আতাউস সামাদ: তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক গুরু by পলাশ মাহবুব

লেখালেখির অভ্যাসটা আগে থেকেই ছিলো। সেই পালে একটু হাওয়া লাগলো স্থায়ীভাবে ঢাকায় আসার পর। চোখে স্বপ্ন আর বুকের সাহস ছিলো পূঁজি।

সাল ২০০০।
পরিবারের পছন্দের সাবজেক্টকে পাশ কাটিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে সবেমাত্র ভর্তি হয়েছি। রেজাল্ট ভালো থাকায় যেকোনও বিষয় নেয়ার সুযোগ ছিলো। পরিবারেরও প্রত্যাশা ছিলো আইন, অর্থনীতি এ জাতীয় কোন বিষয়ে পড়াশোনা করি। কিন্তু নিজের পছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে ঢুকে গেলাম সাংবাদিকতা বিভাগে। মূলত সাংবাদিকতার রোমান্সে পড়েই এই বিভাগে ভর্তি হওয়া।

ক্লাশ তখনো শুরু হয়নি।
দৈনিক মানবজমিনের দাপটের যুগে তখন আরেকটি ট্যাবলয়েড পত্রিকা বাজারে আসি আসি করছে- ‘দৈনিক মাতৃভূমি’। পত্রিকাটি নিয়ে নানা মহলে ব্যাপক আলোচনা। কারণ নতুন এই পত্রিকার সম্পাদক শওকত মাহমুদ আর উপদেষ্টা সম্পাদক আতাউস সামাদ।

আতাউস সামাদ নামটি খুব চেনা। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের রোল মডেলে পরিণত হওয়া আতাউস সামাদের নামটি নানা কারণেই মাথার ভেতরে ছিলো। বিবিসিখ্যাত আতাউস সামাদকে ছেলে-বুড়ো কে না চেনে।

সবকিছু নিয়ে প্রবল আগ্রহের সেই বয়সে জানতে পারলাম আতাউস সামাদ আর শওকত মাহমুদ দুজনই ঢাকা বিশ্বাবদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন- একজন শিক্ষক হিসেবে অন্যজন ছাত্র।

এই একটিমাত্র সূত্রকে পুঁজি করে দেখা করলাম তাদের সঙ্গে- সরাসরি চেয়ে বসলাম চাকরি। দুজনই অবাক- আমার বয়স কম তারওপরে সবেমাত্র ভর্তি হয়েছি ফার্স্ট ইয়ারে। পত্রিকা তো আর প্রভাতী সবুজ সংঘ নয়, চাইলেই চাকরি মিলবে! কিন্তু আমি দমবার পাত্র নই, দেখালাম সঙ্গে নিয়ে যাওয়া প্রকাশিত বেশকিছু গল্প, ছড়া ও অন্যান্য লেখা।

আতাউস সামাদ স্যার বোঝালেন, গল্প লেখা আর সাংবাদিকতা এক জিনিস নয়। বললেন, তুমি তো স্টুডেন্ট, চাকরি করবে কিভাবে? আমি তখন সাহস করে বলে ফেলেছিলাম, স্যার, থিওরি পড়বো ইউনিভর্সিটিতে আর প্র্যাকটিক্যাল এখানে। হাতে-কলমে শিখলে সেটা বেশি কাজে লাগবে।

এক পর্যায়ে আতাউস সামাদ স্যার কিছুটা রাজি হলেন। কিন্তু শর্ত একমাস আমাকে টেস্ট করা হবে।

আগে থেকে পত্রিকায় লেখালেখির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। মানবজমিনেও কাজ করেছি কিছুদিন। মানবজমিন পত্রিকার বেশ কিছু সাংবাদিক পাড়ি জমিয়েছেন মাতৃভূমি পত্রিকায়। তাদের কারও কারও সঙ্গে আগে থেকেই সখ্যতা ছিলো। সেই নামগুলোর মধ্যে আহসান কবির এবং মাহমুদ মেননের (বর্তমানে বাংলানিউজের হেড অব নিউজ) নাম উল্লেখ করা যায়। মেনন ভাই ছিলেন নতুন শুরু হওয়া মাতৃভূমির ফিচার এডিটর। আমি কাজে লেগে গেলাম। টেস্ট পরীক্ষায় পাশও করলাম খুব অল্প সময়ে।

