কলে যদি সাড়া না দেই? by তুষার আবদুল্লাহ
সংবাদকর্মী হিসেবে আমাদের টেলিফোন নম্বরটি’র গোপনীয়তা নেই। অনেকটা ‘চাহিবা মাত্র নম্বর জানাইতে বাধ্য’র মতো অবস্থা।
হাটে-মাঠে-ঘাটে যতো মানুষের কাছে ফোন নম্বরটি বিলি করা যায় ততোই উত্তম।
কারণ বলাতো যায় না, কার কাছে রেখে দেয়া আমার নম্বরটি, কখন গুরুত্বপূর্ণ খবরটি নিয়ে আসে। হয়তো ফেরিঘাটে, গ্রামের কোনো চায়ের দোকানে, ঢাকায় ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় অনেকেই নম্বরটি চেয়ে নিয়েছেন। তাদের কারো কারো মাধ্যমে কতো যে খবর পেয়েছি, তার হিসেব দেওয়া মুস্কিল। টেলিভিশনে তো একাধিক ব্রেকিং নিউজই দিয়েছি অজ্ঞাত সেই ফোন নম্বর সংগ্রাহকদের কাছ থেকে খবর পেয়ে।
সংবাদ কর্মীদের ফোন নম্বরটি যারা চেয়ে নেন, তাদের বড় অংশ কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলে যুক্ত। তারা তাদের সংগঠনের সব খবরকেই গুরুত্বপূর্ণ ভাবেন। তাই ওয়ার্ড থেকে শুরু করে কেন্দ্রের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত আছেন যারা, তারা প্রায়ই ফোন করে নানান খবর দেন। তার বেশির ভাগই অকাজের। কভার করার জন্য আমলে নেওয়া যায় না।
সরকারি দলের পাতি নেতাদের কাছ থেকে যেমন এমন খবর আসে তেমনি আসে বিরোধীদলের পাতি নেতাদের কাছ থেকেও। তবে সরকারি দলের পাতি নেতাদের খবর কিছুটা উড়িয়ে দেওয়া গেলেও, বিরোধী দলের পাতি নেতাদের খবরটাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ, বিরোধীদলের অনেক কর্মসূচির গোপন খবর আসে তাদের মাধ্যমেই।
সহকর্মী মান্নান মারুফ, মাজেদুল নয়ন ও সাজেদা সুইটি মিডিয়া কাভারেজ প্রসঙ্গে ‘না খেলেই গোল চায় বিএনপি’ শিরোনামে যে লেখাটি লিখেছেন, তা পড়ার পরই এই লেখাটির অবতারণা।
যখন পত্রিকায় কাজ করেছি, তখন মোবাইল ফোন আসেনি। অফিসের নম্বরেই খবরগুলো আসতো। সেই সময়ও দেখেছি হরতালে কোথায় পিকেটিং হবে, কোথায় কখন গাড়ি ভাঙচুর হবে, বাসে আগুন দেওয়া হবে, ককটেল বিস্ফোরণ হবে- সে খবর আগের রাতেই পত্রিকা অফিসে চলে আসতো। সেই মতো ক্রাইম রিপোর্টার বা হরতালের দায়িত্বে থাকা রিপোর্টাররা অবস্থান নিতেন। আমিও সেই ফোনে পাওয়া তথ্যমতো স্পটে গেছি।
দেখা গেছে, ফটোগ্রাফারসহ স্পটে কয়েকটি পত্রিকার রিপোর্টার জড়ো হলেই ঘটনাগুলো ঘটানো হতো। ছবি তোলা শেষ, ব্যস কর্মসূচিও শেষ। বলছি নব্বই দশকের গোড়ার দিকের কথা। পরবর্তীতে যখন বেসরকারি টেলিভিশন এলো, সঙ্গে এলো মোবাইল ফোন। রিপোর্টার-ক্যামেরাম্যানদের হাতের মুঠোয় মোবাইল। সেই মোবাইলে ফোন আসতে থাকে।
যখন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় ছিল, তখন আওয়ামী লীগের নেতা-উপনেতা, পাতিনেতারা ফোন দিতেন-কোন গলির মোড় থেকে তারা মিছিল বের করবেন। কোন মার্কেটের সামনে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটাবেন, গাড়ি পোড়াবেন কোথায়। তাদের মূল টার্গেট থাকতো ক্যামেরাম্যানরা। তাদের কাছেই ফোন আসতো বেশি। ফোনে দেয়া স্পটে গিয়ে দাঁড়ালেই ছবি।
ছবি নেওয়া শেষ তো কর্মসূচি শেষ করে নেতা-পাতি নেতারাও স্পট ছেড়ে চলে যেতেন। কারণ, তাদের আর স্পটে থেকে কি লাভ। টেলিভিশনে তো ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফুটেজ প্রচার হয়ে যাচ্ছে। তারপর যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলো। তারা দুই বছর কাটালেন। সেই সময়টায় রাজনৈতিক কর্মসূচি নিষিদ্ধ ছিল। তখনো আওয়ামী লীগ, বিএনপি’র নেতা-কর্মীরা ফোন দিতেন। জনাদশেক কর্মী নিয়ে ঝটিকা মিছিল কখন কোথা থেকে বের হবে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ক্ষমতাসীনদের চোখরাঙানির মুখেও যতোটা সম্ভব সেই মিছিলের ছবি ধারণ করে প্রচার করতো। ওই সময়টায় রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি প্রায় পুরোটাই টেলিভিশন ক্যামেরা নির্ভর হয়ে পড়ে।
