নির্বাচন: তারপর কী
বহু তর্ক-বিতর্ক, নানা নাটকীয়তা ও ব্যাপক সহিংসতার মধ্য দিয়ে ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। ইতিমধ্যে শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বে ৪৯ সদস্যবিশিষ্ট একটি মন্ত্রিসভাও গঠিত হয়েছে। ২৯ জানুয়ারি সংসদের প্রথম অধিবেশন বসবে। নির্বাচনটির আইনসিদ্ধতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে অনেকের মনে নানা প্রশ্ন থাকলেও, এটি একটি বাস্তবতা এবং এই বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে অগ্রসর হওয়া ছাড়া নাগরিকদের সামনে আর কোনো বিকল্প নেই। বস্তুত, আইনে ‘ডকট্রিন অব ফেকটাম ভেলেট’ (Doctrine of factum valet) বলে একটি তত্ত্ব আছে। তত্ত্বটির অর্থ হলো—যদি এমন কিছু ঘটে যায় যা আদৌ ঘটা উচিত ছিল না, কিন্তু পরবর্তী সময়ে ঘড়ির কাঁটা উল্টে দেওয়া সম্ভবপর নয়, তাহলে সে বাস্তবতা মেনে নিয়েই সামনে অগ্রসর হতে হবে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে অপরিবর্তনীয় ধরে নিয়েই সামনে এগোতে হবে, যেমনিভাবে ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ তারিখের বিতর্কিত নির্বাচনটি সবাইকে মেনে নিতে হয়েছিল। আর ১২ জুন ১৯৯৬ তারিখের নির্বাচনটি ছিল সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন—ষষ্ঠ নয়। একইভাবে পরবর্তী নির্বাচন হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তবে গণতন্ত্রের স্বার্থে একাদশ সংসদ নির্বাচন দ্রুততার সঙ্গে অনুষ্ঠিত হওয়া জরুরি। নবগঠিত সরকারের সামনে বর্তমানে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ, যার অন্যতম হলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা এবং অনতিবিলম্বে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করা। যেহেতু উপজেলা নির্বাচন-প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে, তাই উপজেলা পরিষদকে কার্যকর করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট আইনটির সংশোধন করাও এই মুহূর্তে জরুরি।\
আরও জরুরি দুর্নীতি প্রতিরোধের লক্ষ্যে এবং সংসদে এরশাদের জাতীয় পার্টির ভূমিকা নিয়ে জগাখিচুড়ি অবস্থা অবসানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ। সাম্প্রতিক সময়ের সহিংসতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে এবং এগুলোর প্রতিকারও ভিন্ন ভিন্ন। একটি কারণ অবশ্যই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কিত। জামায়াত-শিবির যুদ্ধাপরাধের বিচার ভন্ডুল করতে বদ্ধপরিকর, তাই তাদের সহিংসতায় লিপ্ত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। আর এরা রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন ভঙ্গ করছে, তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে দ্রুততার সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন করতে হবে, যাতে এ নিয়ে আর ‘রাজনীতি’ না হতে পারে। এ ছাড়া তাদের অতীত কৃতকর্মের জন্য জামায়াতে ইসলামীকে অনতিবিলম্বে নিষিদ্ধ করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আরেকটি কারণ হলো, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যকার নির্বাচনকালীন সরকারসংক্রান্ত বিরোধ। এটি রাজনৈতিক বিরোধ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবহার বা বলপ্রয়োগ করে এর সমাধান সম্ভবপর নয়। এই বিরোধের মীমাংসা করতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে। তাই নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই। আর এই সমঝোতা না হলে আমাদের দেশে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক শাসন কায়েম হবে না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য আরও প্রয়োজন বিরোধী দলকে শান্তিপূর্ণভাবে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের সুযোগ প্রদান করা এবং বিএনপির শীর্ষ নেতাদের মুক্তি দেওয়া।
তবে সাম্প্রতিককালে যারাই সহিংসতায় লিপ্ত হয়েছে, বিশেষত ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে—তাদেরই দলমত-নির্বিশেষে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। এ জন্য অনতিবিলম্বে একটি নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করা জরুরি। কমিশনের মাধ্যমে ২০০১ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যারা সহিংসতায় লিপ্ত হয়েছিল এবং রামুর ঘটনায় যারা জড়িত হয়েছিল, তাদেরও যথাযথ শাস্তি দেওয়া আবশ্যক। অর্থাৎ ‘কালচার অব ইম্পিউনিটি’ বা অন্যায় করে পার পেয়ে যাওয়ার অতীতের সংস্কৃতির অবসান চিরতরে ঘটাতে হবে। সেই সঙ্গে আইনের শাসনের খাতিরে রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহারের অপসংস্কৃতির ইতি টানতে হবে। গত কয়েক সপ্তাহের অভিজ্ঞতা থেকে এটি সুস্পষ্ট যে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া সম্ভবপর নয়। বস্তুত, আমাদের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতা না হলে এবং শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে, ভবিষ্যতেও খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন বলে মনে হয় না। একইভাবে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর আসনে অধিষ্ঠিত থাকলে, শেখ হাসিনাও নির্বাচনে অংশ না-ও নিতে পারেন। আর নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা বদল হওয়ার সুযোগ না থাকলে, অনিয়মতান্ত্রিক তথা বল প্রয়োগের মাধ্যমে তা ঘটার আশঙ্কা থেকে যায়।