সেই থেকে শুরু।
২০০০ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত টানা কাজ করেছি আতাউস সামাদ স্যারের সাথে। মাঝে অনেক ঝড়-ঝাপ্টা গেছে কিন্তু স্যার আমাদের আগলে রেখেছেন। সাংবাদিকতার যতটুকু শিখেছি তার প্রায় পুরোটাই স্যারের কাজ থেকে শেখা।
তিনিই প্রথম শিখিয়েছেন কিভাবে ইন্টারভিউ নিতে হয়।
একদিন হঠাৎ বললেন, একটা ইন্টারভিউ নিতে হবে, সাংবাদিক নির্মল সেনের। প্রথমে বেশ উৎফুল্ল হলেও নির্মল সেন নামটি শুনে আমি খানিকটা চুপসে যাই। প্রথমত নির্মল সেন একজন জাঁদরেল সাংবাদিক তারওপরে শুনেছি তিনি নাকি কিছুটা ঠোঁটকাটা স্বভাবের। মুখের ওপর সত্য কথা বলতে কাউকে ছাড়েন না। সেই নির্মল সেনের ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে কি বিপদেই না পড়ি। শুধু নির্মল নামটি ছাড়া সামনে-পেছনে তেমন কিছুই তো জানি না। মনের মধ্যে ভয়। আবার ইন্টারভিউ নেয়ার আগ্রহও প্রচন্ড।

স্যার আমার বিষয়টা আঁচ করতে পেরেছিলেন। তিনি বললেন, ঠিক আছে চলো, আমিও তোমার সাথে যাবো, অনেকদিন দাদার সঙ্গে দেখা হয় না। সেদিনের সেই ইন্টারভিউ পুরোটাই স্যার নিয়েছিলেন। আমি শুধু অনুলিখন করে গেছি। কিন্তু পত্রিকায় নাম ছাপা হয়েছে আমারই।

২.
সাল ২০০৩।

‘এখন’ নামে একটি পত্রিকা করবেন স্যার।
আমাদের মধ্যে কিছুটা অস্বস্তি। আতাউস সামাদের মতো ব্যক্তিত্ব কেন সাপ্তাহিক পত্রিকা করবে! স্যার তো চাইলে চোখ বন্ধ করে যেকোন বড় দৈনিকের সম্পাদক হতে পারেন।

কথাটা সাহস করে বলতে পারি না। কিন্তু একসময়ে তিনি বিষয়টা টের পান। নিজেই খোলাসা করে বলন, তার যতটুকু আর্থিক সামর্থ্য তাতে সাপ্তাহিক পত্রিকার চেয়ে বড় প্রজেক্ট করা সম্ভব না। আর পত্রিকা করতে গিয়ে কোনও প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রিও হতে চান না তিনি। আমরা স্যারের আবেগ এবং সাংবাদিকতার প্রতি দায়বদ্ধতার বিষয়টি টের পাই।

সাপ্তাহিক ‘এখন’ পত্রিকার শুরুটা খুব কাছ থেকে দেখেছি। পত্রিকার লোগো, মেকআপ, লেখা সংগ্রহ সবকিছুতেই আগ্রহ নিয়ে থাকি।

অনেক খেটেখুঁটে সবকিছু দাঁড়ালো। সাপ্তাহিক ‘এখন’-এর লোগো একটু ভিন্ন আঙ্গিকের ছিলো। লোগোতে ছিলো দিক নির্দেশনার অ্যারো এবং তার ওপরে একটি মোরগ। দিক নির্দেশনার অ্যারো দিয়ে রাজনীতির গতি-প্রকৃতি আর মোরগ ব্যবহার করে সকালের শুরু বোঝানো হয়েছে।

একসময় যাত্রা শুরু করলো সাপ্তাহিক এখন। অফিসের সামনে মাঝারি সাইজের একটা সাইনবোর্ডও টানানো হলো। একদিন ঘটলো এক মজার ঘটনা।

দুপরের দিকে অফিসের সামনে কয়েকজন ঘোরাঘুরি করছে। কিছু যেন খুঁজছে মনে হলো। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে জানতে চাইলো, এখানে ভাতের হোটেলটা কোন দিকে?
আমরা তো অবাক। ভাতের হোটেল আসলে কোত্থেকে!

