত্য-শিল্পের সাধনায় ও পরিচর্যায় লেগে থাকা দুটি বিপরীতভাবের ধারার মতো। মধুসূদন বাঙালির চিন্তার ও স্বপ্নের মুক্তিদাতা হয়েও বোতলের টান পরিহার করতে পারেননি। তিনি মদ খেতেন বলে কি সৃষ্টিশীল কাজ করতে পারতেন? না-কি সৃষ্টিজনিত ক্লান্তি দূর করতে গিলতেন মদ? মাথার কিংবা মনের কর্মক্ষমতা কি এভাবে বাড়িয়ে তোলা যায়? কি ভাবতেন আসলে মাইকেল? বোতলে হাতই বা রাখতেন কেন? অথবা চুমুকে চুমুকে কি প্রেরণা পেতেন তিনি? আরো পরে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অতিমাত্রায় নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ায় শেষদিকে তার সৃষ্টির শিল্পমান ধরে রাখতে পারেননি- এ কথা তো অনেকেরই জানা। আমাদের কানে এ সংবাদও পৌঁছেছে যে, অস্ট্রেলিয়ার প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী নামাৎজিরাকে মদ্যপ হওয়ার অপরাধে নাগরিকত্ব হারাতে হয়েছে। তার মানে কি দাঁড়ায়? দাঁড়ায় এটা- চিন্তা ও স্বপ্নময়তায় অবগাহনের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিক ও সামাজিক অগ্রগতি অর্জনের পথ নির্মিত হয়। মেধা কিংবা প্রতিভা আর সাধনার দৃঢ়তা ওই সড়ককে প্রসারিত করে। সদর দরোজা পর্যন্ত পৌঁছতে সহায়তা করে। আর আলগা ভাব কিংবা গোপন গলি-ফর্মুলা (আড়ালে-আবডালে নেশায় বুঁদ হয়ে শিল্পের পথে হাঁটবার বাহানা!) কোনো-কোনো ক্ষেত্রে খানিকটা চমক সৃষ্টি করতে পারলেও আদতে ওটা কেবল ‘ভাব’ বৈ তো অন্য কিছু নয়।
আরেকটি কথা- মানুষ আত্মহত্যা করে কেন? মানসিক যন্ত্রণার কারণে? অনেকে না-কি (শুনেছি) কষ্ট থেকে রেহাই পেতে মদ বা গঞ্জিকার দ্বারস্থ হয়? আবার অন্যের দ্বারা কেউ কেউ প্রভাবিত হয়, অথবা স্রেফ অপরের ক্ষতি করে এমন কথাও আমাদের কানে ও গোচরে আসে। আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে, সূর্যমুখীকে আ্ত্মহননের পথে পাঠালেন না বঙ্কিম। আবার ঠিকই কুন্দকে বিষের বাটি হাতে তুলে দিলেন। এই দ্বৈতচিন্তার সমাবেশ ঘটল কি করে? এখানে শিল্পীর কি লাভ-ক্ষতি? রোহিনীকে গুলি করে মেরে কার লাভ- গোবিন্দলালের না-কি বঙ্কিমের? সাহিত্যচর্চা কি পেশা? তাহলে অন্য পেশার লোকেরা যদি নেশায় বুঁদ হয়, তখন আমরা ব্যাপারটিকে কোন নিক্তিতে পরিমাপ করতে পারি? আজকাল মধ্যে মধ্যে শুনতে পাই- নেশা ছাড়া না-কি মানুষ হয় না। কথাটার মানে দাঁড়ায়- মানুষ মাত্রেই নেশার দাস। যেমন ‘মানুষ অভ্যাসের দাস’। আবার ‘অভ্যাসও কিন্তু মানুষের দাস’। কাজেই নেশায় মগ্ন হয়ে পড়া যেমনটা স্বাভাবিক, তেমনি নেশাকে নিয়ন্ত্রণ করা বা নেশাদ্রব্য থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার কৌশলও মানুষের জানা। অতএব, মানুষ নেশা দ্বারা পরিচালিত নয়। মানুষের সৃষ্টিকর্ম- সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়াদিও নেশার ওপর নির্ভরশীল নয় কিছুতেই। কাজেই ‘আপনার কি কোনো নেশা আছে?’ বা ‘গাঁজা-টাজার অভ্যাস আছে না-কি?’- এই জাতীয় জিজ্ঞাসার উত্তর হয়তো সব সময় ঠিকঠাক মতো পাওয়া যায় না। তাতে অবশ্য শিল্প কিংবা সাহিত্যের কোনো ক্ষতি নেই। শিল্পীকে আঁকতে গেলে বা মঞ্চে দাঁড়াতে গেলে গলায় কিছুটা ঢেলে নিতে হবে। অথবা লিখতে বসলে খানিকটা টেনে নিলে ভালো হয়- এসবের কোনো মানে থাকতে পারে না।
সাহিত্য কি সদর দরোজা দিয়ে বাজারে কিংবা অন্দরে প্রবেশ করে? সাহিত্যের বাজার বলতে আসলে কী বোঝায়? সাহিত্য বাজারে ভালো কাটলে (কেটে কুচি কুচি নয়- বিক্রি-বাট্টা অর্থে) তা বাজার দখল করে। তখন কি সেটা বাজারি হয়ে যায়? আর ‘বাজারি সাহিত্য’ কিংবা ‘বাহারি শিল্প’ কি সকলে গ্রহণ করে? ব্যাপারগুলো মোটেও সরল নয়। এবং সে কারণেই শিল্প-সাহিত্যের সদর দরোজার প্রবেশের ঘটনাটাও একেবারে সোজাসাপটা কাজ নয়। আর গলি-ঘুঁজিতে যে সাহিত্যের চর্চা ও সমাদর- তার কি দশা? প্রকাশ্যে যে শিল্পভুবন আলো ছড়ায় না- তার বিকাশের জন্য যখন দরকার হয়ে পড়ে গলির নীরবতা অথবা গোপনতা, তাকে কি আমরা জাতীয় সাহিত্য-শিল্প বলতে পারি? গাঁজার টানে টানে কিংবা মাদকের মাদকতায় আওড়ানো কথামালা, গেঁজেলের মাতানো কল্পনা ও সৃজনভাবনায় যে শিল্পময়তার বুনন, তাকে আমরা কি নামে ডাকবো? সাহিত্যের বিকাশের জন্য কিংবা শিল্পের পরিচর্যার জন্য গলিতত্ত্বের প্রসঙ্গ ও প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারটা তাহলে আমাদের গোচরে বা অগোচরে, কীভাবে জায়গা করে নিল? এসব সৃষ্টিরই কি বাজার ভালো? হতে পারে। এসবে এক ধরনের মানুষ মাতানোর বিশেষ প্রবণতা থাকে বটে!