আর সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের কারণে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল বলতে গেলে প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা আমাদের গণতান্ত্রিকব্যবস্থাকে চরম ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ঝুঁকিমুক্ত করতে হলে আজ জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন প্রধান দুই দলের মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতা এবং এর ভিত্তিতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সবার অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টার সাম্প্রতিক বক্তব্য, যেখানে তিনি স্বল্প সময়ের মধ্যে আরেকটি নির্বাচনের কথা বলেছেন, যা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক বক্তব্য। এ অবস্থায় অনতিবিলম্বে পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের একটি নির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণ করে একটি রোডম্যাপ প্রণয়ন করা এবং সেই রোডম্যাপের ভিত্তিতে অগ্রসর হওয়া হবে সর্বাধিক যুক্তিযুক্ত। আর বৃহত্তর পরিসরে সংলাপের আয়োজন করে সবগুলো সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯০ সালের তিন জোটের রূপরেখার আদলে একটি ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়ন ও স্বাক্ষর হবে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার জন্য আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানাই। নবগঠিত মন্ত্রিসভা থেকে অনেক বিতর্কিত ব্যক্তিকে বাদ দেওয়া হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। তবে যাঁরা অতীতে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে সম্পদের মালিক হয়েছেন, মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়াও জরুরি। এ ছাড়া কিছু বিতর্কিত ব্যক্তি নতুন মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছেন,
যা কোনোভাবেই উৎসাহব্যঞ্জক নয়। নতুন মন্ত্রিসভায় অনেক ব্যবসায়ী আছেন, যাঁদের আয়ের প্রধান উৎস ব্যবসায়িক মুনাফা। সংবিধানের ১৪৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার প্রমুখ ‘প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে’ অধিষ্ঠিত নন। বিশেষজ্ঞদের মতে, তাঁদের মুনাফাজাতীয় আয় অর্জন হবে সংবিধানের লঙ্ঘন (প্রথম আলো, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৩)। তাই মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত ব্যবসায়ীদের বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নজর দেওয়া জরুরি। আরও কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বিষয়েও প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি দেওয়া জরুরি। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের অন্যান্য সদস্য, উপদেষ্টা, সংসদ সদস্যসহ সব ক্ষমতাধরকে এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাব প্রতিবছর প্রদান এবং তা জনসমক্ষে প্রকাশ করার উদ্যোগ নেওয়া আবশ্যক। এ ব্যাপারে মাননীয় ভূমি প্রতিমন্ত্রীর সাম্প্রতিক এবং মাননীয় অর্থমন্ত্রীর অতীতের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। ক্ষমতাধরদের পরিচ্ছন্ন রাখতে হলে অন্যদের এ ধরনের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে হবে। একই সঙ্গে ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি, আবাসিক এলাকায় প্লট প্রদানের মতো অন্যান্য নাগরিকের তুলনায় পক্ষপাতমূলক সুবিধা প্রদান থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। এ প্রসঙ্গে মাননীয় পরিকল্পনামন্ত্রীর সাম্প্রতিক ঘোষণা উৎসাহব্যঞ্জক। এ ছাড়া আরও আবশ্যক, অনতিবিলম্বে সংসদ সদস্যদের জন্য একটি আচরণবিধি প্রণয়ন করা, যার ফলে তাঁরা তাঁদের ‘প্রাইভেট ইন্টারেস্ট’ বা সরকারি দায়িত্ব পালনের বাইরে যেসব কার্যক্রমের সঙ্গে তাঁরা জড়িত, তা প্রকাশ করতে বাধ্য হবেন।
উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ধারণা করা যায় যে জেলা পরিষদ ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনও শিগগিরই অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু স্থানীয় সরকারের আইনগুলো, বিশেষত জেলা ও উপজেলা পরিষদ আইনে অনেকগুলো গুরুতর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আরও সুস্পষ্টভাবে বলতে গেলে, উপজেলা পরিষদের ওপর সংসদ সদস্যদের কর্তৃত্ব সম্পর্কিত আইনি বিধান পরিষদকে অকার্যকর করে ফেলেছে। তাই স্থানীয় সরকার আইনগুলোর সংস্কার আজ জরুরি। আরও জরুরি একটি বলিষ্ঠ বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচি প্রণয়ন। ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হলেও, মূলত বিরোধী দলের অব্যাহত সংসদ বর্জনের কারণে প্রতিষ্ঠানটি অনেকটাই অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এরশাদের জাতীয় পার্টিকে একই সঙ্গে সরকারে ও বিরোধী দলে রাখার সিদ্ধান্ত সংসদকে অকার্যকর করেই রাখবে। কারণ, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল কথা হলো—ক্ষমতার ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্সেস’ বা ক্ষমতার কেন্দ্রে নজরদারিত্বের বিধান। যেমন, ‘প্রিন্সিপল অব সেপারেশন অব পাওয়ার’ বা ক্ষমতার বিভাজনের নীতির ভিত্তিতে প্রশাসন, আইনসভা ও বিচার বিভাগ একে অপরের ওপর নজরদারি করে, যাতে কোনো বিভাগই ক্ষমতার অপব্যবহার না করতে পারে। একইভাবে সংসদীয় কমিটিগুলোর মাধ্যমে সরকারের স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিত করার ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া সংসদীয় বিশেষ অধিকার সম্পর্কিত কমিটির মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের মতো অপকর্মে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত করা যেতে পারে। কিন্তু এরশাদের জাতীয় পার্টির জগাখিচুড়ির ভূমিকা আমাদের সংসদ তথা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকর করার ব্যাপারে নেতিবাচক ভূমিকাই পালন করবে। তাই এ ব্যাপারেও প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি দেওয়া জরুরি।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক।
No comments