বিশেষ লেখা- ১০০ ডলার কি বেশি চাওয়া? by ইমদাদুল হক মিলন
আমার জাপানি বন্ধু তাকাহাসির বাংলাদেশ
নিয়ে গভীর আগ্রহ। বাংলাদেশের যেকোনো দুর্ঘটনায় সে খুব বিচলিত হয়, রাজনৈতিক
পরিস্থিতি, আন্দোলন ইত্যাদি নিয়ে, মানুষের মৃত্যু নিয়ে দিশাহারা হয়।
রানা
প্লাজার ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে সে আমাকে ফোন করেছিল। সব শুনে টেলিফোনেই
কেঁদেছিল। গার্মেন্ট শ্রমিকদের এ রকম মৃত্যু সে কল্পনাও করতে পারে না।
এপ্রিল মাসে আমি জাপানে ছিলাম। যেদিন ফিরেছি, এয়ারপোর্টে নেমেই শুনলাম রানা প্লাজার দুর্ঘটনার কথা। তার পরদিনই তাকাহাসির ফোন। জাপানে বসে যতটা খবর সে পেয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি খবর পাওয়ার আশায় আমাকে ফোন করেছিল। তারপর শ্রমিকদের মৃত্যুর কথা শুনে, চাপা পড়ে থাকার কথা শুনে, কারো হাত কাটা গেছে, কারো পা, চিরতরে পঙ্গু হয়েছে কেউ- এসব শুনে কেঁদেছিল। এ ধরনের দুর্ঘটনার কথা সে কল্পনাও করতে পারে না।
রানা প্লাজা বা তাজরীন ফ্যাশনসে যা ঘটেছিল সেই ঘটনা দুর্ঘটনা নয়, এক ধরনের হত্যাকাণ্ড। গার্মেন্ট মালিকরা অতি সামান্য বেতনে আমাদের অসহায় মানুষগুলোকে কাজে লাগায়। গার্মেন্ট কারখানার খোঁয়াড়ে নিয়ে পোরে। ১৯ ঘণ্টা কাজ করিয়ে কোনো কোনো শ্রমিকের মজুরি দেয় ২৫০ টাকা। কাজের চাপে শ্রমিকরা অসুস্থ হয়ে পড়লেও ছাড় দেওয়া হয় না। অতিরিক্ত কাজ করতে বাধ্য করা হয়। কাজ না করলে চাকরি চলে যাওয়ার হুমকি। সকাল ৭টা থেকে রাত আড়াইটা পর্যন্ত কাজ করতে বাধ্য করা হয় কখনো কখনো। বেরোনোর পথে তালা, কঠিন মুখের পাহারাদার। মালিকের অনুমতি ছাড়া বাইরে যাওয়া যাবে না। এই তালার কারণে আগুন লাগলে বেরোতে পারেন না শ্রমিকরা। পুড়ে ছাই হয়ে যান। ভবনধসে চাপা পড়ে (কালের কণ্ঠ, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৩)।
যে শ্রমিক পুড়ে ছাই হন, যে শ্রমিক চাপা পড়ে নিহত হন, যে শ্রমিক পঙ্গু হন, তিনি শুধু একাই শেষ হন না; তাঁর সঙ্গে শেষ হয় একটি পরিবার। একটি পরিবারের স্বপ্ন। যে শ্রমিক পঙ্গু হন, তাঁর সঙ্গে পঙ্গু হয় পুরো পরিবার। পঙ্গু মানুষটি বোঝা হয়ে দাঁড়ান পরিবারের। তাঁর ঘরে চুলা জ্বলে না। অসহায় ভঙ্গিতে বসে থাকেন স্ত্রী কিংবা মা, স্বামী কিংবা বোন। সন্তানরা ক্ষুধার কষ্টে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে। এই শ্রমিকদের দিকে তাকিয়েও দেখেন না গার্মেন্ট মালিকরা। তাঁরা বসে থাকেন টাকার বস্তার ওপর। তাঁরা চড়েন কোটি টাকার গাড়িতে। তাঁরা থাকেন রাজপ্রাসাদে। দেশে-বিদেশে বহু ব্যাংকে তাঁদের টাকা। বহু দেশে তাঁদের ঘরবাড়ি। যাঁদের রক্ত, ঘামে, যাঁদের অমানুষিক শ্রমে গার্মেন্ট মালিকদের এই রাজার মতো জীবন, সেই মানুষগুলোর অসহায়ত্ব তাঁরা অনুভব করেন না। সেই মানুষগুলো তাঁদের কাছে তুচ্ছাতিতুচ্ছ, গাছের ঝরে যাওয়া শুকনো পাতার মতো।