তারপর নির্বাচন শেষে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসে। বিএনপি বিরোধী দলের ভূমিকায়। সঙ্গে জামায়াত। দেখা গেলো ওই যে টেলিভিশন ক্যামেরা নির্ভর কর্মসূচি, সেখান থেকে আর রাজনৈতিক দলগুলো বের হতে পারেনি। আওয়ামী লীগ সরকারে থাকলেও তাদের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং রাজনৈতিক দলের নেতারাও টিভি ক্যামেরা নির্ভর আলোচনা অনুষ্ঠান ও কর্মসূচি পালন করছেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। টিভি ক্যামেরা না পৌঁছানো পর্যন্ত তারা বক্তৃতা দিতে ওঠেন না।
বিরোধীদল বিএনপি এবং তাদের প্রধান শরিক জামায়াতের আন্দোলন কর্মসূচি গত সাড়ে চার বছরে পুরোটাই চলেছে টিভি ক্যামেরায় নির্ভর করে। জামায়াত ফোন করে রিপোর্টার, ক্যামেরাম্যান নিয়ে ঝটিকা আক্রমণ করে পুলিশের ওপর। চালায় ভাঙচুর। ক্যামেরায় ধারণ হয়ে যাওয়ার পর তারা আর স্পটে থাকে না। এই কর্মসূচি সব টিভি চ্যানেলই ফলাও করে প্রচার করে। একে ইতিবাচকভাবেই দেখে জামায়াত-শিবির। তারা যে সক্রিয় আছে, তার প্রমাণ রাখছে তারা টিভি পর্দায়। কোটি দর্শক দেখছেন শিবিরের পারফরমেন্স। কতো সহজেই তারা দর্শকের কাছে বা তাদের অনুসারীদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে।
একইভাবে বিএনপিও তাদের হরতালের কর্মসূচি পালন করে কেবলই টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে। টেলিভিশন ক্যামেরা ডেকে নিয়ে তারা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে এবং গাড়ি পোড়াচ্ছে। এই কাজে তারা এক/দু’টি টেলিভিশনের রিপোর্টার এবং ক্যামেরাম্যানকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে। তাদের হয়ে ওই রিপোর্টার-ক্যামেরাম্যানরাই ভাঙচুর-আগুনের ছবি নেওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। যদি কোনো টেলিভিশন স্পটে না পৌঁছায় যথাসময়ে, তাহলে সেই চ্যানেলকে ওই প্রতিনিধিরাই ফুটেজ সরবরাহ করে।
এমন বাস্তবতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এখন রাজনৈতিক দলের কর্মীদের অনুসরণ না করে, কিছু গণমাধ্যম কর্মীর দিকেই নজর রাখেন। কারণ এদের নজরে রাখলেই রাজনৈতিক দলগুলো কোথায় বিশৃঙ্খলা ঘটাবে, তার আভাস পাওয়া যায়।
বাংলানিউজের আমার তিন সহকর্মী যে ‘কলিং’ সংস্কৃতির কথা বলেছেন, তা এখন মিডিয়া পাড়ায় ওপেন সিক্রেট। কিন্তু ওপেন সিক্রেট হলেও অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে সব টেলিভিশনই এই কলগুলোতে নিয়মিত সাড়া দিয়ে যাচ্ছে। ফলে ছোট-খাটো কর্মসূচিও টেলিভিশনে ফলাও করে প্রচার হচ্ছে। আবার কোনো কোনো সহিংস ঘটনা মূহুর্তেই ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে।
আমি হলফ করে বলতে পারি, গণমাধ্যমগুলো যদি একযোগে এসব কলিং ঘরানার কর্মসূচিতে সাড়া না দেয়, সরে আসে এই জাতীয় কর্মসূচির খবর প্রচার থেকে- তাহলে গাড়ি পোড়ানো, ভাঙচুর, অবরোধের মতো কর্মসূচি অনেকটা কমে আসবে। লোক জড়ো করতে না পারলে জনা বিশেক কর্মী নিয়ে কেউ মাঠে নামবে না। অতএব গণমাধ্যমকেই আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কবে থেকে তারা এই কলিং’এ আর সাড়া দেবে না। যদিও বলে রাখা ভাল, কোনো কোনো দলীয় মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্বপালনকারী পত্রিকা ও টেলিভিশন এই কাজটি করেই যাবে। তবে মূলধারা’র বা অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ থাকা গণমাধ্যমের কাছ থেকে সাড়া না পেলে কলিং নির্ভর রাজনৈতিক কর্মসূচি নিরুৎসাহিতই হবে।
তুষার আবদুল্লাহ: বার্তা প্রধান, সময় টেলিভিশন
No comments