কিছুক্ষন পরে বিষয়টা পরিষ্কার হয়। ‘এখন’ পত্রিকার সাইনবোর্ডে মোরগের ছবি দেখে তারা মনে করেছিলো এটা ভাতের হোটেল। তাই দুপুরে খেতে আসা আরকি!

আতাউস সামাদ স্যারকে যখন আমরা ঘটনাটা বলি তখন তিনি শিশুর মতো হাসলেন অনেকক্ষন। মজার বিষয় হচ্ছে পরবর্তীতে এই একই ভুল আরও অনেকে করেছিলেন।   

৩.

আরও অনেক কিছুর মতো স্যারের কাছেই শিখেছি কিভাবে কলাম লিখতে হয়। তাঁর সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘এখন’ পত্রিকায় আমি জীবনের প্রথম কলাম লিখি তাও আবার ধারাবাহিকভাবে।

একদিন আমাকে ডেকে বললেন, শোনো, তোমাকে একটা সুযোগ দিতে চাই। এখন থেকে নিয়মিত একটা কলাম ছাপবো, নগর ডায়েরি। পারবা?

তখন সবকিছুতে হা বলার বয়স। থার্ড ইয়ারে পড়ি। মাথা নাড়ালাম।
বুইঝো কিন্তু, এই নামে আগে আরও একজন কলাম লিখতেন, দৈনিক বাংলার সম্পাদক আহমেদ হুমায়ুন।

এবার ঘাবড়ানোর পালা।
কিন্তু স্যার-ই আবার সাহস যোগালেন এবং নিয়মিত প্রকাশ করলেন আমার লেখা কলাম।

আতাউস সামাদ স্যার তখন নিয়মিত কলাম লিখতেন দৈনিক প্রথম আলোতে। আমি তখনো ইউনিভার্সিটির ছাত্র। স্যারের একটি কলামে প্রসঙ্গক্রমে আমার কথা এক কি দুই লাইন লিখেছিলেন। সেখানে আমার নামের আগে তিনি লিখেছিলেন ‘সাংবাদিক পলাশ মাহবুব’।

সেদিনের কথা এখনো মনে পড়ে। ক্লাসের সহপাঠীদের কাছে আমার আলাদা কদর, আতাউস সামাদের কলামে আমার নাম! অফিসের সহকর্মীদের কেউ কেউ কিঞ্চিত ঈর্ষান্বিত। ডিপার্টমেন্টের স্যারদের দু-একজন নিশ্চিত হতে চান, আমিই সেই পলাশ মাহবুব কিনা। আর আমার মধ্যে সার্টিফিকেট পাওয়ার আনন্দ। কারণ স্যার তাঁর নিজের হাতে আমার নামের আগে সাংবাদিক শব্দটি ব্যবহার করেছেন। গুরুর কাছ থেকে শিষ্যের এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে।

আতাউস সামাদ ছিলেন অনুকরণ করার মতো পূর্নাঙ্গ একটি প্যাকেজ। আগাগোড়া সাংবাদিক এবং সাদা মনের একজন মানুষ। খ্যাতির চূড়ায় থেকেও তার মতো নির্লোভ, নিরহংকার এবং নির্বিবাদি মানুষ এই সমাজে বিরল। কখনো কাউকে আঘাত করে কিংবা অসম্মান করে কিছু বলতে শুনিনি, লেখার তো প্রশ্নই আসে না। তার মধ্যে তারার ঔজ্জ্বল্য যেমন ছিলো তেমনি ছিলো শিশুর মতো শুভ্রতা। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকদের রোল মডেল। সত্যিকারের কিংবদন্তি। বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষায় সমানতালে লিখে যাওয়া তাঁর মতো সাংবাদিক বিরল।

গণমাধ্যম বিস্তারের এই যুগে আরও অনেক পত্রিকা আসবে। টেলিভিশন আসবে। আসবে নতুন নতুন অনলাইন সংবাদপত্রসহ নানান কিছু।

কিন্তু একজন আতাউস সামাদ?
সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার ‘আকালের’ এই সময়ে দিন যত গড়াবে, একজন আতাউস সামাদের অভাব আমাদের ততই পোড়াবে। তাঁর চলে যাওয়ার এক বছরে যা ইতোমধ্যেই আমরা অনুভব করছি।

পলাশ মাহবুব : সাহিত্যিক ও নাট্যকার। প্রোগ্রাম ম্যানেজার- বৈশাখী টেলিভিশন।

No comments

Powered by Blogger.