আজ সকালে হঠাৎই তাকাহাসি ফোন করল। বাংলাদেশের খবরাখবর জানতে চাইল। এখন সে ওসাকায় থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ তার হৃদয়ে। বাংলাদেশের কথা জানার গভীর আগ্রহ তার। কথায় কথায় জানতে চাইল রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর গার্মেন্ট শ্রমিকদের জীবনযাত্রায় কোনো উন্নতি হয়েছে কি না। রানা প্লাজা ধসে যে এক হাজার ১৩২ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছিল বা তাজরীন ফ্যাশনসে আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছিল ১১২ জন শ্রমিক, তাঁদের পরিবারগুলো কেমন আছে। আর হাত-পা হারিয়ে পঙ্গু হয়েছেন যাঁরা, তাঁদেরই বা জীবন চলছে কিভাবে।
নির্লজ্জের মতো বললাম, আমরা তাঁদের খোঁজখবর তেমন রাখি না। খেয়ে না খেয়ে, রোগশোকে ভুগে হয়তো বেঁচে আছেন। আমাদের নিয়ম হচ্ছে যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটলে দিন কয়েক এ নিয়ে খুবই হৈচৈ করা, আহা-উহু করা, তারপর ভুলে যাওয়া। একের পর এক ঘটনা ঘটে আমাদের দেশে। একেকটা ঘটনা নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বিচলিত হই আমরা, তারপর চাপা পড়ে যায় সব।
আমাদের দেশের সবচেয়ে ব্যবসাসফল শিল্প খাত গার্মেন্ট। দেশের ৭৮ শতাংশ রপ্তানি আয় হয় এই খাত থেকে। কিন্তু গার্মেন্ট শ্রমিকদের মজুরি অন্যান্য খাতের চেয়ে কম। একজন গার্মেন্ট শ্রমিকের মাসিক মজুরি ৩০০০ টাকা।
৩০০০ টাকার কথা শুনে তাকাহাসি চমকে উঠল। বলো কী! মাত্র ৩০০০ টাকা। যে শ্রমিক হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দেশের ৭৮ শতাংশ রপ্তানি আয় এনে দিচ্ছেন, টাকার পাহাড় তৈরি করে দিচ্ছেন গার্মেন্ট মালিকদের জন্য, তাঁর মাসিক বেতন মাত্র ৩০০০ টাকা!
বললাম, গত জুনে গার্মেন্ট খাতের নূ্যনতম মজুরি নির্ধারণে মজুরি বোর্ড গঠন করেছে সরকার। গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন ৬০০ টাকা বেতন বৃদ্ধি করতে চাইছে। শ্রমিকরা চাইছেন নিম্নতম মজুরি হবে আট হাজার ১১৪ টাকা। অর্থাৎ ১০০ ডলার। এই নিয়ে বাগ্বিতণ্ডা চলছে। দাবি আদায়ের জন্য পথে নেমেছেন শ্রমিকরা।
আমরা মনে করি, আট হাজার ১১৪ টাকায়ও আজকের দিনে একটি পরিবার চলতে পারে না। একজন মানুষের খাওয়া-পরা, থাকা যত দরিদ্রভাবেই হোক, পাঁচ-ছয় হাজার টাকার নিচে হয় না। সেখানে আট হাজার ১১৪ টাকায় পরিবার নিয়ে চলা অতি দুরূহ। তবু এটুকু পেলেই সন্তুষ্ট আমাদের গার্মেন্ট শ্রমিকরা। কিন্তু তাঁদের এই দাবিও মালিকরা মানছেন না। এ অবস্থায় পথে নামা ছাড়া উপায় কী শ্রমিকদের। তাঁরা কী করবেন, কিভাবে বাঁচবেন?