সাহিত্যের সদর দরোজার সামনের পথে কি স্রষ্টা ও ভোক্তার মানসিক প্রশান্তি প্রলেপ-মলম বিছানো থাকে? যদি এমনটিই হয়, তাহলে বুঝতে হবে যিনি সৃষ্টি করবেন এবং যার জন্য সৃষ্টি হবে উভয়কেই থাকতে হবে সতেজ ও সামর্থ্যবান। কেউ মাতাল বা গেঁজেল হলে সে সৃজনশিল্পী বা গ্রহণদার যে-ই হোন না কেন, সৃষ্টির সৌন্দর্যটা শেষ পর্যন্ত আর থাকে না। থাকতে পারে না। মানসিক প্রশান্তি সৃষ্টিকারীর মানসিক অবস্থাও থাকে প্রত্যাশিত প্রশান্ত-পরিস্থিতির খুব কাছাকাছি। মিথ্যা দিয়ে তো সত্য রচনা চলে না! সদর দরোজা দিয়ে ঢুকতে হলে সাহস লাগে। গলি-ঘুঁজির ভেতরে ঢুকতে ও পথ-চলতে যে সাহস লাগে না- তা নয়। তবে ব্যাপারটা হলো স্পষ্টতা আর গোপনীয়তার। স্পষ্টতায় ফাঁক থাকে না। গোপনীয়তায় অনেক জোড়াতালি থাকে। গোঁজামিলের দরকার পড়ে। ভান ধরলে আসলটা হারিয়ে যায়। সত্য আর মিথ্যা যেমন আলাদা, তেমনই সদর দরোজার শিল্প ও সাহিত্য আর গলির ভেতরে জন্ম নেওয়া শিল্প ও সাহিত্য ভিন্ন ভিন্ন ভুবনের উপাদান। গাঁজার আড্ডায় তৈরি হওয়া কিংবা গলির অন্ধকার পথের ধারা থেকে উঠে আসা সাহিত্য কিংবা শিল্প কতটা গ্রহণযোগ্যতা পায়? শেষ পর্যন্ত কি এগুলো বাজারি হয়ে কিছুকাল ইতি-উতি করে কেটে পড়ে? না-কি থাকে সাহিত্যধারার অনুষঙ্গী হয়ে? এসব বিবেচনায় নানা বিবেচকের চোখ পড়েছে। আজও পড়ছে। আর যতই এসব বিবেচনা আমাদের সতর্ক চোখের সামনে টেবিলে সাজানো থাক-না-কেন, সমাজে ও কালে এবং বোধকরি উত্তরকালেও এসব গেঁজেল সাহিত্যের ভারে আমরা ক্লান্ত হতে থাকবো।
মাঝে মধ্যে উপন্যাস প্রভৃতিকে ‘গল্পের বই’ বলতে শুনি। আগেকার দিনের মানুষ সিনেমাকে না-কি বলতো ‘বই’। সম্ভবত বই-এর কাহিনী অবলম্বনে সেলুলয়েডের ফিতায় কাহিনীর পদার্পণ ছিল বলে এমন নামে ডাক পড়ত। আর আকজাল চিত্রকর্মেরও বই বেরিয়েছে। সঙ্গীত প্রভৃতি জনপ্রিয় ধারা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দুনিয়ার প্রান্তে ও প্রান্তরে; গলি থেকে সদর দরোজা হয়ে সোজা আকাশ পথ ধরে মানুষের চেতন-ভুবনে। কাজেই মেকি গলিতত্ত্ব বা গঞ্জিকানির্ভর শিল্পচর্চার কাল এবং সাহিত্যসাধনার সময় ফুরিয়েছে। আঙুলের চাপে চাপে চলছে চিন্তা-কল্পনা ও স্বপ্নের কারবার। শিল্প এবং সাহিত্যও পেয়েছে বিচিত্র সদর পথের সন্ধান। ভান বা বাহানা কিংবা অজুহাত এখন বহুহাত দূরে সরে গেছে।
No comments