তাকাহাসি বলল, বাংলাদেশের প্রতিটি বিবেকবান মানুষের উচিত গার্মেন্ট শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানো। তাঁদের দাবির সমর্থনে কথা বলা। তাঁদের বেঁচে থাকায় পথ তৈরি করে দেওয়া।
গার্মেন্ট মালিকদের কাছে আমাদের অনুরোধ, শ্রমিকদের এই দাবি আপনারা দয়া করে মেনে নিন। মানুষগুলোকে বাঁচতে দিন। তাঁরা বাঁচলে আপনারা বাঁচবেন। তাঁরা বাঁচলে দেশের সবচেয়ে বড় শিল্প খাত বাঁচবে। দেশের মানুষ সুখে থাকবে।
এপ্রিল মাসে আমি জাপানে ছিলাম। যেদিন ফিরেছি, এয়ারপোর্টে নেমেই শুনলাম রানা প্লাজার দুর্ঘটনার কথা। তার পরদিনই তাকাহাসির ফোন। জাপানে বসে যতটা খবর সে পেয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি খবর পাওয়ার আশায় আমাকে ফোন করেছিল। তারপর শ্রমিকদের মৃত্যুর কথা শুনে, চাপা পড়ে থাকার কথা শুনে, কারো হাত কাটা গেছে, কারো পা, চিরতরে পঙ্গু হয়েছে কেউ- এসব শুনে কেঁদেছিল। এ ধরনের দুর্ঘটনার কথা সে কল্পনাও করতে পারে না।
রানা প্লাজা বা তাজরীন ফ্যাশনসে যা ঘটেছিল সেই ঘটনা দুর্ঘটনা নয়, এক ধরনের হত্যাকাণ্ড। গার্মেন্ট মালিকরা অতি সামান্য বেতনে আমাদের অসহায় মানুষগুলোকে কাজে লাগায়। গার্মেন্ট কারখানার খোঁয়াড়ে নিয়ে পোরে। ১৯ ঘণ্টা কাজ করিয়ে কোনো কোনো শ্রমিকের মজুরি দেয় ২৫০ টাকা। কাজের চাপে শ্রমিকরা অসুস্থ হয়ে পড়লেও ছাড় দেওয়া হয় না। অতিরিক্ত কাজ করতে বাধ্য করা হয়। কাজ না করলে চাকরি চলে যাওয়ার হুমকি। সকাল ৭টা থেকে রাত আড়াইটা পর্যন্ত কাজ করতে বাধ্য করা হয় কখনো কখনো। বেরোনোর পথে তালা, কঠিন মুখের পাহারাদার। মালিকের অনুমতি ছাড়া বাইরে যাওয়া যাবে না। এই তালার কারণে আগুন লাগলে বেরোতে পারেন না শ্রমিকরা। পুড়ে ছাই হয়ে যান। ভবনধসে চাপা পড়ে (কালের কণ্ঠ, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৩)।
যে শ্রমিক পুড়ে ছাই হন, যে শ্রমিক চাপা পড়ে নিহত হন, যে শ্রমিক পঙ্গু হন, তিনি শুধু একাই শেষ হন না; তাঁর সঙ্গে শেষ হয় একটি পরিবার। একটি পরিবারের স্বপ্ন। যে শ্রমিক পঙ্গু হন, তাঁর সঙ্গে পঙ্গু হয় পুরো পরিবার। পঙ্গু মানুষটি বোঝা হয়ে দাঁড়ান পরিবারের। তাঁর ঘরে চুলা জ্বলে না। অসহায় ভঙ্গিতে বসে থাকেন স্ত্রী কিংবা মা, স্বামী কিংবা বোন। সন্তানরা ক্ষুধার কষ্টে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে। এই শ্রমিকদের দিকে তাকিয়েও দেখেন না গার্মেন্ট মালিকরা। তাঁরা বসে থাকেন টাকার বস্তার ওপর। তাঁরা চড়েন কোটি টাকার গাড়িতে। তাঁরা থাকেন রাজপ্রাসাদে। দেশে-বিদেশে বহু ব্যাংকে তাঁদের টাকা। বহু দেশে তাঁদের ঘরবাড়ি। যাঁদের রক্ত, ঘামে, যাঁদের অমানুষিক শ্রমে গার্মেন্ট মালিকদের এই রাজার মতো জীবন, সেই মানুষগুলোর অসহায়ত্ব তাঁরা অনুভব করেন না। সেই মানুষগুলো তাঁদের কাছে তুচ্ছাতিতুচ্ছ, গাছের ঝরে যাওয়া শুকনো পাতার মতো।
আজ সকালে হঠাৎই তাকাহাসি ফোন করল। বাংলাদেশের খবরাখবর জানতে চাইল। এখন সে ওসাকায় থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ তার হৃদয়ে। বাংলাদেশের কথা জানার গভীর আগ্রহ তার। কথায় কথায় জানতে চাইল রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর গার্মেন্ট শ্রমিকদের জীবনযাত্রায় কোনো উন্নতি হয়েছে কি না। রানা প্লাজা ধসে যে এক হাজার ১৩২ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছিল বা তাজরীন ফ্যাশনসে আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছিল ১১২ জন শ্রমিক, তাঁদের পরিবারগুলো কেমন আছে। আর হাত-পা হারিয়ে পঙ্গু হয়েছেন যাঁরা, তাঁদেরই বা জীবন চলছে কিভাবে।
নির্লজ্জের মতো বললাম, আমরা তাঁদের খোঁজখবর তেমন রাখি না। খেয়ে না খেয়ে, রোগশোকে ভুগে হয়তো বেঁচে আছেন। আমাদের নিয়ম হচ্ছে যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটলে দিন কয়েক এ নিয়ে খুবই হৈচৈ করা, আহা-উহু করা, তারপর ভুলে যাওয়া। একের পর এক ঘটনা ঘটে আমাদের দেশে। একেকটা ঘটনা নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বিচলিত হই আমরা, তারপর চাপা পড়ে যায় সব।
আমাদের দেশের সবচেয়ে ব্যবসাসফল শিল্প খাত গার্মেন্ট। দেশের ৭৮ শতাংশ রপ্তানি আয় হয় এই খাত থেকে। কিন্তু গার্মেন্ট শ্রমিকদের মজুরি অন্যান্য খাতের চেয়ে কম। একজন গার্মেন্ট শ্রমিকের মাসিক মজুরি ৩০০০ টাকা।
৩০০০ টাকার কথা শুনে তাকাহাসি চমকে উঠল। বলো কী! মাত্র ৩০০০ টাকা। যে শ্রমিক হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দেশের ৭৮ শতাংশ রপ্তানি আয় এনে দিচ্ছেন, টাকার পাহাড় তৈরি করে দিচ্ছেন গার্মেন্ট মালিকদের জন্য, তাঁর মাসিক বেতন মাত্র ৩০০০ টাকা!
বললাম, গত জুনে গার্মেন্ট খাতের নূ্যনতম মজুরি নির্ধারণে মজুরি বোর্ড গঠন করেছে সরকার। গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন ৬০০ টাকা বেতন বৃদ্ধি করতে চাইছে। শ্রমিকরা চাইছেন নিম্নতম মজুরি হবে আট হাজার ১১৪ টাকা। অর্থাৎ ১০০ ডলার। এই নিয়ে বাগ্বিতণ্ডা চলছে। দাবি আদায়ের জন্য পথে নেমেছেন শ্রমিকরা।
আমরা মনে করি, আট হাজার ১১৪ টাকায়ও আজকের দিনে একটি পরিবার চলতে পারে না। একজন মানুষের খাওয়া-পরা, থাকা যত দরিদ্রভাবেই হোক, পাঁচ-ছয় হাজার টাকার নিচে হয় না। সেখানে আট হাজার ১১৪ টাকায় পরিবার নিয়ে চলা অতি দুরূহ। তবু এটুকু পেলেই সন্তুষ্ট আমাদের গার্মেন্ট শ্রমিকরা। কিন্তু তাঁদের এই দাবিও মালিকরা মানছেন না। এ অবস্থায় পথে নামা ছাড়া উপায় কী শ্রমিকদের। তাঁরা কী করবেন, কিভাবে বাঁচবেন?
তাকাহাসি বলল, বাংলাদেশের প্রতিটি বিবেকবান মানুষের উচিত গার্মেন্ট শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানো। তাঁদের দাবির সমর্থনে কথা বলা। তাঁদের বেঁচে থাকায় পথ তৈরি করে দেওয়া।
গার্মেন্ট মালিকদের কাছে আমাদের অনুরোধ, শ্রমিকদের এই দাবি আপনারা দয়া করে মেনে নিন। মানুষগুলোকে বাঁচতে দিন। তাঁরা বাঁচলে আপনারা বাঁচবেন। তাঁরা বাঁচলে দেশের সবচেয়ে বড় শিল্প খাত বাঁচবে। দেশের মানুষ সুখে থাকবে।
No comments